পলাপলি ----------

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১০:৫৬:০৪ সকাল



ছোটবেলায় যে খেলাটা আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ ছিলো,সেটা হল পলাপলি। এক অদ্ভূত আনন্দ পেতাম। নিখাঁদ আনন্দ। অনেক ছোট থাকতে আমাদের বাড়ির পেছনে বেশ কিছু প্রতিবেশী ছিলো,পরে অবশ্য তারা অন্য স্থানে চলে যায়। তারা দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও ছিলো। ওদের বাড়ি ছিলো একগাদা বাচ্চা-কাচ্চা। ওদের মাঠে ছিলো অনেক সম্পত্তি এবং ধান,গম চাষ করত। আবার আমার ফুফাদেরও ব্যপক ফসল হত। বিলের ধানগাছ অনেক উঁচু হত। ধান কাটার পর ধান গাছের অংশবিশেষ তখনও থেকে যেত, ওটাকে আমরা নাড়া বলতাম। গরুর জন্যে পরে ওই নাড়া কেটে এনে আমাদের বাড়ির পাশের বড় উঠোন বা খৈলেনে রাখা হত। বিশাল স্তুপাকারে পড়ে থাকত সেগুলো। আমরা সে সময় পলাপলি খেলতাম রাতে। আর ওই নাড়ার গাদায় লুকাতাম। নাড়া না থাকলেও অন্যখানে খেলতাম। সাধারনত স্কুলের পরিক্ষা শেষ হলে রাতে খেলা হত। আর চাঁদনী রাত হলে আনন্দের সীমা থাকত না।

সে যে কি আনন্দ পেতাম নাড়ার গাদায় লুকিয়ে ! অনেকে মিলে খেলতাম। বিশেষভাবে এক লটারী করে একজনকে চোর বানানো হত মানে যে সবাইকে খুঁজে বের করবে। সে ১০০ পর্যন্ত গুনতো চোখ বন্ধ করে। আর এর ভেতর লুকাতে হত। নির্দিষ্ট এরিয়ার বাইরে পালানো যাবেনা নিয়ম ছিলো। আমাদের ভেতর দু একজন বেশ বোকা ছিলো, তারা দ্রুত লুকাতে গিয়ে হা হুতাশ করত এবং কোথায় লুকাবে তা ভেবে পেতনা। ওরা সহযে ধরা পড়ত। যে আগে ধরা পড়বে, পরেরবার সে অন্যদেরকে খুঁজে বের করবে। নিয়ম ছিলো আমাকে খুজে পাওয়ার আগেই যদি আমি তার গা ছুয়ে বলি"তিলো" তাহলে সে আবার মুচি।মানে আবার খুজবে পরের দানে। অথবা ভালো মনে করতে পারছি না। আর যে খুজেবের করা চেষ্টা করছে, সে আমাদের গায়ে হাত দিয়ে বলবে "এক্সপ্রেস"। শব্দদুটো ইংরেজী কিন্তু আসলে সঠিক শব্দ কি তা আমি আজও জানিনা। অনেক এলাকায় দেখেছি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহারে এই খেলা খেলত।

অনেক সময় এত জটিল স্থানে লুকানো হত যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিলো। তখন আমরা ছড়া কাটতাম: " এটোঁলে মাটি, ঝাটার কাঠি, না কুক দিলে খেলবো না....." বেশ টেনে টেনে সূর করে উচ্চস্বরে কয়েকবার বলার পর, যারা পালিয়ে ছিলো, তারা শব্দ করে বলত.. "কুক"। এর মানে হল শব্দ করেছি এবার ধরো। তবে আমরা চালাকও ছিলাম, কুক দিয়েই স্থান পরিবর্তন করতাম দ্রুত, যাতে শব্দ অনুযায়ী গিয়ে খুঁজে না পায়।

যারা খুব চালাক চতুর, তারা খুব সহযে খুজে বের করে ফেলত। আর বয়সে ছোট বা তেমন চালাক নয়, এরা খুজতে টাইম নিত। আমরা খুব মজা পেতাম যখন তারা খুঁজে পেতনা কিন্তু খুব টেনশন নিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করত। তবে খুব বেশী দেরী হলে আমরা এসে স্বেচ্ছায় ধরা দিতাম। কারন একেবারে খুজে না পেলে খেলার মজা নেই। অনেকে এমন স্থানে লুকাতো যে খুজে পাওয়া কষ্টকর ছিলো। আমাদের মুরগীর ঘর ছিলো পাকা। সেটার দরজা ছিলো অনেক বড়। মাথা নীচুকরে প্রবেশ করা যেত। কেউ কেউ ওই মুরগীর ঘরে লুকাতো। ওখানে গিয়ে কেউ খুজবে না এটা তারা জানত। ওদেরকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ছিলো। আবার দু একজন গেঁছো ছিলো, তারা ওই রাতে গাছে উঠে বসে থাকত। অনেক পরে নিজেরা এসে ধরা দিত।

সবচেয়ে মজাদার হত তখন, যখন কেউ ভাবছে যে, সে অনেক দারুনভাবে লুকিয়েছে এবং কেউ তাকে খুঁজে পাবেনা। তখন তার অগোচরে চুপি চুপি গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলে অট্টহাসির রোল পড়ে যেত। ব্যাপারটা ছিলো কৌতুককর। আমরা প্রাণ খুলে হিহিহিহি হোহোহো হাহাহা করে হাসতাম। আর চারিদিকে সোরগোল পড়ে যেত। তবে কখনও কখনও এলাকার কিছু মুরব্বী উচ্চ শব্দের কারনে বলত,,এই চুপ কর ! তখন আমরা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে নিরব থাকতাম, তারপর আবার যা তা। তারাও হাল ছেড়ে দিত। আবার রাগী কেউ কেউ তাড়া করত,,,,আমরা তখন পগার পার। কয়েক মিনিট পর আমরা আবার হাজির হতাম। তাদের অত ধৈর্য্য ছিলোনা, তারা নিজেই খ্যান্ত হত। আমাদের এনার্জী লেভেল সবসময়ই হাই থাকত।

একবার আমার ফুফাত ভাই মাহবুব লুকালো আমাদের বাড়ির দোতলার ছাদের পাশের সিড়ি রুমে। ওখানে পাশাপাশি দেওয়ালের খাজ রয়েছে। সে খুব ছোট ছিলো। পুরো দেহ বাইরে রেখে মাথাটা ওই খাঁজে সোজা করে ঢুকিয়ে ভেবেছিলো কেউ তাকে দেখতে পাবেনা, অথচ তার সর্বাঙ্গ বাইরে। উপরে কেউ তাকে আসলে খুঁজতে যায়নি। অনেকক্ষন পর ও নিজে থেকে বের হতে গিয়ে বিপত্তি বাধলো। ও মাথা ঢুকানোর সময় সোজা করে ঢুকিয়েছিলো কিন্তু মাথা বের করার সময় বাঁকা করে বের করতে গিয়ে, মাথা বেধে গেল দেওয়ালে। তারপরও ওভাবেই বের করতে চাচ্ছিলো,আটবে রইলো। শেষে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো। আমি গেলাম। আমিও ওভাবেই টেনে বের করার চেষ্টা করলাম কিন্তু বের হলনা। মাথা ঘসা খাচ্ছিলো। সে বারবার বলতে লাগল- আমার আব্বুকে ডেকে আন। তারপর আমরা তার আব্বুকে ডেকে আনলাম। তার আব্বু এসে মাথা সোজা করে বের করে আনলো। তখন আমরা সকলে উপলব্ধী করলাম যে আমরা পুরো আহাম্মক ! বিষয়টা ছিলো খুবই সোজা।

বহু বছর পর সেই নিখাঁদ আনন্দের দিনগুলো মনে পড়ছে। অসাধারণ ঝরঝরে ছিলো সেই দিনগুলো। খেলার আনন্দে আমি/আমরা লফাতাম। মনের ভেতর থেকে আনন্দ বের হত। খুব হাসতাম আমরা। সে হাসি ছিলো পবিত্র আনন্দের। কোনো সময়জ্ঞান ছিলোনা। আমাদের পিতা-মাতারাও আমাদেরকে ওভাবে ছেড়ে দিত। তাদের শাসন ছিলো অনন্যসাধারণ। সকালে সকলে পড়াশুনা করত,স্কুল থেকে ফিরে খেলাধুলা। দুপরে ঘুম ফাকি দিয়ে খেলা। বিকেলে খেলা। সন্ধ্যায় পড়তে বসা। পড়া শেষে কিছুক্ষন খেলা। আর স্কুলের পরিক্ষা শেষ হলে রাতে খেলতাম পেট ভরে,মন ভরে। সেসব দিন এখনকার বাচ্চারা কল্পনাও করতে পারবে না। এখনকার পোল্ট্রী মুরগী বাচ্চাগুলো এমনেই রুগ্ন,তার উপর ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্ত। এদের বাপ মা'রা অনেক বড় বড় শিক্ষত,বেশীরভাগই ইডিয়ট। আদরের নামে অত্যাচার করে, শাসনের নামে অপরাধে উৎসাহিত করে। আন্ডা বাচ্চাকে আইনস্টাইনের থিওরী শেখায় জোর করে। এরাও শিক্ষা নেয়না, বমি করে দেয়। না এরা পায় শিক্ষা, না পায় সুস্বাস্থ্য । আর্টিফিসিয়াল এই জামানায় সেই শৈশবকে প্রবলভাবে মিস করছি। সকলের সুমতি হোক !

বিষয়: বিবিধ

৬১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File