ওরেগন কেভস , এক অসাধারন ভ্রমন !!!
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:৩১:৪৫ সকাল
আমার অনেক ভ্রমনই অফিসিয়াল কাজের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু আমি কাজের চাইতে ভ্রমনকেই মূল্যায়ন করি বেশী,যদিও কাজ না থাকলে পুরো ভ্রমনের অস্তিত্বই হয় চাকুরী ছাড়া উপরীর মত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে দুনিয়ার অনেক সুন্দর সুন্দর স্থানসমূহ ভ্রমনের সৌভাগ্য দান করেছেন। আমি যখন কোনো স্থান নিয়ে প্রচন্ড উদগ্রীব হয়ে উঠি তখনই তিনি কোনো একটা ব্যবস্থা করে দেন আমার সাধ্যের ভেতর। এবার একটি সুযোগ তৈরী হল আর এক ঢিলে কয়েক পাখি মারার পরিকল্পনা করলাম ক্যালিফোর্নিয়া বরাবর।
"ওরেগন কেভস"
৩রা সেপ্টেম্বর ভোর ৪.৩০ ওরেগন কেভস বরাবর রওনা হলাম, সাথে জিম। জিম'কে সাথে নেওয়ার সকল খরচ আমার। সে মানুষের সাথে মিশেনা বললেই চলে। সে কারো সাথে রুম শেয়ার করেনা ফলে তার কারনে হোটেলের অতিরিক্ত রুম ভাড়া করতে হয়। এতে ভ্রমনের খরচ বেড়ে যায়,তারপরও তাকেই পছন্দ,কারন আর কোনো গতি নেই।
সকালে হাইওয়ে-৫ ছিলো একেবারে ফাঁকা। এক টানে রোজবার্গ নামক এক স্থানের রেস্ট এরিয়াতে আসলাম। হাইওয়ের বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত মনোরম রেস্ট এরিয়া তৈরী করা হয়েছে। সেখানে একটি বিরাট এলাকাকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা, যাতে মানুষ প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে পারে এবং টুকটাক কিছু কাজ সমাধা করে নিতে পারে। বেশীরভাগ রেস্ট এরিয়াই মন কেড়ে নেওয়ার মত। এত সুন্দর চকচকে ও দামী টয়লেট ,বড় শেড,বিশাল গাড়ি,মোটরহোম,আরভি পার্কিং দেখে ভাবছিলাম স্টেটের কিছু নি:স্বার্থ সার্ভিস আসলেই উৎকৃষ্ট।
এবার চলে আসলাম গ্রান্টস পাস পার হয়ে কেভ জংশন। এখানেই ওরেগনের পাহাড়ী গুহা সমূহের দিকে চিকন একটি রাস্তা চলে গেছে পূর্ব দিকে। কিছুদূর গিয়ে আঁকা বাঁকা পাহাড়ী পথ। সে পথে প্রায় আধা ঘন্টা ড্রাইভ করলেই ওরেগন কেভস। সিসকিউ পাহাড়ী এলাকায় এটি অবস্থিত। গুহাটি যে পাহাড়ে,তার উচ্চতা সাড়ে ৪ হাজার ফুটের মত।
প্রবেশ করেই মুগ্ধ হলাম কাঠের কারুকাজ দেখে। এখানে থাকার জন্যে একটি লজ আছে এবং ফরেস্ট সার্ভিস কর্তৃপক্ষের ভ্রমন সংক্রান্ত বড় ভবন। তারা এটা ১৯০৯ সাল থেকে দেখভাল করছে। পুরোটাই কাঠের তৈরী এবং পুরোনো ধাচে গড়া। সকাল ৯টার পর আসলাম। আগেই অনলাইনে মাথাপ্রতি ১০ ডলারে ট্যুর টিকেট কাটা ছিলো। সময় ছিলো সকাল ১০টা। কিন্তু তারা বলল,ইচ্ছা করলে সকাল ৯.৩০ মিনিটের ট্যুর করতে পারেন। স্বানন্দে রাজি হলাম,কারন তাতে সময় বাচে।
মার্সি নামক গাইড আমাদের গ্রুপকে বুঝালো নানান বিধিনিষেধ ।ভেতরের তাপমাত্রা ও পরিবেশ সম্পর্কে জানালো । কিভাবে মাথা নীচু করে হাটুতে ভর করে হাটতে হবে তা জানানোর পাশাপাশি প্রাকটিস করালো। ভেতরে যত রকমের পাথর রয়েছে তার স্যাম্পল দেখালো এবং এর উপর বিশেষ এক এসিড রেখে পাথরের সাথে এটার প্রতিক্রিয়া দেখালো।
ভেতরের তাপমাত্রা ছিল সম্ভবত ৪৪ডিগ্রী ফারেনহাইট বা প্রায় ৬/৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শীতের পোষাক নিয়েই প্রবেশ করা উত্তম কিন্তু এখানে তারা পোষাকও সরবরাহ করে। ট্যুর শেষে সেটা আবার বিশেষ বাক্সে রেখে দিতে হয়। আমি এখান থেকেই পছন্দ করে একটা জ্যাকেট গায়ে দিলাম,যদিও তা গায়ে দেইনি,কারন ততটা ঠান্ডা আসলে লাগেনি।
এনথ্রোপলোজিস্ট ভদ্র মহিলা নানান সব উপদেশ আর নিষেধাজ্ঞার বয়ান করল। বারবার যা বলল তা হল,কোনোভাবেই ভেতরের পাথরে হাত দেওয়া যাবেনা। এমনকি একস্থানের পাথরে হাত দিলে ৫০ হাজার ডলার জরিমানা হতে পারে বলেও জানালো। ভেতরে প্রবেশ করলাম।
এর আগে আমি ওয়াশিংটনের এক গুহায় প্রবেশ করেছিলাম কিন্তু সেটা আর এটা ভিন্ন। সেটা ছিলো একটি বিশাল টানেল। এই গুহাসমূহ তৈরী হয়েছে অনেক মূল্যবান পাথর সমূহে। এলিজা ডেভিডসন নামক নিকটস্থ এলাকায় বসবাসকারী একজন ব্যক্তি এটি ১৮৭৪ সালে আবিষ্কার করে। এই পাহাড়ের মূল উপাদান ছিলো লাইমস্টোন যা ১৯০ মিলিয়ন বছর পূর্বে বিবর্তিত হয়ে মার্বেল পাথরে রূপ লাভ করে। অবশ্য গুহাগুলো তৈরী হয় মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর পূর্বে। যাইহোক আমরা এক লাইনে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ অসাধারন !
ভেতরের গুহাগুলো অত্যন্ত দূর্গম হওয়ায় হাটার রাস্তাগুলো স্টিল এবং কোথাও কংক্রিট দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। তবে তা এতটাই সতর্কতার সাথে করা হয়েছে যাতে গুহার অবয়বের কোনো ক্ষতি না হয়। কখনও মাথা নীচু,কখনও উচু করে সতর্কতার সাথে চলতে থাকলাম। গাইড একেকটি গুহার কাছে নিয়ে সেটার উপাদান ও ইতিহাস সম্পর্কে বয়ান করতে থাকল। বলল, পূর্বে মানুষের শরীরের সংস্পর্শে গুহার পাথরে পরিবর্তন এসেছে। এখানে লাখ লাখ বাদুড় ছিলো যারা মানুষ বাহিত জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ভেতরের বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে পুরোপুরি আলোকিত নয়,আধোছায়া। আমি চারিদিকে তাকাচ্ছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। প্রচন্ড অসমতল গুহা। খুবই দূর্গম। কোনো কোনো স্থানে বড় বড় খাদ,যেখানে পড়ে গেলে মৃত্যু মোটামুটি নিশ্চিত। ভেতরে চলাচলের পুরো রাস্তাসমূহের আয়তন প্রায় ৪৬০০ মিটার। চলতে থাকলাম সতর্কতায়।
কোথাও কোথাও গাইড আলো নিভিয়ে অন্ধকার তৈরী করছিলো এবং তখন বুঝলাম কবরের অন্ধকার। নিজের হাত দেখারও সুযোগ নেই। তখন শুধু নীচ দিয়ে ক্ষিন ধারায় প্রবাহিত পানির ধারার শব্দই ধ্বনিত হচ্ছিলো। গুহার নীচ দিয়ে পানির ধারা বহমান। পাথর ভেদ করে বা চুইয়ে আসা আসা পানি এটি। হাটতে হাটতে একটি বন্ধ দরজার কাছে আসলাম। এটি একটি সুড়ঙ্গ পথ ধরে আসা খুব ঠান্ডা বাতাস প্রতিহত করে। দরজা খোলার পর ঠান্ডা বাতাসের উপস্থিতি টের পেলাম। এরপর সে পথ ধরে হাটতে থাকলাম। রাস্তা কখনও উপরে যাচ্ছে,কখনও নীচে। কখনও ধাপে ধাপে অন্তত ৪ তলা সমান উচুতে উঠে যাচ্ছে। চারিদিকে গহা আর গুহা। নানান কারুকাজ। কিছু কিছু স্থানে সাদা পাথরের মত দেখলাম। গাইড বলল এগুলো আসলে ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়া মারা গিয়ে এমন আকার ধারন করেছে। উপরের ছাদে সুচালো পাথরের অস্তিত্ব। কোনো কোনো পাথর দেখে মনে হচ্ছে এটি যেন দীর্ঘক্ষন জ্বলা কোনো একটি মোমবাতি,যার চারিপাশে গলিত মোমের আস্তরন। উপররের ছাদ থেকে গলিত মোমের মত পাথরখন্ড ঝুলছে। এসবে হাত দেওয়া একেবারেই নিষেধ,কিন্তু আমি প্রত্যেকটা পাথর খন্ডে হাত বুলিয়ে অনুভব করেছি গোপনে। চিন্তা করছিলাম একাজ না করলে সারা জীবন আফসোস থাকবে। আফসোস করার লোক আমি না।
আমি চারিদিকে তাকিয়ে শুধু মুগদ্ধ হচ্ছিলাম আর বার বার বলছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। পৃথিবীতে কত সব সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে,মানুষ আজো তা জানেনা। আর আল্লাহ আমাকে তার কিছু কিছু উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছেন। শুকরিয়া আদায়ের শক্তি ও সাধ্যটাও আল্লাহর দেওয়া। এমন কোনো অবস্থা নেই,যে সময়ের শুকরিয়া আদায় করলে যথাযথ হক আদায় করা হবে ! আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারছি,এটার শুকরিয়া কি দিয়ে আদায় করব !
গুহার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের পাথরের কাঁরুকাজ রয়েছে। কিছু পাথর হতে চুইয়ে চুইয়ে পানির ফোটা পড়ছে নীচে। পুরো রাস্তাটাই ভেজা ভেজা। কোথাও হালকা পানি। কোথাও বড় গুহা,কোথাও ছোট। আমরা চলে আসলাম সবচেয়ে বড় গুহায়। এটা দেখে মনে হচ্ছিলো হল অডিটোরিয়াম । আমরা যেখানে এসে দাড়ালাম তার সামনে একটি ছোটদেওয়াল। এর ওপাশে বড় গুহা। সিড়ি নেমে গেছে নীচে এরপর সেখান থেকে খাড়া অন্তত ৫০ ফুট উপরে। সেখান থেকে আরেকটি সিড়ি আরও উপরে উঠে গেছে। শুনেছি এখানে একবার কনসার্টও হয়েছে। অবশ্য অনেক লোক সমাগমের স্থান এটি নয়।
তবে সবথেকে ভালো লাগল কিছু গুহায় এসে। এখানে উপর থেকে গলিত মোমবাতির মত পাথর এসে নীচের অংশে মিশে পিলার তৈরী করেছে। আর উপরের অংশে জেলি ফিশের মত আকৃতিতে সেগুলি ঝুলে রয়েছে। বিশেষ ঝাড় বাতিও মনে হতে পারে। অতি ভালো মানের ক্যামেরা ছাড়া ভালো ছবি পাওয়া সম্ভব নয়। একটি গুহায় ছোট্ট সাইজের একটা বাদুড় ছিলো ,আমরা একে একে গিয়ে তা দেখে আসলাম। সেটা এতটাই ছোট যে হাতের তালুতে এরকম ৩টি অন্তত রাখা যাবে। এক স্থানে মাকড়শা দেখলাম,এরা ফাঙ্গাস থেয়ে বেঁচে থাকে। এক গুহায় ছোট ভাল্লুকের দেহাবশেষ দেখলাম যা প্রায় দেড় লাখ বছরের পুরোনো।
গুহার এই সৌন্দর্যের তুলনাই হয়না। চিন্তা করছিলাম এখনও কত কিছুই যে অনাবিষ্কৃত রয়েছে তার কোনো খবর নেই। দেড় ঘন্টার ট্যুরে অনেক কিছু দেখেছি কিন্তু সবকিছু মনে করতে পারছি না।
গুহা থেকে বাইরে বের হলাম। পুরো পাহাড়টি মার্বেল পাথরের,অবশ্য মাটিও আছে। এবার গুহার উপরের অংশে উঠতে থাকলাম ট্রেইল ধরে। উপরে ও চারিদিকে ঘন জঙ্গল। পাথরী রাস্তা ধরে উপরে উঠলাম। এটি উচ্চতায় সাড়ে ৫ হাজার ফুট প্রায়। খুব ভালো লাগল। আমি একাই গেলাম। মনে হচ্ছিলো যদি বাঘ ভাল্লুক থাকে ! ওরেগনে অবশ্য প্রচুর ভাল্লুক রয়েছে। আর ছোট সাইজের বাঘ রয়েছে,তবে মানুষকে আক্রমন করার তেমন রেকর্ড নেই। এরা বেশ খাবার দাবার পায় তাই সন্তুষ্ট। সুন্দরবনের বাঘের মত এরা মানুষের উপর ত্যাক্ত বিরক্ত নয়। হাটতে হাটতে হঠাৎ ৩টা হরিন দেখলাম রাস্তার উপর। এরপর দেখী আরও একটা। ছোট্ট একটা হরিন মা হরিনের থেকে দুধ পান করল আমার সামনে। আমার উপস্থিতিতে তারা তেমন গা করল না। আমি ছবি তুলতে থাকলাম,তাতেও আপত্তি নেই। সম্ভবত এদের বংশের কেউ কখনও শিকারীর ধাওয়া খায়নি। নইলে ছুটে পালাতো। দেখে খুব মজা লাগল,যে আমি একা পথে হাটছি আর বুনো হরিন আমার সামনে,ভাবা যায় ! কিন্তু দাড়িয়ে দাড়িয়ে আরেক কথাও ভাবছিলাম। তা হল এদের গায়ে ঠিক কতটুকু গোস্ত হবে। কুরবানী করার কথাও ভাবলাম। গোস্ত খেতে কেমন লাগবে,কোন ঠ্যাংয়ে কতটুকু গোস্ত এসব মাপছিলাম। বেশী গোস্ত নেই গায়ে। এরা ছোট সাইজের হরিন। তবে গোস্ত না খেয়েও পরিতৃপ্ত হলাম। ফুরফুরে মেজাজে নেমে আসলাম। সত্যি এটা ছিলো এক দারুন উপভোগ্য বিষয়।
বিষয়: বিবিধ
১৫৯৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হরিন দিয়া তো কুরবানি হবেনা!!
প্রকৃতি নীরবে অপার সৌন্দর্যের ঢালি মেলে রেখেছে সুবহানাল্লাহ!
জাযাকাল্লাহ খাইর আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন