নিউ চায়না....৫

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১২ মার্চ, ২০১৩, ১১:০৫:২৩ সকাল



আমাকে অফিসিয়াল কাজে কাপু নামক পাহাড়ঘেরা এলাকায় যেতে হবে। গাড়ি পাঠানোর কথা ছিল কিন্তু তার দেরী হবে। আমি ভাবলাম বাসে যাব,যদি কোথাও সমস্যা হয় তাহলে তাকে ফোন করব। হোটেল ম্যানেজারকে রুট জানিয়ে বাস নং দিতে বললাম এবং বাসস্টপ চিনিয়ে দিতে বললাম। তার পূর্বে ডলার এক্সচেঞ্জ করতে হবে। ম্যানেজার আমাকে ব্যাংক অব চায়নাতে নিয়ে গেল। এ ব্যাংকটির শাখা অলিতে গলিতে। অল্প কয়েকজন মানুষ সার্ভিস নিতে আসলেও তারা দীর্ঘক্ষণ বসে ছিল। এর কারন হল এদের অদক্ষতা। এত সাংঘাতিক অদক্ষ্য নারী কর্মীদের দিয়ে এরা যে সার্ভিস দিচ্ছে তাতে বাংলাদেশ হলে ভাংচুর হয়ে যেত। লোকসংখ্যা এদের পর্যাপ্ত রয়েছে সার্ভিস দেওয়ার জন্যে কিন্তু সামান্য কাজের জন্যে যে হারে এরা সময় নষ্ট করছিল তাতে বিরক্তিতে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমাকে একটি ফর্ম পূরন করতে হবে এবং সেটি একজন কর্মকর্তাকে দেখালে তিনি আমার পাসপোর্ট চেক করে ডলার নিবেন এবং ইউয়ান প্রদান করবেন। কিন্তু এই কাজে আমাকে প্রায় ৩৫/৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে হল।

শুরুতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি ভারতীয় কিনা। ভাবলাম আমার চেহারা সুরত দেখে অনুমান করছেন কিন্তু পরক্ষনেই বুঝলাম উনি আমার পাসপোর্ট দেখেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি বললাম, আপনি আসলে ভারতীয় ভিসার পাতাটি খুলেছেন। আমার পরিচয় দেওয়া আছে পাসপোর্টের প্রথম দিকে। আমি সে পাতাটি খুললাম। এরপর তিনি আরেকজনকে আমার পাসপোর্টটি দেখালেন,তিনিও অনুরূপভাবে ভারতীয় ভিসার পাতাটি খুলে অনুরুপ মন্তব্য করলেন। এবার বিভিন্ন তথ্য জানতে চাইলেন এবং আমি তা পাসপোর্ট অনুযায়ী জানালাম। এবার আরেকজনের কাছে পাসপোর্ট গেলে তিনি আবারও একই কাজ করলেন। ভাবলাম কাজ শেষ হয়েছে; কিন্তু না। ব্যপক গবেষণা,ফর্ম পূরনের পর আমি নি®কৃতি পেলাম। কাউন্টারে যারা সার্ভিস দেন,তাদের সামনে একটি যন্ত্র থাকে ,যেখানে কিছু বাটন আছে এবং লেখা-সার্ভিস ভাল হলে এখানে চাপুন,মধ্যম মানের হলে এখানে এবং খারাপ সার্ভিস হলে এখানে চাপুন। ভাবছিলাম বাটন চেপে মন্তব্য করব। কিন্তু করলাম না। কারন এটাই হয়ত এদের ভাল সার্ভিস।

চায়নিজ মেয়েরা সেবা দানের ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিক কিন্তু এরা ঢাকায় বিভিন্ন অফিসে কর্মরত বাঙ্গালী মেয়েদের তুলনায় যথেস্ট অদক্ষ্য। এরা সাহায্য করতে পারলে যেন নিজকে ভাগ্যবান মনে করে কিন্তু সেটা করতে গিয়ে একাধিক ভুল করা এবং সময় নষ্ট করা এদের যেন অভ্যাস। তবে এরা টেকনিক্যাল কাজে বিশেষ পারদর্শী। সার্ভিস ওরিয়েন্টেড প্রতিষ্ঠানে আমি বরাবরই এদের অদক্ষতা দেখেছি। অবশ্য আমার এ মন্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

ম্যানেজার ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে আমাকে জানালো,তুমি ব্যাংকের সামনের বাস স্টপ থেকে ১ নং বাসে চড়ে গন্তব্যে যেতে পারবে। তিনি চলে গেলেন তার কাজে। আমি ব্যাংকে থাকা অবস্থায়ই ম্যানেজার মেয়েটিকে হন্ত দন্ত হয়ে প্রবেশ করতে দেখলাম। সে দৌড়ে হাফিয়ে গেছে। আমাকে বলল,একটু আগে যা বলেছি তা পুরো সঠিক নয়। তোমাকে ২১ নং বাসে একটি স্থানে যেতে হবে এবং সেখান থেকে ১ নং বাসে তোমার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। তিনি চায়নিজ ভাষায় দুটি গন্তব্যই লিখে দিলেন। কিন্তু কিভাবে বুঝব যে আমি আমার গন্তব্যে পৌছেছি ?

এ এক জটিল প্রশ্ন। এরা ইংরেজী জানেনা এবং রাস্তায় কিছু লেখা থাকলেও সেটা চায়নিজ ভাষায়। দুশ্চিন্তা নিয়ে ২১ নং বাসে উঠলাম। উঠেই মুখ দেখে ভাল মনে হওয়া এক লোককে চায়নিজ ভাষায় লেখা কাগজটি দেখিয়ে বললাম এখানে যাব। তিনি বুঝলেন। তারপর ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে,আমাকে বলে দিও কখন নামতে হবে। বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম সেটি সামনে কিনা। ঠিকানা জিজ্ঞেস করা সংক্রান্ত কথাগুলি বা চায়নিজ শব্দগুলি,যা আমার মুখস্ত ছিল তা বার বার পড়তে লাগলাম এবং অন্যকে সে অনুযায়ী জিজ্ঞেস করতে থাকলাম এমনকি ড্রাইভারকেও জিজ্ঞেস করেছি। ভাগ্য সহায় তাই যাকে জিজ্ঞেস করেছি,তিনিও একই গন্তব্যে যাচ্ছেন। তিনি নামার সময় আমাকেও নামতে বললেন। দেখলাম ড্রাইভারও আমাকে খুঁজছেন,তার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে গেলাম। এবার আমার হাতে থাকা ক্যাটালগটি একজন পথচারীকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ১ নং বাস কোথায় পাব। তিনি এক অমায়িক লোক। যাচ্ছিলেন অফিসে এবং বেশ দ্রুতবেগে। তিনি দু একটি ইংরেজী শব্দও জানেন। আমাকে নিয়ে তিনি উল্টোদিকে হাটতে লাগলেন,আমি লজ্জিত হলাম। বললাম,শুধু দেখিয়ে দিলেই চলবে। কিন্তু তিনি সম্ভবত আমার সমগোত্রীয় মানুষিকতা ধারন করেন। আমাকে পাত্তা না দিয়ে আমার উপকারের চিন্তায় বিভোর হলেন। তার অফিসের কথাও বোধহয় ভুলে গেলেন। তিনি অন্তত ২০০ মিটার আমার সাথে হাটলেন এবং বাস থামার স্থানটি দেখিয়ে বিদায় নিলেন। তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিলাম,নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম এবং তাকে জানিয়ে দিলাম যে, তিনি অতিশয় ভদ্র এবং বন্ধুবৎস্যল একজন মানুষ।

রাস্তার বিপরীত পাশে আসলাম। এখানে ফাইভ প্লাস নামক একটি শপিং সেন্টার রয়েছে,এর পাশেই বাসস্টপ। আমি অন্যদের মত করে বাসে উঠলাম এবং বাসে রক্ষিত বক্সে ১ ইউয়ানের কয়েন ফেলে বসলাম। ড্রাইভারকে গন্তব্যের কথা বললাম ,তিনি আমাকে জানাবেন বললেন। আমার আশপাশের ছিটে বসা প্রায় সবাই মেয়ে। অপরিচিত মেয়েদের সাথে কথা বলতে আমার কেমন জানি বাধে। পাশের সিটে বসা একজন ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে হল গরিব এবং অশিক্ষিত। তাকে জিজ্ঞেস করা বোধহয় অর্থহীন। তারপরও জিজ্ঞেস করলাম। কগজ দেখিয়ে বললাম এই স্থানটি কি চিনেন ? সে খুবই কর্কশ ভাষায় আমাকে বলল-চিনি মানে ? এই স্থানটি চিনি মানে কি ?? তারপর আরও কিছু বললেন যা আমি বুঝতে পারলাম না, তবে তিনি যে বিনা কারনে আমার ওপর চটেছেন তা বুঝতে পারলাম। তবে এটা বুঝতে পারিনি যে আমি তার কাছে ঠিকানা জানতে চেয়ে কি অপরাধ করলাম।

খানিক পর কয়েকটি চায়নিজ শব্দ পুজি করে ,সর্বোচ্চ মেধা খাটিয়ে বিনয়ের সাথে পাশের এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম আমার গন্তব্যের কথা। তাকে ক্যাটালগটিও দেখালাম। তিনি আমাকে চমকে দিয়ে স্পষ্ট ইংরেজীতে বললেন-আমি এটা ভালভাবেই চিনি এবং ওখানেই আমি যাচ্ছি। আপনার এই কোম্পানীর পাশেই আমার অফিস। আহ ! কি যে আনন্দ লাগল ! মনে হল মহা সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়ে কাষ্ঠখন্ড প্রাপ্ত হয়েছি যা বেচে থাকার অবলম্বন। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে আরামে বসে থাকলাম। তিনি বললেন, আপনাকে আমি সেখানে পৌছে দেব। আহা চমৎকার ! একেই বলে আল্লাহর সাহায্য যা ঘাটে ঘাটে পাচ্ছি। পূর্বেই নফল নামাজ মানত করা ছিল,এবার শুধু তা আদায় করার পালা। মেয়েটি আমার সম্পর্কে ,দেশের সম্পর্কে জানতে চাইল,জানালাম। তার ব্যাপারে কিছু জানতে চাইনি। যে এলাকায় যাব সেটি একটি ইকোলজিক্যাল পার্ক। খুবই সুন্দর স্থান। সে এলাকায় ঢোকার গেটেই ড্রাইভার আমাকে বলল,এটাই তোমার স্থান ,এখানে নামতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের সিটের মেয়েটি বলল,না তাকে আরও দূরে যেতে হবে। আমার গন্তব্যে গিয়ে বুঝলাম ড্রাইভারের কথা শুনলে আমাকে অন্তত ৩ কি:মি: হাটতে হত। মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানালাম যতটুকু মার্জিতভাবে জানানো যায়।

বিষয়: বিবিধ

১৪১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File