আমেরিকাতে আমার দেখা স্বাস্থ্য সেবা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:২১:১৮ দুপুর
========================
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকায়(যদিও উত্তর আমেরিকার ৩টি দেশ ,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা,মেক্সিকো,তারপরও আমেরিকা বললে মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝে থাকে। সেকারনেই আমেরিকা শব্দটি ব্যবহার করছি) এক বিশাল সংখ্যক মানুষ আইনত অবৈধভাবে বসবাস করে। এদের ভেতর মেক্সিকোর মানুষের সংখ্যাই বেশী। উত্তর আমেরিকার অন্য দুটি দেশ কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশাল বিত্ত বৈভবে ঠাসা অথচ একই রেখায় অবস্থিত মেক্সিকো গরিবী হালে দিনাতিপাত করছে,এটা একটা বিশ্ময়। ক্যাপিটালিজম যে কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবতে শেখায় এটাই তার একটা প্রমান।
আমেরিকার একটা বিশাল সংখ্যক মানুষই স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। অর এদেশে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত মানুষের দু:খের সীমা নেই। এখানে কোনো ব্যক্তি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করলে বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানই ৬ মাস পর তাকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান চাকুরী শুরুর দিনই তাকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে। এটি নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়ম-নীতির উপর। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর আবেদনের সময় সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার প্রদান করেই তবে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এই নাম্বার ছাড়া আবেদন ফর্ম পূরন করা যায়না,সেটা বাতিল হয়ে যায়। আর সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার এর আবেদন করতে প্রয়োজন হয় বৈধভাবে বসবাসের অনুমতিপত্র যা গ্রীন কার্ড হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ একটি চাকুরীর জন্যে বৈধভাবে বসবাস অত্যন্ত জরুরী বিষয়।
প্রশ্ন আসতে পারে,তাহলে যারা অবৈধভাবে আমেরিকায় বসবাস করে তাদের কি উপায় হয় ?
কোটি কোটি মানুষ যারা অবৈধভাবে আমেরিকাতে বসবাস করছে,এরা আসলে কেমন আছে তা তারা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না,অনুভব করবে না। এদেশে বৈধতা ছাড়া চাকুরী পাওয়াই সম্ভব নয়। তাহলে তাদের চলে কিভাবে ?
এদেশে অনেক ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান আছে যারা রাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত ন্যূন্যতম মজুরীর চাইতেও কম মজুরী প্রদান করে এদেরকে কাজের সুযোগ দেয়। এতে উক্ত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সুবিধা হয়। কিন্তু এরকম প্রতিষ্ঠানে কাজ জোটানো খুব সহজ নয়। কারন অবৈধ লোক কর্মরত আছে জানলে এই প্রতিষ্ঠানকে বড় রকমরে আইনী সমস্যায় পড়তে হয়। বহু লোক তাই ক্ষেতে- খামারে কাজ করে,কারো বাড়ির লনের ঘাস কাটে বা এরকম ধরনের কাজ করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। যাইহোক আমরা স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কথা বলছিলাম,আর তার সাথে এটার সম্পর্ক রয়েছে।
যেসব লোক অবৈধ তারা স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারে কিন্তু তাদেরকে সরাসরি হাসপাতাল,ক্লিনিকে গিয়ে সেটা নিতে হয় ,আর এর খরচ আকাশচুম্বী,যার পুরোটাই নিজস্ব পকেট থেকে প্রদান করতে হয়। আমার এক পরিচিত আমেরিকান শিক্ষানবিশ মোটর মেকানিক হিসেবে সিয়ার্স নামক বিখ্যাত কোম্পানীতে কর্মরত ছিলো,কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোম্পানী তাকে স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করেনি। এমতাবস্থায় হঠাৎ এক রাতে সে জ্বরে আক্রান্ত হল। এদেশে সাধারন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩ দিন ভোগার পর তবেই ডাক্তার ওষুধ দিবে কিনা ভাবে। তবে অবস্থা মারাত্মক হলে যে কেউ যে কোনো সময়ই চিকিৎস্যকের শ্মরনাপন্ন হয়। তো এরিকের শরীরের তাপমাত্রা এতই বেড়ে গেল যে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে উপাই ছিলোনা। মূলত সে ডাক্তারের কাছে যাবেনা বলেই পণ করেছিলো,কারন বিশাল বিল মেটানোর অর্থ তার ছিলোনা। শেষ পর্যন্ত সে বাধ্য হল এবং ডাক্তারের ভিজিট ৩০০ ডলার,রক্ত পরিক্ষা করতে দিল সে বাবদ অন্তত ৮০০ ডলার বিল আসল কিন্তু ডাক্তার কোনো ওষুধ না দিয়ে বলল দু-এক দিনের ভেতর এটা ঠিক হয়ে যাবে। তাকে কিছু ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে দিল। যদি এরিকের স্বাস্থ্যবীমা থাকত,তবে বীমা কোম্পানী একটি বড় অংশ(৬৫-৮০%) বহন করত। অবশ্য স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানীর ভেতর ভালো মন্দ রয়েছে।
যারা কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এবং স্বাস্থ্য বীমা রয়েছে,তাদেরকে প্রতি মাসে অথবা প্রতিটি পে-চেকের সাথে সাথে বীমা কোম্পানীকে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ প্রদান করতে হয়,আবার মেডিকেয়ার ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। আবার তার পক্ষ থেকে তার প্রতিষ্ঠানও উক্ত বীমা কোম্পানীকে অর্থ প্রদান করে। এর বিনিময়ে এই কর্মজীবী লোকটি যখন চিকিৎসকের কাছে যান তখন তার সমস্ত খরচের সর্বোচ্চ ৮০ ভাগ বীমা কোম্পানী বহন করে। তবে এর ভেতর মারাত্মক সব ফ্যাকড়া রয়েছে যা বুঝতে দীর্ঘ সময় চলে যায়।
এখানে ডিডাকটেবল নামক একটি অপশন আছে,যা উক্ত কমচারীর কাজের ধরন,প্রদত্ত অর্থের পরিমান,প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহযোগীতার মাত্রা এসবের উপর নির্ভর করে কম বেশী হয়। যদি কারো ডিডাকটেবল ৫০০ ডলার হয় বছরে,তাহলে এটার অর্থ হল এই যে- সারা বছর যতবার চিকিৎস্যা গ্রহন করবে তার খরচের যে অংশটি বীমা কোম্পানী বহন করে,সেটি সর্বোচ্চ ৫০০ ডলার হতে হবে। এর বেশী হলে অতিরিক্ত অর্থ সেই ব্যক্তিকেই পরিশোধ করতে হবে।
যেমন কারো বিল আসলো ২ হাজার ডলার,তাহলে এর সর্বোচ্চ ১৬০০ ডলার বীমা কোম্পানী বহন করেব । অবশ্য নানান ব্যাখ্যা প্রদান করে বীমা কোম্পানী সাধারনত ৬৫-৭০% বহন করে,বাকীটা উক্ত ব্যক্তিকে বহন করতে হয়। যদি এমন হয় যে ডিডাকটেবল ৫০০ ডলার কিন্তু বিলের ১৬০০ ডলারই বীমা কোম্পানী বহন করেছে তাহলে অবশিষ্ট অর্থ(১৬০০-৫০০= ১১০০ডলার) বীমা কোম্পানীকে প্রদান করতে হয়। তবে চিন্তা আসতে পারে যে,তাই যদি হয় তাহলে বিশাল একটা বিল বাধিয়ে বীমা কোম্পানীর অর্থ পরিশোধ করব না। এটার সুযোগ আসলে থাকেনা তেমন। কারন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎস্যার পূর্বেই বীমা কোম্পানীর সাথে কথা বলে এবং তারা কতটুকু অর্থ প্রদান করবে সেটা সেবা গ্রহনকারী লোকটিকে জানায়। আর যদি সেবা গ্রহন করার পর টাকা বকেয়া থাকে,এবং তা পরিশোধ না করা হয়,তাহলে তৃতীয় আরেকটি আইনী সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই বিল নিষ্পত্তি হয়। তারা লিগাল নোটিশ পাঠায়। মিমাংসার চেষ্টা করে। সেটাতে কাজ না হলে আইন-আদালতে বিষয়টি গড়ায়। আর এদেশে কেউ আদালতে কোনো কারনে দোষী সাব্যস্ত হলে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর আবেদনের পর ইন্টারভিউতে টিকে গেলে তার ব্যাকগ্রাইন্ড চেক করা হয়। আর তখন রেকর্ড দেখতে পারে নিয়োগদাতা।
বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো প্রথম সারীর এবং তারা তাদের কর্মচারীদের উন্নত সাস্থ্যবো প্রদান করে থাকে। আর তদের ক্ষেত্রে ডিডাকটেবল এমাউন্টও অনেক বেশী হতে পারে। কখনও দীর্ঘদিন কর্মরত ব্যক্তির জন্যে বীমা কোম্পানী বড় রকমের সুবিধা প্রদান করে থাকে। যেমন আমার সহকর্মী রড প্রথম জীবনে একজন ম্যাটাডোর ছিলো,যারা ষাড়ের সাথে যুদ্ধ করে বা পাগলা ষাড়ের পিঠে বসে দীর্ঘক্ষন টিকে থাকার চেষ্টা করে,,আবার পাগলা ষাড়কে হত্যা করার খেলাও করে। রডের ব্যক্তিগত ষাড়ের খামার রয়েছে। চাকুরীর পাশাপাশি পারবিারিকভাবে সেটা সে দেখাশুনা করে। একদিন এক পাগলা ষাড়ের বে-কায়দা গুতোয় তার কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায়। জরুরী সার্জারীর প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানী তার চিকিৎস্যা ব্যয় ৪৯হাজার ডলারের ভেতর ৪৮হাজার ডলারই প্রদান করে। রডকে মাত্র ১ হাজার ডলার প্রদান করতে হয়। তার কোমরে বিশেষ মেটালের একটি অংশ সেট করা হয়েছে,এখন সে মাঝে মাঝে ঘোড়ায়ও চড়ে।
এদেশে বিশাল ধনী মানুষ যেমন রয়েছে,তার পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষও রয়েছে। তাদের কোনো স্বাস্থ্যসেবা নেই। কখনও দাতব্য সংস্থা কিছু কিছু মানুষের দায়িত্ব গ্রহন করে বটে কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। বাইরে থেকে এদেশকে যারা উদারনৈতিক বলে; ভেতরে আসলে তাদের সঠিক বোধদয় ঘটে। এখানে অর্থ ছাড়া জীবন অচল। আর সেটা উপার্জনও কষ্টকর। এদেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত যেখানে কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ রাজ্যের শাসন রয়েছে। আর ব্যক্তিতে ট্যাক্স প্রদান করতে হয় আলাদাভাবে কেন্দ্র ও অঙ্গরাজ্যকে। এছাড়া আছে নানান খাতের ট্যাক্স। তবে দীর্ঘ চাকুরী জীবন শেষ করে অবসরে গেলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিছু খাত থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত অর্থ পাওয়া যায়,ভবিষ্যতের এ সুবিধার জন্যেই মানুষ ট্যাক্স প্রদান করে,এছাড়া জনগনের ট্যাক্সের অর্থে নানান জনকল্যানমূলক কাজ করা হয়,সেটাও একটি সান্তনা।
তবে শেষ কথা হল আমেরিকার স্বাস্থ্য সেবা বিষয়টা সেবার চাইতে ব্যবসায়িকই বেশী। এখানে স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানী,ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানী এবং হাসপাতালগুলো জনগনের সাথে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় মেতে আছে। বিষয়টা এমন যে অধিকাংশ মানুষ বুঝে কিন্তু কিছুই করার নেই। এমন বহু অভিযোগ রয়েছে যে অনেক রোগের পুরোপুরি নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কৃত হলেও সেটি পুরো গোপন করা হয়েছে,এবং উক্ত রোগের এমন ওষুধ বাজারে ছাড়া হয়েছে যা সারাজীবন ধরেই খেতে হয়। তবে এখানে সেবার মান আসলেই অনেক উন্নত। পয়সা বেশী খরচ হলেও সেবা নিয়ে মুগ্ধ হতে হয়। তাই সেবা প্রাপ্ত মুগ্ধ মানুষ সুস্বাস্থের জন্যে নির্দিধায় পয়সা খরচ করে চলেছে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৯ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক কিছু জানলাম। তবে সুখকর বিষয় হল বৈধ নাগরিকের জন্য ইংল্যান্ডে চিকিৎসা ফ্রি।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
চমৎকার।
আমেরিকার স্বাস্থ্য সেবা বিষয়টা সেবার চাইতে ব্যবসায়িকই বেশী। এখানে স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানী,ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানী এবং হাসপাতালগুলো জনগনের সাথে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় মেতে আছে। একমত। কিছু ঔষধ রয়েছে, যেমন, জ্বর, সর্দি, কফ, হার্ট-বার্ন এগুলো অন কাউন্টারে পাওয়া যায়। Health food store এ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ও আয়ূর্বেদিক ঔষধ পাওয়া যায়
পুজিবাদ ও সমাজতন্ত্র দু'টোই ইহূদীদের সৃ্ষ্টি।
এতে মানবতার কল্যান নেই। একটি পুজিবাদী
সমাজ থেকে এর চেয়ে বেশী আশা করা যায় না । আমেরিকায়ও Communist party
রয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন