অহংকার ইনসাইড
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ৩০ অক্টোবর, ২০১৮, ০৩:৩৯:৪২ দুপুর
-------------------
নাফিস অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ এবং সমাজে সে একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তার আচার ব্যবহারে মানুষ ব্যপক সন্তুষ্ট। সমাজের সাধারন ও অসাধারণ সকলের সাথে তার সমান ভাব। বলা যায় সাধারনের সাথে তার বেশী ভাব। চাষীদের সাথে আইলে বসে কখনও পান্তাও খেয়েছে। কেউ তার সাথে কথা বলতে চাইলে সহাস্যে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলে। তার মত ভালো ছেলে এলাকায় নেই এমনই ব্যক্তি সে। সুন্দর তার ব্যক্তিত্ববোধ।
একদিন এক চায়ের দোকানদার,যার দোকানে সে মাঝে মাঝে বসে গল্প করত, সে তার বাড়িতে আমন্ত্রিত হল। নাফিস বেশ স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। চায়ের দোকানদার তার বন্ধুর মত। তো সেই লোক নাফিসের বাড়িতে তার জান্যে একটা শার্ট নিয়ে গেল। নাফিস আনন্দচিত্তে সে উপহার গ্রহন করল।
নাফিস সুন্দর পোষাক পরিধান করে এবং প্রায় প্রত্যেক বিকেলে খেলাধুলা করে আর সেখানে বেশীরভাগই থাকে সমাজের উচ্চবিত্তের সন্তানগণ। সেখানেও নাফিসের প্রশংসা সকলেই করে।
তো এক বিকেলে নাফিস সেই চায়ের দোকানদার বন্ধুর দেওয়া সস্তা শার্ট পরে মাঠে বাস্কেটবল খেলতে গেল। তার অবস্থা এমন যে সে নিরহংকারী মানুষ। এমনকি সাধারণ সস্তা পোষাকও সে পরিধান করে। ফুরফুরে মেজাজে নাফিস খেলা করছে। হঠাৎ সে দেখলো অনাকাঙ্খিতভাবে সেই দিন মাঠে উক্ত চায়ের দোকানদার উপস্থিত। নাফিস তাকে দেখতে পেল।
এ পর্যায়ে নাফিসের আচরণ কেমন হবে ? নাফিসের কৃত আচরনের সাথে অহংকারের সম্পর্ক আছে কি না ? অথবা কোন পর্যায়ে রয়েছে ?
===========================
১. নাফিস চায়ের দোকানদারকে দেখেই কেমন যেন নিজের ভেতর গুটিয়ে গেল। তার ভাবনা এই যে, চায়ের দোকানদার দেখে ফেলেছে যে, সে তার দেওয়া সস্তা শার্টটা পরিধান করেছে। সে চায়ের দোকানদারের চেহারার দিকে তাকাতে চায়না, কারন এ পর্যায়ে চায়ের দোকানদারের ভেতর একটা তৃপ্তীর ভাব সে লক্ষ্য করবে, হয়ত একটা গর্বিত চেহারা ফুটে উঠবে অথবা সে অশিক্ষিত হেতু শার্টটা গায়ে বেশ মানিয়েছে এ কথাও বলতে পারে। নাফিস তার দিকে পারতপক্ষে তাকাচ্ছে না, আবার খেলায়ও মনোযোগী হতে পারছে না। একটা অদম্য অস্বস্তিতে ভূগছে সে।
২. নাফিস ভাবছে শার্টটা কেন যে আজ গায়ে দিতে গেল ! তাকে লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হল। এখন যদি অন্য বন্ধুরা বুঝতে পারে এই শার্টটা চায়ের দোকানদার দিয়েছে তাহলে ইজ্জতের অবস্থা কি হবে !
৩. নাফিস চায়ের দোকানদারের উপস্থিতিতে তেমন কিছু মনে করেনি, তবে মনের কোথাও ক্ষুদ্র একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। কেমন যেন মৃদু খচখচ করছে। হয়ত মনে হচ্ছে লোকটা আজ উপস্থিত না হলেই বরং ভালো হত।
৪. নাফিস চায়ের দোকানদারের উপস্থিতিতে খুশী হল এবং সে উচ্চস্বরে লোকদের সাথে চায়ের দোকানদারকে পরিচয় করিয়ে দিল এবং বলল যে- এই শার্টটা এই লোক তাকে দিয়েছে।
পাঠকদের বেশীরভাগই নিশ্চিত যে ১ থেকে ৩ নাম্বার পয়েন্টগুলো বাস্তবে ঘটলে নাফিসের ভেতর যথাক্রমে উঁচু ও নীচু মাত্রায় অহংকার রয়েছে,যদিও সে তার সকল আচরনে সমাজের কাছে নিরহংকারী হিসেবে পরিচিত। কারন সাধারণত এরকম ক্ষেত্রে আমাদের ভেতর এরকম আচরন পরিলক্ষিত হয় বা একটা আলোড়ন তৈরী হয়। আর এই আচরনের পরিবর্তন হয় আমাদের ভেতরের সুপ্ত,গুপ্ত অহংকারের কারনে। এটার অস্তিত্ব সমসময় বোঝা যায়না কিন্তু ভেতরে থেকে যায়,যথা সময়ে উঠে আসে। তবে এর নানান রকম মাত্রা রয়েছে। ওই মুহুর্তে নাফিস লজ্জায় মাঠ ত্যাগ করলে বা কোনো অজুহাতে গা ঢাকা দিলে বোঝা যেত তার ভেতর অহংকারের মাত্রা অত্যধিক যদিও তা পূর্বে পরিস্থিতির অভাবে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু আলোচ্য নাফিস যেহেতু নিরহংকারী হিসেবে পরিচিত, তাই তার অহংকারের লেভেল অত চড়া নয়, তবে তা আছে। মূলত: কোনো মানুষই এই অহংকার থেকে মুক্ত নয়, কম অথবা বেশী।
৪ নং পয়েন্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে নিরহংকারী আচরণ মনে হলেও এর ভেতর একটা মনোস্তাত্বিক বিষয় রয়েছে। নাফিস সকলের সামনে উচ্চস্বরে দোকানদারকে পরিচিত করে এবং তার গায়ে থাকা শার্টের পরিচয় প্রদান করে মূলত আগে ভাগে নিজের মহত্ব সম্পর্কে অন্যকে ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তার এই আচরন একটি সতর্কতামূলক অবস্থান। যাতে দোকানদার শার্টের পরিচয় উপস্থাপনের সুযোগ না পায় সে ভয়ে নাফিস আগে ভাগে বিষয়টি প্রকাশ করেছে। তার এই আচরণও অহংকারের একটি বিশেষ লেভেল থেকে উঠে আসা। বলা যায় এই ৪ নং পয়েন্টের আচরনই সবচেয়ে ভয়াবহ। কারন এই অহংকার ধারনকারী ব্যক্তিরা সমাজে গন্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এবং অন্যের চোখে নিরহংকারী ব্যক্তিতের পরিচায়ক। এই বিষয়টি নিয়ে সে নিজেও আত্মতুষ্টিতে ভূগতে পারে ফলে এর ভেতর অহংকার আছে কি না সেটা সে নাও বুঝতে পারে। হয়ত তার মন অতদূর বিশ্লেষনে যাবেনা। অথচ সে নিজেকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এই অহংকারের স্পষ্ট অস্তিত্ব খুজে পাবে। আর রিয়া(লোক দেখানো ইবাদত) নামক যে বৈশিষ্ট্য সেটা এরকম ধরনের অহংবোধ থেকেও উৎসারিত হয়। অন্যের সামনে নিজেকে মহান করে দেখার সুক্ষ্ণ প্রবনতা থেকে বহু বড় বড় অঘটনের জন্ম হয়।
--------------------------------------------------------
৫. নাফিস যেমনভাবে খেলছিলো তেমনভাবে খেলতে থাকল। চায়ের দোকানদারের উপস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকল এবং সালাম জানালো। এরপর খেলাশেষে চায়ের দোকানদারের সাথে কথা বলল এবং তাকে বলল-শার্টটা কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে, ধন্যবাদ।
নাফিসের ৫ নং আচরণটা সবচেয়ে বেশী সঙ্গত। যদিও তার ভেতর অহংকার আছে ও থাকবে কিন্তু এই আচরণটি বেশী পরিমানে দোষমুক্ত। এরকম আচরণকারীকে আল্লাহ বেশী পরিমানে ক্ষমা করেন। রসূল(সাঃ)আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, অহংকার হল আল্লাহর চাদর। আর আল্লাহ কখনই এই চাদরে টানাটানি পছন্দ করেন না। অহংকারের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। তিনি অহংকারীর সমস্ত আমল ধ্বংস করে দেন বা দিতে পারেন। কারন অহংকারে প্রকাশ্য অথবা গুপ্তভাবে আমিত্ব লুকিয়ে থাকে। আর এর আরেক নাম হল অপ্রকাশ্য বা গুপ্ত শিরক। এখানে ব্যক্তির আচরন ও ইবাদত সমূহের ভেতর আল্লাহর কৃতিত্ব শতভাগ স্বীকৃত না হয়ে ব্যক্তির উপরও কিঞ্চিত গিয়ে পড়ে। ফলে আল্লাহর কৃতিত্ব ও অহংকারের চাদর নিয়ে টানটানি হয়ে যায়। নিজের আমিত্ব আল্লাহর আমিত্বের সাথে একাকার হওয়ার চেষ্টা করে। সাবধান ! এটা অত্যন্ত সুক্ষ্ণ এবং মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি ইবাদতের মূল ভিত্তির ভেতর পড়ে এবং ভীত ধ্বংস হলে আমল বরবাদ হয়ে যেতে পারে।
আমাদের আচরণসমূহ লোক দেখানো অহংকারমুক্ত নাকি প্রকৃত অহংকারমুক্ত সেটা নিয়ে গবীরভাবে ভাবতে হবে এবং নিজেই তা সংশোধন করতে হবে। কারন এই বিষয়টি ব্যক্তির মনের অনেক গহিনের বিষয়। অন্যরা তাকে বুঝতে পারবে না সঠিকভাবে। আর ব্যক্তি তার জ্ঞান অনুপাতে তা উপলব্ধী করে থাকে। আল্লাহও সাধ্য অনুসারে কৈফিয়ৎ নিবেন। অামাদের প্রত্যেকের ভেতর অহংকার রয়েছে, আমরা অপরাধী এবং পাপী। কিন্তু শ্রেষ্ঠ সে মানুষ, যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় এবং হেদায়াত কামনা করে। অহংকারী সে, যে সর্বদা ভেবে চলেছে, সে হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
বিষয়: বিবিধ
৭৭৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন