আল্লাহ্র রাসূলের (সা.) রাগ ও জ্ঞানের গুরুত্ব
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২১ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:৩০:০১ সকাল
আল্লাহ্র রাসূলের (সা.) রাগ ও জ্ঞানের গুরুত্ব
------------------------------------------------
[বেশ বড় লেখা কিন্তু ইনশাআল্লাহ্ পড়লে ভালো লাগবে এবং চিন্তার অনেক কিছু পাওয়া যাবে।]
ইসলামে জ্ঞানের গুরুত্ব নিয়ে আমি আগে বেশ কয়েকবার লিখেছি। এই গুরুত্ব কুরআন বা হাদীসে বিভিন্ন ভাবে এসেছে। আমার মতে এই ব্যাপারটা বোঝার খুব সুন্দর আরেকটি উপায় রয়েছে।
আমরা সবাই জানি যে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) সাধারণত হাসিখুশি থাকতেন, খুব অল্প সময়েই রাগ করতেন। যদিও রাগ হলেও তিনি আজে বাজে কথা বলতেন না, সেটা কেবল তার চেহারার বহিঃপ্রকাশে বোঝা যেত। যে অল্প কিছু ঘটনায় তাকে রাগান্বিত হতে দেখা গেছে সে ঘটনাগুলো খেয়াল করলে লক্ষ্য করা যায় সেগুলো জ্ঞান বা 'ইলম রিলেটেড ব্যাপার। অজ্ঞতা, জ্ঞান অর্জনের আদব বা ম্যানারস ঠিক না থাকা, জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতিতে ভুল থাকা - এধরণের ব্যাপারই বেশিরভাগ সময়ে তার রাগের উদ্রেক করেছে। এসব ব্যাপারের চেয়ে আপাত দৃষ্টিতে অনেক বেশি জঘন্য ভুল কাজেও দেখা গেছে তিনি মোটেই রাগ করেননি বরং অত্যন্ত নির্লিপ্ত ও অনেক ক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল ছিলেন।
প্রথমে তার রেগে যাওয়ার কিছু উদাহরণ দেখি আসুন।
১. না জেনে কথা বলার জন্য তাকে রাগতে দেখা গেছে। এক ব্যক্তির মাথায় পাথর লেগে বিরাট ক্ষত তৈরি হয়। পরে তার জন্য গোসল ফরজ হলে তিনি অন্যান্য লোকদের জিজ্ঞেস করেন যে এই অবস্থায় তিনি গোসল না করে তায়াম্মুম করতে পারবেন কিনা। সবাই তাকে বলেন যে এরকম কোনও সুযোগ নেই। নিরূপায় হয়ে তিনি গোসল করেন এবং এতে তার ক্ষত আরও বড় হয়ে যায় এবং তিনি মারা যান। এই ঘটনা শুনে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) প্রচন্ড রেগে যান এবং বলেন: “তারা তাকে হত্যা করেছে, আল্লাহ্ও তাদের হত্যা করুন! তারা যদি না জানে তাহলে জিজ্ঞেস করে না কেন!” [আবু দা’উদ]। আল্লাহ্র রাসূল (সা.) সাধারণত কাউকে অভিশাপ দিতেন না এবং এটা তিনি স্রেফ রাগ করে বলেছেন।
২. জ্ঞানের আদবকায়দা না পালন করার জন্য তিনি রাগ করেছেন। এক ব্যক্তি এসে আল্লাহ্র রাসূলকে জিজ্ঞেস করে, “কীভাবে রোজা রাখেন আপনি?” এ কথায় নবীজীর (সা.) সুন্দর চেহারায় প্রচন্ড রাগের ভাব ফুটে ওঠে এবং ‘উমার (রা.) পর্যন্ত নবীজীর (সা.) এই চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যান এবং আল্লাহ্র ও তার রাসূলের রাগ থেকে পরিত্রাণ প্রার্থনা করেন [মুসলিম]। এই কথায় নবীজী (সা.) কেন রাগ করলেন তার ব্যাখ্যায় ‘উলামারা অনেকে বলেছেন যে এখানে আদব ঠিক ছিলো না। তার বরং জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিলো, “আমি কীভাবে রোজা রাখবো?” শিক্ষককে প্রশ্ন করার সময় যথাযথ আদব ধরে রাখা দরকার।
৩. জ্ঞানের মেথডলজি ঠিক না থাকার জন্য তিনি রাগ করেছেন। ‘উমার (রা.) একদিন কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলেন যা তিনি ইহুদিদের কাছে পেয়েছিলেন। তিনি সেটা পড়া শুরু করলে নবীজী (সা.) রেগে যান এবং উমারকে ভর্ৎসনা করেন। তাকে তিনি জানিয়ে দেন যে যা তার কাছে অবতীর্ণ হয়েছে সেটাই এখন প্রযোজ্য এবং যদি মুসা (আ.) এখন আবার দুনিয়াতে আসেন তাহলে তিনিও নবী মুহাম্মাদের (সা.) কাছে প্রেরিত কুরআনই অনুসরণ করবেন [আহমাদ]। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থাবলি কোনও ডিবেট, ডায়ালগ বা রিসার্চের জন্য পাঠ করা যাবে বলে অনেকে মত দিয়েছেন কিন্তু কোনও মুসলিমের জন্য সেগুলো থেকে গাইডেন্স নেয়া আর বৈধ নয় কেননা কুরআন এসে সেগুলোকে রহিত করে দিয়েছে।
৪. এমন বিষয় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যা ইন্টেলেক্ট দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যেমন কিছু সাহাবী যখন কাদার বা তাকদীর অর্থাৎ আল্লাহ্র পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করছিলেন এবং এ নিয়ে তর্কাতর্কি করছিলেন তখন এটি দেখতে পেয়ে আল্লাহ্র রাসূলের (সা.) চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। তিনি তাদের বলেন, “এইজন্যই কি আমাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তোমাদের পূর্ববর্তীরা ধ্বংস হয়েছে এই নিয়ে তর্কাতর্কি করে। আমি যেন তোমাদের এ নিয়ে আর তর্কাতর্কি করতে না দেখি”। [আত-তিরমিযী, হাদীসটিতে কিছু দুর্বলতা আছে কিন্তু অন্যান্য দলিলের কারনে এটিকে হাসানের পর্যায়ে তুলেছেন অনেকেই]
৫. দরকারের চেয়ে বেশি বোঝার জন্য আল্লাহ্র রাসূল (সা.) রাগ করেছেন। তাকে একটি দায়িত্ব থেকে আল্লাহ্ একবার অব্যাহতি বা ছাড় দেন (হাদীসে দায়িত্বটির নাম আসেনি)। তো কিছু লোক সেই ছাড়কে পাত্তা না দিয়ে বরং বেশি ধার্মিকতা দেখাতে ঐ দায়িত্বটি বেশি করে পালন করতে থাকে। এই কথা নবীজীর (সা.) কানে আসলে তিনি রেগে যান এবং বলেন, “মানুষের কী হোল যে আমাকে যে বিষয়ে ছাড় দেয়া হয়েছে তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্লাহ্র শপথ, আমি তাদের চেয়ে বেশি জানি এবং আল্লাহ্কে তাদের চেয়ে বেশি ভয় করি”। [মুসলিম]
অপরদিকে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা শুনলে মনে হতে পারে আগের ঘটনাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি গর্হিত অথচ আল্লাহ্র রাসূল (সা.) একদমই রাগ দেখাননি, যদিও এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বাকি সাহাবীরা বেশ রেগে গিয়েছিলেন।
১. এক বেদুইন এসে মসজিদে প্রস্রাব করা শুরু করে দিয়েছিলো অথচ নবীজী (সা.) একদমই রাগ করেননি। সাহাবীরা এই কর্ম দেখে লোকটিকে ধরতে গিয়েছিলেন কিন্তু নবীজী (সা.) তাদের নিবৃত্ত করেন এবং সেই বেদুইনকে তার প্রয়োজন পূরণের সময় দেন। তারপর তিনি সাহাবীদের এক বাকেট পানি এনে এর ওপর ঢেলে দিতে বলেন এবং বলেন যে আমাদের সহজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠিন করার জন্য পাঠানো হয়নি। [বুখারী]
২. একজন সাহাবী মদ্যপ অবস্থায় ধরা পড়েন অথচ নবী (সা.) তার ওপর রাগ দেখাননি বরং তাকে দোষারোপ না করার অন্য অজুহাত খুঁজেছেন। এই অপরাধে যখন তাকে ইসলামে নির্ধারিত শাস্তি দেয়া হচ্ছিলো তখন সাহাবীদের একজন তাকে বলে বসেন, “আল্লাহ্র লানত পড়ুক তোমার ওপর”। তখন আল্লাহ্র রাসূল (সা.) বলেন, “এটা বোলো না, সে আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র রাসূলকে ভালোবাসে”। [উসদুল-গাবাহ্] এ থেকে এটাও বোঝা যায় যে একজন মানুষের জীবনে কোনও একটি পাপ থাকার মানেই এই নয় যে সে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত নয় বা তার ইসলামিক কমিটমেনট নেই।
৩. দুজন সাহাবী – একজন পুরুষ ও আরেকজন নারী – দুটি ভিন্ন ঘটনায় ব্যাভিচারে পড়ে যাবার পর নিজেরা এসে আল্লাহ্র রাসূলের কাছে নিজেদের শাস্তি কামনা করেন এবং আল্লাহ্র রাসূল (সা যদিও তাদের পীড়াপীড়িতে শেষমেষ বাধ্য হয়েই তাদের ওপর সেই শাস্তি এক্সিকিউট করেন কিন্তু পুরোটা সময়েই তার ভূমিকা ছিলো সহানুভূতিশীল ও দয়ার্দ্র। একজনের ব্যাপারে তিনি এও বলেন যে শাস্তি মাথায় পেতে নিয়ে যে তওবা তিনি করেছেন তা দিয়ে মদীনার ৭০জনের তওবা কাভার হয়ে যাবে। ঘটনাদুটির কোনোটাতেই তাকে রাগান্বিত হতে দেখা যায়নি।
৪. এমনকি যুদ্ধের সময় মুসলিমদের গোপন খবর এক সাহাবী শত্রুদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। এমন আঁতকে ওঠার মতো ভুল যা কিনা যে কোনও দেশেই সাক্ষাত দেশদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য হবে সেটা হয়ে যাবার পরও নবীজীকে (সা.) ঠান্ডা থাকতে দেখা গেছে। যখন আল্লাহ্র রাসূল (সা.) মক্কাকে ঘেরাও করার জন্য তৈরি হচ্ছেন সাহাবী হাতেব বিন আবু বালতা’আহ তার খবর আগাম মক্কার কুরাইশদের কাছে ফাঁস করার জন্য চিঠি পাঠান। কিন্তু নবীজী (সা.) সেটা আল্লাহ্র কাছ থেকে খবর পেয়ে তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলেন। হাতেবকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এমনটা কেন করলে হাতেব?” হাতেব বলেন, “হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার ব্যাপারে চট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না। মক্কা থেকে যে সাহাবীরা আপনার সাথে হিজরত করে এসেছে তাদের বেশিরভাগের মক্কায় জানাশোনা আছে তাই তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত। অন্যদিকে আমার অতটা খাতির নেই সেখানে, অথচ সেখানে আমার ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। তাই আমি চেয়েছি যে এই খবর তারা আগে থেকে আমার কাছ থেকে পেয়ে গেলে আমার আত্মীয়রা নিরাপদ থাকবে সেখানে। আমি ধর্মত্যাগ করার জন্য মোটেও এ কাজ করিনি বা ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি ভালোবাসার কারণেও করিনি। নবীজী (সা.) এ কথা শুনে অন্য সাহাবীদের বলেন, “সে সত্যি কথাই বলেছে তোমাদের”। তখন ‘উমার নবীজীকে (সা.) বলেন, “আপনি আদেশ করেন তো ওর গর্দান নিয়ে নিই!” তখন নবীজী (সা.) বলেন, “সে বদরের যুদ্ধে ছিলো, তুমি কী জানো, হয়তো আল্লাহ্ বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের দিকে নজর দিয়ে বলেছেন, ‘যা খুশি করো তোমরা, আমি তোমাদের মাফ করে দিলাম”। [আবু দাউদ, আত-তিরমিযি, প্রমুখ]
খেয়াল করুন নিচে যে চারটি হাদীস আপনারা পড়লেন সেগুলোতে যে ভুলগুলো এসেছে আমরা সবাই দাবী করবো হয়তো যে এগুলো ওপরের পাঁচটি হাদীসে বর্ণিত ভুলগুলোর চেয়ে বেশি ওজনদার ও মারাত্নক। অথচ নিচের গুলোতে নবীজীকে (সা.) একদমই রাগ করতে দেখা যাচ্ছে না যেখানে ওপরের হাদীসগুলোতে আমরা দেখছি তিনি স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে বেশ রেগে গেছেন। পার্থক্য এই যে ওপরেরগুলি সবই, যেমনটি আগেই বলা হোলো জ্ঞান সম্পর্কিত ত্রুটি যা নবী (সা.) একেবারেই বরদাশত করতে চাননি কেননা জ্ঞান এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিংই হোলো ইসলাম পালনের মূল উপাদান এবং যা দিয়ে ইসলাম শুরু হয় ও টিকে থাকে। অপরদিকে বহু মারাত্নক গুনাহকেই নবীজী (সা.) যথেষ্ট নির্লিপ্ততার সাথে গ্রহণ করেছেন এ কারণেই যে সেগুলো মানুষের সহজাত দুর্বলতার কারণে ঘটেছে।
এ থেকে নিশ্চিত করেই আমরা বহু চিন্তার খোরাক পেতে পারি
সংগৃহীত
বিষয়: বিবিধ
১৪৭০ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক চিন্তার খোরাক রয়েছে তাতে।
আমিও সেটাই বলি, না জানা অপরাধ নয়, কিন্তু সারাজীবন না জেনে কিছু করে যাওয়া অবশ্যই অন্যায়।
একটা বিষয় খুবই ভালো লেগেছে, কথাটা আমারও মনের কথা। দুই একটি ভুল দেখেই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা, লোকটি আগা গোড়াই খারাপ।
ছোট ছোট বাচ্চারা যখন না বুঝে মসজিদে পেশাব বা অন্য কিছু করে, তাতে বড়রা যেরকম বাজে আচরণ করে, তাদের জন্য এই হাদীস থেকে শিক্ষা রয়েছে।
জাজাকাল্লাহ হুজুর ।
ইসলাম এর পতন হয়েছে তখন থেকেই যখন জ্ঞানার্জন কে দুনিয়াবি কাজ বলে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন