হযরত লোকমান
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১০:১০:১৩ রাত
আল্লাহর এক বিশেষ বান্দা হযরত লোকমান(আল্লাহ তার প্রতি সর্বোচ্চ দয়া করুন,তাকে মহা সম্মানীত করুন) তার সন্তানদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন, আর মহান রব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সেটা প্রচন্ড পছন্দ হয়ে যায় এবং তিনি আল-কুরআনে সেটি উল্লেখ করে আমাদেরকে জানিয়ে দেন। ওহীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, ইসলাম নামক দ্বীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। তবুও বলছি, আজও যদি কোনো পিতা তার সন্তানকে,কোনো ভাই তার ভাইকে,কোনো ব্যক্তি তার পরিবার,আত্মীয়,প্রতিবেশী বন্ধুদেরকে অথবা কোনো ব্যক্তি অন্যদেরকে এমনই কল্যানকর উপদেশ দেয়,নিজে তা মেনে চলে, তবে আল্লাহ তায়ালা হযরত লোকমানের প্রতি যেমনভাবে খুশী হয়ে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, আজও ঠিক তেমনই আচরণ করবেন। অথবা তিনি হয়ত আরও বেশী সুআচরণ করবেন আমাদের সাথে, এমনকি হাদীসে সেটার বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, কারন আমরা আল্লাহর রসূল(সাঃ)কে স্বচক্ষে দেখিনি,তার কিতাব সরাসরি প্রাপ্ত হইনি, বরং আমরা অনেক পরে আসা মানব সমষ্টি,যারা কেবল কিছু কিতাব পড়ে ইমানকে জাগ্রত করেছি। রসূল(সাঃ) আমাদেরকে বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বিশাল মর্যাদার কথা প্রকাশ করেছেন।
সবচেয়ে বড় পাপ হল শিরক। এর মানে হল আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে রব হিসেবে মানা। অথবা আল্লাহর পাশাপাশি অন্যকেও আল্লাহর বৈশিষ্ট্য দান করে তাকে প্রায় সমানতালে ডাকা। অথবা আচরনে এমন অবস্থা প্রকাশ করা যাতে মনে হয় সকল কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ নন। হযরত লোকমান তার সন্তানকে শিরক মুক্ত হতে নির্দেশ নিয়েছিলেন এবং সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন।
"শ্মরন করো , যখন লোকমান তান সন্তানকে বলেছিলো- হে বৎস্য ! আল্লাহর সাথে কোনোকিছুকে শরিক করোনা, অবশ্যই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় যুলুম।" (সূরা লোকমান: ১৩)
এ আয়াতের ব্যাপারে রসূল(সাঃ) একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন অন্য একটি আয়াত- " যারা ইমান এনেছে এবং তাদের ইমানকে যুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি......" আয়াত অবতীর্ণ হয়, তখন সাহাবীরা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং বলেন,,আমাদের ভেতর এমন কে আছে যে,তার ইমানকে যুলুম থেকে পুরো মুক্ত রাখতে পেরেছে ??...তার জবাবে রসূল(সাঃ) বলেন---এখানে এই আয়াত দ্বারা এরকমটা বুঝানো হয়নি,যেটা তোমরা ভেবেছো,,,,,তোমরা কি হযরত লোকমানের উপদেশ খেয়াল করোনি ? তিনি তার পুত্রকে বলেছিলেন-নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে বড় যুলুম ! সূত্র: (বুখারী ৪৭৭৬,মুসলিম ১২৪,তিরমিযী ৩০৬৭)
অর্থাৎ ইমানকে শিরক মুক্ত রাখতে হবে। কি কি ভাবে শিরক হয় তা ভালোকরে জানতে হবে। নইলে আমরা ইমানের উপর যুলুম করে ফেলব।
এ পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা আরেকটি দারুন বিষয় উপস্থাপন করে একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেন। হযরত লোকমানের ঘটনা থেকে মনে হতে পারে পিতা-মাতার আদেশ সবসময়ই শিরোধার্য্য,,,আসলে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। তাদের ভালো আদেশই শিরোধার্য্য, খারাপ আদেশ নয়।
"আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি অত্যন্ত সুআচরনের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় ২ বছরে, (তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি) যে- আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।"
"তোমার পিতামাতা যদি পিড়াপিড়ী করে আমার সাথে শিরক করতে ,যার জ্ঞান তোমার নেই, তাহলে অবশ্যই তুমি তাদের কথা মানবে না। কিন্তু দুনিয়াতে তাদের সাথে সুআচরনের সাথে বসবাস করবে। অত:পর আমারই কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন তোমাদেরকে জানিয়ে দেব তোমারা যা করেছিলে।"(লোকমান: আয়াত ১৪-১৫)
"হে বৎস্য, তুমি নামাজ কায়েম করো, সৎ কাজে আদেশ দাও , অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং বিপদাপদে ধৈর্য্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই এটি দৃঢ় সংকল্পের কাজ।" (সূরা লোকমান : ১৭)
এই উপদেশটা অসম্ভব মারাত্মক দারুন। কারন যে ব্যক্তি অন্যকে উপদেশ প্রদান করবে, তার ভেতর যোগ্যতা থাকতে হবে নইলে তার উপদেশটি সঠিক মাত্রা পাবেনা এবং ভালোভাবে কার্যকরীও হবেনা। ফলে নামাজের মাধ্যমে বা ইবাদতের মাধ্যমে তাকে নিজ গুনাবলী সৃষ্টি করতে হবে এবং একইসাথে সমাজের মানুষের ভেতর সত্যের আওয়াজ তুলতে হবে। মানুষকে সততার পক্ষে আদেশ দিতে হবে,যাতে মানুষেরা সত্যের পথ থেকে সুন্দর ও অনুকূল পরিবেশ তৈরী করতে পারে। এতে গোটা পরিবার,সমাজ হবে সুন্দর এবং সুআচরনের পরিবেশ তৈরী হবে। আর অবশ্যই সমাজে খারাপ কাজ করা হবে। সকলে ভালোর পক্ষে থাকবে না। তখন অসৎ কাজ সমূহের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। সেসব খারাপ কাজে সাধ্য অনুসারে বাধা প্রদান করতে হবে। কিছু করার না থাকলে অন্তত অন্তর থেকে ঘৃণা করতে হবে। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ জারি থাকলেই কেবল একটি সমাজ সুন্দর থাকতে পারে, অন্যথা নয়।
আর মানুষের জীবনে অবশ্যই নানান সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরিক্ষা আসবে। সেটার রূপ অনেক রকম। কখনও নানান বিপদাপদ,কখনও শান্তি সমৃদ্ধী। এই দুই সময়েই মানুষ নিয়ন্ত্রন হারায়। সুখের সময় মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় এবং নিজের নফসের ইবাদত শুরু করে, আর দু:খের সময় আল্লাহকে ডাকে বটে, তবে ধৈর্য্যহারা হয়, হতাশ হয়, আচরনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি অভিযোগ প্রকাশ করে ও অভিমানী আচরণ করে, যা তাকে হারামের দিকে নিয়ে যায় এবং আল্লাহকে রাগান্বিত করে। মূলত: তাকে যেই পরিস্থিতিতেই রাখা হোক না কেন, সে সর্বপ্রথম সন্তোষ প্রকাশ করবে আলহামদুলিল্লাহ বলে এবং ধৈর্য্যধারণ করে পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করবে। তবেই সে প্রকৃত ও পুরোপুরি সফল হবে।
হযরত লোকমান তার সন্তানকে এভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। এখন আমাদের পালা। তার আরও কিছু উপদেশ রয়েছে, পরে আবার আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ !
বিষয়: বিবিধ
৭০৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর আমরা মানুষকে তার পিতামাতার সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি -- তার মাতা তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন কষ্টের উপরে কষ্ট ক’রে, আর তার লালন-পালনে দুটি বছর, -- এই বলে -- ''আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো। আমারই নিকটে প্রত্যাবর্তনস্থান।
হজরত লুকমান অসিয়ত করে চলেছেন তার সন্তানদের, কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াত দুটিতে মনে হতে পারে লুকমানের অসিয়তের মাঝে আল্লাহ অনুপ্রবেশ করেছেন। কিন্তু তা নয়, একজন সজ্জন আর জ্ঞানী ব্যাক্তি নিজ সন্তানের কাছে আপন হক আদায়ের কথা বলবেন, লজ্জ্বা পেতে পারেন। যেমন, সুরা ‘আহযাবে’ এসেছে যে, রসুল সঃ সাহাবীদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন, খাওয়ার শেষে অনেকে অযথা বসে থাকত, যাতে রসুল সঃ অসন্তুষ্ট হতেন, কিন্তু লজ্জ্বার খাতিরে কিছু বলতেন না। আল্লাহ শেষে নিজেই বলে দিয়েছেন। কিন্তু নিজ হকের বিষয়ে বান্দার কাছে তাকিদ দিতে আল্লাহর লজ্জ্বা নেই। সে কথা তৃতীয় আয়াতেই পাওয়া যাবে। আয়াতে আল্লাহ বলেন, আমি মানুষকে পিতামাতার জন্য অসিয়ত করেছি, যে, তারা যেন তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে। তাদের মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে বয়ে বেড়ান। তার পর দু বৎসরে দুধ ছাড়ান। শুধু বয়ে বেড়ানোই নয়, জোঁকের মত শরীরের ভিতর অনন্তর রক্ত চুষতে থাকে। প্রসব বেদনা, যা একমাত্র প্রসূতীরাই জানেন। তার পর আরও দুইবৎসর দুধ যা রক্ত হতেই আসে তা চুষতে থাকে। তার পর আল্লাহ বলেন যে, এর সব বন্দবস্ত আমিই করেছি। আসল ক্রিয়েটর আমিই, আমিই তোমাদের মায়ের অন্তরে মমতা আর বাপের অন্তরে দায়িত্ব বোধ সৃষ্টি করে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছি। তোমরা আমার শুকরিয়া কর আর তোমাদের মাতা-পিতারও। অবশেষে জবাবদেহী করতে তোমাদের আমার কাছেই আসতে হবে। পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর ও তাদের মেনে চল ও তাদের অনুগত হও। এ আয়াতটি তারই একটি যেখানে আল্লাহর হকের পর পরই মাতা-পিতার হকের তাকিদ এসেছে।
১৫) وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
''কিন্তু যদি তারা তোমার সঙ্গে পীড়া-পীড়ি করে যেন তুমি আমার সাথে অংশী দাঁড় করাও যে সন্বন্ধে তোমার কাছে কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের উভয়ের আজ্ঞাপালন করো না, তবে তাদের সঙ্গে এই দুনিয়াতে সদ্ভাবে বসবাস করো। আর তার পথ অবলন্বন করো যে আমার প্রতি বিনয়াবনত হয়েছে, অতঃপর আমারই কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থান, তখন আমি তোমাদের জানিয়ে দেব যা তোমরা করে যাচ্ছিলে।’’
চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ সাবধান করেছেন, যে যদি মাতা-পিতার আনুগত্য কিংবা অনুসরণ করতে গিয়ে দ্যাখ যে, যে বিষয়ে তোমার জানা নেই এমন বিষয়ে তারা আমার সাথে শরিক করতে বলছেন তবে তাদের অনুগত হয়োনা। তবে দুনিয়ায় অবশ্যই তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। আর সর্বদা এমন লোকের অনুসরণ করবে যার গন্তব্য আমার প্রতি রয়েছে। অবশেষে তোমরা সকলেই আমার কাছে ফিরে আসবে আর তোমরা কে কি করতে আমি তোমাদের তা স্মরণ করিয়ে দেব, যদি না বুঝে থাক।
মা-বাবার সাথে সর্বদা ভাল ব্যবহার করতে হবে, কোন অবস্থায়ই দুঃখ দেওয়া যাবে না, তবে তাদের শির্ক সম্পর্কিত কোন আদেশ মানা যাবে না। এটি একটি সমস্যা, যা বৃহৎ আকারে রসুল সঃএর নবুয়তের প্রাথমিক জীবনে দেখা দিয়েছিল। অনেক যুবকেরা ইমান আনলে মা-বাবার পক্ষথেকে বাপদাদার ধর্মে ফিরে যাবার জন্য বাধ্য করা হয়। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাঃ, পিতা গত হয়েছিল। ইমান আনার পর বিধবা মা কঠোর অনশন করে বসল, সাদ ইসলাম ত্যাগ না করলে জীবন দেবে তবু অনশন ভাংবে না। মুসহাফ রাঃ দিগম্বর অবস্থায় বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে মা বাবার আনুগত্য করা যাবেনা বা হুকুম মানা যাবে না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন