আসুন আমাদের ভেতরের অহংকারের স্বরূপ উদঘাটন করি !!
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:২২:০৮ সকাল
রসূল(সাঃ)বলেন- অহংকার নেক আমলসমূহকে ধ্বংস করে ফেলে,যেভাবে আগুন শুকনো খড়-কুটোকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। সম্ভবত বুখারী বর্ণিত। তিনি(সাঃ)আরও বলেন-অহংকার হল আল্লাহর চাদর।....আল্লাহই হল অহংকারের একচ্ছত্র অধিপতি। আর তিঁনি এই বৈশিষ্ট্য মানুষের ভেতর প্রবেশ করিয়ে মানুষের আচার আচরন,চিন্তা,চেতনা পরিক্ষা করছেন।
অহংকার এমন এক মারাত্মক বৈশিষ্ট যার প্রকাশে এক নিমিষেই একজন আলিম শয়তানে পরিনত হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ মানুষ ও জিনকে তার ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছেন আর ইবাদতের মূল বিষয়টিই হল নতজানু হওয়া,বিনয়ী হওয়া, নিজের সকল ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পন করা। আযাযিল নামক মহা সম্মানিত জীন আল্লাহর আদেশে আদমকে(আঃ) সম্মানসূচক সেজদা করেনি এই অহংকারের কারনে। তাকে আল্লাহ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলার পরও সে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে এবং কৃত কর্মের জন্যে তওবা না করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার ক্ষমতা প্রার্থনা করে এবং তা প্রাপ্ত হয় ,আর এভাবে নিজেকে সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিনত করে। আর মানুষকে ধ্বংস করতে শয়তানের অত্যন্ত সফল অস্ত্রের অন্যতম সেরা অস্ত্র হল অহংকার। সাবধান !!!
এমন কোনো মানুষ নেই ,যার ভেতর অহংকার নেই। আমরা বেশীরভাগ সময়ই অহংকারের অবস্থান,উপস্থিতি,পরিমান আচ করতে পারিনা। অহংকার সুপ্ত বিষয় কিন্তু এটি পরিবেশ পেলে মারাত্মক হয়ে ওঠে আর হিতাহিত জ্ঞানকে নষ্ট করে ফেলে। অহংকার আর ক্রোধ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একের উপস্তিতিতে অন্যটি সবল হয়ে ওঠে। এই দুয়ে মিলে ব্যক্তি দিশাহারা হয়ে পড়ে আর শয়তান তার নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে ফেলে। ক্রোধের ভেতর অহংকারের বীজ রয়েছে। ক্রোধের সময় অহংকার প্রকাশিত হয়ে পড়ে। শয়তান ক্রোধান্বিত মানুষের উপর সওয়ার হয়ে সীমা লঙ্ঘনে সর্বাত্মক ওয়াসওয়াসা দেয়। এ কারনে রসূল(সাঃ) ক্রোধের সময়,"আউযুবিল্লাহিমিনাশ শয়তান হির রাজিম" আবৃত্তি করতে বলেছেন,,অর্থাৎ আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে পরিত্রান চাচ্ছি।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানান সব কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে অহংকার প্রকাশিত হয়। আজ আমরা এর ভেতর একটি নিয়ে খানিকটা আলোচনা করব :
১. প্রশংসা
=======
রসূল(সাঃ)বলেন-কারো প্রকাশ্যে প্রশংসা করা মানে তাকে হত্যা করা।.....সাহাবায়ে কেরমগন তাদের সামনে প্রশংসাকারীদেরকে কখনও মাটি ছুড়ে মারতেন এবং এটা তারা এনজয় করতেন না। বরং ওমর(রাঃ)বলেন-যে তোমার দোষ ধরে ,সেই তোমার বন্ধু।
কারো প্রশংসা তার সামনে করলে বিষয়টি তার ভেতর বিশেষ ভাবের সৃষ্টি করে আর এই ভাবটাই হল সূপ্ত অহংকার। কখনও প্রশংসিত ব্যক্তি উচ্ছসিতভাবে অহংকার প্রদর্শন করে অথবা উপস্থিত প্রশংসাকারীদের মন রক্ষার্থে নিজেই নিজের ভালো দিকগুলো গর্ব করে প্রকাশ করতে থাকে। অথবা উপভোগ করতে থাকে। অথবা সে এই ভাব প্রকাশ করেনা কিন্তু তার মন মস্তিষ্ক সুখানুভূতিতে পূর্ণ হয়ে পড়ে আর এ পথ দিয়ে অহংকার প্রবেশ করে। সে তখন নিজের দোষের কথা ভুলে যায়,বা চেপে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে সাহাবীদের(রাঃ) চরিত্র ছিলো ভিন্ন। একবার ২য় খলিফা হযরত ওমর(রাঃ)জনগনের সামনে বক্তব্য প্রদানরত অবস্থায় হঠাৎ থেমে গেলেন এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন-"আমি সেই ওমর,যে মাঠে বকরী চরাতো আর এর বিনিময়ে কিছু খেজুর পেত পারিশ্রমিক হিসেবে"......বক্তব্য শেষ হলে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে বললেন-বক্তৃতা প্রদানের সময় হঠাৎ আমার ভেতর এমন ভাবের উদয় হল যে,আমি তো খলিফা,বিশাল ভূ-ভাগের মানুষের প্রতিনিধী আমি ,আমি কিছু বললে মানুষ তা শোনে। এই চিন্তাটি আমার ভেতর অহংকার তৈরী করছে বুঝতে পেরেই আমি নিজেকে ছোট করতে উক্ত কথা বলি।
এবার আমরা প্রশংসার আরেক দিক নিয়ে আলোচনা করব। আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার সামনে অন্যের প্রশংসা করলে আপনার শুনতে কেমন লাগে ? আপনি সাধারন লোক হলে মনে মনে বলবেন--হ্যা এটাতে আমার মনের ভেতর তোলপাড় হয়। মনে হয় আমার প্রশংসার বদলে কেন অন্যের কথা চলছে !! আর যদি আপনি অসাধারন হন,তাহলে মনে মনে বলবেন-না এটা আমার মনের ভেতর তেমন দাগ কাটেনা।
এবার আবার প্রশ্ন করি--- আচ্ছা ধরুন আপনার সামনে যার প্রশংসা করা হল সে অপরিচিত ব্যক্তি নয়। বরং সে ব্যক্টিটি আপনার বন্ধু,এখন আপনার অনুভূতি কি ??
এ পর্যায়ে আমরা যদি নিজেদের দিকে তাকাই ,দেখতে পাব- দূরের কোনো ব্যক্তির বিষয়ে মনে তেমন ক্ষোভ সৃষ্টি হয়না। তবে যদি কাছের কোনো লোক যেমন আত্মীয়,বন্ধু,পরিচিত,প্রতিবেশী এদের কোনো আচরনের বা কাজের প্রশংসা করলে আমার আচরন কেমন হয়,অথবা চিন্তার জগতে কেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয় ??
আসলে এই পর্যায়ে সমাজের পরিক্ষিত আলেমও অসহায়। সকলেরই এ সময় মনের ভেতর এমন অনুভূতি হয় যে- কেন আমি তার মত ওরকম কাজ করতে পারলাম না ,তাহলে মানুষ আমারও প্রশংসা করত !! এখানে উল্লেখ করছি যে, কারো ভালো কাজ দেখে হিংসা করা জায়েজ রয়েছে,কারন এটি তাকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে,কিন্তু আমরা যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা এরকম বৈধ অনুভূতি নয়। এটা অন্য কিছু।
এ অনুভূতি হল এরকম যে, যার প্রশংসা করা হল তার উপর ক্রোধ জন্মে এবং মনে হয় সে যদি এ ভালো বা প্রশংসিত কাজ না করত তাহলে ভালো হত। সে কেন পরিক্ষায় প্রথম হল !! সে কেন এত টাকা বেতন পাবে !! সে কেন এত সুন্দর গাড়ি কিনল ! সে কেন অত চমৎকার বাড়ি বানালো ! তার রূপ,সৌন্দর্য কেন এত বেশী,কেন মানুষ তার কথা শোনে ! কেন সে এমন এমন কাজ করবে ! কেন আমি এটা পেলাম না ! .....এরকম বিষয়টি মনে অনুরনিত হতে থাকে আর তা আমাদেরকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। কখনও আমাদের মুখ থেকে তার ব্যাপারে রুঢ় কথাও বের হয়ে পড়ে।
কখনও তার প্রশংসা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে তাকে মিথ্যা,হীন,খারাপভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেও থাকি। অথবা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার পাশাপাশি নিজের কোনো ভালো কাজের বিষয়টি উপস্থাপন করে প্রশংসার মোড় ঘুরাতে চেষ্টা করি। আবার কখনও কখনও জোর করে তার/তাদের বিষয়ে সকল ভালো কথা বন্ধ করে দেই। আবার কেউ যদি তার ব্যাপারে বিপরীতমুখী কথা বলে বা তার দোষের কথা প্রকাশ করে তখন আমরা কখনও সেই দোষ চর্চা করেও আনন্দিত হই। উপরোক্ত সকল আচরনই অহংকারের বিভিন্ন স্তরের প্রতিচ্ছবি।
আল্লাহ কত মহান ! তিনি মনের ভেতরে থাকা পাপের জন্যে পাপ লিপিবদ্ধ করেন না,পাকড়াও করেন না বরং তার পাপ আচরনে প্রকাশিত হলেই লেখা হয়। নইলে মনোজগতের উপর ভিত্তি করে পাপ লেখা হলে দুনিয়ার কেউ মুক্তি পেতনা।
অবাক করা বিষয় হল এই যে, গতকাল এই বিষয়টি নিয়ে যখন কিছুটা ভাবছিলাম,তখন আমার এক কলিগের সাথে দেখা হল। সে আমাকে বলল-সম্প্রতি সে বড় একটা প্রমোশন পেয়েছে এবং তার দায়িত্বটা অত্যন্ত সহজ। আমি তাকে হঠাৎই বললাম....ওহ আমি এই পোস্টের জন্যে আবেদন করতে গিয়েও করিনি !!! এরপর আরও কিছু কথা হল,তাকে এপ্রিশিয়েটও করলাম। খানিক পরই আমার মাথায় আসল---আরে আমি এটা কি করলাম !! আমি প্রথমেই বলেছি,,,উক্ত পোষ্টে আমি আবেদন করতে গিয়েও করিনি। এর ভেতর রয়েছে আক্ষেপ এবং একটি ভাব,তা হল এই যে-আমি উক্ত পোস্টে আবেদন করলে আমিই সেটি পেতাম। অর্থাৎ আমি তার থেকে যথেষ্ট যোগ্য,আর আমি আবেদন করিনি বলেই সে এটা পেয়েছে !!! কি ভয়াবহ বিষয় নিজের অজান্তেই প্রকাশিত হয়ে পড়ল ! অর্থাৎ এই অহংকারটি ভেতরে সূপ্ত অবস্থায় ছিলো কিন্তু সঠিক সময়ে তা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে প্রকাশিত হয়ে পড়ল।
এরপর বার বার মনে হতে থাকল,ইয়া আল্লাহ আপনি ক্ষমা না করলে আমি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাব। আমার একমাত্র আমল ও পাথেয় হল আল্লাহর ক্ষমা।
আজ এ পর্যন্তই.....। আসুন আমরা নিজেদের ভেতরটাকে আরেকবার বিশ্লেষন করি। আর যদি চিন্তা করেও নিজেদের ভেতরে অহংকার না দেখতে পাই,তবে হয় মিথ্যা বলছি নয়ত, জ্ঞানের ঘাটতি থাকার কারনে অনুধাবন করতে পারছি না।
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুবই গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতামূলক একটি লিখা। মহান প্রভু আমাদের সকলকেই অহংকার ও হিংসা বিদ্বেষ থেকে নাজাত দিন। আমীন।
জাকাকাল্লাহ খায়ের
মন্তব্য করতে লগইন করুন