লস এঞ্জেলেস থেকে ফিরলাম
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:০২:২০ দুপুর
অনেকদিন থেকেই পরিকল্পনা করছিলাম লস-এঞ্জেলেস যাব। আমার পাসপোর্টটি হাতে লেখা,আবারও মেয়াদও শেষ হয়েছে। ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে হাতে লেখা পাসপোর্ট বিশ্বের কোথাও আর চলবে না। তাই মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করতে হবে। ওরেগনে বাংলাদেশী কনসুলেট নেই তাই লস-এঞ্জেলেস যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওয়েবসাইট থেকে তথ্য নিলাম এবং ফোন করেও সবকিছু জেনে নিলাম। মানিঅর্ডার এবং প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র গোছগাছ করে ফেললাম। তবে শুধু পাসপোর্টের উদ্দেশ্যেই যে ওখানে যাওয়া তা নয়। রথ দেখা ও কলা বেচা একসাথে করাই উদ্দেশ্য।
১৫ দিন পূর্বে আলাস্কান এয়ারলাইন্সে টিকেট কাটলাম অনলাইনে। বুঝলাম ভ্রমনটা শীতে হলে এবং অন্তত একমাস আগে টিকেট কাটলে অনেক সস্তায় টিকেট পাওয়া যায়। যাইহোক ১৪ তারিখ রাত আড়াইটায় বাসা থেকে রওনা হলাম। সাথের সাথী বিভিন্ন রকমের খাবার দাবার।
এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়ে শুনলাম আমার নির্ধারিত জানালার ধারের সিটটি তারা বেচে খেয়েছে। দু:খের সাথে জানালো এখন হয় আমাকে পরবর্তী ফ্লাইটে যেতে হবে নয়ত অন্য আরেকটি সিটে বসে যেতে হবে। তবে সেই সিটটি সকলের আসন গ্রহনের পর প্রদান করা হবে। বললাম সমস্যা নেই,আমি সকাল ৬.৩৫ এর ফ্লাইটেই যাব।
সকলের আসন গ্রহনের পর আমি গিয়ে উঠলাম। সিট খারাপ না কিন্তু পাশে আলাস্কান গ্রিজলী বেয়ার টাইপের যে ভদ্রলোকটিকে পেলাম তার কল্যানে কোমরটা পুরোপুরি সোজা করাটা কষ্টকর হল,কারন আমার সীটের অন্তত ১৫শতাংশ উনি প্রচন্ড অনিচ্ছায়ই দখল করে ফেললেন,ওপাশের জনের ভাগ্যও আমার মত। নিয়তি মেনে নেওয়া আমার স্বভাব,অতএব চলতে থাকল।
আমেরিকার আভ্যন্তরিন কোনো বিমান সার্ভিস যাত্রীদের খাবার দাবারে তেমন গা করেনা। একটু পানীয় এবং ছোট্ট এক প্যাকেট স্নাকসই সব। তবে সীটের পেছনে একটি মেন্যু বুক অাছে,যেখানে নানান খাবার ও তার দাম লেখা রয়েছে। মাত্র দুই ঘন্টার ভ্রমনে এ জিনিস কিনে খাওয়ার লোক আমি না, তবে ফ্রি হলে "না" বলাটাই আমার কাছে অভদ্রতা।
মযলুমের পর যে লোকটির দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয় সে হল মুসাফির। প্লেন টেকঅফের সময় আমি আল্লাহর কাছে ব্যপক দোয়া করলাম। আমার নিজের জন্যে,পরিবার,আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশী,মুসলিম উম্মাহ সকলের জন্যে দোয়া করলাম। আরও বললাম-ইয়া আল্লাহ ,যারা আমার কাছে দোয়া চেয়েছে তাদের নেক দোয়াসমূহ দয়া করে কবুল করে নিন। আকাশে উড়ন্ত যান মৃত্যুর কথা শ্মরণ করিয়ে দেয়। বারবার মনে হচ্ছিলো ওপারের জন্যে কোনো সরঞ্জাম নেই,শুধুমাত্র ভরসা আল্লাহর অফুরন্ত দয়া।
নির্ধারিত সময়ে অবতরন করলাম লস-এঞ্জেলেস এয়াপোর্টে। লস-এঞ্জেলেস হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সবথেকে প্রসিদ্ধ শহর এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বানিজ্য নগরী। ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট হিসেবে এটি বিশ্বে ৫০তম আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২য়। ৮টি বিশাল টার্মিনালে এটি বিভক্ত। আমি কোথাও গেলে পূর্বে কখনই হোটেল বুক করিনা,মাত্র দু একবার ব্যতিক্রম হয়েছে। আবশ্য এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না যে-আমি আগে হোটেলে উঠব নাকি আগে কনসুলেটে যাব।
এখানে গ্রাউন্ড ফ্লোরে সার্ভিস ডেস্কে গেলাম। ভদ্রলোক খুবই অমায়িক। আমাকে হোটেলসমূহের ব্যাপারে বললেন এবং নিকটস্থ একটি হোটেলে ফোন করতে বললেন। এটি হিলটন হোটেল যেটার ব্যাপারে নেটে আগেই দেখেছিলাম। আমি ফোন করাতে হোটেল থেকে জানালো কোনো রুম খালি নেই,আজ বিকেল ৩টায় খালি হবে এবং আমার কাঙ্খিত রুমের ভাড়া ৩৫৯ ডলার প্রতি রাত। আমি বললাম যে নেটে দেখেছি এই রুমের ভাড়া মাত্র ১১০ ডলার। তিনি বললেন ওটা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য,ওটার জন্যে অনলাইনে পূর্বেই বুকিং দিতে হয়। বুঝলাম ভুল করেছি। তবে সমস্যা নেই,ইনশাআল্লাহ সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
আমি বের হয়ে আসলাম এবং দেখলাম মানুষ ট্যাক্সির জন্যে লাইনে দাড়িয়ে আছে। আমিও একটি ট্যাক্সিতে চড়ে বসে বললাম উইলশায়ার বেলোভার্ডের বাংলাদেশী কনসুলেটে যাব। ট্যাক্সী ড্রাইভার আফ্রিকান মুসলিম। তার কাছে জানলাম লস-এঞ্জেলেসের অধিকাংশ হলুদ ট্যাক্সী ড্রাইভার হল বাংলাদেশী। ড্রাইভারগুলো গল্পপ্রিয় হয়। নানান কথা বলতে বলতে গন্তব্যে চলে আসলাম।
কনসুলেটে ঢুকেই আমার মত কয়েকজন যারা এ্যারিজোনা থেকে এসেছে তাদেরকে পেলাম। তবে প্রথমেই সালাম বিনিময় হল ৪০বছর পূর্বে আমেরিকায় আসা বাদল ভাইয়ের সাথে। পুরোটা সময় তিনি লস-এঞ্জেলেসেই থেকেছেন। উনার ৫ ভাই এবং তাদের পুরো পরিবার এখানে আছেন। উনি সাংঘাতিক মিশুক এবং উপকারী মানুষ। কিছুক্ষনের মধ্যেই উনি অন্তরের মধ্যে জায়গা করে নিলেন। গল্পে গল্পে নিজের সন্তানদের কথা জানালেন। তারা উনাকে তেমন পাত্তা দেয়না,সন্তানরা নাকি বলে যে-তারা এখানকার সব কিছু বেশী বুঝে। তাদের সিদ্ধান্ত তাদের। আরো বলে তাদের পিতা বোকা। মূল্যায়ন করেনা। ষাটোর্ধ বড়ভাইটিকে বললাম-"তাদেরকে বলেননি যে-আমি বোকা না হলে তোমরা আজ এত চালাক হতে পারতে না !"
এরমধ্যেই লস-এঞ্জেলেসের বাঙ্গালী কমু্উনিটির প্রধান জনাব বাচ্চু সাহেব আসলেন। উনি এসেই এত কথা বলা শুরু করলেন যে আমি ভাবলাম লোকটা ব্যপক কথাপ্রিয়। কিন্তু খানিকপরই বুঝলাম তিনি চরম উপকারী লোক। উনি গল্প করতেই থাকলেন। একসময় বললেন-আমাদের সন্তানদেরকে আমরা যেভাবে রাখব,তারা সেভাবে থাকবে। যখন নিয়ন্ত্রন করার,তখন নিয়ন্ত্রন না করলে তারা বিপথে যেতেই পারে। উনার সন্তানরা অনুগত,সেটা জানালেন। তার নিজের জীবন কাহিনী বললেন। স্বাধীনতার পরপরই এখানে এসে কি করেছেন সবই বললেন। একসময় এয়ারপোর্টে গিয়ে বাঙ্গালীদের ধরে আনতেন তাদেরকে সাপোর্ট ও কাজ দেওয়ার জন্যে। উনি আমার জন্যে ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং আমাকে বিশেষভাবে দেখার জন্যে অফিসারের সাথে কথা বললেন,যদিও তাকে আমি এটা করতে বলিনি।
কনসুলেটের অফিসার মারাত্মক ভদ্র এবং বন্ধুসূলব মানুষ। তিনি নিজে এসে আমার থেকে সকল কাগজপত্র নিয়ে গেলেন। খানিকপর ভেতরে ডেকে অনলাইনে ফর্ম ফিলআপ করে চেক করতে বললেন এবং ছবি তুললেন,আঙ্গুলের ছাপ নিলেন। সবকিছু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করলেন। আমি তার সুআচরনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন !
ওদিকে বাচ্চু ভাই আমার জন্যে নিকটেই একটি হোটেল বুক করেছেন। আমাকে তার নাম্বারটা দিলেন এবং যেকোনো প্রয়োজনে ফোন করতে বললেন। বাদল ভাই এবং তার ভাই মামুন ভাই মিলে পার্কিং লটের দিকে খানিকদূর আগাতেই দেখলাম একটা গাড়ি ফুটপাথের উপর উল্টো হয়ে আছে। ভেতরের চায়নিজ টাইপ মেয়েটি রাস্তায় আহত হয়ে বসে আছে। পুলিশ এলাকাটি হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে ফেলছে। আসার পথেও এরকম একটি দূর্ঘটনা দেখেছি। বাদল ভাই আমাকে তার গাড়িতে উক্ত হোটেলে পৌছে দিলেন এরপর তিনি আমাকে ডাউনটাউনের একটি বাঙ্গালী রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন যাতে আমি ভালোভাবে খেতে পারি। এখানে অনেক বাঙ্গালীকে দেখলাম। আমি তাকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম । তিনি বিদায় নিলেন।
আমি বাঙ্গালী রেস্টুরেন্টে অনেক রকমের খাবার দেখে দিশাহারা হয়ে পড়লাম। আমি ভুলে গেলাম আমি কে, কোথা থেকে উদয় হয়েছি। আমি ভুলে গেলাম আমার সামনে পেছনে। আমার ক্ষুধার্ত চোখ তখন কেবল বিভিন্ন রকমের রান্নাকরা তরি তরকারীর দিকে। আমি ভাতের সাতে ছোটমাছ,সব্জী,রুইমাছ খেলাম পেট পুরে। আহা কি যে ভালো লাগল ! খাওয়ার পর আমি উদ্দেশ্যহীন হাটতে থাকলাম,মনে আনন্দ,পেটেও ।
রাস্তায় বেশ কিছু মুসলিমকে দেখলাম। কয়েকটা দেশী দোকানও দেখলাম। রাস্তায় প্রচুর গাড়িঘোড়া,যা ওরেগনে দেখা যায় না। প্রচন্ড গুমোট গরমে আমার গা ঘামতে লাগল। মনে হল যেন ঢাকায় এসেছি। আমি রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে এবং বিভিন্ন মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে সাবওয়েতে বা পাতাল রেলে আসলাম। উপরে একটা বড় লিফট আছে এবং চলন্ত সিড়িও আছে যেটা দিয়ে নীচে নামতে হয়। এটা হল ভারমন্ট বেভারলি স্টেশন। আমার উদ্দেশ্য হলিউড যাওয়া। তবে হলিউডের মূল আকর্ষন হল ইউনিভার্সাল স্টুডিও। আমি হলিউড হাইল্যান্ড যাব নাকি ইউনিভার্সাল স্টুডিও যাব তা ঠিক করতে পারলাম না। টিকেট কাটতে এসে দেখলাম কোনো লোক নেই,সবাই মেশিন থেকে টিকেট কাটছে। এক্ষেত্রে একটি ট্যাপ কার্ড পাঞ্চ করে টিকেট কাটার প্রক্রিয়া শুরু করছে। লস-এঞ্জেলেসে একটা বিষয় আবিষ্কার করলাম তা হল অনেক মানুষ অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলতে ভয় পায় বিশেষ করে নির্জন স্থানে। আমি কয়েকজনের কাছে সাহায্য চাইলাম কিন্তু তারা আমার কাছে আসল না। অবশেষে এক মেক্সিকান নারী টিকেট কাটতে আসলে আমি আমার টিকেট কেটে দিতে অনুরোধ করলাম। উনি এক বর্ন ইংরেজী জানেন না,আর আমি স্পানীশের একটিমাত্র শব্দ জানি তা হল হোলা,মানে হ্যালো। ভদ্রমহিলা তার নিজের ট্যাপ কার্ড দিয়ে আমার টিকেট কেটে দিলেন এবং কার্ডটি আমাকে দিলেন যাতে আসার সময়ও টিকেট কাটতে পারি। আমরা ইংরেজী এবং স্প্যানিশে কথা বলতে বলতে প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি ট্রেন দেখিয়ে উঠতে বললেন। বুঝলাম ভাব প্রকাশে ভাষা সব সময় বাধা নয়। উনার কথা বুঝতে না পারলেও উনার ইশারা ইঙ্গিত ভালই বুঝতে পারছিলাম।
ট্রেন চলতে শুরু করল, আমি হলিউড হাইল্যান্ডে নামব মনে করলাম ,তবে কি মনে করে এই স্টেশন পার হয়ে ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে নামলাম। উপরে উঠে আসলাম এবং হাটতে হাটতে পাহাড়ী টিলার মাথায় উঠে আসলাম, এখানেই দুনিয়া কাপানো সব সিনেমা তৈরীর কারখানা ইউনিভার্সাল স্টুডিওর প্রবেশ পথ। এ এক বিরাট প্রযুক্তিময় এবং বিশ্ময়কর কারবারের জায়গা। আগামী পর্বে বাকীটুকু বলব,ঘুম আসছে,আর লিখতে ভালো লাগছে না।
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৯ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দারুন লাগলো আপনার লস এঞ্জেলস ভ্রমন। তবে লস এঞ্জেলস এ আপনার কিছু লস হয়নি তো!
এত বড় লিখা পড়ার আমার সময় নাই ।
স্প্যানিশ "ওলা" দিয়েও তো কাজ সারতে পেরেছেন। বাংগালী রেস্টুরেন্টে উদরপূর্তীতেই লস এন্জেলসের ভ্রমন সফল বলা যায়!
ভালো লগালো , দেখি পরের পর্বে কি আসছে
শুকরিয়া
অফিস নেই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন