নিউ চায়না....৪
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১১ মার্চ, ২০১৩, ১০:২৮:১০ সকাল
হোটেলের বালিশ কখনও জাতের হয়না। এরা তথাকথিত দামী জিনিস দিয়ে এসব সরঞ্জামাদী বানায় বটে ,তবে শিমুল তুলোর বালিশের ওপর জিনিস নেই। আমি কয়েকটা টাওয়েল পর পর রেখে,তার ওপর বালিশ দিয়ে এ দুঃখ মোকাবিলা করলাম। ঘুম হল চমৎকার। যে কোনো স্থানেই আমার ভাল ঘুম হয়। ফাইভ স্টার হোটেলে ঘুমালে যে তৃপ্তি পাই,ফুটপাথে ছালার চট পেতে কেউ ঘুমাতে দিলে মোটামুটি একই রকম তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাব।
চায়নার সকালের কালচারে আমি সাংঘাতিক মুগ্ধ হই। এরা একেবারে সাত সকালে কর্মের জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এটা দেখে আমার পূর্বে মুসলিম শাসনের কথা মনে পড়ে। ফজরের পর আনুষাঙ্গিক,নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ সেরে মানুষ সরকারী বা বেসরকারী কাজে যেত আর যোহরের সময় বা যোহরের পরপরই বাড়ি ফিরত। এতে তারা তাদের পরিবারকে,আত্মীয় স্বজন,বন্ধু-বান্ধবকে বেশী সময় দিতে পারত। এসমস্ত সম্পর্কের বন্ধনও বেশ অটুট থাকত। তাদের শরীর-স্বাস্থ্যও একই কারনে ভাল থাকার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি দেশী বা বহুজাতিক কোম্পানীগুলো কাপড় নিংড়ানোর মত করে আমাদের সার্ভিস নিয়ে যায়। তারপর রসকষহীন দেহ মন নিয়ে বাড়ির চৌকাঠ মাড়ালেই অনুরূপ রস নিংড়ানো স্ত্রী মার-মার কাট-কাট করতে করতে তেড়ে আসে। যদি সেভাবে নাও আসে তবে ক্লান্তি,অবসাদ,বাস্তবতা নানান রকম অর্থনৈতিক বা সংকীর্ণ সামাজিক,পারিবারিক হিসাব নিকাশ তাদেরকে সকল ব্যাপারে কেমন যেন বেরসিক করে তোলে। কিছু অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে কিছু কোম্পানী এভাবে আমাদের সামাজিক,পারিবারিক জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। তবে কালচারটা এমনভাবে সেট করা আছে যাতে এসব যাতাকলে পিষ্ঠ মানুষেরা অভিযোগ ভুলে যায়। উন্নত হওয়া বলতে বরাবরই আমরা অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেই,যার কারনে অন্যদিকে আমাদের হিসাব নিকাশ সহসা করা হয়না। আমরা টাকার চক্রে থেকে টাকার সাথে টাকার তুলনা করি। টাকার উর্দ্ধে উঠে টাকাকে পরিমাপ করতে পারিনা।
সকালে চায়নার কর্মব্যস্ততা আমাকে মুগ্ধ করে। খুব ভোরে ঝাড়–দাররা একটি সাইকেল ভ্যান অথবা ইলেকট্রনিক গাড়ি ,ভ্যাকুয়াম ক্লিনার,ঝাড়– ইত্যাদী নিয়ে হাজির হয়। রাস্তা থেকে যতেœর সাথে ধুলা-বালি,ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে। বড় শহরগুলোতে দেখেছি বিশাল সাইজের পানির ট্যাংক এসে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার করছে। কিছু গাড়ি আছে যেগুলোর নীচে বড় বড় ব্রাশ স্বয়ংক্রীয়ভাবে ঘুরে জমাট ময়লা উঠিয়ে ফেলে,তারপর পানি ছিটিয়ে বা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সাহায্যে পরিষ্কার করে ফেলে। এমন পরিচ্ছন্ন রাস্তায় যে কেউ’ই হাটতে আরাম বোধ করবে। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ফাঁকি দেয়না বলেই জানি। এদের কাজ কেউ তদারকি করে বলে দেখিনি কিন্তু কাজে এরা ফাঁকি দেয়না। অনেক স্থানে দেখেছি সারাদিন টুকটুক করে তারা কাজ করেই যাচ্ছে। তার কাজের সময় শেষ হবার আগে আযাচিত বিশ্রাম নিচ্ছেনা।
সকালে প্রত্যেক রাস্তায় অনেক খাবার বিক্রেতা গরম গরম খাবার তৈরী করে বিক্রী করে। ধনী-গরিব সকলেই সেখান থেকে খাবার কিনে। একেক প্রদেশের খাবারের ধরন একেক রকম। আমি সকালে বিভিন্ন রাস্তায় হেটে হেটে বিভিন্ন রকমের খাবার পরখ করলাম। বেশ কয়েক রকম খেয়েছিও। একহাত লম্বা এক ধরনের টোস্ট জাতীয় জিনিস,এরসাথে ডিম ভাজি। সাথে কয়েক রকমের পিঠা,নুডুলস। কোনোটা বেশী লবনাক্ত,কোনোটা লবন ছাড়া। এদের কিছু সস বা মশলা মেশালে সেটি আমার কাছে আর খাদ্যদ্রŸ্য বলে বিবেচিত হয়না। শাওশিংএর একটি স্পেশাল খাবার হল চালের গুড়ো বা গমের ময়দার খামির তৈরী করে এর ভেতর শুয়োরের মাংস ভরে ভাপে সিদ্ধ করা। সেটি এরা সস দিয়ে খায়। বানানোর প্রক্রিয়া দেখলে খুব ভাল লাগে। কিন্তু এর মধ্যে শুয়োরের মাংশ না দিয়ে অন্য মাংশ দিলেও আমি খেতাম না। নেপালে আমি এ খাবার দেখেছি,সেটাকে মঃমঃ বলে। তবে নেপালের মঃমঃ এর স্বাদ চায়নার মত না। ওটা আমি বেশ খেয়েছিলাম। ওখানকার মুসলিমরা এটা খুব চমৎকার বানায়,ভেতরে দেয় মহিষের মাংস।
রাস্তার পাশের চমৎকার পার্কে বুড়োরা দেখলাম শরীর তাজা রাখার সব রকমের কসরতই করছে। এদের বুড়োরা জং ধরা না। এরা দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকে। কারন এরা প্রচুর কায়িক পরিশ্রম করে। পৃথিবীর সব দেশের তরুন যুবকরাই সকালের ব্যাপারে বাধ্য না হলে এ লাইনে আসে না। অনেকে তখন আসে যখন বুঝতে পারে,না এসে আর উপায় নেই। খেলাধুলার সাথে যুক্ত এমন তরুন,যুবকরা ছাড়া অন্যদেরকে সকালে খুব একটা উঠতে দেখা যায় না। আমাদের দেশের স্টুডেন্টরা তো ফ্রোজেন মুরগী। খেলা-ধুলার মাঠ যেভাবে দখল হয়ে গেছে তাতে তাদের স্টাটাস ব্রয়লার মুরগী থেকে ফ্রোজেন মুরগীতে উন্নিত হবে,এটাই তো স্বভাবিক।
হোটেলের অনতিদূরে অবস্থিত পার্কে দেখলাম বুড়োরা কুংফুর একটি অংশ তাইজিচুয়ান প্রাকটিস করছে। তাইজিচুয়ান এমন একটি আর্ট যা ছোট,বড়,বুড়ো সকলেই করতে পারে। এটি ধীরে ধীরে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে একটি নিয়মের অধীনে এনে তাকে কর্মক্ষম রাখে। এটি একটি দারুন ব্যায়াম। এতে হাত,পা সঞ্চালনের সাথে সাথে শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠা-নামার ছন্দ তৈরী করা হয়েছে। যে কোনো ধরনের মানুষকে শারিরীকভাবে অধিক সক্ষম করতে এর জুড়ি নেই। পূর্বে মনে করতাম চায়নার প্রায় সকলেই মার্শাল আর্টিস্ট। কিন্তু বাস্তবতা হল চায়নার দেড়শ কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি লোকও মার্শাল আর্ট জানেনা।
চলছে.....
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন