এস্টোরিয়া কলাম
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০২ জানুয়ারি, ২০১৮, ১০:৩৮:২৭ রাত
এস্টোরিয়া কলাম
গতরাতে হোটেলে ফিরে বাকলাভা টানলাম চরম। এর ভেতর এক ধরনের নেশা আছে। নেশাখোরের সংখ্যা কম না। রাতে বেশ কিছুক্ষন শরীর চর্চা করলাম হোটেল জিমে। সেখানে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলোনা, কারন ৩১ শে ডিসেম্বর রাতে বোর্ডাররা সম্ভবত ভিন্ন কোনো ইনডোর পার্টিতে ছিলো। একটা ব্যাপার বুঝলাম না,,,, থার্টি ফার্স্ট নাইট নিয়ে আমেরিকানদের ভেতর তেমন মাতামাতির বাড়াবাড়ি নেই। এরা এমনিতেই যে কোনো পার্টিতে মদ মাস্তি করে ,এ রাতও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের নয়। অধিকাংশই রাত ১২টার পূর্বে ঘুমিয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও রাত ১২টার পর আতশ বাজি পোড়ানো হয়। তবে আমি স্থানীয়ভাবে দেখেছি সন্ধ্যার পরপরই আতশবাজি পোড়ায় কোথাও কোথাও, খুব বেশী রাত করেনা।
বাংলাদেশে দেখেছি থার্টিফার্স্ট নাইট মানে বিশেষ কিছু। ঢাকার রাস্তা সন্ধ্যার পরপরই ফাকা হয়ে যায়। চারিদিকে পুলিশ নিয়োগ করা হয় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে। গুলশান,বনানীর রাস্তায় দেখতাম ধনীর দুলালরা দামী গাড়ি নিয়ে মহড়া দিত। অনেক বাড়ির ছাদে বিশেষ পার্টি হত। উচ্চ আওয়াজে মিউজিক বাজত। অনেক ক্লাবে সারা রাতব্যপী বেহায়া পার্টি হত, এখনও হয়। বহু মুসলিমের সন্তানরা দেদারছে মদ,মাদকদ্রব্য খায় এ রাতে। ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নৃত্যগীত করে প্রকাশ্যে। কোথাও সীমা লঙ্ঘিত হয়ে শ্লীলতাহানিও ঘটে। সব দেখে মনে হয়েছে সকল উৎসবই বাঙ্গালীর অবশ্য পালনীয় উৎসব। কোনো মতে কোনো বিদেশী উৎসব বাঙ্গালীদের ভেতর একবার চালু করে দিতে পারলেই হয় ! এরা বংশ পরম্পরায় সেটা
বদকায়ে জারিয়াহ করে ফেলবে। আর বাঙ্গালীর সব উৎসবই ভ্যালেন্টাইন্স ডে। ঈদ,পহেলা বৈশাখ,থার্টি ফার্স্ট,ভ্যালেনটাইন্স সবই এদের কাছে এক রকম। একই স্টাইলে সেলিব্রেট করে। আগে যেটা উচ্চ বিত্তের অকর্মাদের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিলো এখন সেটা একেবারে নীম্ন বিত্ত পর্যন্ত স্পর্শ করেছে। তবে এর বাইরে ভিন্ন চরিত্রের লোক অনেক। তারা অবশ্য সমাজ কর্তৃক বঞ্চিত। সমাজ অবশ্য ইবলিশ কর্তৃক সমাদৃত।
আমি সস্তা লোক। কোথাও হোটেল নিলে সস্তাটাই খোজার চেষ্টা করি, তবে ব্যতিক্রমও হয়। এবার নিলাম সবচেয়ে দামী হোটেল। হোটেলটা পানির উপর। রুম থেকে বাইরে তাকালে কলাম্বিয়া নদীর সংগমস্থল দেখা যাচ্ছে। এ অংশে কলাম্বিয়া নদী প্রশান্ত মহা সাগরে এসে পড়েছে অনেক প্রশস্ত হয়ে। আমি আমি নদীর এপারে ওরেগনের পশ্চিমের শেষ প্রান্তে। দূরে ওয়াশিংটনের লাইটগুলো দেখা যাচ্ছে। বিশাল জলরাশির উপর নানান আলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বিশাল উইন্ডোর উপর বাইনোকুলার রাখা আছে দীগন্ত বিস্তৃত নানান সৌন্দর্য্য উপভোগের। ব্যলকনিতে দাড়ালে সিগালরা উড়ে এসে বসে। লোভীর দল খাবারের ধান্দায় আসে, কিন্তু এদেরকে খাবার খাওয়ানো নিষেধ। এতে নাকি তাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে দেখেছি এরা পতিত খাবার ছো মেরে নিয়ে যায়।
রাতে ভাবছিলাম অসাধারণ এস্টোরিয়ার জলরাশির উপর বা আশপাশে হয়ত আতশবাজি পোড়ানো হবে,,,কিন্তু হলনা। আমি অবশ্য রাত ১১টার কিছু পরেই ঘুমিয়ে ছিলাম। তবে ৪ঠা জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দীবসে অনেক বেশী আতশ বাজি পুড়ে। আমি এবার মূল আলোচনায় যাব:
সকালে ফজরের পর যখন আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে, তখন শীতের পোষাক চাপালাম শরীরে। মন ডেকে বলছিলো ডকের উপর সি-লায়ন উঠে বসে আছে। মাইল দুয়েক দূরের সেই ডকের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখী গাদা গাদা সি-লায়ন গত সন্ধ্যার মত শুয়ে আছে। একটা আরেকটার উপর উঠেছে,অথবা আরেকটার পিঠের উপর মুখ নিয়ে রেখেছে। বেশীরভাগই উয়ো উয়ো....করে বিকট শব্দে এলাকা কাপাচ্ছে। অনেকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এদের মুখ দেখলে খুব হাসি লাগে। মুখের ভেতর বোকা বোকা, দুষ্টুমিপূর্ণ চাহনী আছে। এরা খুব আমুদে প্রকৃতির। উত্তর মেরুর অনেক ভিডিওতে এদের দেখেছি বরফের উপর নানান সব খেলা করে। আর দুনিয়ার নানান স্থানের পার্কে এরা দর্শক বিনোদনে ব্যবহৃত হয়। অনেকে মাথাটা উচু করে চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে থাকে। দেখতে খুব দারুন লাগে। ভাবছিলাম এদের গোস্ত খেতে কেমন ! মনে হল অনেক চর্বি। তবে এর গোস্ত আমার পছন্দ হবেনা। তবে গোস্তের কারনে নয়, প্রবল ঠান্ডা বাতাশ সহ্য করতে না পেরে ফিরে আসলাম।
এবার ভাবলাম পাহাড়ের উপরে এসে মানুষের থাকার স্থানসমূহ দেখব। এখানে পাহাড়ের উপর স্তরে স্তরে অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরী হয়েছে। রাস্তাগুলো দেখলে অবাক হতে হয়। একেবারে খাড়া উপরে উঠে গেছে। একেবারে উপরে উঠে রাস্তার দিকে তাকালে ভয় করে। কারন যদি বরফের কারনে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায় এবং গাড়ির টায়ার পিছলে যায়, তবে সর্বনাশ। উপরের দিকে রাস্তায় হালকা বরয়ের আস্তরন দেখলাম,তবে সেটা বিপজ্জনক নয়।
আমি আরও উপরের দিকে চললাম। গন্তব্য এস্টোরিয়া কলাম। উপরে দেখী অনেক উচু একটা চাওয়ার। কিন্তু সেটা এতটাই চমৎকার স্থানে নির্মিত যা বলে বুঝাতে পারছিনা, বরং আমার চিন্তা শেয়ার করব। এখানে ৫ ডলারে পাকিং নিতে হয়। আমি কেবল বাইরে এসে দাড়ালাম। একরাশ মুগ্ধতা আমাকে শেষ করে দিল। আজ রৌদ্র ঝলমলে দিন, যদিও বেশ ঠান্ডা কিন্তু গতকালের চাইতে তাপ বেশী।
এটা উচু পাহাড়ের মাথা। এখান থেকে আমি চারিদিকে তাকালাম। আমি মনে করলাম, আল্লাহর জান্নাত সম্পর্কে প্রাসাদ,ঝর্ণা,প্রবাহমান নদী,বাগান এসবের কথা এসেছে। সেসব আয়াত,হাদীস শুনে আমাদের মনে জান্নাত সম্পর্কিত যে চিত্র ভেসে উঠে, তা বোধহয় এই স্থান থেকে দেখতে পাওয়া প্রকৃতির থেকে ভালো হবেনা। বাস্তবতা এতটাই মনোরম যে,তা চিন্তার জগৎকে উতরে যায়। একেক জনের চিন্তার বৈশিষ্ট একেক রকম। তবে আমার জান্নাত সংক্রান্ত চিন্তা যে ফকির ফাকরা মার্কা তা প্রমানিত হল। বার বার মনে হচ্ছিলো জান্নাত কত সুন্দর !! পৃথিবীর সেরা সেরা শিল্পীরা কল্পনা করলেও জান্নাতের মত হবেনা, কারন সে সম্পর্কে কোনো মন কল্পনাও করতে সক্ষম নয়। কি মারাত্মক ব্যপার !
আমি উপর থেকে পুরো এস্টোরিয়া শহরকে দেখলাম। আমি দেখলাম একপাশে টলটলে সুন্দর পানির কলাম্বিয়া নদী বহমান। তার কিনার ধরে নানান সব স্থাপনা। নদীতে বিশাল বিশাল জাহাজ,নৌকা চলমান। নদীর দুপাশে কাঠ,পাথরের কারুকাজ। দুপাশে রয়েছে পর্বতশ্রেণী,যা সবুজের সমারোহে বিমোহিত,পুলকিত,,,,,একেবারে নাস্তানাবুদ পরিবেশ। অপর পাশে দেখলাম একই নদী ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ের কিনার ঘেষে সবুজ বনভূমির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরই কোথাও কোথাও সুরম্য অট্টালিকা দাড়িয়ে আছে। আছে ফসলের ক্ষেত। কোথাও কোথাও ফলের বাগান। কোথাও দুদিক থেকে নদীর শাখা এসে মূল নদীতে মিশেছে। মাঝে তৈরী করেছে দ্বীপ। সেখানে অনেকে বাড়ি তৈরী করেছে। উপর থেকে কি যে সুন্দর লাগল !!
এবার আমি এস্টারিয়া কলামের কাছে আসলাম। এটি ১২৫ ফুট উচু। এর সারা গায়ে চিত্রকর্ম অঙ্কিত হয়েছে। আমেরিকার এই অঞ্চলের আদিবাসীদের দৈনন্দিন নানান কর্মকান্ডের উপর এসব চিত্রকর্ম নির্মিত। আমি আমেরিকার এরকম যতগুলো স্থাপনা দেখেছি,তার প্রায় প্রত্যেকটিই দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে নির্মিত। এরকম উচু স্থান থেকে অন্য এলাকা,সাগরের দিকে নজরদারী চালানো সহজ,ফলে এসকল স্থানে সামরিক ঘাটি তৈরী করা হত। এটাও একই উদ্দেশ্যে তৈরী। তবে বর্তমানে প্রযুক্তির নানামুখী উন্ননের কারনে সামরিক কর্মকান্ডের ধরন পাল্টেছে।
আমি বড় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম স্টিলের সিড়ি পেচিয়ে একেবারে উপরে উঠে গেছে। আমি বিরতিহীনভাবে দ্রুত উঠতে থাকলাম। একেবারে মাথায় উঠে আসলাম। মনে হল এখনও তরুনই আছি ! উপরে আরেকটি দরজা রয়েছে। সেটা খুলে বাইরে বের হয়ে দেখী, উচু কলামের চারিদিকে রেলিং। আমি সেখানে দাড়ালাম। এখান থেকে চারিপাশের পুরো পরিবেশ আরও সুন্দর লাগছিলো। আমি আল্লাহু আকবার বললাম। সুন্নাহ হল উচুতে উঠে আল্লাহু আকবার বলা এবং নীচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ বলা। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাসে মনে হচ্ছিলো জমে যাচ্ছি। আমি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দাড়িয়ে থাকলাম। মনে হল আল্লাহ অনেক নিয়ামত দান করেছেন। সুস্থ্যতা দিয়েছেন, সৌন্দর্য্য উপভোগের তাওফিক দিয়েছেন, অথচ নাফরমান এই বান্দার জানা নেই কিভাবে শুকরিয়া আদায় করলে পার্ফেক্ট হবে ! মনে মনে কেবল আল্লাহর প্রশংসা করলাম কিন্তু তুচ্ছ এই প্রশংসা। আল্লাহর ছোট্ট একটা নিয়ামতের জন্যে সারা জীবন সেজদা দিলেও শুকরিয়া আদায় হবেনা। আমি মাথা তুলে উপরে তাকালাম। সেখানে মসজিদের মত গম্বুজ দেখলাম যা স্টিলের ফ্রেমের ভেতর কাচ দিয়ে তৈরী। আমি উচুতে দাড়িয়ে আযান দিলাম, খুব ভালো লাগল। আমি ছাড়া তখন কলামের ভেতর কেউ প্রবেশ করেনি। তবে নামার সময় দেখলাম কিছু লোক উপরে উঠছে। আমার মন ফুরফুরে......এখানে আসা স্বার্থক হল।
বিষয়: বিবিধ
৭১৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সি-লায়নের গোস্ত হল অনেক চর্বি। তবে এর গোস্ত আপনার পছন্দ হবে। ভল টানতে পারবেন। আমারে ভাগ দিয়েন। ] m/
মন্তব্য করতে লগইন করুন