নিউ চায়না......১০
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৭ মার্চ, ২০১৩, ১০:০১:২৮ সকাল
শিনজাং এর কাসগর মসজিদ
প্রতিদিন বিকেলে বাইরে বের হই। হোটেলের উল্টোদিকের রাস্তা ধরে হাটতে থাকলাম। আজ বৃষ্টি হয়েছে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। রাস্তা এখনও খানিক ভেজা। হাটতে থাকলাম। হঠাৎ দেখলাম গ্রামের মত একটি এলাকা। শহরের মধ্যে গ্রাম দেখে কৌতুহলী হলাম। একটি অপ্রশস্ত খাল চলে গেছে এঁকে বেঁকে,তার দুপাশে কংক্রিটের রাস্তা। খালের দুপাশে লোহার গ্রিল লাগানো। কিছুদূর পরপর দুপাশ থেকে সিড়ি নেমে গেছে খালের পানিতে। সিড়িতে বসে মানুষ কাপড়,থালা-বাসন পরিষ্কার করছে। পানি তেমন পরিষ্কার নয়। কয়েক স্থানে কিছু কচুরীপনাও দেখলাম। খালটি কংক্রিটের তৈরী এবং এর ভেতর দিয়ে কংক্রিটের তৈরী নৌকা চলতে দেখলাম,কাঠের নৌকাও ছিল। আমি হাটতে থাকলাম এক পাশের রাস্তা ধরে। দুপাশে জনবসতী। এদের বাড়িগুলোর প্রায় সবটাই একতলা,কয়েকটা দেখলাম দ্বীতল। প্রায় সব বাড়িই পুরোনো। বাড়ির পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে,রং উঠে গেছে,কাঠের দরজা পচে গেছে অথবা ক্ষয়ে গেছে। জানালার অবস্থাও ভাল নয়। ঘরের টালি কোথাও ভেঙ্গে গেছে,সেখানে পলিথিন দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করা হয়েছে। অনেকে ময়লা মলিন কাপড় পরে বসে আছে অথবা আপন মনে কর্মরত। কোথাও ছোট ছোট শুওরের খামার রয়েছে। গাদাগাদি করে মানুষ বসবাস করছে। বেশ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ,তবে কয়েকটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে তারা বেশ স্বচ্ছলতার সাথে বসবাস করছে। সম্ভবত এটা শহুরে বস্তী। চায়নার আধুনিক শহরের ভেতর এমন একটি স্থান নিঃসন্দেহে বেমানান। এরা এদের এ রূপ মানুষকে দেখাতে চায়না,যদিও এটিই চায়নার আদী রূপ। এ মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। এরা অনেক রকমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এখানকার মানুষেরা ছোট খাটো পেশা ধারন করে জীবিকা নির্বাহ করে। পরিচ্ছন্ন কর্মী,নিরাপত্তা প্রহরী,টোকাই ইত্যাদী পেশাদার মানুষের বাস এখানে। এখানে হেটে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ফেরার পথে হঠাৎ দেখলাম এক ইলেকট্রিক সাইকেল ভ্যান ওয়ালা লোক ঘন্টা বাজাতে বজাতে প্রবেশ করেছে। সে ঘন্টার ক্রমাগত আওয়াজে বাচ্চারা দৌড়ে আসতে থাকল। লোকটি বাচ্চাদের বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর বিনিময়ে লোহা লক্কড়,প্লাস্টিক ইত্যাদী গ্রহন করছিল। আমি এ দৃশ্য দেখে আমার ছেলেবেলায় ফিরে গেলাম। এদের সাথে আমার কোনো অমিল দেখলাম না। আমিও এমন ইঙ্গিতপূর্ণ বিশেষ ঘন্টার আওয়াজে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে দৌড়ে ঘন্টার মালিকের কাছে চলে যেতাম। তারপর জিজ্ঞেস করতাম কি নিবে। নগদ টাকায় পণ্য দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাটারী,লোহা লক্কড়,টিন,এলুমিনিয়াম ইত্যাদী গ্রহন করত। তখন আব্বার টর্চ লাইটের ব্যাটারী,রেডিও ব্যাটারী,পুরাতন না পেলে নতুন এ্যালুমিনিয়ামের বাটি,পুরোনো লোহার কড়াই অথবা নতুন কড়াই ভেঙ্গে সেই ঘন্টাওয়ালার কাছে হাজির হতাম। পৃথিবীর সবখানেই বাচ্চাদের আচরণ একই রকম।
বড় রাস্তার ফুটপাথে চলে এসেছি । এখানে ফুটপাশের ওপর কয়েকটা খাবার দোকান দেখলাম। একজন মানুষের অর্ডার নিয়ে ফ্রেন্স ফ্রাই তৈরী করছে,আরেকজনকে দেখলাম বিভিন্ন সব্জী দিয়ে চওমিন(ফ্রায়েড নুডুলস) তৈরী করছে। দুটো দেখেই লোভ হল। আমি প্রথমে ফ্রেন্স ফ্রাই নিলাম এক বাটি এরপর আরেক দোকানদারের কাছে গিয়ে বললাম সব্জী চওমিনের সাথে এই ফ্রেন্স ফ্রাইগুলো ঢেলে দিয়ে একসাথে বানাও। এভাবে বেশ দারুন কিছু হল। চপস্টিক দিয়ে খেতে দারুন লাগছিল। খানিক পরে আমি সেই মুসলিম রেস্টুরেন্টে এসে বিশেষ স্যুপ নুডুলস খেলাম,সাথে ছিল সেই ফ্রেন্স ফ্রাই সমৃদ্ধ নুডুল। এবার সবকিছু একসাথে মিশিয়ে খেতে থাকলাম। ইব্রাহিম ভাই হেসেই খুন। তিনি একটি চপস্টিক দিয়ে আমার প্লেট থেকে একটু খেয়েই বললেন-হুমম মজা,তবে একটু বেশী ঝাল।
ইব্রাহিম ভাই তার ল্যাপটপ নিয়ে আসল। উদ্দেশ্য গুগল ট্রান্সেলেটরের মাধ্যমে কথা বলা। সর্বপ্রথম আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা হল। তারপর তাদেরটা জানালো। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বেশীরভাগই মুসলিম জেনে তারা খুব খুশি হল। তারা বলল,চীনে কোটি কোটি মুসলিম রয়েছে কিন্তু সরকার তা স্বীকার করেনা এবং সরকারী হিসেবে সবসময়ই মুসলিমের সংখ্যা কম করে দেখানো হয়। তাদেরকে বিভিন্নভাবে সুবিধা বঞ্চিত করা হয়। শিনজাং বা জিনজিয়াং প্রদেশে হান চায়নিজদেরকে পূনর্বাসিত করে উইঘুর মুসলিমদেরকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সামান্য অপরাধে মুসলিমদেরকে জেল জরিমানার সম্মুখিন হতে হয়। সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে নানান প্রতিবন্দকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। ধর্ম পালনে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তারপরও জীবন থেমে নেই,একভাবে চলে যাচ্ছে।
ইব্রাহিম ভাইএর বোন মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন লিখে আবার তার কাজে মনোনিবেশ করছিল। খানিক পর এসে উত্তর দেখে আবারও নতুন প্রশ্ন। সে অনেক কথার পর আমার পারফিউম নিয়ে প্রশ্ন করল। বুঝলাম এটা তা খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এটা তাকে উপহার দেওয়া যাবেনা। এটা পুরুষের জন্যে এবং এ মুহুর্তে আমার এটা দরকার। অতিরিক্ত আরেকটা থাকলে তাকে অবশ্যই উপহার দিতাম যদিও সেটা পুরুষের জন্যে ব্যবহৃত হয়। এবার পকেটের অবস্থা ভাল নয় তাই নতুন কিনে দেওয়ার কথা ভাবা গেল না,তবে বারবার মনে হচ্ছিল যদি পারফিউমটা তাকে দিতে পারতাম,খুব ভাল লাগত।
এই রেস্টুরেন্টে এরা হাতেই নুডুলস তৈরী করে। ইলিয়াস ভাই এ ব্যাপারে একেবারে দক্ষ লোক। দেখলাম এক টুকরো ময়দা নিয়ে বেলে গোল বানালো,তারপর লম্বা বনালো,এরপর টেনে আরও লম্বা বানিয়ে মাঝখান থেকে ভাজ করল,এভাবে দলাই মলাই করছিল এবং দুপাশ থেকে একটু একটু করে ময়দা কেটে ফেলে দিচ্ছিল। তারপর আবারও টানাটানি ,হঠাৎ দেখলাম টানাটানির এক পর্যায়ে কিভাবে জানি অনেকগুলো সরু দড়ি তৈরী হয়েছে। অবিশাশ্ব্য ব্যাপার। এবার সেই নুডুলস এক হাড়ি ফুটন্ত পানিয়ে ছেড়ে দিল। খানিকপর তা উঠিয়ে বিভিন্ন মসলা,সস ইত্যাদীর মধ্যে ডুবিয়ে দিল। ওদিকে ইব্রাহিম ভাই এর স্ত্রী ভেতরের কিচেনে নুডুলসের অন্য উপাদান তৈরীতে মগ্ন। সব্জী অথবা মাংস অর্ডার অনুযায়ী তিনি তা তৈরী করতে থাকেন। এরপর সেই নুডুলসের ভেতর দিয়ে পরিবেশন করল। এভাবে এরা প্রত্যেকের জন্যে আলাদাভাবে নুডুলস তৈরী করে থাকে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট বা আরেকটুু বেশী। প্রচন্ড দ্রুত গতিতে সে এটা তৈরী করতে পারে। এটা একটা দর্শনীয় জিনিস বটে। স্বাদও দারুন।
ইলিয়াস ভাই একটি কোল্ড ড্রিংসের বোতল নিয়ে পাশে বসল। আমারও তৃষ্ণা পেয়েছিল। তার সাথে অনেক কথা হল। দেশে তার বাপ মা রয়েছে কিন্তু ইনকাম যথেষ্ট না হওয়াতে বছরে একবার অথবা দুই বছরে একবার দেখা করতে যেতে পারে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কি:মি: ট্রেন যাত্রা এত সোজা নয়। প্লেনের কথা এরা ভাবতেও পারেনা। ছোট এক রেস্টুরেন্ট থেকে এতগুলো মানুষের জীবিকা বের করা এত সোজা নয়। অনেকক্ষণ কথা হল,বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। ইব্রাহিম ভাই এগিয়ে দিতে চাইল কিন্তু তার রেস্টুরেন্ট থেকে আমি মাত্র ১০০মিটার দূরে থাকি। একাই চললাম। তাদের রেস্টুরেন্ট থেকে শুধু পেটই ভরেনি; সরল মানুষগুলোর ভদ্রতায়,ভক্তিতে,ভালবাসায় মনটাও ভরে রইল। নিখাদ ভালবাসার প্রতিদান শুধুমাত্র নিখাদ ভালবাসা দিয়েই দেওয়ার কথা ভাবা যায়। প্রতিদান দিতে পারব না কিন্তু তাদের প্রতি আমার ভালবাসায় কোনো খাদ নেই। তাদের জন্যে দোয়া রইল।
বিষয়: বিবিধ
১৫৬২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন