অপ্রতিরোধ্য আরব -সীরাত(৮)
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০৮:২১:১৭ সকাল
আরব অর্থ হল অনুর্বর ভূমী,বিশুষ্ক প্রান্তর। আরবের পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং সায়না উপদ্বীপ,পূর্ব দিকে আরব উপ-সাগর,দক্ষিনে ইরাকের বিরাট অংশ এবং আরও দক্ষিনে আরব সাগর। এটি মূলত: ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ। উত্তরে সিরিয়া এবং উত্তর ইরাকের একাংশ। এর তিন দিকে সাগর থাকায় একে আরব উপদ্বীপও বলা হয়।
জাজিরাতুল আরব এমন একটি স্থানে অবস্থিত যেটিকে স্থলভাগের মধ্যভাগ বলা যেতে পারে। স্থল ও নৌপথে পৃথিবীর সকল প্রাপ্ত থেকেই সহযে এ ভূখন্ডের সাথে যোগাযোগ করা যায় এবং যেত। প্রাচীনকাল থেকেই এই ভূখন্ডটি বহির্দিক এবং আভ্যন্তরিন দিক থেকে শুষ্ক প্রান্তর ও মুরভূমিতে ঘেরা এবং এর মধ্য দিয়ে চলে গেছে বৃক্ষলতাহীন নগ্ন পর্বতমালা। এর ভৌগলিক অবস্থানের কারনে বর্হিশক্তির হাত থেকে এই ভূখন্ডটি বেশ নিরাপদ ছিল,এর কারনে এখানে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলো ছিল প্রচন্ড স্বাধীনচেতা এবং একরোখা। ফলে তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি রোম ও পারস্য এর প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও এত কষ্টস্বীকার করে দখল করতে চাইত না বা পারত না। আরবকে দখল করতে না চাওয়ার আরেকটি কারণ হল এদের প্রচন্ড স্বেচ্ছাচারিতা,প্রবল স্বাধীনচেতা মনোভাব,কুসংষ্কারাচ্ছন্নতা,হিংস্রতা,আনুগত্য না করার মানুষিকতা,কলহপ্রিয়তা ইত্যাদী। এদের ভূখন্ড দখল করে আনুগত্য আদায় করতে পারবে ,এ ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী শাসকগণ,কোনোভাবেই নি:সন্দেহ ছিলনা। তাছাড়া এখানে এমন কোনো মহা মূল্যবান সম্পদরাশীও ছিলনা যার কারনে বহু কষ্টস্বীকার করে এটাকে দখল করতে হবে। তারপরও রোমান সম্রাট তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার সৈন্য পরিচালনা করে। তবে তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
আরবরা ছিল দূর্দমনীয় এবং তারা যুদ্ধে যেসব অপ্রচলিত নীতি ব্যবহার করত তার সাথে রোমান সৈন্যরা অভ্যস্ত ছিলনা। বিশেষকরে বেদুইন সৈন্যরা ভয়াবহ হিংস্র ছিল। তারা প্রতিশোধ গ্রহনে পিছপা হতনা। যখনই তারা বুঝত নিয়মিত সৈন্যরা তাদেরকে আক্রমন করতে আসছে এবং তারা এর প্রতিরোধ করতে পারবে না,তখন তারা পচাঁদপসরণ করত বিশাল মরুভূমীর দিকে। রোমের নিয়মিত সৈন্যরা মরুভূমীতে অভিযানে বেদুইন আরবদের মত অভ্যস্ত ছিলনা। বেদুইনরা অল্প খাদ্য-পানি নিয়ে বহু দূর পর্যন্ত ভ্রমন করতে অভ্যস্ত ছিল। এক একটি উটে তারা প্রায় ৬ সপ্তাহের খাবার নিয়ে ক্লান্তিহীন ভ্রমন করতে পারত। অল্প খাবার আর পানি গ্রহণ করেও তারা মরুভূমীতে তাদের পারদর্শীতা দেখাতে ছিল সিদ্ধহস্ত। তারা অল্প রসদে মরু ভূমীর মধ্যে যুদ্ধে পারদর্শী ছিল। কখনও রোমান সৈন্যরা তাদেরকে আক্রমন করলে তারা চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে সেসব সৈন্যদেরকে ক্ষতির মুখে ফেলে দিত। রাতে তারা শত্র“ বাহিনীর রসদ লাইনে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ব্যপক ক্ষতি সাধন করত। প্রদিশোধ নিতে তারা একযোগে কাজ করত। এবং তাদেরকে ধরতে পারা মোটেও সহজ ছিলনা। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ হয়ে হঠাৎ আক্রমন করত এবং মরুভূমীতে হারিয়ে গিয়ে পূণরায় সেখানে মিলিত হয়ে পরিকল্পনা করে আবারও আক্রমনের জন্যে প্রস্তুত হত। বিশাল মুরভূমীতে রাত দিনের যেকোনো সময়ে সঠিক দিক নির্নয়ে তাদের পারদর্শীতা ছিল অনন্ন। তাই রোমান অথবা পাশ্ববর্তী দেশের যোদ্ধারা আরবদেরকে সহযে ঘাটাত না। বরং তারা তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনীতে আরব যোদ্ধাদের আলাদা ইউনিট গড়ে তুলেছিল। আরব যোদ্ধারা সাময়িক চুক্তিতেও অন্যের হয়ে যুদ্ধ করত।
আরব কখনই অন্যের অধীনে ছিলনা। সৃষ্টির প্রথম থেকেই এটি ছিল স্বাধীন। বাবেলের অত্যাচারী রাজা বখতে নাসর বণূ ইসরাইলকে ধ্বংস করেছিল এবং বিতাড়িত করেছিল। কিন্তু আরবকে ধ্বংস করতে পারেনি। গ্রীক ও রোমকগণ বহু শতাব্দী পর্যন্ত রাজত্ব করলেও তারা আরবকে আক্রমন করেনি। আলেকজান্ডার ও অন্যান্য রোমক সেনাপতিগণ আরবে আক্রমন পরিচালনা করেনি। আরব পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত হলেও তারা আরবকে আক্রমন করেনি। হাবশীগণ ইয়মেন জয় করে মক্কা আক্রমন করে গজবের শিকার হয়,যা সুরা ফিলে বর্ণিত আছে। ইতিপূর্বেও বেশ কিছু শাসক মক্কা আক্রমন করে গজবের শিকার হয়েছে,তাই বহু শাসক এদিকে আক্রমন পরিচালনা করতে ভয় পেত।
আরবরা সাং®কৃতিকভাবেও স্বাধীন ছিল। তারা নিজেরা যা ভাল মনে করত তা পালন করত। কিন্তু তারা অন্যের সাংষ্কৃতি গ্রহন করেনি। বহুকাল যাবত আরবরা বহির্বিশ্বর জ্ঞান থেকে অজ্ঞ ছিল। তারা অজ্ঞানতার অন্ধকারে বসবাস করত। সমগ্র আরবে অল্প কিছু লোক ব্যতীত সকলেই নিরক্ষর ছিল। তারা কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম পদ্ধতি একত্রে পালন করত না। বরং বহু রকমের বিধিবধান যা তারা নিজেরা রচনা করেছিল সে মোতাবেক পরিচালিত হত। পৃথিবীর অন্য অংশের মত রাজা বাদশাহের কোনো অস্তিত্ব আরবে ছিলনা। যদিও কুরাইশরা সম্মানিত ছিল তার পরও অন্য গোত্ররাও নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করত। প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিজস্ব নিয়মে সন্তুষ্ট ছিল। অন্যের কতৃত্ব না মানার জন্যে তারা দেবদেবীকে পর্যন্ত ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। এবং সেসব দেবদেবীর নামে তারা বিভিন্ন রসম রেওয়াজ চালু করে,তা পালন করত।
আরবের আদী ইতিহাস বর্ণনায় আমাদেরকে আল-কুরআনের সাহায্য নিতেই হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে প্রাচীন কিছু বিষয় সম্পর্কে আবহিত করছেন।
“যখন ইব্রাহিম (আল্লাহর কাছে) দোয়া করল-হে আমার মালিক ! এই (মক্কা)শহরকে নিরাপত্তার নগরীতে পরিণত করুন এবং আমাকে ও আমার সন্তান সন্ততিদেরকে মূর্তীপূজা করা থেকে বিরত রাখুন !”-(আল-কুরআন,১৪:৩৫)
“হে আমাদের মালিক ! আমি আমার কিছু সন্তানকে আপনার পবিত্র ঘরের কাছে এনে আবাদ করলাম,যাতে করে -হে আমাদের মালিক ,এরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে,যেন মানুষের অন্তর এদের প্রতি অনুরাগী হয়,আপনি ফলমূল দিয়ে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করুন ! যাতে ওরা আপনার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে।”-( আল-কুরআন,১৪ঃ৩৭)
“ইব্রাহিম এবং ইসমাঈল যখন এই(ক্কাবা)ঘরের ভিত্তি নির্মান করছিল,(তারা দোয়া করল) হে আমাদের মালিক ! আপনি আমাদের কাজকে কবুল করুন,একমাত্র আপনিই সবকিছু জানেন এবং সবকিছু শোনেন।”-(আল-কুরআন,২:১২৭)
“তোমরা কি একথা বলতে চাও যে,ইব্রাহিম,ইসমাঈল,ইসহাক,ইয়াকুব ও তাদের পরবর্তী(নবী-রসূল)সবাই ছিল ইহুদী কিংবা খ্রিষ্টান ? হে নবী ! আপনি বলে দিন, এ ব্যাপারে তোমরা বেশী জানো ,নাকি আল্লাহ বেশী জানেন ? যদি কোনো ব্যক্তি তার কাছে মজুদ থাকা আল্লাহর কাছ থেকে আগত সাক্ষ্য প্রমানসমূহ গোপন করে,তাহলে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে ?”-(আল-কুরআন,২:১৪০)
“যখন আমি ইব্রাহিমকে এই(ক্কাবা)ঘরের নির্মানের জন্যে স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম,তখন নির্দেশ দিয়েছিলাম-আমার সাথে অন্য কাওকে শরিক করোনা...”-(অঅল-কুরআন,২২:২৬)
“হে আমার মালিক ! আপনি আমাকে নেক সন্তান দান করুন ! অত:পর আমি তাকে একজন ধৈর্য্যশীল নেক সন্তানের সুসংবাদ দিলাম।.......এরপর আমি তাকে ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ দান করলাম,সে হবে নবী ও আমার নেক বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত।......আমি তার(ইব্রাহিম আ এবং ইসহাকের ওপর আমার রহমত বরকত দান করেছি ,তাদের উভয়ের বংশধরদের মাঝে কিছু সৎকর্মশীল মানুষ আছে এবং আছে কিছু নাফরমানও,যারা নিজেদের ওপর যুলুম করে স্পষ্ট অত্যাচারী।-(আল-কুরআন,সূরা সাফ্ফাত: ১০০,১০১,১১২,১১৩)
আল-কুরআনের সূরা ইব্রাহিমের উপরোক্ত বর্ণনায় মক্কা(প্রাচীন নাম ছিল বাক্কা) নগরীর প্রাচীন অবস্থা ফুটে উঠেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিমকে একটি পুত্র সন্তান ‘হযরত ইসমাঈলকে(আ’ দান করেছিলেন। এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে পরিক্ষা স্বরূপ তিনি শিশু ইসমাইল এবং তার স্ত্রী হাজেরাকে নির্জন মরুভূমীর একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে এসেছিলেন। “ইব্রাহিম(আবলেন আমি তোমাদেরকে আল্লাহর হেফাজতে রেখে গেলাম। স্ত্রী হাজেরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর বন্ধু ! আপনি কি এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ লাভ করেছেন ? তিনি(আবললেন-হ্যা ,আমার ওপর আল্লাহ তায়ালার এটাই নির্দেশ। স্ত্রী হাজেরা একথা শুনে বললেন,তাহলে আপনি যান। আল্লাহ নিশ্চয় আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না। আমরা আল্লাহর ওপর নির্ভর করছি এবং তিনিই আমাদের আশ্রয়স্থল।”-(তাফসীর-ইবনে কাসীর,প্রথম খন্ড,বুখারী)। আপন স্ত্রী-পুত্র দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার দূরত্ব অতিক্রম করলে হযরত ইব্রাহিম(আ আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন-“ হে আমাদের প্রতিপালক ! আমি এই জনশুণ্য উপত্যকায় আমার বংশধরদের কতকের বসতি স্থাপন করে যাচ্ছি আপনার সম্মানিত ঘরের নিকট,তা এই উদ্দেশ্যে যে-তারা নামাজ কায়েম করবে। হে মহান প্রভূ ! আপনি আরও মানুষের মন তাদের প্রতি আকৃষ্ট করিয়ে দিন। আর ফলমূল খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে পানাহারের সুব্যবস্থা করে দিন,যাতে আপনার নিয়ামত উপভোগ করে মানুষ আপনার শুকরিয়া আদায় করে।-(আল-কুরআন,১৪: ৩৭) কিছু দিনের মধ্যেই তাদের সাথে থাকা খাদ্য পানীয় শেষ হয়ে যায় এবং ইসমাঈলের মাতা হাজেরা চারিদিকে ছোটাছুটি শুরু করেন খাদ্য-পানীয়ের জন্যে। সহিহ বুখারীর বর্ণনা মতে ইসমাইল(আএর মাতা সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ে উঠে লোকজনের অস্তিত্ব দেখার জন্যে সাত বার দৌড়াদৌড়ী করেছেন,একইসাথে তিনি শিশু ইসমাঈলকে দেখার জন্যে তার কাছে ছুটে আসতেন।
শেষেরবার তিনি যখন ইসমাইলের কাছে আসেন তখন একটি আওয়াজ শুনতে পান। তিনি বলেন-যদিও কোনো উপকার করতে পার তবে কাছে এস। এরপর ফেরেশতা জিবরাইল উপস্থিত হন এবং তিনি হাজেরাকে তার পায়ের গোড়ারী দ্বারা মাটিতে আঘাত করতে বলেন। এরপর সেখান থেকে পানি নির্গত হতে শুরু করে এবং হাজেরা পানির চারিপাশ গর্ত করতে শুরু করেন। তিনি স্থানটি ঘিরে একটি কূপের আকার দান করেন। পরবর্তীতে জরহাম গোত্রের লোক এদিক দিয়ে অতিক্রমের সময় কূপটি দেখতে পায়,তারা বলাবলি করে,ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার এপথে চলেছি কিন্তু পানির চিহ্ন দেখিনি। (জরহাম ছিলেন কাহতানের পুত্র,জরহামীদেরকে কাহতানীও বলা হয়)তারা তখন তাদের গোত্রের সকলকে এই চমৎকার পানির কথা বলেন এবং তাদেরকে নিয়ে আসেন ও মা হাজেরার অনুমতিক্রমে পানি সংগ্রহ করেন এবং .............এরপর ইসমাঈলের(আ মাতার অনুমতিক্রমে এই কূপের আশপাশে বসবাস শুরু করে এবং একটি বসতি গড়ে ওঠে। সেই স্থানটিই হল আজকের মক্কা।
হযরত ইসমাইল এবং তার মাতাকে দেখাশুনা করার জন্যে হযরত ইব্রাহিম(আ মাঝে মাঝে ফিলিস্থিন থেকে মক্কায় যেতেন। মোট কতবার তিনি এভাবে ভ্রমন করেছেন তার সঠিক ইতিহাস আমাদের কাছে নেই,তবে হাদীস থেকে চার বারের কথা স্পষ্ট জানতে পারি । ইসমাইল(আঃ) বয়ো:প্রাপ্ত হলে কুরবানীর ঘটনা ঘটে। মহান আল্লাহর একান্ত অনুগত বান্দা হিসেবে তারা পরিক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তির্ণ হন। যখন হযরত ইসমাইল(আ যুবক হলেন এবং বিবাহিতও ছিলেন,সেসময় পিতা-পুত্র মিলে ক্কাবাঘর পূণ:প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ইসমাঈল(আএর বিবাহের পর তার মাতা মৃত্যুবরণ করেন’-(বুখারী ১মখন্ড)
চলছে.....
বিষয়: বিবিধ
১১৯৮ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ
"(আঃ)"গুলো সব আ হয়ে গেছে
(আঃ লেখার পরে একটা স্পেস দিয়ে ) দিলে ইমো আসবেনা! (আঃ )
লেখার জন্য ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
Question to you, How far way do you live from MALHEUR COUNTY,OR?
মন্তব্য করতে লগইন করুন