রস নিয়ে রসের বয়ান
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:২৯:৪৩ দুপুর
ছোটবেলায় স্কুলের ছুটিতে মামুবাড়ি গেলে প্রধান আকর্ষণ থাকল নানান সব খেলাধুলা। আমার সবচেয়ে পছন্দের আত্মীয় বাড়ি ছিলো মামুবাড়ি। এক অনাবিল আনন্দের স্থান। বছরে একবার যেতাম মার সাথে আর থাকতাম মাসাধিককাল। খেলার সাথী ছিলো অগনিত। আজ কেবল খেজুরের রসের বয়ান হবে,অন্য কথা বাদ।
মামুদের শতশত খেজুর গাছ ছিলো। কসম করে বলা যায় এসব গাছ তারা কেউ লাগায়নি এবং অন্যরাও কেউ খেজুরের গাছ কখনও রোপন করেনি। খেজুরের বড় গাছের নীচেই অনেকগুলো গাছ এমনেই জন্মায়। খেজুর পাকলে পাখি তা খায় এবং বীজ থেকে চারা গজায়। মানুষের ক্ষেতের আইলে নিশানা হিসেবে খেজুরগাছই বেশী থাকত।
মামুদের জমিজমা ছিলো অনেক আর এর ভেতর আমার কাছে প্রধান আকর্ষণ ছিলো খেজুর বাগান। বেশ কয়েকটা খেজুর বাগান ছিলো। আমরা সেখানে দিনের বেলা খেলতেও যেতাম। কিন্তু মূল আকর্ষণ ছিলো সকালে যখন বহু সংখ্যক ভাড়ে করে খেজুরের রস নিয়ে আসা হত। মামাতো কিছু ভাই এবং রাখালরা সাত সকালে উঠে রস সংগ্রহ করত। এসব রসের ভেতর কিছু গাছের রস কেবল খাওয়ার জন্যে থাকত। যেসব গাছ মোটা তাজা ,পুরোনো এবং বেশ কয়েকদিন পর পর কাটা হয় তার রসই ভালো হয়। যশোরের স্থানীয় ভাষায় এসব গাছের নাম- দেইড়ো গাছ। তবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন অথবা কুয়াশা থাকলে খেজুরের রস ততটা মিস্টি হয়না শুনেছি।
মিস্টি রস খাওয়ার কিছু নিয়ম ছিলো। সকালের রস খাওয়ার আগে আগুন বানানো হত। মূলত এ আগুন রাতে রান্নার পর চুলার ভেতর যে কাঠ পোড়ানো কয়লা তার আগুন। উপরে ছাই আর ভেতরে গনগনে আগুন থাকত। এর উপর আমরা আরও আগুন বানাতাম। তবে পলের আগুন মিছে কথা,এটা জানতাম। তাই পল বা খড়ের আগুন বানাতাম না। কয়লার এই আগুনে আমরা আলুও পোড়াতাম। তবে সেটা মাঝে সাঝে। সাধারনত আমরা আগুনের চারিপাশে বসতাম ছেলে বুড়ো সকলে আর বড়রা নানান সব খোশ গল্প করত। এরপর আসত খেজুরের লাল টকটকে রস আর মুড়ি। সেসব লাল রঙের রস এখনকার জেনারেশন চোখে দেখেনি,মনে হয় শুনেওনি কখনও। কারন এসব রস কেবল যশোর ও ফরিদপুরে পাওয়া যায়। তবে এটা নির্ভর করে গাছির উপর। ভালো গাছি বুঝে কোন গাছ কিভাবে কাটলে গাড় লাল রস পাওয়া যায়।
সেই রসের একটা সুন্দর ঘ্রান ছিলো। দূর থেকেও বোঝা যেত কোথায় রসের ভাড় আছে। আর এক গ্লাস খাওয়ার কোনো নিয়ম ছিলোনা। তিন,চার পাচ গ্লাস করে খেতাম। কেউ কেউ বড় কাসার মগে খেত। সাত সকাল ছাড়া এটা খাওয়ার নিয়ম নেই। সকালে আগুনের পাশে বসে এটা খেতে হয়। আমি বেশ কয়েকবার বমি করে দিয়েছি গলা পর্যন্ত রস খাওয়ার কারনে। কিন্তু এরপর আবার খেয়েছি। সে রস একবার খেলে আরেকবার খেতে হবে,মলম বিক্রেতার মত গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। আবার সন্ধ্যায় রস খেতাম। সকালে রস সংগ্রহ করে সেখানে আরেকটি ভাড় পাতা হত।বিকেলে গাছ কাটার পর সেখানে ভাড় পাতলে ৩/৪ ঘন্টা পর বেশ খানিকটা রস জমা হয়,সেটাই সান্ধ্যরস। সকালের পাতা ভাড়ের রস মিস্টি হয়না। সন্ধ্যায় আমরা খেজুর বাগানে যেতাম। বয়সে বড়রা গাছে উঠে রস পাড়ত। এটাকে রস ঝাড়া বলে। সন্ধ্যার রসও দারুন মিস্টি হত। গাছ বুঝে ঝাড়তাম। আর এই রস খাওয়ার নিয়ম হল ক্ষেতে গজানো নতুন ছোলা পুড়িয়ে তার সাথে। এভাবে পোড়ানো ছোলাকে স্থানীয়ভাবে বলা হত ছোলাহুড়া। এই পোড়ানোরও নিয়ম আছে। পরিষ্কার মাটির উপর খেজুর গাছের ফাতরা(নারকেলের ছোবড়ার মত এক ধরনের জিনিস যা খেজুর গাছের ডালের ভেতর থাকে)ধরাতে হয়,এর উপর কাচা,অর্ধ পাকা ছোলার গাছ দিতে হয়। একসময় আগুন নিভে যায়। এরপর সেই ছোলা ধুলোযুক্ত অবস্থায়ই দুহাতে তুলে ডলা দিয়ে খেতে হয়। পাত্রে তুলে খেলে হবেনা,এতে নিয়ম ভঙ্গ হবে। এভাবে কিছু পোড়া ছোলা খেতে হবে আর তার সাথে রস। সেই ছোলার স্বাদ যে পায়নি,সে দুনিয়ার চরম এক নিয়ামত হারিয়েছে। যাইহোক আবারও সকালের রসে ফিরে যাই। সাত সকালেই ভাড়ের পর ভাড় রস উড়ে যেত,কারন আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক।
এরপর অন্য রস বড় বড় টিনের তাওয়ায় জ্বাল দেওয়া হত গুড় তৈরীর জন্যে। পরবর্তী আকর্ষন হল চিটাগুড় খাওয়া। পাতিলে যেটুকু গুড় থাকে তা ভাড়ে পোরার পর অবশিষ্টাংশ গুড় আবারও খানিকটা জ্বাল দিলে প্রবল আঠালো হয়ে ওঠে। আমরা খেজুরের পাতা ভাজ করে আবার বাশের চাছ দিয়েও তা তুলে খেতাম। গ্রামে যাদের চাছের ঘর থাকত,তাদের ঘরের এক কোন থেকে সেটা ভেঙ্গে নিতাম চুপিসারে। সেই আঠালো গুড় বা চিটগুড় খাওয়ার মত মজা আর নেই রে পাগলা.....।
রস জ্বালিয়ে শেষে তা গাড় খয়েরী রং ধারন করত এবং ঘন হয়ে যেত। তখন এটা নতুন ভাড়ে ভরে রাখা হত। রসের ধরন ভেদে গুড়ের মান নির্ভর করে। ভালো রসের গুড়ের মান ভালো। আবার গুড়ের রং নির্ভর করে বিচ মারার উপর। বিচ মারা মানে হল যখন গুড় তৈরী হয়ে যায় তখন কাঠের চামুচ,ওড়ং বা এরকম কিছু জিনিস দিয়ে পাতিলের গায়ে গুড় ক্রমাগত ঘসতে হয়। এভাবে ঘসতে ঘসতে উক্ত স্থানে গুড়ের রং বাদামী হয়ে যায়,তখন অন্য স্থানের গুড়ের সাথে ওটা গুলিয়ে দিতে হয়। যতবার এরকম বিচ মারা হবে ততই গুড়ের রং গাঢ় খয়েরী থেকে হালকা হতে হতে বাদামী রং ধারন করবে। আর সেটা দেখতেও বেশ দারুন হয়। এই গুড় ভাড়ে ভরে রাখলে উপরের অংশে একটা পুরু সর পড়ে যায়। সেটা তুলে খাওয়ার মজা খুব কম লোকই বোঝে.....আমি সেই অংশ সংখ্যক লোকের একজন
উপরে যেমন লাল রঙের রস খাওয়ার বর্ণনা দিলাম,সেই রস যদি না খেয়ে জ্বাল দেওয়া হয়,তাহলে দ্রুততম সময়ের ভেতরই গুড় তৈরী হয়,কারন উক্ত রস অপেক্ষাকৃত ঘন। আর এই রসের গুড়ের ঘ্রান দূর থেকে পাওয়া যায়। এই গুড় থেকে যদি পাটালী বানানো হয় তাহলে এর স্থানীয় নাম হল নলেনী পাটালি। নলেনী পাটালী একবার খেলে মন ভরে না। এটা খাওয়ার নিয়ম হল মুড়ি দিয়ে খাওয়া। আগে এক মুঠো মুড়ি মুখে পুরে চিবাতে হবে এরপর নলেনী পাটালীতে এক কামুড়,এভাবে চলতে থাকবে। এছাড়া ভেজানো চিড়ার সাথে নারকেল কুড়া আর এই পাটালী অথবা গুড়, লা জবাব। অথবা রাতে তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়ার পর নিয়মানুযায়ী সব শেষে দুধ দিয়ে ভাত মেখে এই গুড় বা নলেনী পাটালি মানে হল দুনিয়ার চোখে জান্নাতী খাবার। যেসব বুড়ো মানুষের মুখে দাত নেই,তাদের এই দুধ-গুড় দিয়ে ভাত খাওয়া দেখলে অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে....অবশ্য দু এক জনের হাসির থলে বিস্ফোরিতও হতে পারে,,তাতে কারো কিছু এসে যায় না।
এবার আসি একালের খেজুরের রসে। একালে মানুষের মন থেকেই রস উঠে গেছে,গাছ তো বহুদূর। যেখানে নদীই শুকিয়ে কাঠ,সেখানে ভাড়ের ভেতর রস খোজাই তো বিলাসীতা। দেশের বাড়ি গিয়ে সকালে রসের জন্যে রাস্তার নানান মোড়ে পায়চারী করেও রসওয়ালার দেখা পাওয়া যায় না। কারন রসওয়ালারা বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসলেই বিক্রী হয়ে যায়। ছোটবেলায় মামুবাড়ি গিয়ে বলতাম যে আমাদের এলাকায় রস বিক্রী হয়। তারা শুনে অবাক হয়ে যেত,যে রস আবার বিক্রী হয় ! এটা তো এমনেই পাওয়া ও খাওয়া যায়। যে কেউ যে কোনো লোকের গাছের রস অনায়াসে খেত,কেউ কিছু মনে করত না। কারো বাড়ি রস থাকলে অন্যরা তার বাড়ি গিয়ে খেতে পারত। তবে এরকমটা সাধারনত করত না,কারন সেখানে প্রায় প্রত্যেকের বাড়িই রস ছিলো।
ঢাকায় একবার এক লোক দেখলাম রস বিক্রী করছে। ময়মনসিংহ থেকে বহু কষ্টে রস এনেছে লোকটা,রসের রং সাদা। আমি লোভে পড়ে এক গ্লাস খেলাম,আর মনে হল- এই লোক এর ভেতর হিসু করেনিতো !! রসের স্বাদ এরকম হবে কেন ! আর গন্ধও উলা রসের। উলা রস মানে হল যে রস কোনো কারনে ভালো হয়নি,বা পচা রসও বলা যায়। এরপর ঢাকায় কোনোদিন খেজুরের রস খাওয়ার চেষ্টা করিনি। যশোরে শুনলাম দু একজন বাটপার রসের কদর বুঝে কৃত্তিম উপায়ে রস তৈরী করছে। তবে তারা সুবিধা করতে পারেনি। কারন এলাকার লোক বোঝে আসল রস কেমন এবং কেউ এভাবে রস তৈরী করলে একবারের বেশী স্থানীয় লোকদের কাছে বিক্রী করতে পারবে না। তার ব্যবসাই লাটে উঠবে। বলা যায় স্থানীয় গাছিরা সৎ। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। গত প্রায় ২ দশকে বাংলাদেশের বহু স্থানে ব্যপকহারে ইটের ভাটা গড়ে উঠেছে,কারন ব্যপক নগরায়ন। এসব ইটের ভাটায় গাছ হিসেবে যেসব গাছ বেশী পুড়েছে তা হল খেজুর গাছ। গ্রামের কৃষকরা প্রকাশ্যেই বলেছে,খেজুর আবার গাছ হল ! রসের নেই কদর,,গুড়ের নেই দাম। গুড় বানাতে যত কাঠ নষ্ট হয়,তার চেয়ে গুড়ের দাম অনেক কম। দূর করে দাও সব খেজুর গাছ। মাত্র ৫০/১০০ টাকায় বড় বড় খেজুর গাছ বিক্রী হয়েছে ইটের ভাটায়। লাখ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। অথচ এসব গাছ বড় হতে বহু বছর সময় লেগেছিলো। পরবর্তীতে আইন হয় যে খেজুর গাছ বা অন্য গাছ ইটের ভাটায় পোড়ানো যাবেনা কিন্তু ভাটার মালিকরা অতি চালাক। তারা এক ট্রাক কয়লা কিনে ভাটার কাছে ফেলে রাখে আর গাছ পালা পুড়িয়ে ইট তৈরী করে।
বাঙ্গালীর মত চালাক জাতি দুনিয়ায় নেই,কিন্তু চালাকীগুলোর পরিনাম সম্পর্কে তারা বড়ই অপরিনামদর্শী। বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর এবং রস ভক্তদের খেজুরের গাছের উপর। অবস্থা এমন হয়েছে যে মানুষের কাছে টাকা আছে কিন্তু খেজুরের রস নেই,কারন গাছ বিক্রী করে দিয়েছে ,তাও মাত্র এক,শ টাকার বিনিময়ে। বর্তমানে একভাড় রসের দামই তাদের বিক্রীত একটি গাছের দামের সমান। আর গুড়ের দাম চিনির চেয়ে অনেক বেশী। অনেকে গুড়ের ভেতর চিনি মেশায়। অতএব তাদের কেউ কেউ কপাল চাপড়াচ্ছে। কেউ কেউ খেজুর গাছ রোপন করছে,কিন্তু যে হারে তারা কেটেছে সে হারে কেউ রোপন করেনি। ফলে রসের জন্যে লাইনে দাড়িয়ে থাকো। আর রসের রং যে লাল হতে পারে,সেটা আমার লেখা পড়ে জেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই,কারন দু-তিন দিন অন্তর একবার গাছ কাটা হচ্ছে বেশী রস বের করার জন্যে। রস যত বেশী বের করা হবে,ততই তার রং সাদা হবে এবং সুমিষ্ট হবেনা। তারপরও দু এক জনের রস এখনও বেশ ভালো কিন্তু তাদের খুজে পাওয়া দুষ্কর। সেসব গাছিও এখন কমে গেছে। মানুষের মন এখন বানিজ্যিক হয়ে উঠেছে। কারন বহু মানুষের হাতে কাচা টাকা এসেছে ,তারা খেজুরের রসে রসালো হতে চায় ,টাকা ব্যাপার না,,তবে ভালো রস এখন ব্যাপার !
বিষয়: বিবিধ
২৫৫৬ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রস নিয়ে রসালো কাহিনী পড়ে শৈশবের দিনগুলোতে বিচরণ করলাম।
তবুও আশাবাদী ভাইয়ের সাথে সহমত।
ফুটখানেক লম্বা –আগেভাগে পরিষ্কার করে রাখা পাটকাঠি ( সে সময়ে সস্তা প্লাস্টিকের পাইপ ছিল না) সাথে নিয়ে বিশেষ খেজুর গাছটির মাথায় উঠে, চুপিচুপি চুষে রস খাওয়ার মজাও আলাদা ছিল, ভাঁড় টেনে মাটিতে নামিয়ে আনার ঝক্কি ছিল না!
মন্তব্য করতে লগইন করুন