মাস্তানি !

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৩ আগস্ট, ২০১৮, ১০:১৫:১৭ সকাল

মাস্তানি !

===============

ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় ক্যারেক্টারের ভেতর একটা ছিলো মাস্তান, আরেকটা ছিলো দস্যু। দুটোর চরিত্রের ভেতর মিল থাকলেও ধরন আলাদা। আমি যখন একেবারেই ছোট, তখন দস্যু বনহুরের নাম জানতে পারি আমার ফুফাত ভাই সাবুর মাধ্যমে। বয়সে আমার চেয়ে মাত্র দু-বছর উপরে হলেও জ্ঞানে বিদ্যায়,বিবেচনায় আমার অনেক উপরে ছিলো। তার মুখে দস্যু বনহুরের গল্প শুনে পুলকিত হতাম আর মনে মনে নিজেকে দস্যু বনহুর হিসেবে কল্পনা করতাম। একদিন দেখী তার হাতে দস্যু বনহুরের একটা বই...সেই পর্বের নাম ছিলো সম্ভবত: পাতালপুরিতে দস্যু বনহুর ! সেটা নিয়ে পড়ে তো বনহুরের ভক্ত হয়ে গেলাম।

রোমেনা আফাজের লেখা সিরিজ গল্প ছিলো এই দস্যু বনহুর। আমার পূর্বের জেনারেশনের কাছে এই বইটার কাটতি ছিলো অনেক বেশী,তবে ছোটবেলায় দেখেছি আরও অনেকে এই বই পড়ত। এরপর সাইমুম সিরিজ পড়ি, তবে আহমেদ মুসা লোকটা ছিলো বেশী ভালো, পরহেজগার আর তার সাথে নানান রাজনৈতিক কাহিনী থাকত,যা আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না, সে কারনে তার অবস্থান আমার চোখে ছিলো বনহুরের নীচে। আমার পছন্দ হত রবীনহুড মার্কা চরিত্র, যদিও রবীনহুডের নাম তখন জানতাম না। আমার দুলাভায়ের এক বিশাল আলমারী ভর্তী বই ছিলো, সেখানকার প্রায় সব বই আমি পড়েফেলেছিলাম। যাইহোক প্রসঙ্গে আসি....

আমাদের এলাকা ঐতিহ্যগতভাবে দাঙ্গাবাজ। পাশের গ্রাম বা মফস্বলের সাথে সারাজীবন দেখছি মারামারি চলছে। মারামারির তেমন কোনো কারন থাকত না, নিছক শক্তি প্রদর্শন করা ছাড়া এর ভেতর অন্য কিছু দেখিনি। তবে মারামারি যা নিয়েই হোক না কেন, দুপাশে বসবাসরত দুই রাজনৈতিক দল বি.এন.পি ও আওয়ামী লীগ এটা নিয়ে বিশাল দ্বন্দে লিপ্ত হয়ে পড়। এর রেশ থাকত কয়েক সপ্তাহ, এরপর ঠান্ডা হত। সাধারনত স্থানীয় কলেজ থেকেই বেশীরভাগ মারামারির সূত্রপাত হত। আমরা ছোটরা ছোটবেলাথেকেই এসব মারামারির ভেতর বড় হয়েছি। ফলে মনের ভেতর মাস্তানী,মারামারি,কাটাকাটির একটা প্রভাব ছিলো।

যখন দুই পক্ষে মারামারি হত, তখন আমরা সেসব নিজ চোখে দেখার জন্যে উসখুস করতাম এবং না দেখতে পেলে গল্প শুনতাম। কে কিভাবে কাকে মারল ,কুপালো সেসবই ছিলো সেরা গল্প। আমরা কারওকে কাওকে হিরো বানাতাম আর অপর গ্রাম বা আওয়ামী লীগ গ্রামের সকল লোক ছিলো আমাদের চোখে শত্রু,যদিও উভয় পাশেই ভালো-মন্দ উভয় ধরনের লোকই ছিলো। আমি খেয়াল করেছি লোকেরা মাথা দিয়ে চিন্তা করত না। তারা তাদের অহংকার,জিদ,হাটু,হাত,পা,অস্ত্র এগুলো দিয়ে বিবেচনা করত, ফলে যে কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে তারা দ্রুত রাজনৈতিক লেবেল দিয়ে পরষ্পরের উপর ঝাপিয়ে পড়ত। শত শত বোমা ফাটত,গুলি ছুড়ত,রামদা,ক্রিচ,রড,চায়নিজ কুড়াল,কাটা রাইফেল,পিস্তল এসবের মহড়া চলত। মজার ব্যাপার হল এর ভেতর অনেকে ছিলো যারা হিরো হবার জন্যে অন্যদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাহাদুরী করার চেষ্টা করত। আমরা ছোটো হলেও বুঝতাম কিন্তু কিছু বলতাম না। তবে অনেকে মাস্তান বা বীর বাহাদূর হিসেবে খ্যাত ছিলো। আমরা সকলে তাদেরকে সমিহ করতাম। নিজেরা তাদের মত মাস্তান হতে চাইতাম। আসলে আমাদের সামনে ভালো মডেল সমাজ তুলে দিতে পারেনি, সমাজ যাদের নিয়ে গঠিত ছিলো, তাদের চিন্তাগত বৈচিত্র তেমন চোখে পড়েনি,,সম্ভবত তারা ভালোর সংজ্ঞা জানত না তেমন।

আরও যখন ছোট ছিলাম তখন মাস্তান কাকে বলে তা জানতাম না, তবে শব্দটা শুনতাম খুব বেশী। একদিন বিশ্বাস পাড়ার এক ছেলেকে দেখলাম কেউ বলল-ওই যে মাস্তান !! আমি খুব খেয়াল করে দেখলাম। দেখতে খুব সুন্দর ছেলেটা। মাথায় খুব সুন্দর সিল্কী চুল। লম্বা বাবরী করে কাটা। সে মাথা ঝাকালে চুলগুলো সুন্দর করে দুলত। সেই চুল আমার যে কি ভালো লাগত ! আমি বুঝেছিলাম, মাস্তান মানে হল যাদের মাথায় লম্বা চুল থাকে। আবার অনেকে কারো লম্বা চুল দেখে বলত,,কিরে মাস্তান হয়ে গেছিস নাকি ?? সেসব শুনে ভাবতাম বড় চুল মানেই মাস্তান।

সেসময় বাংলা সিনেমাতে প্রায় সব নায়কেরই লম্বা চুল দেখতাম। তারা সিনেমায় লম্বা চুল নিয় মাস্তানী করত। সম্ভবত চলটা সেখান থেকেই শুরু। আমিও লম্বা চুল রাখতে মনস্থির করলাম। কিন্তু এটা হলনা,, কারন আমার চুল বিশ্বাস পাড়ার ওই মাস্তানের মত সুন্দর ছিলোনা, তবে এটাও মূল কারন না। আমার আব্বা বাজারের সন্তোষ নাপিতের কাছে গিয়ে বলত,,,একে আর্মী ছাট দিয়ে দাও। সন্তোষ নাপিত আমার চুলের গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ত। আব্বা আবার বলত,,,চুল যেন নখ দিয়ে ধরা না যায় !! সেটা শুনে দু:খ পেতাম, কিন্তু বাপের কথার উপর কথা বলার সাহস আমাদের ৬ ভাই-বোনের কারো ইহকালে হয়নি,, তা যে সে ধরনের কথাই হোক। যাই বলুক,,হু বলেই মেনে নিতাম। অবশ্য মায়ের মাধ্যমে আপিল করার একটা রাস্তা সর্বদাই খোলা থাকত।

জীবনে প্রথম বড় চুল রেখেছিলাম ক্লাশ ৪ এ উঠে। একদিন সেই চুলে সুন্দর করে সাবান অথবা শ্যাম্পু দিয়ে স্কুলে গেলাম। হুজুর স্যার বেছে বেছে পড়া ধরছিলো। তবে আমার প্রায় সব সূরা মুখস্ত ছিলো। স্যার বলল-ওই যে শ্যাম্পু করা লম্বা চুলের মাস্তান....তুই বল....। আমি সূরা মুখস্ত বললাম। স্যার প্রশংসা করল,এভাবে যে,, চুল লম্বা হলেও বা মাস্তান মার্কা হলেও পড়া পারে ! স্যারের কথার গুলি কোনোদিনও মারিনি,কিন্তু আমাকে যে মাস্তানের সাথে তুলনা করেছে,,চুল তাহলে বেশ দারুনই হয়েছে !! এইটা চিন্তা করেই প্রবল আবেগে ভেসে গেলাম।

দৌড়াতে দৌড়াতে হালকা লাফ দিতাম,যাতে চুলগুলো নেচে ওঠে,,,চুলগুলো বাতাসে উড়তে থাকলে নিজেকে নায়ক মনে করতাম। তবে বিশ্বাস পাড়ার ওই ছেলেটার মত হতে পারলাম না, যার মূল নাম বাদ দিয়ে লোকে মাস্তান বা মুস্তান বলে ডাকত। আজও তার মূল নাম আমি জানিনা, সম্ভবত অন্যরাও জানেনা। যাইহোক আমার মাস্তানী বেশীদিন থাকেনি। একদিন আব্বা দেখে বলল-এই তোর চুল এত বড় ক্যান,,কাওরাদের মত। উল্লেখ্য: সে সময় এক শ্রেনীর নীম্ন হিন্দু শুয়োর চরাতো। তারা কখনও কখনও আমাদের এলাকার উপর দিয়ে চলে যেত, তখন আমরা শুয়োরদেরকে ইট দিয়ে আঘাত করে মজা পেতাম। যারা এই শুয়োর চরাতো তাদেরকে কাওরা বলত। এই কাওরাদের চুলও লম্বা ছিলো। কিন্তু আমার বাপ আমার লম্বা চুলের জন্যে মাস্তানের সাথে তুলনা না করে কাওরাদের সাথেতুলনা করে বলল- কাল বাজারে গিয়ে চুল কেটে আসবি, নখ দিয়ে যেন ধরা না যায় !

হায় ! আমার মাস্তান হওয়ার ইতি হল ওখানে,,,,তবে আরও পরে এসে লম্বা চুল রেখে তা রাবার দিয়ে বাঁধতাম, এক কানে দুলও পরতাম,,সে আরেক কাহিনী !!

বিষয়: বিবিধ

৭৩১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385761
১৩ আগস্ট ২০১৮ দুপুর ১২:৩২
বাকপ্রবাস লিখেছেন : কানের দুলের অপেক্ষায় রইলাম
১৪ আগস্ট ২০১৮ দুপুর ১২:৫৮
317914
দ্য স্লেভ লিখেছেন : Rolling on the Floor Rolling on the Floor Rolling on the Floor Rolling on the Floor

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File