ইউরেকা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৭ অক্টোবর, ২০১৬, ০৭:২৯:২৯ সন্ধ্যা
হাইওয়ে ১০১ ধরে ক্যালিফোর্নিয়ার ইউরেকা সিটির দিকে এগিয়ে চললাম। রাস্তা কোথাও খানিকটা পেচালো আবার সোজা চলেছে। চলতে চলতে কখনও বনের ভেতর যাচ্ছি আবার কখনও সাগরের তীরের দেখা পাচ্ছি। কিছু কিছু স্থানে দারুন সব লুকআউট আছে যেখানে মানুষ গাড়ি থামিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করছে। অসাধারন দৃশ্য। বেশ কিছু স্থানে রেস্ট এরিয়া তৈরী করা আছে,সেখানে থেমে টয়লেট ব্যবহার করা যায় এবং কিছুক্ষন বিশ্রামও নেওয়া যায়। আমি মাত্র একটি স্থানেই থামলাম। তাড়াতাড়ি যেতে যাচ্ছিলাম ,কারন ভারতীয় রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে পারব।
ইউরেকার প্রবেশ পথে হামবোল্ট বে'র অবস্থান। এটি এমন একটি বড় লেকের মত জলাধর যার একদিক অনেক সরু হয়ে সাগরের সাথে যুক্ত। এর একদিকের আকৃতি গোলাকার,অন্য দিকের আকৃতি একটু লম্বাটে। মাঝ বরাবর একটি সেতু ওপাশের সামোয়া উপদ্বীপকে সংযুক্ত করেছে। হাইওয়ে দিয়ে চলার সময় দেখা যায় জলরাশী রাস্তা বরাবর এসেছে। এই জলরাশীর অনেক কিনারে মজবুত কাঠের পুল তৈরী করা হয়েছে যা রাস্তার মত করে ঘিরে রেখেছে। সে এক অসাধারন জিনিস। এখানকার পানিতে তেমন ঢেউ নেই কারন সাগরের পানি বেশ ঘুর প্যাচে এখানে এসেছে। সুন্দর সব দৃশ্য দেখতে দেখতে ইউরেকায় চলে আসলাম।
হোটেলে চেকইন করেই ভারতীয় রেস্টুরেন্টের খোজে বেরিয়ে পড়লাম। খানিক বাদেই তা খুজে পেলাম,কিন্তু দুপুর প্রায় ৩টা বেজে গেছে,ফলে বুফে লাঞ্চ বন্ধ। মনে বেশ দু:খ পেলাম। পেটেও খুব ক্ষুধা। পাশের এক পিৎজার দোকানে গেলাম,কিন্তু দেখলাম সেখানকার বেশীরভাগ পিৎজাই শুওরের গোস্তে তৈরী। চলে আসলাম। আশপাশে আর ভালো কোনো খাবারের রেস্টুরেন্ট দেখলাম না। সাথে সিদ্ধ ডিম ছিলো,কলা,ফলমূল,চিপস,এমন্ড,কর্ণনাট ইত্যাদী কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুধার মাথায় মনে হল এগুলো টয়লেটে ফ্লাশ করে দেই। ওদিকে আমার অফিসিয়াল কাজ রয়েছে নিকটস্থ এলাকায়। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। কাজে চলে গেলাম পেটে ক্ষুধা নিয়ে। সেখানে টুকটাক কিছু খেলাম তবে ক্ষুধা মরে যাবে ভেবে খুব অল্প খেয়েছি। কাজ শেষে ভারতীয় রেস্টুরেন্টের দিকে গেলাম। বিকেল থেকেই রাতের খাবার শুরু হয় কিন্তু আইটেম অনুযায়ী বিল পরিশোধ করতে হবে। তা হোক,আগে জীবন বাঁচাই.....। গেলাম রেস্টুরেন্টে। এটা হল ভারতীয় শিখদের রেস্টুরেন্ট। ভেতরে দু একটা আরবী ক্যালিগ্রাফী আর অনেক হিন্দু দেবদেবীর ছবি দেখলাম। অর্ডার করলাম ভেড়ার গোস্তের কারী,ভাত,গার্লিক নান রুটি,চিকেন মাসালা। খাবার আসতে অন্তত ১৫মিনিট সময় লাগল কারন তৈরী করে খাওয়ায় এরা। এরপর খাবার দিল আর সব উড়িয়ে দিলাম পেটের ভেতর। বিল দেখে মনে হল এক আইটেমের দামেই দুপুরের লাঞ্চ হয়ে যেত। তবে টানলাম ব্যপক।
যদিও একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা হচ্ছিলো কিন্তু বিশ্রাম নিলেই সময় শেষ হয়ে যাবে তাই শহরটা প্রথমে ঘুরতে চাইলাম। শহরের ভেতর এক চক্কর দিয়ে চলে গেলাম ২৫৫ রোড ধরে সামোয়া উপদ্বীপের উদ্দেশ্যে। এখানে ব্রীজের নীচে পাশাপাশি ছোট ছোট দুটি দ্বীপ রয়েছে ,একটি উডলী আইল্যান্ড,আরেকটা ইন্ডিয়ান আইলান্ড। প্রথমে উডলীতে গেলাম। এটা খুব সুন্দর। এখানে একটি পোতাশ্রয় রয়েছে যেখানে সমুদ্রের মাছ ধরা জাহাজ ও নানান প্রমোদতরী নোঙ্গড় করে থাকে। ক্যাফে মেরিনা নামক একটি ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টও আছে যেখানে তাজা মাছের ফ্রাই খাওয়া যায় কিন্তু আমার পেট ভরা। আমি জাহাজঘাটের রাস্তা ধরে হাটাহাটি করলাম এবং দু একটা জাহাজেও উঠলাম। এখানে হাটাহাটি করতে বেশ লাগল। এবার ফিরে আসলাম,উদ্দেশ্য ইন্ডিয়ান আইল্যান্ডে যাওয়া। কিন্তু এটার আকার উডলীর থেকে বড় হলেও এতে প্রবেশ করার কোনো রাস্তা নেই। এটা বসবাসেরও অনুপযোগী। কেবল দুটো ঘর দেখলাম সম্ভবত কেউ মাঝ ধরা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করে। সেখানে পানি পথেই কেবল যাওয়া যায়।
চলে আসলাম সামোয়া পেনিনসুলা। নিউ নেভী বেজ রোড ধরে বামে চললাম শেষ মাথা পর্যন্ত। এখানে ইউ.এস কোস্টগার্ড স্টেশন রয়েছে এবং 'সামোয়া ফিল্ড' নামক এয়ারপোর্ট রয়েছে যা ছোট। এখানে বেশ কিছু মানুষ বসবাস করে বহু পূর্ব থেকে। এলাকায় অনেক পুরোনো বাড়ি দেখলাম। বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরোনো পোস্ট অফিস,ফায়ার সার্ভিস দেখলাম। এখানে অনেক মানুষের পেশা হল মাছ শিকার। একটা পুরোনো কিন্তু বিশাল রেস্টুরেন্ট দেখলাম যা বিখ্যাত। পূর্বে কারখানা শ্রমিকদের জন্যে মূলত এরা খাবার তৈরী করত। বর্তমানে এখানে অভিজাত লোকও আসে। বেশ দামী সামুদ্রিক খাবার এরা তৈরী করে। রেস্টুরেন্টের সামনে পুরোনো জাহাজের কিছু যন্ত্রাংশ,পুরোনো নৌকা ইত্যাদী দেখলাম।
এবার পেনিনসুলা ড্রাইভ ধরে অন্য পাশে গেলাম। টায়ার সিটি হয়ে ম্যাড রিভার কাউন্টি পার্কে আসলাম। খানিক ঘুরলাম। এদিকে রাস্তার একপাশে সাগর সৈকতের অবস্থান কিন্তু রাস্তা থেকে সেখানে যেতে নানান চড়াই উৎরাই পার হতে হয়। আমি দুটি স্থান থেকে চেষ্টা করেছি সাগর সৈকতে যেতে।
সামোয়ার এক অপরিচিত লোকালয়ে আসলাম। এক স্থানে গাড়ি পার্ক করে নির্জন এক ট্রেইল ধরে সমুদ্র সৈকতের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। খানিক পর উঁচু নীচু রাস্তা একেবারে ভৌতিক রূপ ধারন করল। চারিদিকে ঘন বন জঙ্গল,ভেতরে সরু পথ। কিছু কিছু স্থানে অন্ধকার। আমি হাটতেই থাকলাম। রাস্তা এক স্থানে বিভক্ত হয়ে ডানে ও বায়ে চলে গেছে। বামের রাস্তাটি ধরলাম। এটি উপরের দিকে উঠে গেছে। আরও বেশ খানিক সময় চলার পর কানে সাগরের ঢেউয়ের আওয়াজ আসল। এবার দ্রুতগামী হলাম। শুরু হল ব্যপক বালুকারাশি এবং বালিয়াড়ী বা বালির ঢিবি। সেটা পার হয়ে ওপাশে দেখলাম আরও বেশ কিছু উঁচু নীচু রাস্তা ,তার ওপাশে সাগর। বেশ রাগ হল। এত কষ্ট করে এসে দেখলাম আরও অনেক পথ গিয়ে সাগরে উঠতে হবে। বালিতে চলতে পা দেবে যায়,আমি দাড়িয়ে সাগরকে দেখলাম কিছুক্ষন। এবার ফিরে আসলাম কিন্তু কিছুদূর এসেই পথ হারিয়ে ফেললাম। আসার সময় উত্তেজিত ছিলাম তাই শুধু সামনেই চলেছি। আমি খানিকক্ষন দাড়িয়ে থেকে ভাবতে লাগলাম যে ঠিক কোন দিক থেকে এসেছিলাম। এবার এক রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য ছিলো অপরিচিত মনে হলে পেছনে চলে আসব এবং অন্য রাস্তা ধরে আগাবো। ওদিকে সন্ধ্যা হতে বেশী দেরী নেই। আমার ভয় করতে লাগল। ভাবছিলাম যদি হারিয়ে যাই !! ওদিকে মোবাইলের চার্জও তেমন নেই। আর এই বনে নেটওয়ার্কও নেই। আমি দৌড় শুরু করলাম। বেশ খানিকক্ষন দৌড় দিয়ে দেখলাম এক টিলার উপর থেকে নীচের রাস্তা দেখা যাচ্ছে,সেদিকে গেলাম। এবার সেই রাস্তা ধরে বায়ে এগিয়ে গাড়ি পার্কিংএ আসলাম। এখানে অবশ্য হারানোর রাস্তা নেই। যে ট্রেইলগুলো রয়েছে তার যে কোনোটি ধরে চললেই হয় রাস্তা ,না হয় সমুদ্র পাওয়া যাবে। কিন্তু এই অপরিচিত স্থানে পথ হারানোর হেপা আছে,সেটাই সমস্যার। এদেশে যে কোনো প্রয়োজনে ৯১১ নাম্বারে ফোন করলে সরকারী সাহায্য যেকোনো মূল্যে পৌছাবে তারা। প্রয়োজনে আকাশে হেলিকপ্টার ও বিশেষ বাহিনী নামিয়ে খোজাখুজি করবে,কিন্তু অতদূর চিন্তা করতেও ভয় করে।
এবার আরেক পার্কে আসলাম। মনে হচ্ছিলো এই পার্কের ঠিক ওপাশেই সাগর সৈকত। সে মোতাবেক একটা পায়ে হাটা রাস্তা ধরে চললাম। চলতেই থাকলাম। রাস্তা ফুরানোর নাম নেই। খানিক পর দেখী বিষয়টা ঠিক পূর্বের মতই। একটু দূর থেকে উচু নীচু রাস্তার উপর দিয়ে সাগর দেখা যায়। আবারও রাগ হল....। ফিরে আসলাম। আসলে সাগর সৈকতে পৌছতে হলে এখানে অনেক কষ্ট করে তবে পৌছতে হয়। অত ধৈর্য এবং সময় আপাতত নেই। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গেছে।
সাগর তীরের জনবসতীর ভেতরের রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকক্ষন চললাম এবং ফিরতি পথ ধরলাম। এরপর চলে আসলাম হোটেলে। মাগরীবের সময় বেশ ঘুম পাচ্ছিলো,সারাদিন অনেক ধকল গেছে। মাগরিবের সাথে এশার কছর পড়লাম। মানে দুই ওয়াক্ত একসাথে পড়লাম। মুসাফিরের জন্যে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড়। কিন্তু খানিক পর আবার শহর ঘুরতে বের হলাম। এবার রুমে এসে গভীরভাবে একটা ঘুম দিলাম।
খুব ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই ওরেগনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ক্লামাথ নামক একটি স্থানে যখন এসেছি তখনও সূর্য ওঠেনি। হঠাৎ রাস্তার ডানে তাকিয়ে দেখী শত শত হরিন। হাইওয়ে ১০১ ধরে দ্রত আগাচ্ছিলাম...সামনে কিছুদূর গিয়েই আবার পেছনে ফিরে আসলাম। এবার হরিনদের মাঝে এসে থামলাম। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। জীবনে প্রথমবারের মত এমন দৃশ্য দেখলাম। আমার ডানে ও বায়ে শত শত ছোট,মাঝারী ও বিশাল সব হরিন হেচে বেড়াচ্ছে। কেউ ভয় পাচ্ছেনা বরং তাদের মত চরে বেড়াচ্ছে। ঘাস খাচ্ছে একে অপরের গা ঘেসে দাড়াচ্ছে। কেউ কেউ আমার দিকে বোকার মত তাকাচ্ছে। সে এক অসাধারন দৃশ্য। কিছু হরিনের শিং বিশাল বড়,তাদের আকৃতি বড় ষাড়ের মত। সুন্দর স্নিগ্ধ সকালে এমন এক দল হরিনের সাক্ষাৎ একেবারে জান্নাতি অনুভূতি। আমি ক্যামেরায় বন্দী করলাম তাদেরকে। খানিকপর কিছু লোক এসেও তাদেরকে দেখতে লাগল। আবারও যাত্রা শুরু করলাম। খানিক দূর এসে দেখী এক স্থানে আবারও শত শত হরিনের পাল। পূর্বের চাইতে সংখ্যায় বেশী মনে হল। কিন্তু এবার আর থামলাম না। বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে হরিন শিকারের অনুমতিদেওয়া হয়। তবে এভাবে চরে বেড়ানোর সময় হরিন শিকারের অনুমতি নেই। এ সংক্রান্ত নানান নিয়ম নীতি রয়েছে যা লঙ্ঘন করলে বিশাল অংকের জরিমানা হয়। ফলে মানুষ আইন মেনেই শিকার করে।
ক্রিসেন্ট সিটি এসে ডাচ ব্রাদার্সের কফি কিনলাম এবং মনের সুখে চলতে শুরু করলাম। পথিমধ্যে এক কেসিনোতে এসে শরীরের পানি পরিবর্তন করলাম। ভেতরে দেখলাম শত শত গেম খেলার মেশিন। এসব আসলে জুয়ার মেশিন। বহু লোক এখানে পয়সা উড়ায়। আগে ভাবতাম ধনীরাই পয়সা উড়ায় কিন্তু মধ্যবিত্তরাও উড়ায় ধনী হওয়ার চিন্তায়। ধনী হোক বা না হোক নেশাটা থাকে,আর সেই নেশায় এরা সারাজীবন কেসিনোতে পয়সা উড়ায় এবং নানান লাটারীর টিকেট কাটে।
খানিক পর মনে হল...আরে,,আসার পথে তো এই কেসিনো দেখিনি !! তবে কি রাস্তা ভুল করলাম !! ঠিক,, যা ভেবেছি তাই। অন্তত ৩০মাইল রাস্তা ভুল করলাম। এরপর আবার একটি বাইপাস রাস্তা ধরে গ্রান্টসপাসের রাস্তা পেলাম এবং ওরেগনের উদ্দেশ্যে লতে শুরু করলাম। মনে শুধু ফুর্তি। ওহ হরিনগুলো একেবারে স্বপ্নের মত ছিলো !
বিষয়: বিবিধ
১১৯৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বুফে টা পেলে মনে হয় দুই বেলার খানাই উসুল করে নিতেন!
অষ্টেলিয়া, চায়নাতে ছিলেন। ও-লেখাগুলো খুব প্রানবন্ত ছিল। চালিয়ে যান, সাথে আছি। পরে
সব গুলো লেখা, বই আকারে প্রকাশ করতে পারবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন