যেভাবে হাদীস সংরক্ষিত- ১ম পর্ব (সীরাত-৫)
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৫১:০৩ সকাল
আল-কুরআন আল্লাহর প্রত্যক্ষ আদেশ আর হাদীস হল তার ব্যাখ্যা স্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান দান করেছেন। কুরআন এবং বিস্তারিত সুন্নাহ দিয়ে আমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন,-
“ আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন(জীবন ব্যবস্থা) হিসেবে মনোনিত করলাম” -(আল-কুরআন,৫ঃ ৩)।
দ্বীন হল সেটাই; যা আল্লাহ আদেশ করেছেন এবং রসূল(সাঃ) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু রসূল(সাঃ) প্রথম দিকে হাদীস লিখে রাখতে নিষেধ করতেন, যদিও পরবর্তী পর্যায়ে তিনি হাদীস লেখার অনুমতি দিয়েছেন। প্রথম দিকে লিখতে নিষেধ করতেন, কারণ তিনি মনে করতেন এতে কুরআনের আয়াত ও হাদীস কেউ কেউ গুলিয়ে ফেলতে পারে। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সরকারী কার্যসমূহ সমাধা করা, বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ-গোত্রপতিগণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নিকট পত্র প্রেরনের জন্যে তা নিয়মানুযায়ী লিখিত হত এবং এসকল পত্র লেখার পর রসূল(সা তা শুনতেন এবং সত্যায়িত করতেন। এমন শতাধিক পত্র এখনও বর্তমান রয়েছে। রসূল(সা বিভিন্ন বিষয় লেখার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন সাহাবাকে নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজনকেও দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন। এভাবে লিখিত হয়েছে চুক্তিপত্র,সন্ধীপত্র,দাওয়াতপত্র,প্রশাসনিক বিভিন্ন নির্দেশ সম্বলিত পত্র,যুদ্ধের সময় নির্দেশপত্র বা বিভিন্ন দিক নির্দেশনা ও খবরাখবর,প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ও লিপিবদ্ধ হয়েছে।
হযরত আলী(রা: ) এবং ওসমান(রা: ) উভয়ই ওহী লেখক ছিলেন এবং রসূলের(সা: ) বিভিন্ন নির্দেশ ও চিঠি-পত্র লিখতেন। কিন্তু কোনো কারনে তারা অনুপস্থিত থাকলে উবাই ইবনে কাব(রা: ) এবং যায়েদ বিন সাবিত(রা: )তাদের স্থলাভিষিক্ত হতেন। খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আস(রা: ),মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান(রা: ) রসূলের(সা: ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়াদী লিখতেন। মুগীরা ইবনে শোবা(রা ও হোসাইন ইবনে নূমাইর(রা: )জনসাধারনের কার্যাবলী, পারষ্পরিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়াবলী লিপিবদ্ধ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আরকাম ইবনে আবদেয়াগুস(রা: ) ও আলী ইবনে উকবা(রা: ) আরব গোত্রসমূহের কূপগুলোর বিবরণ,আনসারীদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য,পারিবারিক বিষয় ইত্যাদী লিখতেন। যায়েদ ইবনে সাবিত(রা ওহী লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজা বাদশাহ এবং প্রভাবশালীদের উদ্দেশ্যে পত্র লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। মুকাইকিব ইবনে আবু ফাতিমা(রা: ) মালে গতিমতের ব্যাপারে লিখতেন। হানযালা ইবনে রবী(রা: ) এসকল সাহাবীদের অনেকের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করতেন।
-(হযরত মাওলানা হাফিজ যাকারিয়া (রহ: )-সাহাবা চরিত)
সাহাবায়ে কেরামগণ অত্যন্ত যত্নের সাথে এবং অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে ও সতর্কতার সাথে হাদীস সংগ্রহ করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবীদের কাছ থেকে অন্যরা জেনে নিতেন। প্রধান সাহাবীগণও একে অন্যের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সিন্ধান্ত ,মতামত জানতেন। জিজ্ঞাসিত হবার পর তারা রসূলকে(সা: ) কোন কাজ কিভাবে করতে দেখেছেন সেটা অঙ্গভঙ্গীসহ বর্ণনা করতেন এবং সেখান থেকে তার কি মনে হয়েছে বা সিদ্ধান্তটা কি হতে পারে বা হবে সেটাও জানাতেন। অন্যরা সেটা মেনে নিত এবং এভাবে বিষয়টি লিপিবদ্ধও হত। সাহাবীরা ছিলেন উম্মতের সবথেকে নিষ্ঠাবান,নির্ভূল অনুসারী। সাহাবীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকায় ইসলাম প্রচারে ছড়িয়ে পড়েন, কিন্তু কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন হলে এবং সে সম্পর্কে তার কাছে তথ্য না থাকলে,তারা শত মাইল এমনকি হাজার মাইল ভ্রমন করে একটি হাদীস সংগ্রহ করেছেন এমন অসংখ্য ঘটনা আমরা ইতিহাসে দেখী। যেমন দুগ্ধপানকারী** বোনকে না জেনে বিয়ে করলে পরবর্তীতে জানার পর এর ফয়সালা কি হবে শুধু এই হাদীসটি জানতে উকবা ইবনে হারিস(রা: ) মক্কা থেকে মদীনায় গমন করেন, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ একটি হাদীস জানতে মদীনা থেকে এক মাসের দূরত্ব সিরিয়ায় গমন করেন, আবু আইয়ুব আনসারী(রা: )একটি হাদীস সম্পর্কে সন্দেহ দূর করতে মদীনা থেকে সুদূর মিশরে গমন করেন। ইতিহাসে হাদীসের শিক্ষার জন্যে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের পরবর্তী আলিমরা সর্বদা ভ্রমনের ওপর থাকতেন। এতে রাস্তার দৈর্ঘ্য বিবেচ্য বিষয় ছিলনা এবং দু:খ কষ্টের বিবেচনা ছিল গৌন।
(** = আরবের রীতি ছিল সন্তান জন্মের পর দূরবর্তী কোনো স্বাস্থ্যকর স্থানে কয়েক বছর লালন পালন করতে দাইয়ের কাছে পাঠানো। তারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পরের সন্তানকে আপন দুগ্ধ পান করাত।)
সাহাবাদের সময়ে হাদীস লিখিত ও অলিখিত দুটোই ছিল। তারা হাদীস মুখস্ত করতেন, তাঁর(সা: ) অভিব্যক্তি,ভাব ইত্যাদীও পুরোপুরি মুখস্ত করতেন। পরবর্তীতে কেউ হাদীস জিজ্ঞেস করলে তা রসুলের(সা: ) সে সময়ের পূর্ণ অভিব্যক্তি,আবেগ অনুভূতীসহ প্রকাশ করতেন। এবং তাদের শ্মরণশক্তি ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য, তারা সহযে বিস্মৃত হতেন না। আরবদের শ্মরণশক্তি প্রবাদতুল্য। বনী ইসরাঈল যেমন বহু নিয়ামত প্রাপ্ত হয়েছে , তেমনী আরবরা আল্লাহর কাছ থেকে বিরাট শ্মরণশক্তি প্রাপ্ত হয়েছিল। তারা বংশ পরম্পরায় প্রাচীন উপকথা,ইতিহাস,বংশ তালিকা,বংশের বিভিন্ন ঘটনাবলী,কবিতা ইত্যাদী মুখস্ত করে রাখত। তাদের বেশীরভাগ লোকই লেখাপড়া জানত না কিন্তু তারা নিখুঁতভাবে মুখস্ত করতে পারত এবং তা সহসা ভুলত না। এসব নিয়ে বড়াইও চলত। তারা বিভিন্ন আসরে প্রাচীন কাহিনী,কবিতা,বংশতালিকা ইত্যাদী প্রকাশ করত। এমনকি তারা তাদের পালিত ঘোড়ার বংশ তালিকাও মুখস্ত করে রাখত। এসব কাজ তারা ঐতিহ্যগতভাবে করত।
ঈমাম শাফেয়ীর(রহ: ) মতে হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা শুধুমাত্র মক্কা-মদীনাতে ছিল ষাট হাজার। এর মধ্যে দশ হাজার সাহাবীর বিষয়ে লিখিত আছে। ঈমাম আবু যুর’আ রাজীর() মতে হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার। আরও বহু ঈমামের মতে তাদের সংখ্যা লক্ষাধীক ছিল। বহু সাহাবী তাদের জীবনকে হাদীস চর্চা ও তা প্রচারে জীবনকে ওয়াকফ করেছিলেন। আসহাবে সুফ্ফার এই একটি কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ ছিলনা। তাদের ঘর সংসার ছিল না। তারা মসজীদে নববীতে দিন-রাত হাদীস চর্চা করতেন,অন্যরা তাদের জিবীকার ব্যবস্থা করত।
সাহাবাদের পরবর্তী পর্যায়ের আলিম ,যারা সাহাবাদের থেকে কুরআন-সুন্নাহ চর্চা করেছেন তারা তাবেঈন এর তাদের ছাত্ররা তাবেঈ-তাবেঈন, এরা সকলেই অত্যন্ত নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে জ্ঞান চর্চা করেছেন এবং তা লিখিত ছিল। প্রথমে হাদীস শ্রবন,শিক্ষা লাভ করা,মুখস্ত করা তারপর হাদীস মোতাবেক আমল করা বা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। তারপর হাদীস প্রচার করা বা অন্যকে শিক্ষা দেওয়া এবং হাদীস লিপিবদ্ধ করা ছিল সাহাবায়ে কেরাম অত:পর তাবেঈন ও তাবেঈ-তাবেঈনের কাজ এবং পরবর্তীকালের আলিমরা প্রযুক্তির সান্নিধ্য পাওয়ায় হাদীস সংরক্ষনে সুবিধা হয়েছে। ফলে হাদীস অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই সংরক্ষিত হয়েছিল।
রসূলের(সাঃ)জীবদ্দশায় কুরআন এবং হাদীসের বৈশিষ্ট্য,পার্থক্য ছিল স্পষ্ট এবং সাহাবায়ে কেরামগণ উভয়টাই সু-স্পষ্টরূপে জানতেন। তাদের স্মৃতিতে এটি ছিল সর্বদা জীবন্ত। কিছু সংখ্যক সাহাবা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হাদীস লিখে রাখতেন। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর(রা: )-(সূত্র: বুখারী), আবু হুরায়রা(রাঃ) অন্যের সাহায্যে লিখে রাখতেন-( সূত্র: ফুতহুল বারী)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস(রা: ) হাদীস লিখে রাখার অনুমতি চাইলে রসূল(সা: )বলেন-“তুমি লিখতে থাক। আল্লাহর শপথ আমার মুখ থেকে প্রকৃত সত্য ছাড়া কিছুই বের হয়না।”-( সূত্র: দারেমী)
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা: ) বলেন, রসূল(সা: )বলেছেন- “ইলমে হাদীসকে সংরক্ষন কর। আমরা জানতে চাইলাম তা কিভাবে ? তিনি বললেন-তা লিখে নাও।”-(সূত্র: মুস্তাদরাক) আবু হুরায়রা(রাবলেন, একজন আনসার সাহাবী রসূলের(সা: ) কাছ থেকে হাদীস শুনতেন, তার এটা ভাল লাগত কিন্তু তিনি শ্মরণ রাখতে পারতেন না। এটা তিনি তাঁকে(সা: ) জানালে তিঁনি(সা: )বললেন, তোমার ডান হাতের সাহায্য গ্রহণ কর। এর দ্বারা রসূল(সা: ) লিখে রাখাকে বুঝিয়েছেন।-(সূত্র: তিরমিযী)
আবু হুরায়রা(রা: ) বলেন,সাহাবাদের মধ্যে আমার থেকে অধিক কেউ হাদীস বর্ণনা করেনি কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে আমর বিন আস(রা: ) করেছেন,কারণ তিনি হাদীস লিখে রাখতেন, আর আমি লিখে রাখতাম না।
-(বুখারী)
প্রথম দিকে আবু হুরায়রা(রা: )হাদীস লিখে রাখতেন না, কিন্তু পরে তিনি অন্যের দ্বারা লিখে রাখতেন। তার লিখিত হাদীসের সংখ্যা ছিল ৫হাজার -(মুস্তাদরাক হাকেম), হযরত আবু হুরায়রার(রা: ) ঘরে লিখিত হাদীসের এক বিশাল স্তুপ ছিল -(ফুতহুল বারী), ‘মুসনাদে আবু হুরায়রাহ’ নামক যধফরঃয গ্রন্থটি সাহাবাদের যুগেই সংকলিত হয় -( ইবনে সা’আদ- তাবাকাত)
হযরত আনাস(রা: ) ছিলেন রসূল(সা: ) এর খাদেম। তিনি লেখাপড়া জানতেন। তার পিতা তাকে রসূলের(সা: ) খেদমতে পেশ করেন। তিনি হাদীস লিখে রাখতেন। -(উদসুল গাবা), তিনি দশ বছর রসূলের(সা: ) খেদমতে ছিলেন। সাঈদ ইবনে হেলাল(রা: ) বলেন,আমরা আনাস ইবনে মালেককে হাদীস বর্ণনা করার জন্যে শক্ত করে ধরলে তিনি একটি চোঙ্গা বের করে আনলেন এবং বললেন, এসব হাদীস। আমি রসূলের(সা: ) মুখ থেকে যা শুনেছি তাই লিখেছি এবং এরপর তাকে(সা: ) তা পড়ে শুনিয়েছি
-(মুস্তাদরাক হাকেম)
এভাবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা: )ও হাদীস লিখে রাখতেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র আব্দুর রহমানের কাছে এটি সংরক্ষিত ছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা: ) যেসব হাদীস শুনতেন তা লিখে রাখতেন। তিনি চিঠিপত্র প্রেরনের মাধ্যমেও হাদীস প্রচার করতেন। -(তিরমিযি,আবু দাউদ,কিতাবুল আকযিয়া), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা: ) বলেন-‘আমরা রসূলের(সা: ) হাদীস মুখস্ত করতাম।’ -(মুসলিম,ভূমীকা-পৃ-১০)
“হযরত আলী(রা: ) হাদীস লিখে রাখতেন। চামড়ার থলের মধ্যে রক্ষিত তার সেই সংকলনটি তার সাথেই থাকত। তিনি বলতেন-আমি রসূলের(সা: ) নিকট থেকে এই সহিফা এবং কুরআন মজীদ ব্যতীত আর কিছুই লিখিনি। সংকলনটি স্বয়ং রসূল(সা: ) লিখিয়েছিলেন। এতে যাকাত,রক্তপণ,বন্দীমুক্তি,মদীনার হেরেম এবং আরও বিষয় সম্পর্কে বিধান উল্লেখ ছিল।” -(বুখারী,ফুতহুল বারী)
আবু হুরায়রা(রা: ) বলেন- “মক্কা বিজয়ের দিন রসূল(সা: ) ভাষণ দিলেন। আবু শাহ ইয়ামানী(রা বললেন- ইয়া রাসুলুল্লাহ(সা: ) ! এ ভাষণ আমাকে লিখে দিন। তখন এ ভাষনটি রসূল(সা: ) তাকে লিখে দেওয়ার আদেশ দেন।”-(বুখারী,তিরিমিযি,মুসনাদে আহমদ)
***(হযরত আবু হুরায়রার(রা: ) সংকলিত হাদীসের একটি কপি (ঈমাম ইবনে তাঈমিয়ার(রহ: ) হস্তলিখিত) দামেস্ক এবং বার্লিনের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে)***
“আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা: ) মৃত্যুর পূর্বে এক উট বোঝাই হাদীসগ্রন্থ রেখে গিয়েছিলেন।” -(ইবনে সা’আদ-তাবাকাত), “হযরত মুগীরা ইবনে শূবা(রা: ) মুয়াবিয়া(রা: )কে তার অনুরোধক্রমে বহু সংখ্যক হাদীস লিখে দিয়েছিলেন।” -(বুখারী), শুধু পুরুষ সাহাবী নয় বরং মহিলা সাহাবীরাও হাদীস সংরক্ষন করেছিলেন। এদের মধ্যে উ¤মূল মোমেনিন আয়েশা(রা: ) সর্বাধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য উ¤মূল মোমেনীনগনও হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল(রহ: ) হাদীস বর্ণনাকারী মহিলা সাহাবীর সংখ্যা বলেছেন ১৩০ জন, অনেক আলিম বলেছেন ৫০০জন। সাহাবায়ে কেরামগণ রসূলের(সা: )কাছ থেকে হাদীস শ্রবন করে আসার পর নিজেরা আলোচনা করতেন। হযরত আনাস (রা: ) বলেন রসূলের(সা: ) কাছ থেকে হাদীস শোনার পর তিঁনি যখন উঠে যেতেন, তখন আমরা সেখানে বসে থাকতাম এবং হাদীসসমূহ পরষ্পর পূনরাবৃত্তি করতাম। আমরা যখন সেখান থেকে উঠতাম তখন প্রত্যেকেরই সব হাদীস মুখস্ত হয়ে যেত। এসব বৈঠকে সাহাবীর সংখ্যা থাকত ৬০/৭০ জনের মত।
-(মাজমাউ জাওয়ায়েদ)
হযরত মুয়াবিয়া(রা: ) বলেন- “একবার আমি রসূলের সাথে ছিলাম, তিনি মসজিদে প্রবেশ করে একদল লোককে উপবিষ্ট দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন তোমরা এখানে কেন বসে আছ ? তারা বলল-আমরা নামাজ শেষে আল-কুরআন এবং রসূলের(সা: )সুন্নাহ নিয়ে পারষ্পরিক আলোচনা করছি।” -(মুস্তাদরাক হাকেম), “রসূল(সাএর জীবদ্দশাতেই মদীনাতে নয়টি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে নামাজান্তে কুরআন সুন্নাহ চর্চা হত।” -(উলুমূল হাদীস ওয়া মুসতালাহু)
পরবর্তীতে তাবেঈন-তাবেঈ তাবেঈনের যুগে হাদীসের ব্যপক চর্চা হয়। প্রবীণ তাবেঈনদের জন্ম হয় ১০ম হিজরীর পর, আর ১১০ হিজরী পর্যন্ত বেশ কিছু সাহাবায়ে কেরাম জিবীত ছিলেন। ফলে তাবেঈনগণ সাহাবাদের দীর্ঘ সহচর্য লাভ করেন। একজন তাবেঈন বহু সংখ্যক সাহাবীর সান্নিধ্য লাভ করে হাদীস সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ের আলেমগণ অর্থাৎ তাবেঈ তাবেঈনের নিকট তা পৌঁছে দেন।
রসূল(সা: ) বলেন- “তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ আদায় করতে দ্যাখ, সেভাবেই নামাজ আদায় কর।” -(বুখারী), এর অর্থ হল,নামাজসহ প্রত্যেকটি ইবাদত বা নির্দেশনা আল্লাহর রাসূলের মত করে পালন করতে হবে। এটিই ইবাদত। এটা প্রত্যেকটি সাহাবা জানতেন এবং নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করতেন। আবার রসূল(সা: ) একজন লোকের নামাজ আদায় করা দেখে তাকে আবার নামাজ আদায় করতে বললেন, তিনি নামাজ আদায় করার পর আবারও নামাজ আদায় করতে বললেন এবং শুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি লক্ষ্য করলেন এবং ভুল সংশোধন করলেন। এভাবে তিনি কোনো বিষয় শুধু দেখিয়ে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হতেন না, বরং শুদ্ধভাবে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা সেটাও দেখতেন।
আল-কুরআন সরাসরি আল্লাহর অবতীর্ণ করা বাণী। লাওহে মাহফুজ(এটি এমন একটি স্থান যেটার অবস্থান আমরা জানিনা,তবে এটি আসমানে সংরক্ষিত একটি স্থান, যেখানে আল্লাহ তার বাণী লিখে রেখেছেন) নামক স্থানে আল্লাহ যেভাবে তার বাণী লিখে রেখেছেন হুবহু সেভাবেই রসুলের(সাঃ) নিকট তা প্রেরণ করা হয়েছে, এটার মূল ভাবটাও আল্লাহর। আর হাদীস হল ব্যবহারিক জীবনে আল্লাহর আদেশ। হদীসের নির্দেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে কিন্তু এর ভাষা,ভাব রসূলের(সা: ) পক্ষ থেকে। এটাকে পরোক্ষ ওহী বলা হয়। মানুষ তার ব্যবহারিক জীবনে কিভাবে চলবে,আচরণ করবে,কোন কাজটি কিভাবে করবে সে ব্যাপারে রসূল(সা: ) যে-সকল নির্দেশনা দিয়েছেন,সেটা তার নিজস্ব মনগড়া বিষয় ছিলনা। রসূলগণ মনগড়া কথা বলেন না, তারা যেভাবে আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশনাপ্রাপ্ত হন সেভাবে মানুষকে পরিচালনা করেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-“রসূল স্বীয় প্রবৃত্তির তাড়নায় কিছুই বলেন না,তিনি তাই বলেন,যা ওহীরূপে প্রদত্ত হন”-(আল-কুরআন,সূরা নাজম:৩-৪)
রসূল(সাঃ) সুন্নাহ প্রচারকদের ব্যাপারে দোয়া করেছেন- “ইয়া আল্লাহ ! সেই ব্যক্তিকে সজীব ও আলোকোজ্জল করে রাখুন,যে আমার কথা শুনে তার স্মৃতিতে ধরে রাখল, তার পূর্ণ হেফাজত করল এবং এমন লোকের কাছে পৌছে দিল, যে তা শুনতে পায়নি”-(তিরমিযি)
রসূল সা: আবুল কায়েস গোত্রের লোকদেরকে উপদেশ দিয়ে বললেন- “এ কথাগুলো পুরোপুরি শ্মরণ রাখবে এবং যারা উপস্থিত নেই, তাদের কাছে পৌছে দিবে”-(বুখারী)
রসূল(সাঃ) বলেন- “আমার থেকে প্রচার কর, তা সে একটি আয়াতই হোক”-(বুখারী, তিরমিযি)
রসূল(সাঃ) বলেন-“আজ তোমরা শুনছ, তোমাদের কাছ থেকেও শোনা হবে।”-(মুসতাদরাক হাকেম,১ম খন্ড)
রসূল(সাঃ) বলেন- “আমার পর লোকেরা তোমাদের কাছে হাদীস শুনতে চাইবে। তারা এই উদ্দেশ্যে তোমাদের কাছে এলে তাদের প্রতি সদয় হয়ো এবং তাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করো।”
-(মুসনাদে আহমদ)
১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জে রসূল(সাঃ) বলেন- “উপস্থিত লোকেরা যেন আমার এ কথাগুলো অনুপস্থিতদের কাছে পৌছে দেয়।”-(বুখারী)
“যে ব্যক্তি জ্ঞান গুপ্ত রাখবে,আখিরাতে তার মুখে আগুনের লাগাম পরানো হবে”-(তিরমিযী), সহীহ বুখারীতে একটি হাদীসে আছে.....“রসূল (সাঃ) স্বপ্ন দেখলেন(নবীদের স্বপ্নও ওহী) তিনি ফেরেশতা জীবরাইলের সাথে ভ্রমন করছেন......এক স্থানে দেখলেন একজনের মাথা একটি পাথরের ওপর রেখে আরেকটি পাথর দিয়ে আঘাত করে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হচ্ছে। লোকটি পাথরখন্ডটি কুড়িয়ে আনার সাথে সাথে মাথাটি আবার পূর্বের অবস্থায় সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং তাকে আবারও পাথর দ্বারা আঘাত করা হচ্ছে......তিনি(সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন,এরূপ কেন হচ্ছে ? জিবরাঈল বললেন, সে জ্ঞান অর্জন করেছিল কিন্তু মানুষকে তা শিক্ষা দিতনা বা প্রচার করত না।....”
আবার রসূল(সাঃ) বলছেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার নামে মিথ্যা আরোপ করবে,তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম”-(বুখারী)
আর “কেউ মিথাবাদী হওয়ার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট যে,সে যা কিছু শোনে তাই(সত্য-মিথা যাচাই না করেই) বর্ণনা করে”-(মুসলিম,আবু দাউদ), রসূল(সাঃ) আরও বলেন-“আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করা অন্য কারো ওপর মিথ্যা আরোপের মত নয়। যে ব্যক্তি আমার ব্যাপারে এমন কিছু বলবে যা আমি বলিনি,তাহলে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা তৈরী করে নেয়”- (বুখারী)
অর্থাৎ ইসলাম প্রচার অবশ্যই করতে হবে কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবেনা। এমন কথা বলা যাবেনা,যা রসূল(সাঃ) বলেননি বা অনুমোদন করেননি। সকল সাহাবা এ বিষয়টি জানতেন যে আল্লাহর রসূলের ব্যাপারে সামান্য মিথ্যা আরোপ করলে বা সে ক্ষেত্রে সহায়তা করা হলে তার পরিনতী কি ভয়াবহ হতে পারে। এছাড়া আল-কুরআন সংরক্ষনের সুবিধার্তে সুন্নাহ লিখে রাখতে কিছুটা নিরুৎসাহিতও করা হয়েছিল, এতে সাহাবীরা হাদীস লেখার ব্যাপারে সাবধানী ছিলেন,অনেকে লিখতে জানা সত্ত্বেও ভুল হয়ে যেতে পারে এমন চিন্তায় লেখেননি। ফলে খুলাফায়ে রাশেদার সময়েও হাদীস শ্রেণীবদ্ধভাবে পুরোপুরি লিপিবদ্ধ হয়নি। তবে প্রক্ষাত সাহাবীরা জীবিত থাকার কারনে কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি,কারন তাদের কাছে সুন্নাহ ছিল জীবন্ত। শ্রেণীবদ্ধভাবে লিখিত না থাকলেও সুন্নাহ অনুযায়ী চলতে অসুবিধার সম্মুখিন হতে হয়নি। প্রখ্যাত সাহাবাদের আল্লাহর রসূলের(সা পুরো জীবনটাই ছিল মুখস্ত।
বিষয়: বিবিধ
২৩০৭ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
https://www.youtube.com/watch?v=VOUp3ZZ9t3A&list=PLAEA99D24CA2F9A8F
মন্তব্য করতে লগইন করুন