কেপ ডিসএপয়েন্টমেন্ট !!

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১১:১৫:১৭ সকাল



ওয়াশিংটনের লং বীচ পেনিনসুলার সুন্দর রাস্তা ধরে ধীর্ঘক্ষন ড্রাইভ করলাম। ফেরার রাস্তায় কিছুক্ষন পর পরই বিভিন্ন পার্ক চোখে পড়ছিলো আর সেখান থেকে বিস্তৃত কলাম্বিয়া নদীর সৌন্দর্য্য ধরা পড়ছিলো। এ অংশে কলাম্বিয়া নদীর ভাব দেখলে মনে হয় সেটা বুঝি সাগর। আসলে সাগরের সংযোগস্থল বলে নদী কিছুটা ভাব নেয় আর কি। অনেকটা কুকুরের মত, মালিকের বাড়িতে বাঘের মত ভাব নেয়। আমি চললাম কেপ ডিসএপয়েন্টমেন্টের দিকে।

ইলওয়াকোর শেষ মাথা থেকে ডানে মোড় নিয়ে পাহাড়িয়া পথে চললাম। বেশী দূরে নয়। এটা হল লং বীচ উপদ্বীপের শেষ মাথা,যা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রশান্ত মহা সাগরে পতিত হয়েছে। এখানে আসলে বেশ কিছু লুকআউট দেখা যায়। পাহাড়ের উপর থেকে দূরের সৌন্দর্য্য অসাধারন লাগে। এক স্থানে এসে দেখলাম প্রবল ঢেউগুলো পাহাড় পরিবেষ্টিত ভূমিতে আঘাত করছে প্রবলভাবে। সবুজ বনভূমি সমৃদ্ধ পাহাড়গুলো সাগরের কিনারে নেমে গেছে। উপর থেকে পাহাড়,সাগর আর বালুকাবেলার মিলনমেলা দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার বলতে হয়।

পরবর্তী স্থান হল কেপ ডিসএপয়েন্টমেন্ট ট্রেইল। এটা খুবই দারুন জায়গা। এক পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কয়েকটি পাহাড় আরও উপরে উঠে গেছে। সেসব পাহাড়ে চিকন সুন্দর হাটার রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। রাস্তার কিছুদূর পরপর বসার স্থান,ফুলের বাগান রয়েছে। আছে শ্যাওলা ধরা গাছগাছালি। এসব দৃশ্য আসলেই বর্ণনা করতে ভালো লেখক বা কবি হতে হয়। দু-তিন লাইনে যা লিখে যাচ্ছি তা আসলে অনেক পৃষ্ঠায় প্রকাশ করার মত। কেপ মানে হল অন্তরীপ বা দ্বীপের/ভূখন্ডের মাথা, আর ডিসএপয়েন্টমেন্ট মানে হল হতাশা,নৈরাশা বা মনোভঙ্গ। কিন্তু এই চমৎকার স্থানটির এমন নাম কেন হল জানা নেই। আমার মনে হল নিরাশ লোকও এখানে এসে আশান্বিত হবে, রসকসহীন লোক রসগোল্লার মত আচরণ করবে !

আমি উপরে উঠে গেলাম। সেখানে পাহাড়ের মাথায় একটি তথ্য কেন্দ্র রয়েছে, এখানে রাডার ব্যবস্থাও রয়েছে। এ অংশ থেকে আরও উচুতে উঠলাম। একেবারে সরু রাস্তা এটা। আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম অদ্ভূত সুন্দর চিত্র চারিদিকে। উপর থেকে দূর সাগরের সৌন্দর্য্য দেখলাম। পাহাড়ের নীচ দিয়ে সূচালো হয়ে স্থলভাগ সাগরে প্রবেশ করেছে। বহু আগে এখানে একটা জাহাজের প্রতাশ্রয় ছিলো,যেখানে বড় বড় জাহাজ নোঙ্গড় করত। কিন্তু সেটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে কোনো কারনে। তবে সে উপলক্ষ্যে সাগরের একটা নির্দিষ্ট অংশে বাধ দেওয়া হয়েছিলো সম্ভবত পাথরের তৈরী প্রাচীর এটি, যা পানি দ্বারা প্রায় ঢাকা। উপর থেকে বোঝায় যায় বড় বড় ঢেউগুলোর বাধাপ্রাপ্ত হতে দেখে। সে অংশে এসে ঢেউগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকৃতি নিচ্ছে। পাহাড়ের মাথায় উঠে নিজেকে বিজয়ী মনে হল। কি বিজয় করলাম তা অবশ্য বুঝতে পারলাম না,,,,সম্ভবত সৌন্দর্য্য বিজয় করেছিলাম !

পাশেই রয়েছে একটি লাইট হাউস,যা অন্য একটি পাহাড়ের উপর স্থাপিত। লাইটহাউসটা খুব দারুন। আসলে স্থলভাগের শেষ অংশে এরকম সুন্দর পাহাড় খুব সুন্দর লাগে আর তার উপর যদি লাইট হাউস থাকে,সেটা ব্যপক দারুন। আমি একটু একটু করে অনেক সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। এরপর ফিরতি পথ ধরলাম। এই দ্বীপে মার্কির সৈন্যদের একটা ছোট ঘাটি আছে, সেদিকে যাওয়া নিষেধ। গতবার ভুল করে সে ঘাটির কাছে গিয়েছিলাম। সেটা ছিলো ২ বছর পূর্বে। আমি শেষে গিয়ে বোকা হয়ে রইলাম, কারন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলোনা। কেউ অবশ্য বাধা দেয়নি। তারা বুঝেছিলো রাস্তা ভুল করেছি। যাইহোক এবার চিনুক শহরের কাছে আসলাম।

এখানে একটি পাহাড়ের উপর মাটি খুড়ে বিশাল শক্তিশালী বাঙ্কার তৈরী করা হয়েছে। এই বাঙ্কারটি অনেক পুরোনো এবং বর্তমানে পরিত্যক্ত। পাহাড়ের উপরে বিশাল দুটি কামান সাগর বারাবর তাক করা আছে। এখন অবশ্য এসব কামানের কোনো কাজ নেই দর্শন করা ছাড়া। আমি বাঙ্কারে নামলাম খাড়া সিড়ি দিয়ে। ভেতরে কবরের অন্ধকার। অনেকগুলো আকাবাকা ঘর সেখানে। অজানা কিছু যন্ত্রাংশও দেখলাম। এই বাঙ্কারের পাশে আরেকটা বাঙ্কার রয়েছে। আরও কিছু গোপন বাঙ্কার রয়েছে যার বড় গেট লক করা দেখলাম। স্থানটা ভালো লাগল। কিন্তু বেশীক্ষন থাকলাম না। কারন আমার মাছের ক্ষুধা লেগেছিলো।

এবার কলাম্বিয়া নদীর তীরে চলে আসলাম। ব্রীজের ওপাশে ওয়াশিংটন অংশে নদীর তীর ধরে বহুদূর হাইওয়ে চলে গেছে। সেদিকে ড্রাইভ করলাম। থামলাম একটা পয়েন্টে। সেখানে মানুষ দাড়িয়ে নদীর অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করে, সত্যিই তা উপভোগ্য। আমিও উপভোগ করলাম। কিন্তু আমার পেটে তখন মাঝের খলবল আওয়াজ শানিত হল। বুঝলাম মনের কথা পেট টের পেয়েছে। সে আমাকে ধাবিত করল,,,আমি বাধিত হলাম।

এস্টোরিয়াতে মস নামক একটা দারুন রেস্টুরেন্ট আছে, বেশ বড় এবং প্রসিদ্ধ। গিয়ে দেখলাম মানুষ রেস্টুরেন্টে একটু সিট পাওয়ার জন্যে লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে। একসময় আমার ডাক আসল। আমাকে একটি স্থানে বসতে দেওয়া হল। এটা একেবারে অশান্ত নদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। কাচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে নদীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। এখানে দাম একটু বেশী,তবে তাজা মাছ সব। কড মাছের গ্রিল,কড মাছ ফ্রাই,ফ্রেন্স ফ্রাই,মাছের ছোট টুকরো,চিজ,ক্রিম আরও কি সব দিয়ে ক্লাম চাওডার নামক এক খাবার বানানো হয়,সেটাও খেলাম। এটা বেশ দারুন। প্রথম দিকে খেতে মনে চাইত না, পরে ভালো লেগেছে। আরও এটা সেটা খেলাম। বিল আসল বড় সড়। কিন্তু যেহেতু নিয়মিত আসা হয়না তাই কিছু মনে করলাম না।

হোটেলে ফিরলাম। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে,তাই ভাবলাম আজ আর কোথাও যাবনা। লবিতে এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হল, চরম অমায়িক। আমাকে তুরষ্কের মানুষ ভেবেছে। লোকটার তুরষ্কের সাথে বোধহয় অনেক সম্পর্ক রয়েছে। বলল সেখানে সে অনেকদিন ছিলো। সালামও দিতে পারে। তুরষ্কের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা সুন্দর মনে হল। বারবার প্রশংসা করছিলো। এটাই প্রথম না। অনেক আগে এরকম একজনকে পেয়েছিলাম, সে লোকও তুরষ্কের মানুষের খুব প্রশংসা করেছিলো। এ প্রশংসা মুসলিমদের,তাই মুসলিম হিসেবে আমার খুব ভালো লাগল। লোকটা খুব বন্ধুত্বপরায়ন। সে আর তার বৌ এখানে ছুটিতে বাই সাইকেল চালাবে বলে সাইকেল সাথে নিয়ে এসেছে। মজার লোকজন সব।

হোটেলে প্রতি সন্ধ্যায় স্মোকড স্যামন,মদ আরও এটা সেটা ফ্রি খাওয়ানো হয় ইভিনিং ব্রেকফাস্ট হিসেবে। বাঙ্গালী ফ্রি সার্ভিস খুব পছন্দ করে, কিন্তু আমি যখন নীচে নামলাম তখন তাদের ব্রেকফাস্ট টাইম শেষ অনেক আগেই। ফিরছিলাম। হঠাৎ ম্যানেজার এসে হাজির। তিনি বললেন.....আমি আপনার জন্যে নিজে স্মোকড স্যামন নিয়ে আসছি। আবার দু:খ প্রকাশ করল ব্রেকফাস্ট মিস করার কারনে। সার্ভিসে খুশী না হয়ে উপাই নেই। খানিক পর সে আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে হাজির। মদের কথাও বলল,,,। আমি বললাম- এসব খাইনা। এর বদলে আমাকে একগাদা সফট ড্রিংস এর ক্যান দিল। অনেকগুলো স্মোকড স্যামনের ভেতর এক পিছ মুখে নিয়ে মনে হল এটা স্রেফ ধোয়ার ভেতর দিয়ে ঘুরিয়ে আনা। আমি অন্য স্থানে এ জিনিসি খেয়েছি,,, স্বাদ খারাপ না। কিন্তু এটা কোন স্টাইলে বানাইছে আল্লাহ মালুম। টপাটপ ডাস্টবিনে ফেললাম। চিজ,বিস্কুটগুলো নিলাম।

রাতে বড় জানালার পাশে থাকা আধোশোয়া হবার সোফায় হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। দূর বিস্তৃত অশান্ত জলরাশীর উপরেচোখ পড়তেই ভালো লাগল। কোথাও কোথাও আলোর ফুয়ারা ছিলো। কখনও কখনও জাহাজগুলো নানান আলোয় সজ্জিত হয়ে চলে যাচ্ছিলো। মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকালাম। তারকারাজি প্রতিভাত হল। ছোটবেলা থেকেই আকাশের উল্কাপিন্ড দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু আকাশের দিকে বেশীক্ষন তাকালাম না। স্রষ্টার আরশ উপরেই। লজ্জিত হলাম। এক নাফরমান বান্দার উপর আল্লাহর অনেক নিয়ামতের বিষয়টা মাথায় আসল। নাফরমান জানেনা কৃতজ্ঞতা কাকে বলে। লজ্জিত নাফরমান চোখ নামিয়ে বিছানায় গমন করল। তবে আল্লাহ এমন দয়ালু সত্ত্বা,যিনি নাফরমানদের উপরও দয়া জারি রাখেন ! তিনিই দয়ার স্রষ্টা !

বিষয়: বিবিধ

৭৫৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384660
০৭ জানুয়ারি ২০১৮ সন্ধ্যা ০৭:৫৫
আকবার১ লিখেছেন : চমৎকার
০৯ জানুয়ারি ২০১৮ সকাল ০৯:১৯
317271
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ধন্যবাদ ভ্রাতাHappy Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File