পোর্টল্যান্ড সায়েন্স মিউজিয়াম ভ্রমন
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ০২:৪৭:২৪ দুপুর
আজ দিনটা বৃষ্টিস্নাত ছিলোনা,তবে মেঘলা। ফজরের নামাজের পর প্রতিদিনকার মত ঘুমালাম। উঠছি উঠবো করতে করতে প্রায় সাড়ে নয়টা বাজালাম। এরপর রেডি হয়ে পোর্টল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দু একবার সূর্য উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে, জনগন তাকে ভুলে গেছে কিনা ! গত ৩ সপ্তাহ উনার কোনো খবর নেই.....এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে মেঘমালা।
যাইহোক ভালোই ভালোই শহরের কেন্দ্র ধরে ব্রিজ ও ফ্লাইওভার পার ধরে অলামেট নদীর ওপারে পৌছলাম। একেবারে নদীর ধারেই OMSI নামক বিশাল স্থাপনা। ১৩ ডলারে প্রবেশ টিকেট টিকেট এবং সাথে ৫.৭৫ এ প্লানেটারিয়াম শো,৬.৭৫ এ সাবমেরিন এ প্রবেশের টিকেট নিলাম। বিশাল স্ক্রিনে ৩ডি সিনেমা দেখার ব্যবস্থা আছে কিন্তু এসব আমি দেখিনা। আরো আছে মোশন সিমুলেটর। হলিউডে এই জিনিস পরখ করতে গিয়ে মাথা ঘুরে গিয়েছিলো। আসনগুলো ব্যপক নড়াচড়া করবে আর বিশাল স্ক্রীনে ৩ডি শো চলবে,মনে হবে আমিও ঘটনার সাথে চলছি। অনেকের এতে মোশন সিকনেস শুরু হয়। আমারও হয় তবে সবসময় নয় এবং অতিরিক্ত হলেই এমন হয়।
রবীবার ছুটির দিন, লোকজন এসেছে বেশ দেখলাম। প্রথমে প্লানেটারিয়াম শোতে ঢুকলাম। ভেতরে আমিসহ সম্ভবত ১৫জনের মত হবে,প্রায় সব আসনই খালি। এটি একটি গোলাকার রুম। উপরে ছাদে বড় গম্বুজ,যা মূলত: একটি গোলাকার স্ক্রীন। খানিকপর শো শুরু হল মহাকাশ নিয়ে। এ সপ্তাহেরই ছবি দেখানো হল,যা শক্তিশালী টেলিস্কোপে ধারন করা হয়েছে। এক প্রফেশনাল ভদ্রলোক মহাকাশ সম্পর্কে ধারনা দিচ্ছিলো। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা না। তারকাগুলোকে অন্ধকারের ভেতর আলোর বিন্দু মনে হচ্ছিলো আর তার মধ্যে কিছু আছে অতি উজ্জ্বল আর কিছু কম উজ্জ্বল। এসব উজ্জ্বল তারকার একটির সাথে আরেকটির সংযোগে কাল্পনীকভাবে বিছিন্ন চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে এবং সেটা বহুকাল পূর্ব থেকে চলে আসছে। সেগুলো সুন্দরভাবে চিত্র সহকারে দেখানো হল। কিছু আছে ভাল্লুকের মত,কিছু মাছের মত,সিংহ আছে,তরবারীসহ মানুষ আছে,প্রাচীন দেব-দেবীসহ আরও অনেকসব চিত্র দেখলাম। বিষয়টা এতটাই হাস্যকর মনে হল যে মনে হচ্ছিলো পর্দায় চেয়ার ছুড়ে মারি। ছোটবেলায় শীতকালে লেপের নীচে ঢুকে উপরে তাকাতাম। তখন উপরের আলোয় লেপের ভেতরের তুলোর গঠন চোখের উপর নানান আকৃতিতে ভেসে উঠত। দেখতাম নানান প্রানী,গাছপালা নানান ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে আছে। আর সেটা এমন যা অন্যের চোখে হুবহু একইভাবে ধরা পড়বে না,বরং সেও দেখলে তার নিজের কল্পনার মত করে দেখবে। এখানেও তারাভরা আকাশ নিয়ে এমনই চিত্র আকা হয়েছে যার সাথে আসলেই মেলানো কষ্টকর। যে চিত্র দেখে মানুষ মনে হতে পারে, সেটাকে ঘোড়া বানানো হয়েছে,অথবা যা দেখে বান্দর মনে হতে পারে,সেটিই ভাল্লুক বানানো হয়েছে। তবে তারকাগুলো যেহেতু একইভাবে অবস্থান করছে তাই শুরুতে কেউ ওটা দেখে ভাল্লুক হিসেবে আখ্যায়িত করলে এবং অভিমতটি প্রতিষ্ঠিত করলে,বাকীরা সেটা বিশ্বাস করতে বাধ্য। কারন এগুলো করে মূলত: রাতে সমুদ্রবক্ষে দিক নির্দেশনা নিত নাবিকরা। ফলে সকলে একই রকম ও সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়ার স্বার্থে এসব কথা মেনে নিয়েছে। নি:সন্দেহে এটা বলা চলে যে-আপনি উজ্জ্বল তারকাগুলোর অবস্থান দেখে কথিত জীব-জন্তুর আকৃতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন না,যদি না এ বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু জ্যোতিষীরা আরেক কাঠি সরেশ। তারা এসব তারকার অবস্থান বিশ্লেষন করে মানুষের ভাগ্য গণনা করে।
বৃহস্পতি,মঙ্গল,প্লুটোসহ কয়েকটা গ্রহ ও তাদের উপগ্রহগুলোকে দেখলাম। গোলাকার বড় পর্দার প্রায় অর্ধেকটা অংশ আলোকিত করে বলা হল এটি হল মহাকাশের একটি মোটামুটি বড় তারকা,আর সামনে ছোট্ট যে আলো দেখছেন,সেটা হল আমাদের সূর্য্য। বুঝলাম আমাদের বিশাল সূর্য্য বড় তারার তুলনায় নস্যি। শো শেষ হল।
এবার সাবমেরিনের জন্যে অপেক্ষমান থাকলাম। এটাই ছিলো আমার কাছে প্রধান আকর্ষণ। কারন সাবমেরিনে চড়া সবার ভাগ্যে জোটেনা। এখানে কর্মরত একজন বৃদ্ধ ভলান্টিয়ার আমার সাথে খোশগল্প শুরু করল। প্রায় ১০ মিনিট গল্প করলাম। লোকটা সাংঘাতিক অমায়িক। এর ভেতর আমেরিকান নেভীর অবসরপ্রাপ্ত ও বয়ষ্ক সদস্য এসে বলল-আর মাত্র ৫ মিনিটেই তোমার অপেক্ষার পালা শেষ হবে।
তাকে অনুসরন করলাম। তিনি নদীতে নিয়ে গেলেন। ইউ.এস.এস ব্লুব্যাক ৫৮১ নামক সাবমেরিন এটা। ১৯৫৯ সালে যাত্রা শুরু করলেও এটা এখনও উপযোগী,যদিও সার্ভিস থেকে ১৯৯০সালে অবসর নিয়েছে। এখন এটি আভ্যন্তরিন কিছু রুটিন কাজ করে।
ভেতরে ঢুকে মনে হল যন্ত্রপাতির ভেতর কেউ আমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তেমন বর্ণনা দিতে পারব না,কারন চারিদিকে শুধু যন্ত্র আর যন্ত্র,মনে হল ঢাকার নওয়াবপুর রোডে ঘুরছি,যার দুপাশে সারিসারি যন্ত্রপাতির দোকান।
দ্বিতল বিশিষ্ট এই সাবমেরিনে মোট ৭৬ জন ক্রু আছে। এদের থাকার জন্যে যে কেবিন দেখলাম তা হল কফিন বক্স। ছোট্ট পরিসরে উপর-নীচ ৩টি বেড। হাত দিয়ে মেপে দেখলাম প্রথম দুটি বেড উচ্চতায় এক হাতের একটু কম,আর একেবারে উপরেরটা ১৩/১৪ উঞ্চির বেশী অবশ্যই হবেনা। এতগুলো লোকের টয়লেট ৩টা আর গোসলখানাও ৩টা। সেটার ভেতর শরীরটা কোনো রকমে ঢুকানো যাবে। নিয়ম হল প্রতি সপ্তাহে একবার গোসল করবে এবং বাথরুমে ঢুকে সুইচ টিপলে ৩০ সেকেন্ড ঠান্ডা পানি তার উপর পড়বে। এটাই গোসল। ভেতরে চলাচলের জায়গা একেবারেই সংকীর্ণ। এক চেম্বার থেকে আরেক চেম্বারে যাওয়ার দরজা পাইপের মত। আগে পা দিয়ে মাথা নীচু করে যেতে হয়। জানলাম এখানে ক্রুরা হয় একেবারে তরুন,নইলে টিকতে পারবে না। প্রতি ২ মাস পরপর ক্রু পরিবর্তন করা হয়। অবশ্য আধুনিক পারমানবিক শক্তিতে চালিত সাবমেরিন এর থেকে প্রায় আড়াই গুন বড়, সেটাতে ক্রুরা ৩ মাস পর পর পরিবর্তিত হয়। সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা বেশ উন্নত।
আমেরিকা অবশ্য ১৯০০ সালে প্রথম সাবমেরিন তৈরী করে,সেটা একেবারেই ছোট ছিলো। ভদ্রলোক বেশ রসিক,সেটাকে স্যান্ডউচের সাথে তুলনা করল। গেলাম ডাইনিং রুমে। এই টিমে আমরা মাত্র ৪জন লোক। অবশ্য বেশী মানুষ একবারে এখানে আসতে পারেনা। আরেকজনের নেতৃত্বে দেখলাম ৪/৫জন লোক একইভাবে দেখছে। ভদ্রলোক রাশিয়ার সাবমেরিন এবং আমেরিকান সাবমেরিনের নানান তুলনা করল।
কম্পিউটার রুমে গিয়ে সমুদ্রের নানান প্রানীর নানান রকমের শব্দ শুনলাম। এরমধ্যে তিমির শব্দটা বেশী উৎকট। গেলাম ড্রাইভিং রমে। ড্রাইভিং সিটে বসলাম কিন্তু সাবমেরিন হল অন্ধ। এটি চলে বাদুড়ের মত আল্ট্রাসাউন্ডে। শব্দ তরঙ্গ ছুড়ে দেখে সামনে ,পেছনে,উপরে,নীচে কি আছে। এরপর সেভাবে হিসেব করে চলে। ভেতরে একটি বিশাল কম্পাস আছে। কখনও সাগরের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে সাধারন কম্পাস অকেজো হয়ে পড়ে,তখন এই কম্পাসটি ব্যবহৃত হয়। অবশ্য আধুনিক সাবমেরিনের কম্পাস অনেক বেশী উন্নত। সাবমেরিনের বিশেষ স্থানে পানি ভরে নিয়ে ডুব দিতে হয়। আবার ভেসে ওঠার জন্যে পানি বের করে বিশেষ কিছু চেম্বারে বাতাস ভরা হয়। ভেসে থাকা অবস্থায় বাইরে দেখার জন্যে কিছু যন্ত্র আছে। সাবমেরিন কোথা থেকে যাত্রা করছে,কত গভীরে আছে,কতদূর যাবে এসব বিষয় পূর্ব পরিকল্পিত। এবং এটি ম্যাপ অনুযায়ী সেভাবেই চলে।
এবার আসলাম টর্পেডো চেম্বারে। গাইড তার অভিজ্ঞতা থেকে লেকচার দিয়েই চলেছেন। বিশাল বিশাল আকারের ২২টি টর্পেডো রিজার্ভ করা যায় এটাতে। টর্পেডো ছোড়ার জন্যে ৬টি গান আছে। আধুনিক সাবমেরিনে ব্যালেস্টিক মিসাইল যুক্ত আছে,যা পানি থেকে পানিতে ও আকাশে নিক্ষেপ করা যায়। ভদ্রলোক অনেক জ্ঞান দিয়েছে কিন্তু বেশীরভাগই ভুলে গেছি। বারবার বলছিলো প্রশ্ন করতে,কিন্তু কি প্রশ্ন করব তা খুজে পাচ্ছিলাম না। একসময় দেখা শেষ হল। ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসলাম। খুব মজা লাগল সাবমেরিন দেখে।
এবার মিউজিয়ামের এখানে সেখানে চক্কর দিলাম কিন্তু তেমন একটা ভালো লাগল না। এরকম বিষয় অগে বহু দেখেছি। ফিরতি পথ ধরলাম। কিন্তু পোর্টল্যান্ড এসে এশিয়ান স্টোরে যাবনা,তা হয়না। সব্জী আর জ্যান্ত তেলাপিয়া কিনলাম। এক হালাল স্টোরে গিয়ে মুরগী আর তেতুল কিনলাম। আমার তেতুলের স্টক শেষের পথে ছিলো।
ফিরেই রান্নাবান্না শুরু করলাম। অনেক দিন পর লাউ আর জ্যান্ত তেলাপিয়া টানলাম।
বিষয়: বিবিধ
১২০২ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তেলাপিয়া কি রান্না না করে জ্যান্তই খেলেন!!!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
ভালই লাগলো আপনার ভ্রমন বর্ণনা।
তবে একটি প্রশ্নঃ আপনি তেতুল দিয়ে কি করেন?
আমার তো তেতুল দেখলেই জিবে পানি এসে যায়।
আপনি কিভাবে কি করেন, জানাবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন