অপারেশন কানাডা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৩ জুন, ২০১৬, ১০:২৯:১৩ রাত
২৭শে মে,২০১৬। কানাডা যাওয়ার ক্ষেত্রে প্লেনের টিকেট নির্ধারিত থাকলেও গাড়িকে বেছে নিলাম। ভোর ৪টার পরপরই রওনা হলাম যাতে রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম থাকে,এমনিতেই ওরেগনে মানুষ জন কম। সাথে সহকর্মী ড্যানিয়েল।
হাইওয়ে ৫ পুরো ফাকা। ওয়াশিংটনের ভেতর হাইওয়ে ৫ এ ঘন্টায় ১৩৫কি:মি: বেগে চালানো যায়,যা ওরেগনের থেকে ৮কি:মি: বেশী। অনেকে এর থেকে বেশী গতিতে চলে। তবে মাঝে মাঝে জরিমানার সম্মুখিন হয়। আমেরিকাতে নির্ধারিত গতিসীমার ১৫/১৬ কি:মি: বা ১০ মাইল উপর দিয়ে চললেও পুলিশ কিছু মনে করেনা। গতি নিয়েই চললাম।
সাথে আছে আমার বহু রকমের খাদ্য খাবার। সিয়াটলে হালকা বিরতি নিলাম। সাড়ে ৬ বা ৭ ঘন্টা ড্রাইভ করে ওয়াশিংটনের কানাডা বর্ডারে পৌছলাম। মোট রাস্তা সম্ভবত ৮শ কি:মি: হবে। কানাডা বর্ডারের ইমিগ্রেশন সার্ভিস রাস্তার উপর তৈরী বিশেষ বুথে দেওয়া হয়। কাওকেই গাড়ী থেকে নামতে হয়না। এখানে অন্তত ১০/১২টা লাইনে গাড়ী কানাডায় প্রবেশ করে। শত শত গাড়ি অপেক্ষমান দেখলাম। খুব দ্রুততায় কাজ হয় এখানে। গাড়ি বুথের সামনে আসলে একজন অফিসার পাসপোর্ট,গ্রীনকার্ড দেখল এবং কানাডা কেন যাচ্ছি জানতে চাইলো। তরপর গ্রীনকার্ডটি মেশিনে পাঞ্চ করে ফেরত দিয়ে হাসিমুখে বলল-ওয়েলকাম ইন কানাডা।
এপাশে মানি এক্সচেঞ্জ আছে। আমেরিকান ১ ডলার = কানাডিয়ান ১.২৫ ডলার। কানাডিয়ান ডলার গ্রহন করলাম। গত কয়েক বছরে আমেরিকার অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ায় কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়ান ডলারের বিপরীতে এটি অনেক শক্তিশালী হয়েছে। মনে পড়ছে ২০১৩ সালে সিডনীতে ১ আমেরিকান ডলার প্রদান করে অস্ট্রেলিয়ান ডলার পেয়েছিলাম ৮০ সেন্ট। আর আজ অস্ট্রেলিয়ান ডলার আমেরিকান ডলারের বেশ নীচে অবস্থান করছে।
এপাশে খুব নিয়ম মেনে ড্রাইভ করলাম,কারন নতুন দেশ। কিন্তু খেয়াল করলাম আমি ছাড়া আর কেউ গতিসীমা মেনে চলছে না। তারপরও নিয়ম ভঙ্গ করলাম না। এপাশে হাইওয়ে তত প্রশস্ত নয়। আর বিশাল সংখ্যক গাড়ি চলছে রাস্তায়। গতিসীমা সর্বোচ্চ ১০০কি:মি:। প্রায় ৪০ মিনিট পর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভারে নির্ধারিত হোটেলে পৌছলাম।
উইইকপিয়ার ২০১১ সালের জনসংখ্যার হিসাব মতে এটি কানাডার ৮নং সিটি। ৫২% জনগনই ভিন্ন দেশ থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছে,যাদের মতৃভাষা ইংরেজী নয়। কিন্তু এখানকার এক প্রবীন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জেনেছি গত কয়েক বছরে ভ্যাঙ্কুভারের জনগন হয়েছে প্রায় দ্বিগুন। এর বেশীরভাগই চায়নিজ এবং বেশকিছু ভারতীয়,পাকিস্থানী,বাংলাদেশী। রাস্তায় বের হয়েই বিষয়টা ধরা পড়ল। চারিদিকে শুধু চায়নিজ আর চায়নিজ। বৈধ ব্যবসার পাশাপাশি তারা নানান অবৈধ ব্যবসায়ও জড়িত। অনেব বড়বড় ব্যবসা এদের দখলে।
রাস্তাগুলো বেশ সরু,যা এত অধিক সংখ্যক মানুষের চলাচলের উপযোগীতা হারিয়েছে। লেনগুলোও অপ্রশস্ত মনে হল। ৩ নং লেইনে মানুষ গাড়ি পার্ক করে রেখেছে,যদিও সেটি দন্ডনীয় অপরাধ কিন্তু পুলিশকে এই দন্ড আরোপ করতে দেখা যায় না। কারন উপাই নেই। এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের বিকল্প উপায় তেমন নেই বললেই চলে। তাই বেশীরভাগ মানুষই রাস্তায় নিষিদ্ধ স্থানেই গাড়ি পার্ক করে।
ভ্রমনে শরীরের ক্যলরী অনেক পোড়ে বিশেষ করে গাড়ী ড্রাইভ করলে। কারন রাস্তায় মনোযোগ দিতে হয়। পুরো রাস্তায় কেবল সিয়াটলের তেলের পাম্পে কিছুক্ষন বিরতি নিয়েছিলাম। ড্যানিয়েল অলস প্রকৃতির,লং ড্রাইভ তার ভালো লাগেনা। আমি এর বিপরীত, নতুন অভিজ্ঞতা নিতে আমার ভালো লাগে। এক ভারতীয় রেস্টুরেন্টে গলা পর্যন্ত খেয়ে যার যার রুমে প্রবেশ করে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম।
খানিকপর আমি নীচে নেমে রিসিশনিষ্ট এর মাধ্যমে জানলাম রাস্তার ওপাশে ২/৩ ব্লক পর একটি মসজিদ আছে। আজ শুক্রবার তাই জুম্মা পড়তে গেলাম। কিন্তু অনেক খোজাখুজির পরও মসজিদ না পেয়ে যখন ফিরছি,তখন একজন দাড়ি,টুপিওয়ালা বৃদ্ধকে হাটতে দেখে থামলাম। সালাম দিয়ে তাকে মসজিদের কথা জিজ্ঞেস করাতে বললেন-তিনিও যাচ্ছেন,তবে অন্য একটি মসজিদে। তাকে নিয়ে চললাম মসজিদে। জানলাম উনি মুয়াজ্জিন। ভদ্রলোক সিরিয়া থেকে ৪৫ বছর পূর্বে আমেরিকা এসেছিলেন এবং ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পি.এইচ.ডি করেছেন। এরপর ৯০ এর দশকের শুরুতে ভ্যাঙ্কুভারে আসেন। তার কাছে জানলাম এখানে অনতিদূরেই অনেক বাংলা,পাকিস্থানী,ভারতীয় হালাল রেস্টুরেন্ট,গ্রোসারী দোকান আছে।
যে মসজিদে গমন করলাম সেটা একটি বড় আন্ডার গ্রাউন্ড স্পেস। এটাকে স্থানীয় মুসলিমরা মসজিদ বানিয়েছে। ঈমাম পাকিস্থানী। তিনি রমজানের ব্যাপারে বয়ান করলেন ইংরেজীতে। খুৎবার সময় দেখলাম মসজিদে লোকে লোকারন্য। ভালো লাগল।
চারিদিকে লোকে লোকারন্য,এটা তেমন ভালো লাগল না। অতিরিক্ত গাড়ির জন্যে ট্রাফিক জ্যাম অহরহ দেখা যায়। আমি অবশ্য রাস্তায় হাটার ক্ষেত্রে নিয়ম নীতি মানিনা। রাস্তা ফাকা পেলে দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হই,অথবা কখনও গাড়ির সামনে দিয়েই দৌড় দেই। এভাবে ফ্রেজার রোডের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হাটলাম। ফ্রেজার নামক একটি নদীও আছে চমৎকার। হেটে হেটে নানান খাবারের দোকান পাট দেখলাম। একসাথে এত হালাল খাবার দেখে মন প্রান ভরে গেল। কোন কোন রেস্টুরেন্টে খাব,মনে মনে তার একটা চিত্র অঙ্কন করে ফেললাম। কিছু ফলমূল কিনে হোটেলে ফিরলাম। ফিরেই পাকা আম খেলাম পেট ভরে। একেবারে সদ্য পাকা সুন্দর আম।
বিকেলে কিছু কাজ সেরে শহরটা ঘুরে দেখলাম। শহরে যানবাহন হিসেবে রয়েছে কার,ইলেকট্রিক বাস,পাতাল রেল,আকাশ রেল ইত্যাদী। রাস্তায় অধিক সংখ্যক মার্সিডিস বেঞ্জ,বি.এম.ডব্লিউ,পোরশ চোখে পড়ল। পুরোনো গাড়ি তেমন একটা চোখে পড়েনি। বিশাল ধনী এবং গরিব একইসাথে বসবাস করে এখানে। এমনকি ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খেতে দেখেছি,তবে এমন চিত্র একেবারেই নগন্য।
লোকসংখ্যা ব্যপক হওয়ার কারনে চাকুরীর বাজার এখানে খুব বেশী সুবিধার নয়। তবে ছোটখাটো হলেও মানুষের চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখানে মিনিমাম বেতন ঘন্টায় ১১ ডলার,যা আমেরিকান ডলারে প্রায় ৯ হয়(আমেরিকার বেশীরভাগ স্টেটে মিনিমাম বেতন ঘন্টায় ৯ ডলারের উপর,ওরেগনে ১০ এর উপরে। এটাকে ১৫ করার ব্যাপারে অনেক মহল সরকারকে চাপ দিচ্ছে,যদিও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলো এগুলোর বিপক্ষে,কারন তাদেরকে অত্যধীক বেতন প্রদান করতে হবে)। বাড়ি ভাড়া অনেক বেশী,খাওয়ার খরচও বেশী। যানবাহনের তেলের দাম অত্যধীক হওয়ায় চলাচলের খরচও বেশী। তাই স্বল্প বেতনে মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। বিশাল সংখ্যক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করে,অথচ দেশে তাদের পরিবার,আত্মীয়স্বজন,বন্ধু বান্ধব হয়ত তাকে কোটিপতি ভাবে। অন্যকে সাহায্য না করলে হয়ত ভাবে, টাকা নিয়ে সে মজা করছে,আসলে তার জীবন ওষ্ঠাগত,কিন্তু সম্মান হারানোর ভয়ে নিজের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা সে প্রকাশ করেনা। তবে ভালো বেতনেও বহু মানুষ কাজ করছে। তারা দামী গাড়ি বাড়ি নিয়ে ভালো আছে। রাতে খেলাম আল ওয়াতান নামক রেস্টুরেন্টে।
আরও ২ পর্ব চলবে ইনশাআল্লাহ....
বিষয়: বিবিধ
১৮৯৬ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অপারেশন লিখা দেখে ভাবলাম,
ইঞ্জিনিয়ার আবার ডাক্তারি শুরু করলো কবে থেকে??
পরে দেখলাম, আরে নাহ, ঘটনা ভিন্ন।
আসলে মুর্খ, মুর্খ ই রয়ে গেলাম, জ্ঞান আর হলো না বুঝি এই জিবনে।
নামটা ইটিং কানাডা ও হতে পারত!!!
ভ্রমনের বর্ণনা মনমুগ্ধকর। ধন্যবাদ।
নাহ! একটু পরে চমৎকার ছবি, উপভোগ্য ভ্রমণ আনন্দ কাহিনী আর সেইসাথে লোভনীয় খাবারের গল্প পড়ে আমোদিত হলাম।
তবে পারাপারে সতর্ক থাকা চাই কিন্তু ছোট ভাই।
পুটীর মা আসলেই অনেক ভাগ্যবতী!
আপনাদের জন্য অনিঃশেষ দোয়া ও শুভেচ্ছা কামনা।
মাহে রমযানের লিখাগুলোতে বেশী বেশী উপস্থিতি চাই কিন্তু ছোট ভাই............।
আতি সতর্কই থাকি। মাঝে মাঝে চান্স নেই আর কি। পুটির মার থেকে আমি বেশী ভাগ্যবান। সে লোক ভালো। রাগটা একটু বেশী। কিন্তু মায়াও আছে। আমাকে বাগানে রেখে আসে,কিন্তু শিয়ালে কামুড় দিবে এটা চিন্তা করে পরক্ষনেই আমাকে নিয়ে যায় ঘরে। ....
আপনার বাড়ি গেলে দেখাবো খাওয়া কাকে বলে। ছিটারুটি আর গরুর গোস্ত রান্না করবেন। হাড়ি সুদ্ধ ঝেড়ে দেব। দেশী মুরগী পছন্দ কিন্তু সেটা তো ওখানে নেই....
যে কেউ পড়লে মুগ্ধতা পাবেই। জাজাকাল্লাহ
অরগনে এতটা কঠিন নয়।
গ্রীনকার্ডটি পেয়েছেন। congratulation। দক্ষিনে চলে আসেন।
আপনি ,ইবনে বতুতার মত দেশ ভ্রমনে পন্ডিত।
একদম সত্য বলেছেন রে ভাই, আমিরাতেও এমন লোকের অভাব নেই। ধন্যবাদ
" অন্যকে সাহায্য না করলে হয়ত ভাবে, টাকা নিয়ে সে মজা করছে,আসলে তার জীবন ওষ্ঠাগত,কিন্তু সম্মান হারানোর ভয়ে নিজের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা সে প্রকাশ করেনা। তবে ভালো বেতনেও বহু মানুষ কাজ করছে। তারা দামী গাড়ি বাড়ি নিয়ে ভালো আছে।" এটা মধ্যপ্রাচ্যের বেলায়ও প্রযোজ্য। ধন্যবাদ আপনাকে
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন