এ এক অসাধারণ অনুভূতি
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৫ নভেম্বর, ২০১৮, ০৬:১২:০৮ সকাল
--------------------------------
পরিকল্পনা করেছিলাম এ মাসের মাঝামাঝি,যে সাগরের একেবারে কিনারের কোনো মোটর হোম পার্কে পার্ক করে এক রাত কাটাবো। অনলাইনে পেলাম ডিপো-বে এবং লিংকন বীচের মাঝামাঝি একটি অসাধারণ মনোরম স্থান। মাত্র একটা স্পেস ফাঁকা ছিলো আর সেটা নির্ধারিত হল আমার জন্যে।
আজ সকাল ৯টায় রওনা হলাম। পথে তেল নিলাম মোটর হোমের। শালা আমার চেয়ে বহুগুণ বেশী হাভাতে। ৫০০০ সিসির ইঞ্জিন তেল খায় ঢকঢক করে। প্রতি ৮/৯ মাইল পার হতেই এক গ্যালন তেল খেয়ে ফেলে। তারপরও কিছু করার নেই, মন চাচ্ছে, ফলে টাকা তুচ্ছ, ইতরস্য ইতর !
তবে ২৬ ফুটের এই বাস রাস্তায় চালালে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। গতিসীমা মেনে চলতে হয়। ওরেগন না হয়ে অন্য স্টেট হলে এই জিনিস চালানো কষ্টকর ছিলো। যাত্রা করলাম প্রশান্ত মহাসাগরের তীর বরাবর। রাস্তায় একটা ডোনাটের দোকানে ঢুকে এক বক্স মজার ডোনাট কিনলাম। এটা এক বিশেষ ধরনের নরম পাউরুটি বলা যায়। আমি ক্রিম ফিল বা ভেতরে মজার ক্রিম দেওয়া আছে এরকমগুলো পছন্দ করি। এর বাইরের অংশে চকলেট। নানান রকমের কিনলাম।
যাত্রা শুরু হল। আজ সকালে ছিলো হালকা বৃষ্টি এবং কুয়াসা। আস্তে আস্তে বৃষ্টি থেমে যেতে থাকল। কুয়াশাও কেটে গেল। চারিদিকে পরিষ্কার ভাব হল স্পষ্ট। অসম্ভব সুন্দর মসৃণ পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকলাম। পথে কয়েকবার পুলিশের গাড়ি দেখে রক্ত হাফ লিটার কমে গিয়েছিলো,পরে পানি খেয়ে রক্তের পরিমান বাড়িয়েছি। অবশ্য নিয়ম লঙ্ঘন করিনি। পুলিশ দেখলে আসলে ভয় পাওয়ার কারন পুলিশ নিজে নয়,,বরং জরিমানা। এককালীন জরিমানা হলেও একটা কথা ছিলো, কিন্তু ইন্সুরেন্স মানি দ্বিগুন হয়ে যায়। এটাই হল ভয়, কারন বছরের পর বছর উচ্চহারে এই পয়সা গুনে যেতে হয়।
আজ শনিবার, সাধারণত বন্ধের দিনগুলোতে রাস্তায় প্রচুর গাড়ি দেখা যায়,কিন্তু আজ কেন যেন গাড়িঘোড়া কম ছিলো,,বোধহয় আমি চলছি,এ কারনেই.....সম্মানের সাথে রাস্তা থেকে সব সরে গেছে সব। অনেকক্ষন পর নিউপোর্ট বে-তে আসলাম। এখানে হাইওয়ে ১০১ ধরে লিংকন সিটির দিকে এগিয়ে চললাম। হাইওয়ে ১০১ হল প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেষে তৈরী হওয়া অসাধারণ এক হাইওয়ে। এটা ওরেগন হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে গেছে....বিশাল এক রাস্তা। এই হাইওয়ে ধরে চলতে থাকলে কিছু দূর পরপর নানান সব আউটলুক পাওয়া যায়। ভোরবেলা হলে কোথাও কোথাও বুনো হরিনের পালও দেখা যায়। যেখানে গাড়ি থামার ব্যবস্থা আছে, সেখান থেকে সাগরের সৌন্দর্য্য অবলোকন করা যায়। তবে সবগুলো স্থানে আরভি পার্ক করার ব্যবস্থা নেই। ছোট গাড়ি হলে আজ অনেকগুলো সুন্দর স্থানে থামতে পারতাম। কি যে সব সুন্দর সুন্দর স্থান। সবুজ বনভূমী,সাথে সাগর, আর নির্মল বাতাস। অক্সিজেন টানলেই টাকা উসুল হয়ে যায়।
লিংকন সিটি পার হয়ে লিংকন বীচে আসলাম। এই বীচটা খুবই সুন্দর। এখানে সাগরের স্রোত আড়াআড়ি বাড়ি খায় এবং পানি ঘুরতে থাকে। একেবারে তীরের পাশেই আরেকটা স্থল চর আছে। সেখানে পানি এসে আছড়ে পড়ে অসাধারণ অবস্থার সৃষ্টি করে। প্রচুর পাখি দেখলাম। আজকের তাপমাত্রা ৫০ডিগ্রী ফারেনহাইট কিন্তু সাগর পাড়ের স্বাভাবিক ঠান্ডা বাতাসের পরিবর্তে খুব কম গতির বাতাস ছিলো, যার কারনে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিলো না। হঠাৎ দেখী সহকর্মী ফ্রাঙ্ক তার পরিবার নিয়ে ঘুরছে। তার সাতে কথা বললাম। এর পরপরই দেখী আরও দুজন সহকর্মীও হাজির। আরে বাহ ! এত দূরের এক সি-বীচে সব পরিচিত লোক....। অামি সাগরের কাছাকাছি হলাম । আসলে আমার হারামী মোবাইল ভালো ছবি তুলছে না চোট পাওয়ার পর। আমি খালি চোখে যা দেখেছি,তা তুলতে ভালো ক্যামেরাও ব্যর্থ হবে,কিন্তু কিছুটা ভালো বোঝা যেত ভালো ক্যামেরায়। অত্যন্ত বিশাল সব ঢেউ ক্যামেরায় ছোট ছোট দেখা যাচ্ছে। সাগরের সে কি গর্জন। তবে আসার পথে সাগরের পাথুরে অংশের উপর তীব্র ঢেউগুলোর আছড়ে পড়ার দৃশ্যগুলো ছিলো আসলেই ভয়ঙ্কর সুন্দর। এ শব্দ বহু দূর থেকে শোনা যায়। আমার বিশ্বাস এরকম অংশে দাড়িয়ে থাকা কোনো সাধারণ বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করতে বাধ্য হবে। এক ভয়ঙ্গর দৃশ্য এটা। প্রবল শক্তি নিয়ে বিশাল ঢেউ পাথরের বুকে আসছে পড়ে এবং টালমাটাল হয়ে যায়, বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। এসবের স্রষ্টা তাহলে কেমন !
বীচে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে এক অনলাইনের বড়ভাইকে ফোন দিলাম। অনেকক্ষন গল্প হল। তাও শালা গল্পের সাবজেক্ট হল নরেন্দ্র মোদী। অতি চমৎকার এক সুন্দর সি-বীচ থেকে আমি নরেন্দ্র মোদীকে কল্পনায় দেখতে থাকলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম অসহায় মুসলিমদের অন্তরের ভেতর থাকা ভালোবাসার পবিত্র স্থান বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, দেখলাম গুজরাটে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে অসহায় মুসলিমদের,,দেখতে পেলাম হাজারে হাজারে ধর্ষিত মুসলিম নারীর আহাজারী আর মোদী,বাজপেয়ী,আদভানীর মত নেতৃত্বদানকারী হায়েনাদের অট্ট হাসি। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। চললাম আমার গন্তব্যের দিকে,কিছুটা পেছনে।
পথে ডোরী কোভ নামক এক ছোট সুন্দর রেস্টুরেন্টে থামলাম। এর সাথে আরেক রেস্টুরেন্ট, ভেতরে সংযোগ দরজা রয়েছে। কিন্তু ওপাশে নানান সব মদ,গ্রিল্ড চিকেন,শুয়োর ,গরু ,মাছ পাওয়া যায়। তবে ওই পরিবেশ পছন্দ না তাই এপাশেই থাকলাম। ছোট হলেও খাবারের দাম দেখে চোখ কপাল ভেদ করে মাথার মাঝখানে পৌছে গেল। ছোট ছোট কয়েক পিছ ফ্রায়েড মাছের দাম ২৪ ডলার। আমার পছন্দের ক্লাম চাওডার,যা বানানো হয় কুচি কুচি করে রান্না করা স্যামন, চিজ ও নানান জিনিস দিয়ে তৈরী গ্রেভীর সাথে। খুব মজা লাগে এটা। দুটোই নিলাম, কারন এভাবে হাসিমুখে ঢুকে ইউ টার্ন নিয়ে বের হয়ে গেলে ওরা মনে মনে মুখে গু কুলি করে মারতে পারে ভেবেছিলাম। টানলাম চরম। তবে এসব খাবার যত ভালোই হোক মাথা পর্যন্ত টানা যায় না। চাষাভূষো মানুষের শানে এসব খাবার আসলেই বেয়াদবী।
পথে এক দারুন লুকআউটে থামলাম। এখানে সাগরে এসে পড়েছে এক সুন্দর নদী। এই অংশের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করলে আমার নামে মানহানী মামলা হবে,,আমি মামলা পছন্দ করিনা। এতটুকু বলছি, সাগরের তীর ধরে একটা লম্বা স্থল ভূমী,মনে হয় যেন উপদ্বীপ। এর পেছনে নদীর পানি আর সামনে মহাসমুদ্র। আর সেই স্থলভাগে অসাধারণ সুন্দর সব বাড়ি তৈরী করা হয়েছে। তবে সেসব বাড়িতে যেতে হলে প্রাইভেট নৌযান দরকার হয়। ভূমী থেকে মাত্র কয়েকশত মিটার দূরে এগুলো। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে বিশেষ সব নৌযান পার্ক করা। এরা সবাই ধনী লোক। এই অংশটা কত সুন্দর তা বললে বিশ্বাস করবেন না, গন-পিটুনী দিবেন,,ফলে ভয়ের কারনে বর্ণনা এ পর্যন্তই থাক। তবে নিয়ত করেছি ছোট গাড়ি নিয়ে ওখানে যাব ইনশাআল্লাহ !
এবার আমার আরভি পার্কে আসলাম। এটা হল স্যান্ড এন্ড সি আরভি পার্ক। সাগরের পাশে মনোরম করে তৈরী করা বড় একটা পার্ক। এদের অফিস থেকে নির্দেশিকা নিলাম কিভাবে কি করতে হবে। ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড নিলাম, কিছু উপদেশ বাণীও। এরপর সাগরের একেবারে কিনারে উঁচু স্থানে পার্ক করলাম। গাড়ির ভেতর থেকে অশান্ত সাগরের রূপ দেখা যাচ্ছে। আমি সাগরের পাশে কিছুক্ষন ছিলাম। এত ভালো লাগল,যা বলার মত না। একেবারে অসহ্য ব্যাপার !
গাড়ির ভেতর আমার বেশ কয়েকদিনের খাবার,পানি রয়েছে। এটা একটা চলন্ত বাড়ি। এর ভেতর সকল সুবিধা রয়েছে। তবে তেল,গ্যাস না পুড়িয়ে বিদ্যুতের আউটপুটের সাথে গাড়ির মেইন প্লাগ জুড়ে দিয়ে সকল সুবিধা উপভোগ করছি। এইমাত্র খেয়াল করলাম ল্যাপটপের চার্জার বাসায় ফেলে রেখে এসেছি। এখন এই চার্জটুকুই ভরসা। যোহরের কসর নামাজ, সাথে আসরেরটাও যোগ করে নিলাম। সফরকারীদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ এক বিরাট ছাড়। সত্যি মানুষ খুব ফাঁকিবাজ প্রাণী। কসর পড়তে মজা লাগে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের এই সুন্দর তীরে আমার বেডরুমের জানালার পাশে বালিশে মাথা রেখে এক দৃষ্টিতে অশান্ত সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকতে অসম্ভব ভালো লাগে। এ এক অদ্ভূত সুন্দর অনুভূতী। আল্লাহ আমাকে ভাগ্যবানদের ভেতর রেখেছেন,, তিনি আমার পরবর্তী কালগুলোতেও মহা সৌভাগ্যশালীদের কাতারেই রাখুন এবং আপনাদেরকেও !
বিষয়: বিবিধ
৭৫৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লেখাটি ভালো লেগেছে। এই রকম আরো পাবো আশা রাখি।
আমার ফেসবুকে রেগুলার পাবেন ইনশাআল্লাহ। অনেক ধন্যবাদ
ব্লগ প্রেমীরা আবার একটু সরব হলে ব্লগটা আবার জমে উঠতো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন