বোইং ফ্যাক্টরী ভ্রমন
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৩ জুন, ২০১৬, ১০:২৭:১৮ সকাল
কানাডা থেকে ফেরার পালা। হাতে আরো একদিন ছুটি ছিলো। পরিকল্পনা ছিলো ফেরার পথে ওয়াশিংটনের এক সাফারী পার্কে যাব কিন্তু সেখানে যেতে ৪ঘন্টা ড্রাইভ করতে হবে এবং সিয়াটলে ফিরতে ৩ঘন্টার বেশী সময় লাগবে। এত দীর্ঘ ভ্রমন অসহ্য। এমনিতেই ভ্রমনের উপর আছি। তাই চিন্তা করলাম ওরেগনের সাফারী পার্কে যাব আগামীকাল। যাত্রা করলাম কানাডা-আমেরিকা বর্ডার বরাবর।
শুনেছিলাম কানাডা থেকে ফেরার সময় আমেরিকাতে ফলমূল নিয়ে আসতে দেয়না। কিন্তু অফিসার জিজ্ঞেস করল ফলমূল আছে কিনা। বললাম আছে। জিজ্ঞেস করলেন কি কি ফল ? বললাম । উনি বললেন,আচ্ছা ঠিক আছে,ধন্যবাদ,তোমার দিনটা ভালো যাক। দিনটা রৌদ্রজ্জ্বল দারুন । ভাবছিলাম পোর্টল্যান্ড পৌছে ভারতীয় রেস্টুরেন্টে খাব কিন্তু এটা মেমোরিয়াল ডে হওয়াতে সব বন্ধ ছিলো।
যাইহোক সিয়াটলের পূর্বে পেন ফিল্ড নামক স্থানে প্লেন তৈরীর বিশ্বসেরা কোম্পানী বোইং এর একটা বড় ফ্যাক্টরী দেখতে গেলাম। উইলিয়াম বোয়িং নামক ব্যক্তি সর্বপ্রথম ফ্যাক্টরীটি ছোট করে তৈরী করেন সিয়াটলে ১৯১৬সালে। এর সদরদফতর ইলনয় অঙ্গরাজ্যের শিকাগো শহরে। এই কোম্পানী ছোট,বড় যাত্রীবাহী বিমান,যুদ্ধ বিমান,রকেট ও মহাশূণ্যের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি,যানবাহন তৈরী করে।
বোইংএর একেকটি ফ্যাক্টরী সুবিশাল। এতটাই বিশাল যে দূর থেকে দেখলেও সহসা আচ করা যায়না শুরু আর শেষ কোথায়। পেন ফিল্ডের ফ্যাক্টরীতে ট্যুরের ব্যবস্থা রেখেছে বোইং। প্রবেশ পথে দুটি বড় ফলকে বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে স্বগত জানিয়ে দেখলাম। ফলকের প্রথমেই আরবীতে লেখা আহলান সাহলাম। হঠাৎ মনে হল ভুল দেখলাম নাতো ! পরে বুঝলাম এটার মর্ম। আসলে আরব দেশগুলোই বোয়িং এর সবথেকে বড় ক্রেতা। তাই স্বাগত জানাতে তাদের ভাষা প্রথমে ব্যবহৃত হয়েছে। ভেতরে দুনিয়ার প্রায় সব দেশেরই পতাকা দেখলাম উপরে ঝুলছে,তারা বোইংএর ক্রেতা দেশসমূহ।
২০ ডলারে টিকেট কাটলাম। এখানে অফিস বিল্ডিংএর নীচ তলায় বোইংএর কিছু ইঞ্জিন ও প্লেনের যন্ত্রাংশ রয়েছে যেখানে ছবি তোলা যায়। কিন্তু ট্যুরে গিয়ে ফ্যাক্টরীর কোনো ছবি তোলা যায় না। শুরুতেই মোবাইল ফোন ও ক্যামেরা লকারে রেখে দিতে হয়।
১২টার সময়ে যত লোক হল তা নিয়ে ২টা গ্রুপ করা হল। তারপর গেলাম একটি অডিটোরিয়ামে,সেখানে একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার বোইংএর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ভিডিও দেখালো এবং নানান জ্ঞান দিল। পুরো ট্যুর সময় ৯০ মিনিট এবং এই সময়ের মধ্যে টয়লেটে যাওয়া যাবেনা তাই শেষবারের মত টয়লেটপর্ব শেষ করতে অনুরোধ করল। আমার সমস্যা নেই মনে করে বসে থেকে একেবারে শেষ মুহুর্তে দৌড় দিয়ে পানি পরিবর্তন করে আসলাম।
দুই গ্রুপ দুই বাসে গিয়ে উঠলাম। উভয়ের সাথে গাইড রয়েছে যারা সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। এখানে সবস্থান ঘুরে দেখার অনুমতি নেই। তাদের সব প্রযুক্তি তারা প্রদর্শন করেনা। প্রথমে যে বিশাল বিল্ডিংএ গেলাম সেটার গেট ৩০০ফুট চুড়া এবং উচ্চতা ৯০ফুট। অটোমেটিক দরজাটা ভাজ হয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। একটি বিশাল লম্বা টানেলের ভেতর দিয়ে চললাম। মাঝ বরাবর গিয়ে একটি বিশাল লিফটে উঠলাম এবং উপরে উঠে দেখলাম অনেকগুলো প্লেন জোড়া দেওয়ার জন্যে আনা হয়েছে। পেন ফিল্ডের ফ্যাক্টরীতে প্লেনের পার্টস তৈরী করা হয়না বরং অন্য ফ্যাক্টরী থেকে বিভিন্ন অঙ্গ এখানে এনে পূর্ণ রূপ দেওয়া হয় এবং আকাশে উড়িয়ে পরিক্ষা করা হয় ও সরবরাহ করা হয়। অর্ডার ছাড়া কানো প্লেন তৈরী করা হয়না। উপর থেকে প্লেন তৈরী করার দৃশ্য দেখতে বেশ ভালো লাগে। এখানে পাশাপাশি ৭টি ফ্যাক্টরী বিল্ডিং রয়েছে যা ৯০ ফুট উচু এবং একেকটা বিল্ডিং ১০০ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। বিশাল সব প্লেন তৈরী করা হচ্ছে সেখানে। বোইং তার সকল যন্ত্রাংশ নিজেরা তৈরী করেনা। বিশ্বের বিখ্যাত কোম্পানীগুলো থেকে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তারা ক্রয় করে এবং নিজেরাও অনেক কিছু তৈরী করে।
পরপর কয়েকটি ফ্যাক্টরীতে গমন করলাম এবং বিশাল সব তথ্য গাইড জানালো যা স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়,প্রয়োজনও নেই। সেসব তথ্য ইন্টারনেট থেকে পাওয়া যায়। দেখলাম বোইং ৭৮৭ মডেলের নতুন প্রযুক্তির প্লেন তৈরী করছে। এই মডেলটি তৈরীতে তারা উচ্চ প্রযুক্তির মেটাল ব্যবহার করেছে যা স্টিলের চাইতে শত গুন বেশী শক্তিশালী কিন্তু হালকা। এই প্লেনের জ্বালানী খরচ ২০% কম,ফলে এর দাহিদা বেশী। আমিরাত এয়ালাইন্স,টার্কিশ এয়ার লাইন্স এর জন্যে অনেকগুলো তৈরী হচ্ছে দেখলাম।
প্লেনের বিশাল বিশাল সব অংশ বড় বড় অত্যাধুনিক ক্রেন দিয়ে সুন্দর করে সংযুক্ত করা হচ্ছে। ভেতরের সাজসজ্জার কাজ করা হচ্ছে। এরপর যখন পুরো প্লেন তৈরী হয়ে যাচ্ছে ,তখন তা বাইরে এনে নিজস্ব রানওয়েতে নিয়ে উড়িয়ে পরিক্ষা করা হচ্ছে। বহু আগে ভাবতাম প্রত্যেক দেশ সাদা প্লেন কিনে নিয়ে নিজেদের দেশে এনে নিজেদের মত করে রং করিয়ে নেয়। কিন্তু আসলে তা নয়। এরা ডিজাইন সংক্রান্ত পরামর্শ নিয়ে নিজেরা উক্ত ডিজাইন তৈরী করে অথবা ক্রেতার থেকে ডিজাইন গ্রহন করে হুবহু সেভাবে রং করে। এছাড়া ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী এরা ভেতরটাকে সাজায়। অনেক এয়ারলাইন্স চিপাচাপা সিট তৈরী করে যাতে বেশী যাত্রী বহন করা যায়। ডমেস্টিক এয়ারলাইন্সগুলো এরকমটা করে সাধারনত। প্রত্যেক প্লেনের ওয়ারেন্টী নির্ভর করে কতবার এটি আকাশে উঠল এবং কতঘন্টা এটি চলল তার উপর। যেসব প্লেন দীর্ঘদিন চলেছে,তাদেরকে প্লেনের কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আমেরিকাতে এরকম বিশাল বিশাল প্লেনের কবরস্থান রয়েছে। কখনও কখনও সেসব প্লেন হলিউডের কোনো সিনেমার বিশেষ দৃশ্যে ব্যবহৃত হয়।
এখানে অনেক মানুষ টেস্ট ফ্লাই দেখতে আসে। পাশেই হাইওয়ে আছে,সেখানে চলমান মানুষ বিশাল বিশাল প্লেন পার্ক করা দেখতে দেখতে সড়ক দূর্ঘটনাও ঘটায়। গাইড বলল হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে বোইংকে অনুরোধ করা হয়েছে রাতের বেলা প্লেন হাইওয়ের পাশের অংশে পার্ক না করে রাখার জন্যে। খুব দ্রুত সময় পার হয়ে গেল। অনেক মজা লাগল হাইটেক কারবার দেখে। এটা আসলে চোখে না দেখলে বর্ননায় কিচ্ছু বোঝা সম্ভব নয়। আমি বর্ননাও দিতে পারলাম না এ বিষয়ে তেমন জ্ঞান না থাকার কারনে। তবে অনুভূতি অসাধারন।
ফিরতি পথ ধরলাম,বহুদূর যেতে হবে। মনে মনে পরের দিন সাফারী পার্ক ভ্রমনের নিয়ত করলাম।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৪ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন