হাদীস যেভাবে সংরক্ষিত হল-শেষ পর্ব(সীরাত ৬)
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:০১:৩২ সকাল
খলিফা হযরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ প্রথম হাদীস সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। তিনি হাদীস সংগ্রহের জন্যে আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে হাজাম(রহ: ) এবং সাঈদ ইবনে ইব্রাহিমকে(রহ: ) একাজে নিযুক্ত করেন। ফলে খলিফার এ সংক্রান্ত ঘোষণার পর সর্বপ্রথম ইবনে শিহাব যুহরী(রহ: ) গ্রন্থাকারে হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। সাঈদ ইবনে ইব্রাহিম(রহ: ) বলেন- খলিফার নির্দেশে আমরা স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র দফতরে হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলাম,এবং সেগুলো খিলাফতের প্রত্যেক অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিল।
(সূত্র: ইবনে আবদিল বার,জামিউ বয়ানিল ইলম-বৈরুত:দারুল জীল-১৯৭৪,পৃ-৩৬)
ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের আদেশে সর্বপ্রথম ইবনে শিহাব যুহরী হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে হাদীস সংকলন করেন। এরপর থেকে হাদীস শাস্ত্রের গ্রন্থ সংখ্যা ব্যপকভাবে বাড়তে থাকে।
-(ফুতহুল বারী)
ইবনে শিহাব যুহরী’ই(রহ: ) সর্ব প্রথম হাদীস এবং সীরাত বা নবী চরিতকে পৃথকভাবে সন্নিবেশিত করেন। তিনি ঈমাম যুহরী নামে ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তবে তার হাদীস গ্রন্থটি বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী বা রাবীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা ধারার ভিত্তিতে রচিত ছিল না। সর্ব প্রথম ঈমাম মালিক(রহ: ) ‘মুয়াত্তা’ হাদীস গ্রন্থটি বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী রচনা করেন বা হাদীস সংকলন করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। সমসাময়িক অন্যান্য প্রখ্যাত আলিমগণ হাদীস শাস্ত্রে ব্যপক অবদান রেখেছেন। ঈমাম মালিক(রহ: )সহ আরও বহু প্রখ্যাত আলিম ছিলেন তার সুযোগ্য ছাত্র। ইমাম মালিকের(রহঃ) মুয়াত্তা হাদীস গ্রন্থ প্রথম শেণীর মর্যাদা লাভ করে। এরপর ইমাম আবু হানীফার(রহঃ) দুই সুযোগ্য সহচর ঈমাম মুহাম্মদ(রহ: ) এবং ঈমাম আবু ইউসুফ(রহ: ) আবু হানীফার(রহ: ) রেওয়ায়েতগুলো একত্র করে ‘কিতাবুল আসার’ সংকলন করেন। এ যুগের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদীস সংকলন হচ্ছে- ‘জামি’-সুফিয়ান সওরী(রহ: ),জামি-ইবনুল মুবারাক(রহ: ),জামি-ঈমাম আওযাই(রহ: ),জামি-ইবনে জুরাইজ(রহ: )। পরবর্তীতে আসে বুখারী,মুসলিম,তিরিমিযি,আবু দাউদ,নেসাঈ,ইবনে মাজাহ,মুসনাদ,কিতাবুল উম্ম,ইবনে হিব্বান,ইবনে খুজাইমা,দারু কুতনী,তাবারানী ইত্যাদী প্রখ্যাত হাদীস গ্রন্থ।
পরবর্তীতে হাদীস শাস্ত্রের বিশুদ্ধতা পরিক্ষায় আসমাউর রেজাল শাস্ত্র রচিত হয়। এটি ইতিহাস পরিক্ষার এমন একটি পদ্ধতি,যা পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র উদাহরণ। এখানে বর্ণনার সত্যসত্য নির্ধারনে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে তার নাম উসূলুল হাদীস। এখানে উল্লেখিত আছে কি কি দোষ থাকলে বক্তব্য গৃহীত হয়না, কি কি গুণ থাকলে তা গৃহীত হতে পারে, কি কি গুনের কারনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় ইত্যাদী।
যিনি ঘটনা বর্ণনা করছেন,তাকে প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয় বা প্রত্যক্ষভাবে রসূলের(সাঃ) কাছ থেকে জানতে হয়। ঘটনা যেখানে লিপিবদ্ধ হচ্ছে সেখানে প্রথমজন থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনাকারীর বিস্তারিত তথ্য,জীবনী লিপিবদ্ধ থাকে। এখানে তার ব্যক্তিগত পূর্ণাঙ্গ পরিচয়,স্বভাব-চরিত্র,জীবিকা অন্বেষনের পদ্ধতি,কখনও মিথ্যা বলেছেন কিনা,তার জ্ঞানের পরিধী,স্মৃতিশক্তি কেমন ইত্যাদী সকল বিষয়ে লিপিবদ্ধ থাকে। তার চারিত্রিক কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত সঠিক বক্তব্যও গ্রহণ করা হয়না, অথবা হলেও সেটি দূর্বল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এভাবে প্রত্যেকটি হাদীস অনুসন্ধান করে তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করা যায়।
তবে কিছু কিছু হাদীস এমন আছে যেগুলোকে কোনো কোনো আলিম সঠিক বলেছেন এবং কেউ কেউ সন্দেহযুক্ত বলেছেন অথবা বাদ দিয়েছেন। এর অর্থ হল, উভয়েই এই বিষয়ে ব্যপক গবেষণা করেছেন এবং কেউ হয়ত দেখেছেন বর্ণনাকারীগণ বা রাবী তার ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে কখনও মিথ্যা বলেছেন বা এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন যা উক্ত আলেম তার জ্ঞানে ভাল চোখে দেখেন না,তখন তিনি উক্ত রাবীর বর্ণনা পরিহার করেছেন। এমন ক্ষেত্রে তিনি যদি মনে করেন যে,এখানে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে; তখন তিনি তার একটি যুক্তিসঙ্গত বা সুন্নাহসম্মত ব্যাখ্যাও দান করেন। আবার দেখা যায় একই হাদীস অনুসন্ধান করে আরেকজন আলেম তা গ্রহণ করছেন। এর কারণ হতে পারে, উক্ত রাবী হয়ত তার নিজের কোনো ব্যাপারে ছোট খাট মিথ্যা বলেছিলেন যেটি মিথ্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়, বা ততটা সীমা লঙ্ঘন করেনি,অথবা তিনি মিথ্যা বলেছেন কিনা সে ব্যাপারে হাদীস সংগ্রাহক আলিম পুরোপুরি নিশ্চিত নন,তবে রাবী পূর্ববর্তী যে সূত্র বা বর্ণনাক্রম উল্লেখ করেছেন তা পুরোপুরি সঠিক,আবার একই বিষয়ে একাধিক রাবীর বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে উক্ত আলেম একই হাদীস গ্রহণ করছেন এবং তারও একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন। কোনো হাদীসের বর্ণনা একজন রাবীর কাছ থেকে পাওয়া গেলে সেটাকে গরীব হাদীস বলা হয়। (বিভিন্ন রকমের হাদীস রয়েছে,রাবীদের সম্পর্কে অনেক তথ্য রয়েছে,যা প্রায় প্রত্যেক হাদীসগ্রন্থের প্রথম দিকে বর্ণনা করা হয়ে থাকে,বিস্তারিত বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নয়)
তবে মুতাওয়াতীর হাদীস নিয়ে আপত্তি নেই। এটি হল এমন ধরনের হাদীস যার বর্ণনা রাবীগণ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেন এবং তাদের একের সাথে অন্যের জানাশোনা নেই। বিষয়টা এমন- ধরুন রাস্তায় একটি দূর্ঘ্যটনা ঘটল,সেখানে দশ জন লোক প্রত্যক্ষদর্শী ছিল এবং তারা ছিল দশটি এলাকার এবং যাদের একের সাথে অন্যের কোনো সম্পর্ক ছিলনা। পরবর্তীতে উক্ত দশটি এলাকায় গিয়ে দশ জনের সাথে আলাদা আলাদাভাবে কথা বলে যদি উক্ত দূর্ঘ্যটনার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হয়,এবং যদি তারা সুবিস্বস্ত হয়,তাহলে তাদের বর্ণনার ভাষায় কিছু পার্থক্য থাকলেও সত্য বিষয়টি অবশ্যই জানা সম্ভব হবে। এই পদ্ধতির নাম মুতাওয়াতির। ‘শুধুমাত্র নিয়ত সম্পর্কিত বিষয়ে প্রায় ৭০০টি সনদ রয়েছে’-(তাদবীন-পৃ-৫৪)। বহু সংখ্যক মুতাওয়াতির হাদীস রয়েছে।
হাদীস শাস্ত্র নিয়ে কাজ করতে হলে আল-কুরআনের বিষয়েও ব্যপক জ্ঞান থাকা দরকার হয়। কোনো হাদীস কুরআনের কোনো আয়াতের বা ইসলামের মূল ভাবের বিরোধী হলে তা পরিত্যাগ করা হয়। এভাবে বহু উপায় উপকরণ রয়েছে হাদীসের সঠিকতা নির্ণয়ে। কিছু হাদীস রয়েছে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণীয়, কিছু হাদীস কেউ গ্রহন করেছেন এবং কেউ কেউ করেননি, কিছু হাদীস কিছু আলিম গ্রহণ করেছেন দূর্বল হিসেবে,কিছু হাদীস মিথ্যা বা জাল প্রমানিত হওয়াতে বাতিল করা হয়েছে। কেউ হাদীস গ্রহনে অতিরিক্ত সতর্ক,আবার কেউ কিছুটা ছাড় দিয়েছেন,তবে সেগুলোকে দূর্বল/গরিব হাদীস বলেছেন। একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, ইমাম বুখারী(রহঃ) বহু দূরের একটি অঞ্চলে একজন হাদীসের আলেমের কাছে গমন করলেন হাদীস সংগ্রহের জন্যে, কিন্তু তিনি তাকে দেখলেন কিছু ছোলা হাতে নিয়ে উক্ত আলিম তার ঘোড়াকে ডাকলেন এবং সেটাকে ধরলেন, কিন্তু ছোলাগুলো ঘোড়াকে খেতে দিলেন না। এটাকে ঘোড়ার সাথে প্রতারণা সাব্যস্ত করে তিনি সেই আলিমের কাছ থেকে হাদীস সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকলেন। আরেকবার এক আলিমের গরুর বাচ্চা মারা যাওয়াতে গরু দুধ দিবেনা এই চিন্তায় তিনি চামড়ার মধ্যে খড়কুটো ভরে গরুর সামনে রেখেছিলেন,যাতে গরু এটাকে তার বাছুর ভাবে এবং দুধ দোহনে সমস্যা না হয়। এটাকে গরুর সাথে একটি প্রতারতা আখ্যায়িত করে ঈমাম বুখারী(রহঃ)উক্ত আলিমের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করেননি। এভাবে বহু সংখ্যক হাদীস শাস্ত্রের পন্ডিত ব্যক্তি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাদের ব্যাপারে অনেক অবিশ্বাস্য রকমের সত্য কাহিনী রয়েছে।
হাদীস শাস্ত্রে কিছু ঈমাম এমন অবদান রেখেছেন এবং এমনভাবে হাদীস সংগ্রহ করেছেন যে, তাদের ওপর সকল বিশেষজ্ঞের আস্থা রয়েছে। যেমন ঈমাম বুখারী(রহ ও ঈমাম মুসলিম(রহ। লক্ষ লক্ষ হাদীস থেকে তারা যে প্রক্রিয়ায় সঠিকটি বেছে নিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ এবং অসম্ভব ধরনের। অতিরিক্ত কঠোরতায় তারা প্রতিটি হাদীস সন্নিবেশিত করেছেন। বুখারী ও মুসলিম হাদীস গ্রন্থের সূত্র উল্লেখ করার সময় এর পূর্বে সহীহ শব্দটি যুক্ত করা হয়, কারণ এই শাস্ত্রদ্বয়ের বিশুদ্ধতা নিয়ে আলিমদের মধ্যে দ্বিমত নেই। এছাড়া আরও অনেক হাদীস শাস্ত্র রয়েছে যার ওপর অধিকাংশ আলিমের আস্থা রয়েছে। একই হাদীস একাধিক কিতাবেও সন্নিবেশিত হয়েছে। কোনো কোনো হাদীস শাস্ত্রে মাত্র দু-একটি ছাড়া সবগুলোই সঠিক বলে প্রমানিত হয়েছে। তবে এখানেও পূর্বের বক্তব্যটি প্রদান করতে হচ্ছে। যিনি সঠিকতা নিরূপণ করছেন তিনি কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি হাদীসকে গ্রহণ করছেন বা দূর্বল হিসেবে নিচ্ছেন বা পরিত্যাগ করছেন,সেটি লক্ষ্যনীয়।
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল, আলিমদের মধ্যে কোনো কোনো হাদীস গ্রহণ করা বা না করার মধ্যে যে মতদ্বৈততা রয়েছে,তার ব্যাখ্যা আমাদের জন্যে সুফল বহন করে। কারণ এতে আমরা হাদীস শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করার সুযোগপ্রাপ্ত হই,সতর্ক হতে পারি। এতে উম্মাহ উপকৃত হয়। প্রখ্যাত আলেমগণ কখনই মতদ্বৈততাকে মত-বিরোধের দিকে নিয়ে যান না এবং নিয়ে যাননি। কারণ তারা জানেন সর্বোত্তম পদ্ধতিতে,অতি শ্রদ্ধার সাথে বিতর্ক করতে হয় বা নিজের মতামতকে উপস্থাপন করতে হয়,এটাই সুন্নাহ। মুসলিমের সাথে সত্য প্রচারে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়া, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হারাম।
যাইহোক রিজাল শাস্ত্র এমন একটি শাস্ত্র,যেখানে কোনো বাণী রসূলের(সাঃ) মূখ নিসৃত কিনা বা তার অনুমোদিত কিনা সেটা অনুসন্ধান করে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রিজাল শাস্ত্রটি এতটাই উৎকৃষ্ট মানের যে উচ্চারিত দু-একটি শব্দের সত্যতাও নিরূপণ করা সম্ভব।
আর আমি যেসকল জাল হাদীস দেখেছি সেটার অনেকাংশই আমাদের মৌলিকত্ত্বে আঘাত করেনা, তবে কিছু কিছু জাল হাদীস মারাত্মক। সাধারণ মানের বানোয়াট হাদীস কেউ না বুঝে বিশ্বাস করলেও তেমন কিছু এসে যায় না(বানোয়াট হাদীস জানার সাথে সাথে পরিত্যাগ করতে হবে),তবে জ্ঞান অর্জন করা ফরজ,আমাদেরকে সাবধানী হতে হবে। জ্ঞানী ব্যক্তিদের ওপর দায়িত্ব,তারা সত্য অনুসন্ধান করবে তাদের সাধ্য মত। কিন্তু কোনো হাদীসকে জাল হিসেবে পাওয়ার পর তা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে।
একটি বহুল প্রচলিত জাল হাদীস উল্লেখ করছি-“ সুদূর চীন দেশে হলেও বিদ্যা অর্জন করতে যাও” আরেকটি বহুল প্রচলিত জাল হাদীস হল-“দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।” প্রথম জাল হাদীসটি কেউ না জেনে বিশ্বাস করলে কিছু এসে যায় না, কিন্তু দ্বিতীয়টি গ্রহণ করলে ঈমানের ক্ষেত্রে ব্যপক গড়বড় দেখা দিতে পারে।
প্রথম জাল হাদীসটি-“ সুদূর চীন দেশে হলেও বিদ্যা অর্জন করতে যাও” সম্পর্কে মুহাদ্দীস আল্লামা শাওকানী(রহ: ) বলেন-এই হাদীসটি মুহাদ্দীস উকাইলী(রহ: ) এবং মুহাদ্দীস ইবনে আদী(রহ: ) কর্তৃক হযরত আনাস(রা: )এর সূত্রে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। শাওকানী(রহ: ) বলেন-এই হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দীস ইবনে হিব্বান বলেন এটি একটি বানোয়াট হাদীস,এর কোনো ভিত্তি নেই। এই হাদীসের সনদে আতেকা নামক একজন মুনকারুল হাদীস বা হাদীস শাস্ত্রের অগ্রহনযোগ্য ব্যক্তি রয়েছে। আল্লামা ইবনুল জওজী(রহ: ) তার ‘মওযুআতে’ বা জাল হাদীসের কিতাবে এই হাদীসটি অন্তর্ভূক্ত করেছেন। ইমাম আযযাহাবী(রহ: )তার ‘তালখীছুল ওয়াহিয়াহ’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে,এই হাদীসটি অনেক সনদে বর্ণিত হয়েছে,যার কিছু অংশ গ্রহনযোগ্য আর কিছু অংশ অগ্রহনযোগ্য। হাদীসটির দুটি অংশ রয়েছে। একটি হল বিদ্যা অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ,আরেক অংশ হল চীন দেশে গিয়ে বিদ্যা অর্জন। এই হাদীসে চীন দেশ সংক্রান্ত প্রতিটি সনদই মওযু বা অগ্রহনযোগ্য। আর বিদ্যা অর্জনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপের বিষয়টি সত্য।
(কাশফুলখফা-১/১৫৪,কিতাবুল মাওযুআত-১৫৪,আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুআ-২৭২)
আর ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’ সু-মধুর বাক্যটি সম্পর্কে মুহাদ্দীস আল্লামা ইসমাইল অললুনী উল্লেখ করেছেন যে-ইমাম সাগানী(রহ: ) বলেন যে,এটি একটি বানোয়াট উক্তি,হাদীস নয়। এ সম্পর্কে মুল্লা আলী কারী(রহ: ) বলেন হাফেজুল হাদীসগনের কাছে এই হাদীসটির কোনো ভিত্তি নেই। আল মাওযুয়াতুল কুবরা গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে-হাদীস শাস্ত্রের প্রখ্যাত পন্ডিত মুহাদ্দীস যারকানী(রহ: ) বলেন আমি এই হাদীসটি সম্পর্কে অবগত নই। আর মুহাদ্দীস মুঈনুদ্দিন(রহ: ) বলেন এটি কোনো হাদীস নয়,বরং পূর্ববর্তী কোনো মনীষীর উক্তি। আল মাকাসিদুল হাসানাহ-১৮৯,কাশফুলখফা ১/৪১৩,আল মাসনু-৯১)
আসলে হাদীসটির আধুনিক সূত্র হল লিবিয়ার সাবেক নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফী। দেশবাসীর ব্যপক আনুগত্য দরকার হলে তার ভাড়াকরা বুদ্ধিজীবীরা দেশপ্রেমের ওপর পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিল এবং পুরোনো এই বাক্যটি বিবৃত করেছিল। বিষয়টি এতটা ব্যপকভাবে প্রচার করা হয় যে সাধারণ মানুষ এটাকে হাদীস হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি নিজে উঁচু দরের কমিউনিস্ট হলেও হাদীসের নামে ফায়দা তুলতে কার্পণ্য করেননি। রসূল(সাঃ) সকল গোত্রগত,বংশগত,অঞ্চলগত,বর্ণগত,ভাষাগত জাতিয়তাবাদকে মানুষের চিন্তা ও সমাজ থেকে ধবংশ করে এক উম্মাহর চিন্তা সরবরাহ ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে এসকল ক্ষুদ্র উপাদানে মুসলিম যদি নিজেকে উদ্বুুদ্ধ করে; তাহলে সে আবারও ইসলামপূর্ব জাহেলিয়াতে ফিরে গেল, যেখানে এসবের ভিত্তিতে আবেগ অনুভূতি নির্ণিত হত।
রসূল(সাঃ) বলেন-“যে ব্যক্তি জাতীয়তাবাদের দিকে ডাকে ,সে আমার উম্মত নয়”-(আবু দাউদ,নাসাঈ,রিয়াদুস-সালেহিন) “...এবং সতর্ক থাক গোত্রগত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন।”-(আল-কুরআন,৪ঃ১)
তবে কেউ কোনো ভূখন্ডে বসবাস করলে; সেখানকার আবহাওয়া জলবায়ু,মানুষকে তার ভাল লাগবে এটা স্বাভাবিক এবং এ কারনে কোনো অঞ্চলকে ভাল লাগতে পারে। এই দূর্বলতা বা ভালবাসা অন্যায় নয়। কিন্তু এই ভাললাগা,ভালবাসা বা দূর্বলতার ভিত্তিতে বিচার ফয়সালা করা,আবেগ সৃষ্টি করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া চরমভাবে নিষিদ্ধ। এই দূর্বলতাটাকে আদর্শের ভিত্তি বানানো যাবে না। রসূল(সা মক্কা থেকে মদীনায় হিযরতের সময় বারবার পেছনের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তার প্রিয় মক্কা নগরীকে দেখছিলেন। মক্কায় জন্মানো এবং সেখানে বেড়ে ওঠার কারনে মক্কার প্রতি তার স্বাভাবিক টান ছিল বা আবেগ-ভালবাসা ছিল। কিন্তু তিনি এই ভূখন্ডগত অনুভূতীর ভিত্তিতে তার উম্মতকে পরিচালিত করেননি বা আদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেননি। ওটা ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়,যাতে সে দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। খ্যাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারটিও তাই। এগুলি তার মধ্যে ভাল লাগার অনুভূতী সৃষ্টি করে। পুরোনো অভ্যাসের ব্যাপারটি মনে করিয়ে দেয়,তাতে সে মানুষিক সুখ অনুভব করে। এ বিষয়গুলিতে একের সাথে অন্যের বিস্তর পার্থক্য থাকতে পারে। রসূল(সা: ) আল্লাহর বিধান দ্বারা এসকল জাতিয়তাবাদী আদর্শ ধবংশ করে দিয়েছেন,যাতে তার উম্মত এগুলোর ওপর নির্ভর করে নিজেরা মানুষিক ও আদর্শগতভাবে বিভক্ত না হয়ে পড়ে।
জাতিয়তাবাদী আদর্শ থেকে অন্যরা সহজে আবেগ-অনুভূতীগতভাবে এবং পদ্ধতিগতভাবে পরিত্যাজ্য হয়। আর এই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নির্ণিত সিদ্ধান্তে ভুল হয় ,কারণ এখানে স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। ইসলাম আমাদেরকে চিন্তাগত ঐক্যের কথা শেখায়, যেটি হল জীবনাদর্শ এবং সারা বিশ্বে এটি এক। আর বিধানটি সকল মানুষের স্রষ্টার কাছ থেকে অবতীর্ণ হওয়ার কারনে সেটি সকলের ক্ষেত্রে সমান এবং একমাত্র সঠিক।
আমরা পৃথিবীর যে ইতিহাস পড়ি তা অনেকটা একতরফা। সেটি সত্য কিনা বা কতটুকু সত্য তা বিচারের কোনো রাস্তা খোলা নেই। কিন্তু আসমাউর রেজাল শাস্ত্র এমন একটি শাস্ত্র; যার প্রশংসা করেছে ইসলামের শত্রুরাও। বহু মনীষী স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন এর শ্রেষ্ঠত্বের কথা। জার্মানীর আরবী ভাষার পন্ডিত ডক্টর স্পেঙ্গর,যিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য থাকা কালে ইসাবা নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন,সেখানে তিনি লেখেন- “ পৃথিবীতে অতীতে এমন কোনো জাতি ছিলনা,বর্তমানেও নেই,যারা মুসলিমদের রিজাল শাস্ত্রের ন্যায় একটি শাস্ত্র তৈরী করতে পেরেছে, যার সাহায্যে আজ আমরা অনায়াসে পাঁচ লক্ষ লোকের বাস্তব জীবনী অবগত হতে পারি।”
পৃথিবীর বহু সংখ্যক লেখক মহান আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রাসূল মুহাম্মদ(সাঃ) এর জীবনী লিখেছেন। এতটা ব্যপকভাবে পৃথিবীতে আর কোনো মানুষের জীবনী লিখিত হয়নি এবং পঠিত হয়নি। কোনো মহামানবের জীবনী এতটা ব্যপকভাবে অনুসৃতও হয়নি। পূর্বের সকল নবীকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হলেও মুহাম্মদ(সাঃ) কে গোটা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যে আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, যাতে সকল মতাদর্শের ওপর তার আনিত জীবন বিধান বিজয় অর্জন করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“তিনি সুস্পষ্ট বিধানসহ তার রাসূলকে প্রেরণ করেছেন, যাতে তা সকল বিধানের ওপর বিজয়ী হতে পারে,তা মুশরিকদের কাছে যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।”-(আল-কুরআন,৬১: ৯)
ইসলাম নামক বিধানের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত (“হে মুহাম্মদ ! আমি আপনাকে সকল মানুষের হেদায়েতের জন্যেই প্রেরণ করেছি”-আল-কুরআন,সূরা সাবাহ:২৮,
“তিনি বরকতময়,যিনি স্বীয় বান্দা(রসূল সাঃ)এর প্রতি আল-কুরআন অবতীর্র্ণ করেছেন, যেন তিনি নিখিল বিশ্বকে সতর্ক করতে পারেন।”-আল-কুরআন,সূরা ফুরকান:১)।
রসূল(সা বলেন-“গোটা বিশ্বের মাখলুকের জন্যে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে”-(মুসলিম)
“প্রত্যেক নবী প্রেরিত হয়েছেন শুধুমাত্র আপন সম্প্রদায়ের জন্যে,কিন্তু আমি প্রেরিত হয়েছি সকল জাতির মানুষের জন্যে।”-(বুখারী ও মুসলিম)
তিনিই সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তারপর আর কেউ নবীরূপে আবির্ভূত হবে না। তার মাধ্যমে নবুয়্যতের মিশন সু-সম্পন্ন হয়েছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-“মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নন,বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী”-(আল-কুরআন,সূরা আহযাব: ৪০)
রসূল(সাঃ)বলেন-“আমার এবং অন্যান্য রসূলের উদাহরণ এইরূপ যে, কোনো একটি সুরম্য অট্টালিকা নির্মিত হল এবং মানুষ এর সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে থাকল এবং প্রশংসা করতে লাগল। কিন্তু এই সুরম্য অট্টালিকার এক কোনে একটি ইটের পরিমান স্থান শূণ্য দেখে তারা বলতে লাগল, আহা ! কতই না সুন্দর হত যদি এই ইটের পরিমান শূণ্যস্থান পূরণ হত ! অত:পর তিনি(সাঃ) বলেন- আমিই সেই শূণ্যস্থান পূরণস্বরূপ ইট খন্ড,আর আমিই সর্বশেষ নবী।” -(সহীহ বুখারী)
রসূল(সা: ) বলেন- “নিশ্চয়ই রিসালাত ও নবুয়্যতের সূত্র বন্ধ হয়ে গেল,অনন্তর আমার পর আর কোনো রসূলও হবেন না, নবীও হবেন না।” -(আল-মুসনাদ-ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ৫ম খন্ড,পৃ-২৪৮)
রসূল(সা বলেন- “আমার পরে আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না”-(তিরমিযি)
“রসূলের(সাঃ) ওফাতে ওহী নাযিল হওয়ার রাস্তা চীরতরে বন্ধ হয়ে গেছে”- (সহিহ মুসলিম)
রসূল(সা বলেন- “...আমিই হলাম আকেব, আর ‘আকেব’ হল ঐ ব্যক্তি,যার পরে আর কোনো নবী নেই” -(বুখারী ও মুসলিম)
বিষয়: বিবিধ
১৯০৯ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
আরেক পন্থী হল বাতিল। এরা কবর পুজারী,শিরক,বিয়যাত নিয়ে আছে। এরা কিছু সহি কিতাবের পাশাপাশি মারেফতি বা সুফীদের লে খা বিভ্রান্ত কিতাব চর্চা করে এবং নিজেদের মতেও পরিচালিত হয়। ব্যাখ্যাগত পার্থক্য সমস্যা না। কিন্তু বিভিন্ন আলেমদেরকে ানুসরনকারী কিছু পাতি হুজুর আছে ,এরা নিজেদের মত কে প্রতষ্ঠিত করার জন্যে অন্যকে পচায়। এরাই সমস্যা বাধিয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন