ক্কাবার সত্য ইতিহাস-২
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১০:৫৫:২৩ রাত
বি:দ্র: রসূল(সাঃ)এর জীবনী গ্রন্থ লিখতে এসে ক্কাবার ইতিহাস বর্ণনা করা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমি রসূল(সাঃ)এর আগমনের পূর্বের আরবের অবস্থা উল্লেখ করার স্বার্থে আরবের ইতিহাস সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি এবং যেহেতু আরবের মানুষের ইতিহাস ক্কাবা কেন্দ্রীক,তাই ক্কাবার ইতিহাসও উঠে এসেছে।
“এবং সেই সময়কে শ্মরণ কর, যখন ক্কাবা ঘরকে মানব জাতির মিলনকেন্দ্র এবং নিরাপত্তার স্থান করেছিলাম এবং বলেছিলাম,তোমরা ইব্রাহিমের দাড়াবার স্থান মাকামে ইব্রাহিমকে সালাতের স্থান রূপে গ্রহণ কর। ইব্রাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ করেছিলাম ক্কাবা ঘর তাওয়াফকারী,ইতিকাফকারী,রূকু ও সেজদাকারীদের জন্যে আমার এ ঘরকে পবিত্র রাখতে......(আল-কুরআন,২:১২৫)
হযরত ইব্রাহিম(আঃ) নির্জন মরুভূমীতে শিশু ইসমাইল এবং স্ত্রী হাজেরাকে রেখে আসার পর সেখানে আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয় এবং আল্লাহ যমযম কূপের সৃষ্টি করেন। এটার পানি এমন যে, তাতে পিপাসা মেটার পাশাপাশি খাবারের কিছু চাহিদাও পূরণ হয়। এমনই একটি বরকতময় কূপের পাশে বা কূপকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে জনবসতী গড়ে ওঠে। (ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের অন্য স্ত্রী সারাহ’র গর্ভে আরও একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেন,তিনি ছিলেন হযরত ইসহাক(আঃ),সারাহ ছিলেন বন্ধ্যা এবং বৃদ্ধা কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের গৃহে মানব রূপে বিশেষ ফেরেশতা পাঠিয়ে পুত্র ইসহাকের সুসংবাদ দান করেন এবং একইসাথে ইসহাকের(আ পুত্র ইয়াকুব(আঃ)এরও সুসংবাদ দান করেন। -সূরা যারিয়াত,২৪-৩০) (তাওরাত আদী পুস্তক,অধ্যায় ১৬,পদ ২১ অনুযায়ী সেসময় ইব্রাহিম (আ এর বয়স ছিল ১০০, আর বাইবেল অনুযায়ী তার বয়স ছিল ৯৯। তাওরাতের একই অধ্যায়ের ১৬ পদ অনুযায়ী হাজেরা যখন ইসমাইলকে(আপ্রসব করেন,তখন ইব্রাহিমের(আবয়স ছিল ৮৬।)
উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, যখন ইব্রাহিম এবং ইসমাইল(আঃ) আল্লাহর আদেশে ক্কাবা নির্মান করলেন এবং এই কাজটিকে গ্রহণ করার জন্যে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন,তখন তা গৃহিত হল এবং আল্লাহ তায়ালা এই স্থানটিতে বরকত দান করলেন। এটাকে নিরাপদ নগরী বানালেন এবং মানব জাতির জন্যে এটাকে মিলনকেন্দ্র বানালেন। ক্কাবাকে ঘিরে ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতার জন্যে এখানে লোকে লোকারণ্য হতে শুরু করল। এ স্থানটি ব্যবসা বানিজ্যেরও স্থান হয়ে উঠল। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম(আঃ)কে মানব জাতির নেতা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং তার অনুসারীদেরকে মুসলিম হিসেবে নামকরণ করেন। তাকে(আঃ) মানব জাতির নেতা হিসেবে মনোনিত করা হলে তিনি আল্লাহর কাছে তার বংশধরদের নের্তৃত্ব-কর্তৃত্ব পাওয়ার ব্যাপারে জানতে চান। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জানান,যারা যালিম নয় তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। ইব্রাহিমের(আঃ) পুত্রদ্বয় ইসমাইল(আঃ) এবং ইসহাক(আঃ) এর বংশধর বাড়তে থাকে এবং পরবর্তীতে তারা বিশাল প্রভাবশালী হিসেবে জাতি গঠন করে। (উল্লেখ্য হযরত ইসহাকের(আঃ) বংশ থেকে বহু সংখ্যক নবী-রসূল এসেছেন কিন্তু ইসমাইল(আঃ) এর বংশ থেকে একমাত্র মুহাম্মদ(সাঃ) এসেছেন)
যদিও কিছু বর্ণনায় দেখা যায় মক্কার ইতহাস শুধুমাত্র ইব্রাহিম(আঃ)পর্যন্ত নয় ,বরং পৃথিবীর প্রথম মানব ইতিহাস এখান থেকে শুরু কিন্তু আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্য নেই। আল-কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি এটিই মানব জাতির জন্যে নির্ধারিত প্রথম ঘর। আর যেহেতু প্রথম মানব এবং নবী ছিলেন হযরত আদম(আঃ),তাই অনুমান করা যায় তার সন্তানগণ এ অংশেই ছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন দিকে তারা ছড়িয়ে পড়েছেন। তবে আদম(আঃ) থেকে হযরত ইব্রাহিম(আঃ) পর্যন্ত ইতিহাস আমাদের কাছে নেই। তাদের উভয়ের মাঝে কত সময় অতিবাহিত হয়েছে ,তার কোনো তথ্য নেই। এমনকি সে সময় সম্পর্কে অনুমান করারও কোনো উপায় নেই। আর তাওরাত,যাবুর,ইঞ্জিল(বাজারে শত রকমের ইঞ্জিল বা বাইবেল পাওয়া যায়) কিতাবসমূহ বিকৃত হওয়ার কারনে আমরা সেখান থেকে সঠিক তথ্য প্রাপ্ত হতে পারছি না। তবে যখন ইব্রাহিম(আঃ) ক্কাবার মূল স্থানটি প্রাপ্ত হন,তখন ক্কাবার আশপাশ জনশূণ্য ছিল। আমরা কুরআন সুন্নাহর বর্ণনা থেকে বুঝতে পারি এটি বহু বছর থেকেই বিরান ভূমী ছিল। পরবর্তীতে এটি হয়ে ওঠে একটি বিশাল জাকজমকপূর্ণ স্থান।
“রসূল(সাঃ) বলেন, হে আরববাসীগণ ! এই(ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের স্ত্রী) হাজেরাই তোমাদের আদী মাতা।”-(বুখারী ও মুসলিম)
পরবর্তীতে ইব্রাহিম (আঃ)এর বংশধররা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের দ্বারা বিরাট বিরাট রাজত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়। “আমি তো ইব্রাহিমের বংশধরদেরকে কিতাব এবং জ্ঞান- বিজ্ঞান দান করেছিলাম,আর আমি তাদেররকে এক বিশাল পরিমান রাজত্বও দান করেছিলাম।”-(আল-কুরআন,৪:৫৪)
আরবের আদী ইতিহাস সম্পর্কে লিখতে বসলে,পাঠক ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলবেন। কারণ সেখানে বিশাল বিশাল বংশ,গোত্র ছিল এবং একেক গোত্রের একাধিক শাখা প্রশাখা বিভিন্ন দিকে গিয়ে আবারও বিশাল আকার ধারন করেছিল। এ সংক্রান্ত বিষয়ে বহু কিতাবও লিখিত হয়েছে ,তবে কোনো কিতাবই বিতর্কের উধের্ব উঠতে পারেনি। কারণ এত বিশাল তথ্য নিখুঁতভাবে প্রাপ্ত হওয়া সম্ববপর নয়। তাই সঙ্গত কারনেই আমি কিছুটা সার সংক্ষেপ ব্যবহার করেছি।
হযরত ইসমাইল(আঃ) ১২টি পুত্র সন্তান লাভ করেন। তারা হলেন: ১.নাবেত, ২.কায়দার,৩.আদবাইল,৪.মোবশাম,৫.মেশমা,৬.দুউমা,৭.মাইশা,৮.হাদদ,৯.তাইমা,১০.ইয়াতুর,১১.নাফিস,১২.কাইদমান (এবং নাসিমা নামক একটি কণ্যা ছিল,তাকে বিয়ে দেওয়া হয় হযরত ইসহাক(আএর পুত্র ঈসু ইবনে ইসহাকের সাথে-ইবনে কাসীর-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ২য় খন্ড) । এই ১২টি সন্তানের মাধ্যমে ১২টি গোত্র তৈরী হয় এবং তারা মক্কাতেই বসবাস শুরু করে। তারা ইয়েমেন,মিসর,সিরিয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করে জিবীকা নির্বাহ করত। পরবর্তীকালে এরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইসমাইল(আঃ)এর পুত্রগনের মধ্যে প্রথম দুই পুত্র নাবেত এবং কায়দার সম্পর্কে অল্প তথ্য পাওয়া গেলেও অন্য পুত্রদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়না। তার পুত্র নাবেতের বংশধররা অত্যন্ত শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং আরবের আশপাশেও তারা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তৎকালীন সময়ে তাদের সমকক্ষ কেউ ছিলনা। তাদের পরে আসে রোমকদের যুগ। রোমকরা নাবেতীদেরকে পরাজিত করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
দ্বিতীয় পুত্র কায়দারের বংশধর মক্কায় বসবাস শুরু করে এবং তাদের ব্যপক বংশবৃদ্ধি ঘটে। পরবর্তীতে আসে আদনান এবং তার পুত্র মায়াদ এর সময়কাল। এরা ছিলেন ব্যপক প্রভাবশালী। আদনান ইসমাইল(আঃ)এর কততম উত্তর পুরুষ তার সঠিক ইতিহাস নেই। অনেকের মতে আদনান থেকে হযরত ইব্রাহিম(আঃ)পর্যন্ত চল্লিশ পুরুষের ব্যবধান রয়েছে। তবে সত্য শুধু আল্লাহই জানেন। তবে রসূল(সাঃ) তার নিজের বংশধারা বর্ণনার সময় আদনান পর্যন্ত এসে থেমে যেতেন বলে কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়। রসূল(সাঃ)বলেছেন বংশধারা বিশেষজ্ঞরা ভুল তথ্য পরিবেশন করে থাকে। তবে আদনানের পুত্র মায়াদ পর্যন্ত বংশধারা ইতিহাসে পাওয়া যায়(আদনানের আরেক পুত্রের নাম আক্)। মায়াদ থেকে বংশধারা বিভক্ত হয়ে বহু শাখায় বিস্তৃত হয়েছিল।
সীরাতে ইবনে হিশামে মায়াদের বংশধারা বর্নিত হয়েছে এভাবে: মায়াদের ৩ পুত্র: মুদার,রাবিয়া,আনমার। মুদারের ২ পুত্র: ইলিয়াস,আইলান। ইলিয়াতের ৩ পুত্র: মুদরাকা,তাবেখা,কামায়া। মুদরাকার ২ পুত্র: খুজাইমা,হুজাইল। খুজাইমার ৪পুত্র: কেনানা,আসাদ,ইসদাহ,আল হাউন। কেনানার ৪পুত্র : নাদার(ইবনে হিশাম নাদারের আরেক নাম কুরাইশ বলেছেন,এর থেকেই কুরাইশ বংশ নামকরন করা হয়েছে। অন্যরা বলেছেন মালেকের পুত্র ফিহিরের আরেক নাম ছিল কুরাইশ),মালেক,আব্দ-মানাহ,মিলকান। নাদারের ২পুত্র: মালেক,ইয়াখদুধ। মালেকের ১পুত্র: ফিহির। ফিহিরের ৪পুত্র:গালেব,মুহারিদ,হারেস,আসাদ। গালেবের ২পুত্র:লুয়াই,তাইম। লুয়াইএর ৪পুত্র:কাব,আমের,উসামা,আউফ। কাবের ৩পুত্র: মুরদা,আদী,উসাইছ। মুরদা’র ৩পুত্র: কিলাব,তাইম,ইয়াকযাহ। কিলাবের ২পুত্র: কুসাই,যুহরাহ। কুসাইএর ৪পুত্র: আবদে মানাফ,আবদুদ-দার,আব্দুল উজ্জাহ,আব্দ কুসাই। আবদে মানাফের ৪পুত্র: হাশিম,আব্দ শামস,মুত্তালিব,নওফেল। হাশিমের পুত্র আব্দুল মুত্তালিব। আব্দুল মুত্তালিবের ১০টি পুত্র এবং ৬টি কন্যা ছিল। পুত্রগণ: আব্বাস,হামজা,আব্দুল্লাহ,আবু তালিব,যুবায়ের,হারেস,হাজলা,মুকাওয়েম,দিরার,আবু লাহাব। কন্যাগণ: সাফিয়া,উম্মে হাকিম আল বায়দা,আতিকা,উমায়মা,আরওয়া,বাররাহ।
-(তারিখে আরদুল কুরআন২য় খন্ড-পৃঃ৭৭-৮৬,তিবরী,উমাম আল মূলুক,২য় খন্ড:পৃ-১৯১-১৯৪,আল-আলাম,পৃ:৫-৬,আর রাহিকুল মাকতুম,ইবনে হিশাম,ঈমাম বুখারীও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন)
অপরদিকে হযরত ইব্রাহিমের(আঃ) আরেক পুত্র ইসহাক(আঃ) থেকে আসে হযরত ইয়াকুব(আঃ)। এবং ইয়াকুব(আঃ)এর আরেক নাম ছিল ইসরাইল। তার বংশধরদেরকে তার নামানুসারে বনী ইসরাইল বলা হয়। হযরত ইয়াকুব(আএর ১১টি পুত্র ছিল(ইউসুফ আলাইহিস সালাম ছিলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালামের পুত্র) এবং সেখান থেকে তাদের ব্যপক বংশ বিস্তার ঘটে। এই বনী ইসরাইলের ওপর আল্লাহ তায়ালা প্রচুর নিয়ামত বর্ষণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে তার অনেকগুলি উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তারা বারবার আল্লাহর নাফরমানী করেছে এবং গজবের শিকার হয়েছে। বনী ইসরাইলে আল্লাহ তায়ালা বহু সংখ্যক নবী পাঠিয়েছেন। কথিত আছে এই বনী ইসরাইল দুই শতাধিক নবীকে হত্যা করেছে। হযরত ইসহাক(আঃ)এর বংশধররা ব্যপক বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তারাও বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। বনী ইসরাইলের অনেকে আরব এবং এর আশপাশে বসতী গড়ে তোলে। বনী ইসরাইলের সর্বশেষ নবী ছিলেন হযরত ঈশা(আঃ)। তার(আঃ) অনুপযুক্ত এবং বিভ্রান্ত অনুসারীদের(খ্রিষ্টান) একটি ক্ষুদ্র অংশও আরবে বসবাস করত।
ইসমাইল(আকে জুরহাম গোত্রের লোকেরা নেতা মনোনিত করেছিল প্রথম থেকেই। তার পুত্রগণও মক্কার শাসক কাজ পরিচালনা করতেন এবং আরবের বাইরে গিয়েও তারা পৃথক পৃথম রাজ্য শাসন করেন, কিন্তু পরবর্তীতে ইসমাঈল(আএর সন্তানদের থেকে মক্কার শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় জুরহাম গোত্র। বলা হয়ে থাকে জুরহাম বা কাহতানী বংশ এসেছে হযরত নূহ(আ থেকে। জুরহাম গোত্র প্রথম দিকে ভাল থাকলেও পরবর্তীতে পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং ক্কাবা চত্তরে পাপ কাজ করতে থাকে। কথিত আছে আসাফ ইবনে বুগা এবং নায়লা বিনতে ওয়াইল নামক নারী ক্কাবা ঘরে ব্যভীচারে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ গযব নাযিল করে তাদেরকে পাথরে পরিণত করে দেন। এ বিষয়টি মানুষ জানতে পেরে যাতে সাবধানী হয়,তার কারনে মূর্তী দুটিকে ক্কাবার কাছাকাছি একটি স্থানে রাখা হয়,কিন্ত পরবর্তীতে আসাফ এবং নায়লার মূর্তীকে পূজা করা শুরু হয়। তাদেরকে দেব-দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়।
জুরহাম গোত্র যখন পবিত্র ক্কাবা চত্তরে সীমাহীন পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং ক্কাবাকে অসম্মান করতে থাকে ,তখন ইয়েমেনের বাধ ভাঙার পর মারাত্মক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশত্যাগী গোত্র,যারা খুজা’আ(ইয়েমেন ত্যাগ করে সিরিয়া অভিমূখে রওনা হওয়ার পর তারা তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে পৃথক হয়ে যায় ফলে তাদের নাম হয় খুজা’আ বা বিচ্ছিন্ন দল ) নামে পরিচিত ,তারা জুরহামের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তারা জুরহামকে যুদ্ধে আহবান করে। বনূ ইসমাইল(আ জুরহামের প্রতি বিতশ্রদ্ধ থাকার কারনে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। যুদ্ধে খুজা’আ গোত্র বিজয়ী হয়। জুরহাম গোত্রকে মক্কা থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন তাদের নেতা আমর ইবনে হারিস ইবনে মুদাদ জুরহামী রাগে ক্ষোভে ক্কাবা শরীফ থেকে দুটি মূল্যবান বস্তু রূকন ও হাজরে আসওয়াদ খুলে নেয়,একইসাথে অলংক্রিত তরবারীসমূহ,বর্ম নিয়ে যমযম কূপের ভেতর নিক্ষেপ করে। আরও কিছু মূল্যবান বস্তু তারা যমযম কূপের ভেতর নিক্ষেপ করে ইয়েমেনে চলে যায়। ....পরবর্তীতে বানু বকর ও খুজা’আ গোত্রের উপগোত্র গাসসানীরা মক্কার কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। কুরাইশ গোত্র তখন পরষ্পর বিচ্ছিন্ন এবং বনূ কিনানার বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
-(ইবনে কাসীর-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,২য় খন্ড
খুজা’আ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী গোত্র। সকল ক্ষমতা মূলত: তাদের হাতেই ছিল। পুরুষানুক্রমে তারা ক্কাবার শাসনভার গ্রহণ করে। তাদের শেষ ব্যক্তী ছিল হালিল ইবনে হাবিশ্যিয়া ইবনে সালুল ইবনে কাব ইবনে আমর ইবনে রযী’আ খূযাঈ। হালীল ইবনে হাবিশ্যিয়ার কন্যা হিরাকে বিয়ে করেন বনূ আদনানের কুসাই ইবনে কিলাব। এরপর ক্কাবা শরীফ বা মক্কার সকল কতৃত্ব চলে যায় কুসাই ইবনে কিলাবের হাতে। অর্থাৎ হযরত ইসমাঈল(আএর বংশে। ....খুজায়ীরাই প্রথম আরবে মূতৃী পূজার প্রচলন করে। এই অপকর্মের মূল হোতা ছিল তাদের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও অগাধ সম্পদের অধিকারী নেতা আমর ইবনে লুয়াই। সে হজ্জের মৌসুমে দশ হাজার উট জবাই করত এবং মক্কাবাসীদেরকে সে আপ্যায়ন করত। তাদেরকে মধু,ছাতু,ঘি দিয়ে উপাদেয় হালুয়া তৈরী করে খাওয়াত। আরববাসীদের ওপর তার প্রভাব ছিল ব্যপক এবং তার কথাকে তারা শরিয়তের মত অনুসরণ করত। আমর ইবনে লুয়াই সিরিয়া ভ্রমন করে এবং সেখানে বালকা অঞ্চলের মায়াব নামক স্থানে সে স্থানীয় আমালীক সম্প্রদায়কে মূর্তীপূজারত অবস্থায় দেখেন। তিনি তাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতে তারা জানায় যে,মূর্তীর কাছে কিছু চাইলে তা পাওয়া যায়,এমনকি বৃষ্টির জন্যে তার কাছে প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হয়। বিষয়টি তার ভাল লাগে এবং তিনি তাদের কাছ থেকে একটি মূর্তী নিয়ে ক্কাবাঘরে প্রতিষ্ঠা করেন।
-(ইবনে কাসীর-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,২য় খন্ড)
ইবনে ইসহাক মূর্তীপূজার প্রচলন সম্পর্কে বলেছেন যে, প্রথম দিকে ক্কাবাকে মহা পবিত্র মনে করে আরবগণ বা অন্যরা ক্কাবার স্থান থেকে ছোট ছোট পাথর সংগ্রহ করে কাফেলা পরিচালনা করত। উদ্দেশ্য ছিল তারা বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে এই পবিত্র পাথরের কল্যানে। এরপর কাফেলা কোনো দূরবর্তী স্থানে গেলে আল্লাহ কল্যাণ বর্ষণ করবেন ও বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন এই আশায় এসকল পাথরের চারপাশে তাওয়াফ করা শুরু করে। তারা ভাবত -তারা ক্কাবাকেই তাওয়াফ করছে,কারণ এটি ক্কাবার পাথর। পরবর্তীতে তারা পছন্দনীয় যেকোনো পাথর পেলেই তাকে পবিত্র মনে করত এবং কল্যানের আশায় তাকে বিভিন্নভাবে সম্মান করতে শুরু করে। এভাবে যুগে যুগে বিষয়টি বিকৃত হতে হতে পুরোপুরি মূর্তীপূজায় রূপান্তরিত হয়।
ইবনে কাসীর আবু রাজা আতারদীর আস সাহীহ গ্রন্থের একটি বর্ণনা করেছেন -‘জাহেলী যুগে আমরা এমন ছিলাম যে,কোনো পবিত্র মনে হওয়া পাথর না পেলে আমরা মাটি দিয়ে একটু উঁচু স্থান তৈরী করতাম, এরপর সেখানে একটি বকরী এনে দুধ দোহন করে তারপর নাজরানা পেশ করতাম। এরপর মাটির স্তুপের চারিদিকে তাওয়াফ করতাম।’
তবে তারপরও ইব্রাহিম(আএর কিছু সঠিক রিতিনীতি তারা পালন করত এবং বায়তুল্লাহ শরীফকে সম্মান করত। তারা তাওয়াফ ও ওমরা করা,আরাফার ময়দান ও মুজদালিফায় অবস্থান করা,পশূ কুরবানী করা, হজ্জ ও ওমরার জন্যে ইহরাম বাধা ইত্যাদী পালন করত। কিনানা ও কুরাইশ গোত্র তাওয়াফের সময় উচ্চস্বরে আজকের দিনের মতই তালবিয়া পাঠ করত : লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ! লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক,ইন্নাল হামদা,ওয়ান নিয়ামাতা,লাকাওয়াল মূলক,লা শারিক্কালাকা....অর্থাৎ বান্দা হাজির বান্দা হাজির..বান্দা হাজির হে আল্লাহ,আপনার কোনো শরিক নেই। কিন্তু এরপর তারা অতিরিক্ত উচ্চারণ করত: হে আল্লাহ ! কিন্তু আপনার একটি শরিক আছে তবে আপনি তার মালিক এবং তার মালিকানাধীন সবকিছুর মালিক ! এ প্রসঙ্গে সূরা ইউসুফের ১০৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-“তারা আল্লাহকে স্বীকার করে কিন্তু আল্লাহর সত্ত্বার সাথে শরীক করে”। তারা যখন তালবিয়া পাঠ করত এবং বলত বান্দা হাজির, ইয়া আল্লাহ আপনার কোনো শরিক নেই, তখন রসূল(সা তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলতেন,যথেষ্ট হয়েছে এবার থামো। অর্থাৎ এরপরই তারা যাতে আল্লাহর শরীক স্থাপন না করতে পারে তাই তাদেরকে থামিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন।
-(ইবনে ইসহাক, ইবনে কাসীর বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য়)
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে-রসূল(সাবলছেন-আমি আমর ইবনে আমীর খুযাঈকে জাহান্নামে দেখেছি সে তার নাড়িভূড়ী হেচড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে”। বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা মতে সে আরও কিছু রকমের রসম রেওয়াও চালু করেছিল। ইবনে হিশামের বর্ণনায় এসেছে-আমর ইবনে লুয়াই হুবল দেবতার মূর্তী প্রথম ককাবাগলে স্থাপন করে। তবে ইনি আমর বিন লুয়াই ছিলেন কিনা তা নিয়ে মতদ্বৈততা আছে। সেটা না হলেও এটা বলা যায় যে, খুজা’আ গোত্রই এই পাপপ্রথা চালু করেছিল। সর্বপ্রথম মূর্তীপূজা শুরু করে হযরত নূহের(আ সম্প্রদায়। আল্লাহ তায়ালা সূরা নূহের ২৩ নং আয়াতে বলেন-এবং তারা বলেছিল-তোমরা কখনও পরিত্যাগ করোনা তোমাদের দেব-দেবীকে,পরিত্যাগ করোনা ওয়াদ,সওয়া,ইয়াগুস,ইয়ায়ুক ও নাসরকে।”
ইবনে আব্বাস(রাবলেন- ওয়াদ,সওয়া,ইয়াগুস,ইয়ায়ুক ও নাসর ছিল হযরত নূহ(আএর সম্প্রদায়ের সৎকর্মশীল লোক ছিলেন। তারা আল্লাহর বিধানকে ভালভাবে মেনেছিলেন এবং পরহেজগারীতে সুবিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর মানুষ তাদের কবরে অবস্থান করতে শুরু করে এবং পরবর্তী প্রজন্ম এসব কবরে পূজার্চনা করতে শুরু করে। এবং এদের নামে মূর্তী গড়ে বিভিন্ন স্থানে তার পূজার্চনা শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল এসবের মাধ্যমে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। ইবনে ইসহাক বলেন-ওয়াদ এর মূর্তী স্থাপিত হয়েছিল দুমাতুল জান্দালে বনী কালবের কাছে,সওয়া ছিল বনী হুযায়লের উপাস্য,ইয়াগুস ছিল জারশ এলাকায় বনী আনউম ও বনী মিযহাজ গোত্রে। ইয়াউক ছিল ইয়েমেনের হামদান এলাকায়,এটির তত্ত্বাবধায়ক ছিল বনী খায়ওয়ান। নাসর ছিল হিমইয়ার অঞ্চলে ,কিলা গোত্র ছিল এর উপাসক।
-(ইবনে ইসহাক,ইবনে হিশাম-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,২য় খন্ড)
বিষয়: বিবিধ
১৫৪০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন