আমার নাট্য জীবন
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:৩৯:১৬ রাত
=============
ঢাকা ভার্সিটির টি.এস.সিতে আড্ডা দিচ্ছি,,,,বন্ধু মুরাদ বলল,চল আমরা গ্রুপ থিয়েটারে ভর্তি হই। মুরাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব লেজের সাথে গোবরের মত। জীবনের ঢাকা টাইম কেটেছে ওর সাথে। একসাথে থাকতাম প্রায় সময়ই। মানুষ হিসেবে সে খুবই ভালো। আমরা শাওলিন উশু(কুংফু) স্কুলে ছিলাম,সেখান থেকেই মুরাদ আর জনির সাথে গভীর বন্ধুত্ব হয়। জনিকে নিয়ে পরে লিখব।
তো আমরা দেখলাম টি.এস.সির দেওয়ালে দুটো বড় পোস্টার নাট্যকর্মী নেওয়া হচ্ছে মর্মে। একটা ঢাকা নান্দনিক,আরেকটা ছিলো ঢাকা পদাতিকের। দুজন গবেষণায় লেগে গেলাম কারা ভালো !! আমি যুক্তি দিলাম পদাতিক শব্দটাই তো সুবিধার না,,,আর নান্দনিক শব্দটাই তো সুন্দর,,,ঢাকার শ্রী যাই হোক না কেন,,দুজনের ক্ষেত্রে কমন। ফলে চল ঢাকা নান্দনিকেই যাই। মুরাদ আমার কথা ফেলত না। গেলাম নান্দনিকে। ভর্তি হলাম।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির শহিদুল্লাহ হলের পাশে,,,মসজিদ ছিলো বহুকাল আগের ,ছোট মসজিদটার সামনের দুই তলা বিল্ডিংয়ে আমাদের নাট্যশালা ছিলো। পরে অবশ্য এটা সরিয়ে নেয়। নাটক ফাটক আমার মোটেও পছন্দ ছিলোনা, সেটা মুরাদকে বললামও। কিন্তু সে বলল বিকেলে আড্ডা দেওয়ার এটা একটা উপায়, ফাও না ঘুরে চল নাটক করে দেখী।
সেসময় লাকী ইনাম,তার স্বামীর নাম মনে আসছে না উনারা মাঝেমাঝে রিহার্সাল করাতেন, বিটিভির নাটকে মাস্তানী চরিত্রে অভিনয় করত সেলিম ভাই,আরও বেশ কিছু শিল্পী ছিলো বেশ প্রতিষ্ঠিত, তারা আমাদের ক্লাশ নিত। প্রথম একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট দিল " তিনি আসছেন" , বই আকারে দেওয়া হল। আমি তার আগা মাথা কিছুই বুঝতাম না। নাটকের কাহিনীও পছন্দ ছিলোনা। তবে নানান রকমের মানুষের সাথে কথা বলা যেত,মজা করা যেত, ওটাই ছিলো আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
আমরা ছিলাম স্বাধীনচেতা মানুষ। আজ এক কাজ তো কাল আরেক কাজ। নাটকে জীবনেও কোনোদিন সপ্তাহে ৪ দিন যাইনি, অথচ ৬দিন নিয়মিত যাওয়া নিয়ম ছিলো। নাটকের নানান ওয়ার্কশপ হত,তখন বড় কোনো শিল্পী আসত স্পেশালী শেখানোর জন্যে। আমাদের ভেতর অনেকে প্যাকেজ নাটক,বিজ্ঞাপন করত। আমাদের উদ্দেশ্য আসলেই এরকম ছিলোনা। নিয়মিত না হবার কারনে আমাদের নাটকের কোনো চরিত্র দেওয়া হত না। একবার আমাদের একটা চরিত্র দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু আমরা নিয়মিত না হওয়াতে তা আন্যদেরকে দেওয়া হয়।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার লজ্জা ছিলো প্রবল। এসব ডায়ালগ মানুষের সামনে কিভাবে বলল,এই লজ্জায় মরে যেতাম। তবুও গ্রুপে খারাপ করতাম না। আমরা ক্লাসের ভেতরও গল্প করতাম অন্যদের সাথে। তবে ওরা খুব ভদ্র এবং বন্ধুবৎসল হওয়ার কারনে আমাদের কিছু বলত না। আমাদেরকে অন্যরা খুব গুরত্ব দিত এবং পছন্দ করত। আমরা দুবার থিয়েটার হলে অভিনয় করতে উঠেছিলাম। আমাদের উভয়ের পরিবারের লোকেরাও এসেছিলো নাটক দেখতে। আমার পরিবারের লোক আমাকে চিনতে পারেনি,কারন আমার মুখে নকল দাড়ি ছিলো, পীরের মুরিদ ছিলাম নাটকে। কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। ৩ ঘন্টায়ও আসলো না। শেষে নাটক বাতিল হল,জনগনকে টিকেটের টাকা ফেরত দেওয়া হল। আরেকবার এভাবে স্টেজে ওঠার সময়ও লোডশেডিং চলছিলো এবং তা বাতিল করা হল। দুটো ঘটনাই ছিলো অনাকাঙ্খিত এবং অবাক করার মত। কারন নাটক শুরু হওয়ার অল্প কিছুক্ষন পূর্বেই এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। এটা ছিলো বেইলী রোডের থিয়েটারে।
ওরা যেই নাটকই লিখুক,তার মধ্যে খেয়াল করতাম ইসলামকে কৌশলে পচাতো। এটা ভালো লাগত না। তাদের নাটকের ভেতর মাওলানা,পীর,হুজুর এসব চরিত্র রাখত খারাপ উদ্দেশ্যে।
এরপর আমরা বিটিভির একটা বিজ্ঞাপনেও অংশ নেই। আর ব্যক্তিগতভাবে আমার অনেক নাটকে অফার আসে পরবর্তীতে। সে সময় মার্শাল আর্টিস্ট হিসেবে আমার অল্প কিছু সুনাম ছিলো। এর উপর নির্ভর করে পরিচিত নাটক নির্মাতা বন্ধুরা নাটক তৈরী করতে চেয়েছিলো। পরে দেশের প্রতিষ্ঠিত ,পরিচিত টিভি নায়িকাদের বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের সবকিছু চুড়ান্ত করেছিলো। কিন্তু ততদিনে আমি ইসলামের ছায়াতলে এসে বাতিল করলাম। এমনকি নায়িকাকে আরেক নায়কের সাথে দিয়ে ভিন্নভাবে স্ক্রিপ্ট লিখতে চাইলেও আমি রাজি হইনি। কোনোভাবেই আমি এ জগোতে থাকতে রাজি হয়নি। আমি নাটকের জীবনের সকল লোককে পরিত্যাগ করে গুডবাই দিয়ে চলে আসি। মানুষের কাছে যা লোভনীয় তা আমি প্রথ্যাখ্যান করেছি । আর থিয়েটারে অভিনয় করতে চাওয়া ওই সন্ধ্যার লোডশেডিং নিয়ে উপলব্ধী ছিলো এই যে, হয়ত আল্লাহ চাননি আমি ওদিকে যাই। আমি বদ হলেও মোটামুটি ইমানদার ছিলাম।
ঢাকা নান্দনিকে প্রত্যেক বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের ক্লাশ ছিলো । কিন্তু ক্লাশের ভেতরই আমরা আসর এবং মাগরিবের নামাজ পড়তে যেতাম পাশের মসজিদে। এবং একবারের জন্যেও নামাজ মিস করিনি। সেসময় আমার বয়স খুব কম ছিলো কিন্তু আবেগ ছিলো। আর আমি কারো পরোয়া করতাম না। আমাদের দেখাদেখী আরও একজন বা দুজন আমাদের সাথে নামাজে আসত,তবে নিয়মিত নয়। আমাদের নাটকে বা বাংলাদেশের যেকোনো নাকটের সাথে জড়িত মানুষদের যারা উপরের দিকে থাকে,তাদেরকে বেশীরভাগই নাস্তিক হিসেবে দেখেছি। যদিও তখন বুঝতাম না, কিন্তু পরে বুঝেছি এরা সব নাস্তিক অথবা মুসলিম হলেও ইসলাম থেকে বহু দূরের। আমাদের গ্রুপ লিডাররা আমাদের নামাজ আদায় করাকে পছন্দ করত না। কয়েকবার তারা নামাজের সময় ক্লাশ থেকে উঠতে নিষেধ করেছে, কিন্তু তাদের কথায় পাত্তা দেইনি,উঠে মসজিদে গিয়েছি। এ বিষয়টা সম্ভবত তাদেরকে আমাদের ব্যাপারে ভাবতে বাধ্য করেছিলো।
একদিন বিকেলে তারা আমাদেরকে ডেকে বলল, ক্লাশে যে পরিমান উপস্থিতি থাকলে নাটকে কাজ করতে পারা যায় সে পরিমান উপস্থিতি তোমাদের নেই,,,,ফলে গুডবাই । আমরাও চলে আসলাম। পরে আমার উপলব্ধী ছিলো এই যে, আমার মিডিয়া জগতে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটা উত্তম ছিলো।
বিষয়: বিবিধ
৭৪০ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পেশা অভিনেতা, লেখক, নাট্যকার, শিক্ষক।
জাতীয়তা বাংলাদেশী
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ Flag of Bangladesh.svg
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার একুশে পদক (২০১২)
দাম্পত্যসঙ্গী লাকী ইনাম
সন্তান হৃদি হক
প্রৈতি হক
মন্তব্য করতে লগইন করুন