জন্ম থেকে জ্বলছি
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৩ জানুয়ারি, ২০১৯, ০৯:০০:০৩ রাত
--------------------
প্রচন্ড শীতে এক খড়ের গাদার নীচে আমার জন্ম হয়। আমার মা আমাদের ১০ ভাইবোনকে সর্বদা আগলে রাখত। তার পেটের নীচে থেকে আমরা প্রচন্ড ঠান্ডার সময় উষ্ণতা নেওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু মাটির ঠান্ডায় কাবু হয়ে যেতাম। মায়ের দুধে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ হতনা,কারন মা নিজেই খেতে পেত না। জীর্ণ শীর্ণ দেহে এদিক ওদিক থেকে কিছু পঁচা বাসি খাবার খেয়ে আসত। মানুষ সেটাও তাকে দিতে চাইতো না। তারা তাদের বাড়ির পেছনের সারখানায় পঁচা জিনিস ফেলত। সেখানে মা কিছু খেতে গেলেও তাকে ঠিল মেরে তাড়িয়ে দিত লোকেরা।
আমাদেরকে রেখে মা বেশীক্ষন থাকতে পরত না। প্রচন্ড মায়ায় খানিক পর পর এসে দেখে যেত, আমরা সকলে ঠিক আছি কিনা। কখনও খড়ের গাদার কাছাকাছি অপরিচিত লোকেরা চলে আসলে মা প্রচন্ড রকম ক্ষেপে যেত। এমনভাব করত যেন কামুড় দেবে, কিন্তু সে কখনই কাওকে কামুড় দেয়নি। এরকম করত আত্মরক্ষার জন্যে। নিজের জন্যে তার মায়া ছিলোনা, সে আমাদের নিরাপত্তায় সদা উদগ্রীব থাকত।
ভাবতে পারেন , আপনাদের দুটো সন্তান হলেই তাদেরকে নিয়ে কি আচরণ করেন ! সবসময় চোখে চোখে রাখেন, কত দামী দামী শত রমকের খাবার দাবার তাদেরকে খাওয়ান। আবার অনেকে কি খাওয়াবে,সেটা ভেবেই সন্তান গ্রহন করেনা অথবা গড়িমসি করে। কিন্তু যাদের সন্তান আছে ,কত আদর যত্ন করেন আপনারা সন্তানদেরকে। অথচ আমার মা দশটা সন্তানের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু খাবারের চিন্তায় আপনাদের মত পেরেশান হয়নি। আল্লাহ আমাদেরকে এই ওয়াদা দিয়েছেন যে তিনি আমাদেরকে সাহায্য করবেন। যখন আমরা লোকলয়ে থাকিনা, বনে জঙ্গলে থাকি, তখন আল্লাহ সেখানে আমাদের খাবার পৌছে দেন, আমরা সর্বদা আল্লাহর জিকির করি, আপনারা তা শুনতে পান না। আমরা লোকালয়ে থাকলে আমাদের খাবারের দায়িত্ব মানুষের উপর ন্যাস্ত করেন। আরেকটা বড় ব্যাপার হল , আমরা আপনাদের আশপাশে থাকলে আপনারা কি আচরন করেন আমাদের সাথে সেটাই আল্লাহ দেখতে চান। আমরা যার আশপাশে থাকি,তাকেই আমাদের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। অথচ মানুষ তাদের সেই দায়িত্ব ভুলে যায়। আমরা মানুষের আশপাশে থাকলে প্রায় নিশ্চিত থাকি এরা সুআচরণ করবে না, কিন্তু তারপরও আমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করি। আল্লাহ আমাদেরকে প্রশান্তি প্রদান করেন, আপনারা তা অনুভব করতে পারেন না।
আমার মা কিছুদিন পূর্বে একজনের বাড়ির পেছনে কিছু উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সময় বাড়ির মালিক বড় একটা ইট ছুড়ে মারে। এতে আমার মায়ের পা ক্ষত বিক্ষত হয়। সেই অবস্থায়ও মা প্রতিশোধের কথা না ভেবে সেই লোকের জন্যে হেদায়াতের দোয়া করে চলে আসে। আপনারা আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা প্রানী, কিন্তু আপনাদের অনেকের আচরনের কারনে আল্লাহর কাছে আমাদের চেয়েও অনেক নিকৃষ্ট প্রানী। আপনারা মালিকের নাফরমানী করেন। অন্যকে নিজের সম্পদে ভাগ দিতে চাননা। তবে আপনাদের কেউ কেউ খুব ভালো। তারা খুব সম্মানিত। আমরা দেখেছি ফেরেশতারাও তাদের জন্যে দোয়া করে। শয়তান তাদের ক্ষতি করতে আসলে একদল ফেরেশতা সেসব শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়।
এবার আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটা বলব। সেদিন ছিলো শুক্রবার। এদিন মানুষেরা একটু ভালো রান্না করে। পাশের বাড়ির লোকেরা ছাগল জবাই করেছিলো। আমার মা গোস্ত নয়, একটু বাতিল অংশ,অথবা হাড় খাওয়ার জন্যে সে বাড়িতে প্রবেশ করে। গৃহকর্তা ধারালো ছুড়ি দিয়ে মায়ের ঘাড়ে কোপ মেরে তাড়িয়ে দেয়। পুরো এক সপ্তাহ আমার মা ছাটফট করতে থাকে খড়ের গাদার নীচে। হাটতে পারত না, তাই কোথাও গিয়ে কিছু খেতেও পারত না। আমরা ছিলাম দুধ থেকে বঞ্চিত। আমরা সমস্বরে ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করতাম, মানুষেরা বিরক্ত হয়ে কেবল ঢিল ছুড়ত। আমরা বাঁচার জন্যে আরও ভেতরের দিকে চলে যেতাম, তবুও আমাদের চিৎকার থামত না।
কয়েকদিন পর দগদগে ঘায়ের জ্বালায় মা মারা যায়। তার শরীর থেকে প্রচন্ড রক্ত ক্ষরন হয়েছিলো। আমরা অথৈ সাগরে পড়লাম। বয়স মাত্র কিছুদিন। দুনিয়ার কিছুই চিনিনা। মানুষের সম্পর্কে ধারনা সুখকর নয়, কোথায় যাব কি করব ! আমরা দশ ভাইবোন গলাগলি হয়ে উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতাম।
একদিন জীর্ণ শীর্ণ শরীর নিয়ে অর্ধমৃত হয়ে পড়ে আছি সকলে, এমন সময় এক লোক এসে আমাকে টেনে বের করল। আমি অন্যদের ধরে রেখেছিলাম কিন্তু সে জোর করে টেনে বের করল। আমার গলায় দড়ি পরালো। এরপর টানতে টানতে মোটর সাইকেলের পেছনে বেধে নিল। আমি সেখান থেকে আমার অন্য ভাইবোনদর দিকে তাকালাম। তারা আমাকে দেখে প্রবলভাবে কাঁদছিলো, কিন্তু তাদের কিচ্ছু জানা ছিলোনা, কি ঘটছে,কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাদের আদরের ভাইকে ! লোকটা মোটরসাইকেল হাকিয়ে আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেল। খেজুরের রসের গুড় তৈরী হচ্ছিলো, আমাকে লোকটা বাতিল কিছু গুড় খেতে দিল। এত মজা কখনই পাইনি। কিন্তু পরক্ষনেই আমার অন্য ভাইবোনের কথা মনে পড়াতে দু:খে মুষড়ে পড়লাম।
বাড়িওয়ালার দুষ্টু ছেলের খেলনাস্বরূপ আমাকে তার হাতে সোপর্দ করে। সে আমার গলায় দড়ি বেধে অনেক নির্যাতন করে মজা পেত। আমার কান্না ছিলো তার আনন্দের কারন। তার পিতাও আমার পেছনে অযথা লাথি মেরে চিৎকার শুনতে চাইতো আর তার ছেলেকে নিয়ে অট্টহাসি হাসত। আমার ব্যাথাই হল তাদের বিনোদন, কি ভয়াবহ ! তারা আমাকে মোটামুটি খেতে দিত। কিন্তু প্রচুর নির্যাতন করত। আমি বড় হতে থাকলাম। মানুষের কিছু কমান্ডও বুঝতে শুরু করলাম। আমি প্রবল আনুগত্বের নিদর্শন রাখা সত্ত্বেও তারা তেমন সুআচরণ করত না। রাতে আমি জেগে থাকতাম বারান্দায়। ওরা রাতে সূরা ক্কিরাত পড়ে ঘুমাতো না, তাই রাতে শয়তান প্রবেশ করত ঘরে, তখন আমি উচ্চস্বরে ডেকে উঠতাম। বলতে চাইতাম তোমরা সতর্ক হও, সূরা কিরাত পড়ো,, আল্লাহর ফেরেশতারা এসে ওদেরকে তাড়িয়ে দিবে। কিন্তু আমার ভাষা তো ওরা বোঝেনা। কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানও নেই। ওরা বিরক্ত হয়ে আমাকে লাথি মারত। কিন্তু তারপরও আমি একই কাজ করতাম, কারন ওটাই আমার রবের নির্দেশ।
সারারাত জেগে একদিন দিনের বেলা ঘুমাচ্ছি,বাড়ির মালিক প্রবল বেগে আমাকে লাথি মারলো। আমি মহ্য করতে না পেরে তার পায়ে কামুড় দিয়ে বসলাম। তখন আমাকে প্রচন্ড পেটালো এবং বাড়ি থেকে বের করে দিল। আমি ভাবতাম তার রাগ পড়ে গেলে আবার নিয়ে আসবে, তাই ঘরে ঢুকতে চাইতাম বারবার। কিন্তু সে আমাকে বস্তায় ভরে দূরের এক শহরে রেখে গেল। ওটাই তার সাথে শেষ দেখা।
এরপর আমি এই শহরের এক ছিন্নমূল কুত্তা। ডাস্টবিনে পড়ে থাকা খাবার খাই। কখনও গোস্তের দোকানে গিয়ে কিছু পাই, কখনও কখনও কেউ লাঠি দিয়ে পেটায়। আমার যে পরিমান খাবার দরকার তা আমাকে কেউ দেয়না, আমিও পাইনা। সারা বছরই আমার পেটে ক্ষুধা থাকে। আবর্জ্যনা খেয়ে আমার শরীরে নানান রোগে বাসা বেঁধেছে। আমার এই অবস্থার জন্যে আপনারাই দায়ী। আপনারা ভুলে গেছেন আমি আপনাদের জন্যে দুনিয়াতে একটি পরিক্ষা।
কুরবানীর ঈদে ভেবেছিলাম পেট ভরে গোস্ত খাব, কিন্তু কোপ খেলাম এক যালিমের। আমার গলার কাছে এক কোপ মারলো। আমি দগদগে ক্ষত নিয়ে রাস্তায় হেটে বেড়াই। ভয়ানক যন্ত্রনা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করি। শরীরটাকে একটু বাঁকালেই প্রচন্ড ব্যাথা লাগে। আপনারা কি নিজেদের ক্ষেত্রে এরকম আচরণ পছন্দ করেন ? আপনারা না মুসলিম ! মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, হজ্জ করে আসেন !! কিন্তু আল্লাহ আমাদের সাথে সুআচরণ করতে বলেছেন ,সেটা কেন ভুলে যান ? একই রব আমাদের, অথচ আপনারা কতটা অনুদার ! কাফিরদের দেশে কুকুরের সাথে সুআচরণ করা হয়, তাদের মানবিক মূল্যবোধ আপনাদের চেয়ে বেশী,যদিও সত্য ওরা গ্রহন করেনি। কিন্তু তাদের মানবিক আচরনের কারনে আল্লাহ ওদেরকে দুনিয়াতে প্রাচুর্য্য দিয়েছেন এবং আপনাদের আচরনের কারনে আপনাদেরকে নানান শাস্তির ভেতর রেখেছেন,আপনারা উপলব্ধী করেন না। আজ আমার উপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার জন্যে এই বাংলার লোকেদেরকে অভিশাপ দিলাম,,,আপনারা যালিমদের দ্বারা নিষ্পেষিত হতে থাকবেন,যতক্ষণ না বোধদ্বয় হয় !
বিষয়: বিবিধ
৫৮২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন