ভ্যাঙ্কুভারের তিক্ত অভিজ্ঞতা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ৩০ আগস্ট, ২০১৭, ০৫:৪৮:৩৯ সকাল
এবারে দেশ ভ্রমনের উপর তেমন লেখা হয়নি, আসলে খাওয়া ছাড়া তেমন ভালো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। অবশ্য খাওয়ার ঘটনাটাই অন্যতম আকর্ষনীয় আমার কাছে কিন্তু সকলে তা অনুধাবন করবে না ! আমি সবসময় খাই খাই করলেও বাস্তবে আসলে কম খাই। আগে বেশী খেতাম। এখন বেশী স্বস্থ্য সচেতন হওয়ার কারনে অনেক বাছ বিচার করি। আর একবারে বেশী খেতে পারলেও খাইনা। ফলে বাড়িতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। আমি বেশী শারিরীক কসরত করলেও সর্বোচ্চ ২ বেলা ভাত খাই। কিন্তু বাড়িতে কোনো কাজ ছিলোনা। শুয়ে বসে আমি অভ্যস্ত নই, ফলে ক্ষুধা তেমন লাগত না। আর এর ভেতরই ৩ বেলা ভাত। অবশ্য সকালে কখনও কখনও রুটি থাকত। আর প্রায় প্রত্যেকদিনই দাওয়াত থাকত কারো না কারো বাড়ি। ফলে আমার শরীর ওভার লোড নিতে পারল না। কয়েকদিন চলেছিলো নিতম্বতলে অম্বরধারা। পরে স্বাভাবিক হল, আবারও খাওয়া। খেয়াল করলাম শাক,সব্জী,দেশী তরকারী,জ্যান্ত মাছে আমার শরীর চাঙ্গা। তার মানে হল আমরা জন্মগতভাবে যেসব খাবারে অভ্যস্ত, সেসব খাবারই আমাদের মূল খাবার। শরীর ওটাই নিজের জন্যে পছন্দ করে রাখে। যাইহোক মূল বক্তব্যে আসি......
ফেরার সময় আমার সর্বমোট যাত্রা ছিলো ৩৪ ঘন্টার। আমি ঢাকা থেকে প্রথমে গুয়াংজু এবং সেখানে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে আসলাম। প্লেন উড়েছিলো ১৪ ঘন্টার বেশী সময়। এত দীর্ঘ সময়ে এমনেই মানুষের বিরক্তি আসে।
ভ্যাঙ্কুভারে নামার পর দেখলাম প্লেনের গেইটে অন্তত ১০জন পুলিশ। তারা বিভিন্ন যাত্রীর সাথে কথা বলছে। আমার সাথে কথা বলল এবং আমাকে তারা তাদের সাথে নিয়ে গেল। যাবার পথে পুলিশ ভদ্রমহিলা নানানসব প্রশ্ন করল, যা আগে কেউ কখনই করেনি। জানতে চাইলো কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি,কি করি,এখানে কাওকে চিনি কি না ইত্যাদী। এরপর নীচ তলার বিশাল কাউন্টারে গেলাম। সেখানে আরও ২জন পুলিশ এসে আমার হাতের ব্যাগ তন্ন তন্ন করে তল্লাসি করল। প্রত্যেকটা বাতিল,পুরোনো কাগজ,এমনকি টিস্যু পেপার সম্পর্কেও প্রশ্ন করল। প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিলাম। প্রত্যেকটি খুটিনাটি জিনিস চেক করে মেজাজ খারাপ করা প্রশ্ন করতে লাগল। আমি এমনিতেই ক্লান্ত ছিলাম, তার উপর চায়না ইস্টার্ণের খাবার তেমন খেতে পারিনি। পিপাসাও লেগেছিলো,সাথে ক্ষুধা। এরপর তারা উল্টপাল্টা প্রশ্ন করতে থাকল।
আরেক অফিসার এসেও একই প্রশ্ন প্রথম থেকে শুরু করল। তারা আমার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছে প্রথমেই। এবার প্লেনের লাগেজ বক্সে যে সুটকেসটি দিয়েছিলাম, যেটি ওরেগনের পোর্টল্যান্ড থেকে নেওয়ার কথা ছিলো, সেটা তারা এয়ারলাইন্স এর সাথে কথা বলে বের করে নিয়ে আসল। এবং আমার সামনে স্যুটকেস খুলে তন্নতন্ন করে প্রত্যেকটা জিনিস দেখল। প্রত্যেকটা জিনিস সম্পকে জানতে চাইছিলো এটা কি ? কেন এখানে ? এটা দিয়ে তোমার কি প্রয়োজন ? তুমি কখনও ক্রাইমের সাথে যুক্ত ছিলে কি না ? মাদক গ্রহন করো কি না ??প্লেনে কার পাশে বসেছিলে ? কি কথা হয়েছে ? কতবার টয়লেটে গিয়েছিলে? কতক্ষন ছিলে ? সবকিছুর উত্তর দিলাম শান্তভাবে।
এবার একজন মুসলিম অফিসার আসলো এবং টুকটাক প্রশ্ন করলো। জানতে চাইলো আমি কতগুলো ভাষায় কথা বলতে পারি। এই লোক কথার প্যাচে ফেলে জানতে চাইলো মাদক চোরাচালানে আমি সহযোগীতা করেছি কি না। এরপর আমার সারাদেহ তল্লাশি করল কাপুড়ের উপর দিয়ে। আমার সাথে যা কিছু ছিলো এমনকি নগদ ডলার, সেটাও টেবিলের উপর রেখে দিতে হয়েছিলো। এরপর একে একে অফিসাররা এসে সেসব চেক করছিলো। আমার বিশাল এবং বিস্তারিত ইন্টারভিউ নিল। এরপর জিজ্ঞেস করল....আচ্ছা তোমাকে এতক্ষন এত কিছু জিজ্ঞেস করলাম ,তা তুমি এত শান্ত কেন ? আর সবকিছু এতটা মনে রেখেছো কেন ? যা জানতে চাইছি স্পেসিফিকলি সেটার উত্তর দিচ্ছ,,,, তবে কি তোমার সবকিছু পূর্ব পরিকল্পিত ? এবার মেজাজ বিগড়ে গেল। ইতিমধ্যে তারা আড়াই ঘন্টা নষ্ট করেছে। বললাম-আপনারা এরকম কেন করছেন ? আমি শান্ত স্বভাবের লোক,যুক্তিপূর্ণ অর্থবহ কথা বলতে অভ্যস্ত, কিন্তু আপনাদের কর্মকান্ড অযৌক্তিক মনে হচ্ছে এবং আপনারা আমাকে উত্তক্ত করছেন। কেন এসব করছেন ?
এক পুলিশ বলল- তুমি প্লেনের ভেতর একজনের থেকে তার পাসপোর্ট নিয়েছো, সেটা কোথায় ? লোকটা কে ? তার সাথে তোমার কতবার কথা হয়েছে ? তাকে আগে চিনতে ? আমাদের কাছ তোমার ব্যাপারে আগেই ইনফর্মেশন ছিলো,তাই তোমাকে আমরা এখানে এনেছি। মাথায় আগুন ধরে গেল কিন্তু শান্ত থাকলাম। কারন এরা কি করছে তা ভালোই বুঝলাম। আমি শান্তভাবে হাসলাম। বললাম, আচ্ছা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি ?
বললেন ,,বলো। আচ্ছা আপনি জানলেন কিভাবে যে আমি অন্যের পাসপোর্ট নিয়েছি ? আর অন্যের পাসপোর্ট নিয়ে আমার লাভ কি ? পুলিশ বলল- এর মানে হল ,তুমি অন্যের পাসপোর্ট কোথাও পৌছে দিয়ে কিছু অতিরিক্ত পয়সা ইনকাম করবে। অন্যকে এদেশে আসতে সহযোগীতা করার কারনে তারা তোমাকে কিছু পয়সা দিবে।
আমি বললাম-দেখুন আমি আমেরিকার নাগরিক এবং আমার ভালো জব রয়েছে,তাহলে এসব কেন করব ? সে বলল-কারন তুমি অতিরিক্ত পয়সা চাও। বললাম, কারো পাসপোর্ট বহন করে তাকে এভাবে অন্যদেশে অনুপ্রবেশে সাহায্য করা যায় ? তখন বলল-তাহলে সেই প্যাকেটে কি মাদক ছিলো ? বললাম- কোন প্যাকেটে ??? আপনি খুব ভালোকরেই জানেন যে এমন কিছু ঘটেনি, তাহলে এভাবে প্রশ্ন করছেন কেন ? শুধু পেচাচ্ছে বলে অতিরিক্ত প্রশ্নে গেলাম না। বললাম, দেখুন এদেশে আমি কাওকে চিনিনা আর আমার গন্তব্যও এখানে নয়। ছুটি শেষে বাড়ি ফিরছি। আর প্লেনে পাশের লোকগুলো ছিলো চায়নিজ। আমি চায়নিজ বেশ কিছু শব্দ জানলেও ভাষা জানিনা। তাদের সাহে সহযাত্রী হিসেবে দু-একটি কথা হয়েছে,সেটাও সাধারন। এছাড়া কারোসাথে কোনো কথা হয়নি। এবার দূরে বসা এক ভারতীয় মেয়েকে দখিয়ে বলল-ওকে চেনো ? বললাম, একই প্লেনে এসেছি কিন্তু চিনিনা। তাকে নিয়ে আবার ৫/৬টা ফাউল প্রশ্ন করল। ধৈয্যের সাথে উত্তর দিলাম। দেখলাম সেই মেয়েটির ব্যাগও একইভাবে তল্লাসী করছে।
এবার বলল-দ্যাখো সত্য বলে দাও,স্বীকার করো। এতেই তোমার কল্যান। ওই লোকটার কাছ থেকে তুমি একটা প্যাকেট নিয়েছিলে। তুমি যদি দোসী হও তাহলে কিন্তু তোমার ৩ মাসের জেল হবে। বললাম- ৩মাস না যাবজ্জীবন কারাদন্ডে প্রস্তুত যদি দোষী সাব্যস্ত হই। তখন বলল-ঠিক আছে তাহলে তোমাকে আদালতে নিয়ে যাই,, ৩/৪ দিন সময় লাগবে প্রমান করতে। এই কথা শুনে একটু ভয় পেলাম। কারন বিনা কারনে ৩/৪ দিন যদি সত্যি এরা নিয়ে নেয়,তবে তা আমার জন্যে ক্ষতির হবে। মনে মনে প্রথম থেকেই আল্লাহকে ডাকছি। আল্লাহ সবসময়ই সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। ভরসা ছিলো আল্লাহর উপর। আর আমি মানুষিকভাবে মোটেও দূর্বল ছিলাম না।
বললাম প্লেনের ভেতর তো সিসি ক্যামেরা আছে, সেটা চেক করেন,তাহলে দেখতে পারবেন আমি কি কি করেছি। তখন বলল-হ্যা সেটা চেক করতেই তো অন্তত ২/৩ দন সময় লাগবে,কারন সেখানে একটা প্রসেস আছে। ভাবলাম একথা বলি যে, অপরাধ প্রমানিত না হলে পুলিশের নামে ক্ষতিপূরন মামলা করব ,,,,, কিন্তু এটাও ভাবলাম যে, এরা ক্ষেপে গেলে নিজের সম্মান বাচানোর জন্যে আরও উল্টোপাল্টা কাজ করে আমাকে আটকানোর চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যে দেখলাম একজন ভারতীয় নাগরিককে হাতকড়া পরিয়ে ভেতরে কোথাও নিয়ে গেল। খানিক পর দেখলাম তাকে মুক্ত করেছে। এসব দেখে আমি আর তর্কে গেলাম না, যদিও আমার যুক্তি ছিলো ১৬ আনা পক্ষে।
এবার তারা আমার পেনড্রাইভ,মোবাইল,ল্যাপটপ,চার্জার সব নিয়ে ভেতরের রুমে স্পেশালী চেক করল। এই দীর্ঘ সময়ে তারা অবশ্য আমাকে একটা চেয়ারে আরাম করে বসতে দিয়েছে। আমার মনে হল, তারা গোপন স্থান থেকে ক্যামেরায় আমার অবস্থা পর্যবেক্ষন করছে। কারন তারা সকল সময়ে আমার সাথে ছিলোনা। হঠাৎ হঠাৎ আসছিলো আর প্রশ্ন করছিলো। কথা দ্বারা তারা আমাকে মোটেও কাবু করতে পারেনি।
যখন ৩ঘন্টারও বেশী সময় অতিবাহিত হয়েছে, তখন একজন অফিসার এসে বলল-তোমার পাসপোর্ট নাও, এই যে এখানে দ্যাখো তোমার সবজিনিসপত্র ঠিক আছে কিনা। সবকিছু গুছিয়ে নাও। তুমি কি ক্ষুধার্ত ? পানি খাবে ? বললাম টয়লেটে যাব,,,,সেখান থেকে ফিরে পানি খেলাম। তখন বলল-তোমার জন্যে লাঞ্চ অর্ডার করছি। অর্ডার করল। কিন্তু লাঞ্চ আসতেদেরী হওয়াতে অফিসারকে বললাম, এটা থাক, আমাকে এখন যেতে হবে। পুলিশ অফিসার বলল-আশাকরি কিছু মনে করোনি, এটা আমাদের দায়িত্বের অংশ ছিলো। অফিসার আমার ব্যাগ নিয়ে আমাকে আলাস্কান এয়ারলাইন্সে পৌছে দিল।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিলো এই যে, বাইরে থেকে আমেরিকা বা কানাডায় ফল,ফসলের বীজ নিয়ে প্রবেশ করা যায়না। কিন্তু এরা আমার প্রত্যেকটা জিনিস তন্নতন্ন করে কয়েকবার চেক করলেও বড় বীজের প্যাকেটটা মোটেও খেয়াল করেনি। অবাক হলাম, এটা অবাক হওয়ার মতই ব্যাপার ! এটাই ভাগ্য। যদিও বাংলায় এটাকে বজ্র আটুনী, ফসকা গেরো বলে, কিন্তু আসল বিষয় হল, আল্লাহ যা তাকদীরে লিখেছেন তা ঘটবেই। বীজগুলো আমি এখানে এনে রোপন করে দেশী সব্জী খাব, এটাই হয়ত আল্লাহ চেয়েছেন !
আমি এখানে কাজ সেরে হেটে চলে আসলাম অপর প্রান্তে। এখানে এয়ারপোর্টের ভেতরেই আমেরিকান ইমিগ্রেশন রয়েছে,যদিও এটা কানাডা। আমেরিকা-কানাডার ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়। আমি আমেরিকান অংশে এসে কম্পিউটারাইজড মেশিনে নিজেই নিজের তথ্য টাইপকরলাম এবং এর সাথে যুক্ত বিশেষ স্কানারে পাসপোর্ট স্ক্যান করে ওকে করলাম। একটি বিশেষ কাগজ প্রিন্ট হল। সেটা নিলাম।
দেখলাম ইমিগ্রেশনে মাত্র একজন অফিসার চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। বিশেষ কাগজটি তাকে দেখানোর সাথে সাথে সহাস্যে বলল- আমেরিকায় তোমাকে স্বাগতম ! ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম নির্ধারিত প্লেনের গেইটে। আমেরিকান ইমিগ্রেশনে সম্ভবত দেড় মিনিট সময় লেগেছিলো। পরবর্তীতে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে কোনো ট্রানজিট নেবনা। তবে এক কানাডিয়ান বন্ধুকে একথা বলাতে তিনি বলেছিলেন- আমেরিকাতেও তার একই অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। আমেরিকান পুলিশ তাকে হেনস্থা করেছিলো। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে নাকি দু দেশের পুলিশ দু দেশের নাগরিককে এভাবে বেশী বেশী হেনস্থা করছে। এই লোকটা নানান সব কেলেঙ্কারীর জনক।
বিষয়: বিবিধ
৮২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন