রমজানে ব্লগ আয়োজন: প্রথম রোজা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২০ জুন, ২০১৬, ০৯:১৫:০৬ রাত
আমার প্রথম রোজা রাখার অভিজ্ঞতার কথা ঠিক মনে নেই কিন্তু প্রথম প্রথম রোজার দিনগুলোর কথা বেশ মনে আছে। আমাদের সময়ে রোজা রাখতে পারাটা ছিলো বেশ ক্রেডিটের ব্যাপার। সে সময়েই দেখেছি বেশ কিছু সিনিয়র লোক রোজা রাখত না কিন্তু তারা লোকরজ্জায় তা প্রকাশও করত না। আবার আমরা রোজা রাখলে তারা খুশী হত,অবাকও হত। বলত-এত অল্প বয়সেই তোরা রোজা রাখতে পারিস !
আমরা ভেবে পেতাম না তারা কেন রোজা রাখেনা। তাদের ভাষায় এর ব্যাখ্যা ছিলো-এটা খুব কষ্টকর,দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে পারিনা। তবে অনেকের পিতার হুঙ্কার ছিলো তাদেরকে যেন খেতে না দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের মায়েরা ঠিকই খেতে দিত।
আমর আব্বা মা উভয়েই বলত-তোর রোজা দুপুর পর্যন্ত। মায়ের রান্না হত ১২ টার পর বা ১টার দিকে। সে পর্যন্ত ছিলো আমার রোজা। সবথেকে মজা হত সাহরী খাওয়ার সময়। আব্বা সবাইকে ডেকে তুলত আর বিশাল তোড়জোড় শুরু করত। সে ছিলো বেশ উৎসবপ্রিয় মানুষ। সবসময় হাকডাক করতে পছন্দ করত। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে উঠে খাবার দাবারে তদারকি করত। তাকে দেখে বোঝা যেত এটা আসলেই রমজান মাস এবং ইবাদতের উৎসবের মাস। ওদিকে মসজিদে সাইরেন বাজানো হত মানুষকে ডাকার জন্যে। স্থানীয় এতিমখানার শিশুরা রাস্তায় রাস্তায় ইসলামী সঙ্গীত গাইত মানুষকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্যে। বিভিন্ন মসজিদের মুয়াজ্জিনরা মোটামুটি বেসূরো গলায় ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশ করত,তা শুনে আমার ব্যপক লজ্জা লাগত। কারন সেসব সঙ্গীতের কথা সাজানো হত সর্বনীম্ন মানের সস্তা বাংলা শব্দ দিয়ে আর সূর হত হাভাতে মার্কা। সেসব সঙ্গীত শুরু হলে দোয়া করতাম যাতে দ্রুত শেষ হয়। তবে এসবের উদ্দেশ্য ব্যহত হতনা। মানে লোকজন প্রায় মাঝ রাতেই উঠে সাহরীর আয়োজন করত। এরপরও অনেককে দেখেছি সাহরী মিস করেছে ঘুমের কারনে।
অনেক পরিবারের মায়েরা সে সময় উঠে নতুন করে রান্না বান্না করত। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এটা হতনা। মা রাতের ভাতে পানি ঢেলে রাখত। আমরা সর্বদা সাহরীতে পান্তা ভাত খেতাম। এটাই মজা লাগত। সাহরীতে সাধারনত তরকারী দিয়ে কিছু ভাত খাওয়ার পর দুধ,অত্যন্ত সুন্দর পাকা মর্তমান কলা,পাকা আম,চিনি,কখনও কখনও দৈ ভাতের সাথে মেখে খেতাম। অত্যন্ত মজা লাগত এটা। সাহরী মানেই মনে করতাম দুধ কলা দিয়ে পান্তাভাত খাওয়া। সেসময় আমাদের এলাকায় সাগর কলার প্রচলন তেমন ছিলোনা। আমরা মর্তমান কলাই চিনতাম। আর সে কলা পাকলে অনেক দূর থেকে সুগন্ধ ছড়াতো। যখন বেশী পাকত,তখন এর খোসা অনেকটা কালো হয়ে যেত, সেসব কলা বেশী মজা।
ছোটবেলায় রোজা রাখি বা না রাখি সাহরী মিস করতে চাইতাম না। কিন্তু প্রত্যেকদিন রোজা রাখি আব্বা অন্তত এটা চাইত না। হতে পারে রোজা রাখলে পড়ায় ফাকি দেব এটা ভেবে নিষেধ করত। সে সময়ে রোজার সময় স্কুল প্রায় ১ মাস ১৫ দিন বন্ধ থাকত। কিন্ত আমাদেরকে গৃহ শিক্ষকের কাছে সকাল-সন্ধ্যা পড়তে হত। যাইহোক সে সময়ে সাহরী খাওয়ার নেশা ছিলো। কিন্তু আব্বাকে ডিঙ্গিয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত যাওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো।
আমাদের রান্নাঘর ছিলো থাকার ঘরের সামনের পাশে। এটা ছিলো আরেকটি পৃথক ঘর। আব্বা সাহরী আগেভাগে খেয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে থাকত। বেশীরভাগ দিনে আমাকে ডাকত না,কিন্তু আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। আমি উঠে ছটফট করতাম কিভাবে সাহরী খাব সেই যন্ত্রনায়। তবে সাহরী মিস করলেও আমার জন্যে সাহরীর খাবারসমূহ মা যত্নকরে রেখে দিত যাতে সকালে খেতে পারি। কিন্তু নগদ আর বাকীর ভেতর পার্থক্য বুঝতাম। আমি চাইতাম সঠিক সময়েই কাজটি করতে। যেদিন আব্বার সাথে সাথে ঘুম ভাঙ্ত,সেদিন আব্বা ঘরের ভেতর খাওয়ার সময়ই চুপিচুপি রান্নাঘরে হাজির হতাম। উল্লেখ্য: আব্বা সবসময় তার ঘরের মেঝেতে বসে একাকী খেত। আমাদের সাথে খেতনা। বিশেষ উপলক্ষ্য ছাড়া এটার ব্যতিক্রম হতনা। আমরা সকলে এবং মা রান্নাঘরে খেতাম। এটাই পছন্দ ছিলো,কারন আব্বাকে আমরা সকলে খুব ভয় পেতাম।
যেদিন ঘুম ভাঙত আর দেখতাম আব্বা বারান্দায় বসা,তখন নানান ফন্দি ফিকির করে রান্নাঘরে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। সবসময় সফল হতাম না। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। একদিনের ঘটনা না বলে পারা যাচ্ছেনা। সে সময় আমরা ছোটরা বিছানায় প্রস্রাব করতম নিয়মিত। এমন একজনকেও মনে করতে পারছি না,যে বিছানায় প্রস্রাব করত না। রাতে স্বপ্ন দেখতাম সুন্দর কোনো টয়লেটে বা মাঠে বা কোনো গোপন স্থানে প্রস্রাব করছি,কিন্তু খানিকপর বুঝতাম বিছানা ভাসিয়ে দিয়েছি। অনেক রাতে উঠে বিছানায় শুকনো কাথা বিছিয়ে আবার ঘুমাতাম। মা সকালে তোষক রোদে দিত। তো যা বলছিলাম...আমি,মা,আমার উপরের বোনটা একসাথে ঘুমাতাম। এক সাহরীর সময় আমার ভাগনীও ঘুমাচ্ছিলো। সে আমার থেকে বয়সে ছোট ছিলো। ঘুম থেকে উঠে দেখী সকলেই রান্নাঘরে সাহরী করছে,আর আব্বা বারান্দায় বসে আছে। আমরা উঠে পায়চারী করতে থাকলাম আর নানান সব পরিকল্পনা করতে থাকলাম কিভাবে রান্নাঘরে যাওয়া যায় ! বারবার দরজার কাছে এসে উকি দিয়ে দেখছিলাম আব্বা উঠে কিনা,কিন্তু তার ওঠার খবর নেই। শেষে দেখলাম সাহরী প্রায় শেষের পথে ,কিছু একটা করা দরকার। লোভে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার ভাগনীকে শিখিয়ে দিলাম একটা কথা-"বলবি বিছানায় হিসু করে ভাসিয়ে ফেলেছি....এটা বলতে বলতেই ঝেড়ে দৌড় দিবি রান্নাঘরে" সে বুঝল। আমরা দুজন সমস্বরে বিছানা ভেজানোর কথা বলতে বলতেই এক দৌড়ে রান্নাঘরে। সম্ভবত: আব্বা একবার বলে উঠল...এইই.. !!! আমরা ততক্ষনে নেই !! একদৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে সাহরী খাওয়া শুরু করলাম।
আমাদের কাছে রোজার গুরুত্ব ইফতার খাওয়া ছাড়া আর কিছু ছিলোনা। আমরা অতকিছু বুঝতাম না। সে সময়ে পাড়ায় এক পাল বাচ্চা ছিলো,সকলে একসাথেই খেলতাম। সকলেই বড়াই করে রোজা রাখত। কে কয়টা রোজা রেখেছে সেটা নিয়ে প্রতিযোগীতা হত। আমার এখনও মনে পড়ে, সারাদিন রোজা রেখে আসরের পর বিনা কারনে গোপনে পানি খেয়ে ভাব নিয়েছিলাম যে রোজা আছি। সে সময়ে আমি ব্যপক মিথ্যা বলতাম। রোজা না রেখেই বলতাম রোজা আছি। ওজু করার সময় কিছু পানি খেয়ে ফেলতাম।
আমাদের বাড়িতে ইফতারী হত বিরাট জাকজমকের। বিরাট আয়োজন করতে পছন্দ করত আব্বা। আর আমার পছন্দ ছিলো খাওয়া। নাক মুখ দিয়ে খেতাম। স্থানীয় বাজারেও দারুন সব ইফতার পাওয়া যেত। কিছু কেনা হত আর কিছু বাড়ি বানানো হত। ইফতারী খেতাম পাগলের মত। ইফতারীটা আব্বা আমাদের সকলকে নিয়েই করত। বড় একটা ডালায় আলুচপ,পেয়াজু,বেগুনীসহ নানান কিছু থাকত। আব্বা আমার প্লেটে বেশী তুলে দিত আর খাওয়ার সময় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। আর বলত...ভালোকরে চিবিয়ে খা...আমার গতি বেশী থাকত,মনে হত গিলছি।
পরবর্তীতে আসলেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে রোজা রাখতাম। কখও ৪/৫টা,কখনও ১০/১২টা রাখতাম। ঠিক কবে থেকে ৩০টা রাখা শুরু করেছি মনে নেই কিন্তু সেটা অনেক ছোটবেলায়ই হবে। প্রথম দিকে রোজা রাখলেও নামাজ পড়তাম না। শুক্রবারে আব্বা,ভাই মসজিদে নিয়ে যেত,ওটাই । আমি নামাজ পড়া শুরু করেছি আমার ফুফাত ভাই সাবুকে দেখে। ও দৈনিক ৩ ওয়াক্ত পড়ত। ওর দেখাদেখী আমিও ১/২ ওয়াক্ত করতে করতে বাড়াতে থাকি। সে পরে ৫ ওয়াক্ত পড়ত,এরপর আমিও ওর দেখাদেখী পড়তে থাকলাম। ইবাদতে ও ভালো কাজে সে আমাদের প্রায় সকলের চাইতে এগিয়ে ছিলো।
ছোটবেলায় গৃষ্মে রোজা পেয়েছিলাম। তখন অনেক ছোট ,কষ্ট হত। আমরা গণ্টার পর ঘন্টা নদীতে থাকতাম যাতে কষ্ট কম হয়,পিপাসা কম লাগে। তারপরও দুপুর হলে পিপাসায় কলিজা ফেটে যেত। আর বিকেলে সময় গুনতাম কখন ইফতার হবে ! আমি খুব ছোটবেলায় কুরআন পড়া শিখলেও নিয়মিত তিলাওয়াত করতাম না। কখনও রমজানে একটু বেশী পড়তাম। তারপরও সেই সময় থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত মাত্র এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করেছি। ২০১৬ সালে অবশ্য শুরু করেছি ধারাবাহিকভাবে এবং অর্ধেকের বেশী এগিয়েছি। আমাদের এলাকায় ইফতারের সময় বড় মসজিদ থেকে বিশেষ পটকা ফোটানো হত। তখন সবাই একসাথে ইফতার করত। সে রীতি এখনও আছে। আমরা ৩ রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে সেটা প্রত্যক্ষ করতাম কখনও,তারপর এক দৌড়ে বাড়ি এসে ইফতার। যেদিন রোজা রাখতাম,সেদিন অন্তত ১৫ মিনিট আগে ইফতার সামনে নিয়ে বসে থাকতাম। আহ সেসব ইফতারের কথা কখনও ভুলব না। আমার ছোটবেলার রোজাই যেন ছিলো সাহরী ও ইফতারের খাওয়ার জন্যে....
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৪ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা ভাণ্ডারে বেশ রসদ আছে। অনেক মজা পেলুম পড়ে।
সত্য কথাগুলোই ফুটে উঠেছে লিখায়। রোজা মানেই সেহরী খাওয়ার আনন্দ!!!!
ছোট বেলায় এমনটি হওয়া স্বাভাবিক হয়ত। কেননা প্রায় সবার বেলায় এমন টি হয়েছে।ধন্যবাদ।
আমাদের পরিবারের কেউ ২বছর বয়সের পর বিচানায় পেশাবের রেকর্ড নেই। আমার মেজ জেঠার পরিবারের সদস্যদের এ রেকর্ড এলাকাজুড়ে, একজন তো বিয়ের পরেও কিছুদিন বিছানায় জাড়তেন।
আপনার সরল স্বীকারোক্তিগুলো দারুন লেগেছে। তাহলে খাদক সেই ছোট কাল থেকেই। মঝা পেলুম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন