সীরাত -২
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১১:১২:২৩ রাত
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন তার নিজস্ব বিচার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহ প্রদর্শিত পথে চলার জন্যে। কিন্তু মানুষ সে স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়ে স্বেচ্ছাচারীতার পরিচয় দিয়েছে। জীবনোপকরণ,সময় এবং স্বাধীন জ্ঞানের অধিকার প্রাপ্ত হয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে। নিজেদের ইচ্ছাকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। তারা আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবীদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে, নির্যাতন করেছে এমনকি অনেককে হত্যাও করেছে (সূরা আল ইমরানের ২১ নং আয়াতে আল্লাাহ তায়ালা বলছেন- “যারা আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে, যারা অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করে এবং মানব জাতিকে যারা ন্যায় ও ইনসাফ মেনে চলার আদেশ দেয় তাদেরকেও হত্যা করে, এদেরকে আপনি এক কঠোর শাস্তির সুসংবাদ দিন”)।
কোনো নবীর মৃত্যুর পর তার উম্মতরা আবারও বিভ্রান্ত হয়েছে। সর্বদা তাদের অনুসারীর সংখ্যা নগন্য হওয়ার কারনে তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়েছে। হত্যাও করা হয়েছে। এরপর নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী চলতে পারার সুবিধার্তে নবীদের প্রচলিত শিক্ষাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেকে সেটার সাথে কৌশলে আরও কিছু বিষয় সংযুক্ত এবং কিছু বিষয় বিযুক্ত করে নতুন বিধানের জন্ম দিয়ে মানুষকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছে।
আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে বলেছেন-“....তাদের নিজেদের ধর্ম বিশ্বাসের মাঝে নিজেদের মনগড়া ধারণাই তাদেরকে প্রতারিত করে রেখেছে।”-(আল-কুরআন:৩:২৫)
এভাবে বহু সময় অতিবাহিত হবার পর এবং অনেক নবীর আগমনের পর হযরত নূহ(আঃ) আসলেন.............(“নূহের পর আমি কত মানবগোষ্ঠীকে ধবংস করে দিয়েছি ! ” ....আল-কুরআন,১৭ঃ১৭) আরও অনেক সময় অতিবাহিত হবার পর হযরত ইব্রাহিম (আঃ), ইসমাইল(আঃ), ইসহাক(আঃ), ইয়াকুব(আঃ), ইউসুফ(আঃ).......আরও পরে মুসা(আঃ) প্রেরিত হন। তিনি(আঃ) তাওরাত কিতাব নিয়ে আসেন। বেশীরভাগ মানুষই তাকে প্রত্যাখ্যান করে,তার ওপর নানামুখী অত্যাচার নির্যাতন করে। তাঁর(আ ওফাতের পর আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব ‘তাওরাত’ বিকৃত করা হয়। তাকে(আঃ) অধিকাংশ মানুষ পরিত্যাগ করার পরও তিনি বনী ইসরাইলের নেতা ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটিত বহু সংখ্যক মুযিযা ও গজবের কারনে ভেতরে ঈমান না থাকা সত্ত্বেও অনেকে তাকে ভয়, সম্মানের চোখে দেখেছে। আবার কিছু অনুসারী তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছে। তাঁর(আ সম্প্রদায় সরাসরি আল্লাহর গজবের ভয়ে অনেক নিয়ম কানুন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তাঁর(আঃ) ওফাত পরবর্তী সময়ে তাঁর উম্মতের বুদ্ধিমান প্রতারক শ্রেণী জনতার কাছে সম্মান মর্যাদা পাবার আশায় সুকৌশলে আসমানী কিতাবের বিকৃতি সাধন করেছে। যেহেতু কিছু লোক স্বতস্ফূর্তভাবে ভালবেসে এবং অনেকে ভয়ে অনুসরণ করত তাই অনুসারীদেরকে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত করার মানষে সমাজের অভিজাত সেসব বুদ্ধিমান শ্রেণী কিতাব সংশোধন করতে থাকে। তারপরও আজও পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের কিছু অংশ অবিকৃত রয়েছে। তবে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রনের কারনে এবং সত্য কতটুকু সে সম্পর্কে আমাদের কাছে সঠিক তথ্য না থাকার কারনে, আমরা তা নি:শঙ্কচিত্তে গ্রহণ করতে পারিনা। আর সর্বশেষে আল্লাহর মনোনিত কিতাব আল-কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারনে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের অনুসরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(রসূল (সা বলেন- “তোমরা তাওরাত ও ইঞ্জিলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন কর, কিন্তু আমলের জন্যে আল-কুরআনই যথেষ্ট”-মুসনাদে ইবনে হাতেম,তাফসীর ইবনে কাসীর)
একদা এক চোখ বিশিষ্ট(এক চোখ অন্ধ ছিল) ইহুদী আবব্দুল্লাহ বিন সুরিয়া রসূলকে(সাঃ) বলেন-“আমরাই সঠিক পথে রয়েছি। তোমরা আমাদের অনুসারী হও, তোমরাও সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে।” তার এ কথার জবাবে আল্লাহ তায়ালা আয়াত অবতীর্ণ করেন-“এবং তারা বলে যে, তোমরা ইহুদী অথবা খ্রিষ্টান হও,তাহলে তোমরা সুপথ পাবে। আপনি বলুন-আমরাই ইব্রাহিমের(আঃ) দ্বীনের উপর অটল আছি এবং নিশ্চয়’ই তিনি(ইব্রাহিম আঃ) অংশীবাদীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না।”-(আল-কুরআন,২:১৩৫)
তোমরা বল-আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, আর যা হযরত ইব্রাহিম(আ,ইসমাইল(আ,ইসহাক(আ,ইয়াকুব(আ এবং তদীয় বংশধরদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং মুসা(আ ও ঈশাকে(আ যা প্রদান করা হয়েছিল,সেসবের প্রতি ঈমান আনয়ন করছি। তাদের মধ্যে কাওকে আমরা প্রভেদ করিনা এবং আমরা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী।”
-(আল-কুরআন,২:১৩৬)
এভাবে চলতে থাকে পৃথিবী। হযরত মুসা(আঃ)এর ওফাতের পাচ’শ বছর পর হযরত ঈশা(আঃ) প্রেরিত হন। তাকেও নানামুখী অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তার ওপর ইঞ্জিল নামক কিতাব অবতীর্ণ হয়। অধিকাংশ মানুষ তাকে গ্রহণ করেনি। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করা হলে, আল্লাহ তায়ালা তাকে আসমানে উঠিয়ে নেন (আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আসল সত্য জানাচ্ছেন- “তাদের উক্তি এই যে, আমরা অবশ্যই মারইয়ামের পুত্র ঈশাকে(আঃ) হত্যা করেছি, যদিও তারা কখনই তাকে হত্যা করেনি। তারা তাকে শুলবিদ্ধও করেনি,মূলত: তাদের কাছে এমনি একটা কিছু মনে হয়েছিল। যারা মতবিরোধ করছিল,তারাও সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেল। এ ব্যাপারে তাদের অনুমানের অনুসরণ ছাড়া সঠিক কোনো জ্ঞানই ছিল না। তবে এটা নিশ্চিত যে,তারা তাকে হত্যা করেনি। বরং আল্লাহ তাকে তার নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা মহা পরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়।”
আল-কুরআন,সূরা আন্ নিসা,১৫৭-১৫৮)
এরপর একইভাবে তাওরাতের মত ইঞ্জিলকেও বিকৃত করা হয়। যদিও আজও ইঞ্জিল কিতাবের কিছু অংশ অবিকৃত রয়েছে কিন্তু সত্যের সাথে মিথ্যা মিশ্রিত হবার কারনে পুরোটা পরিত্যাজ্য। প্রাচীন কালে আজকের মত প্রিন্টিং মিডিয়ার আবির্ভাব না ঘটাতে নবীদের বাণী শিষ্যদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকত,অথবা লিখতে জানা কোনো শিষ্য তা কোথাও কোথাও লিখেও রাখতেন। কিন্তু এটির পরিপূর্ণ রূপ না থাকাতে এবং নবীর ওফাত পরবর্তী সময়ে বিধান মানতে না চাওয়ার কারনে সেসব বাণীর অধিকাংশই সঠিকভাবে সংরক্ষিত হতে পারেনি। আর অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ এগুলো সংক্ষিপ্তাকারে জানার কারনে সুবিধাবাদী শ্রেণীদের ক্ষেত্রে কিতাব বিকৃত করা সহজসাধ্য হয়েছে।
হযরত ঈশার(আঃ) ওপর নাযিলকৃত ইঞ্জিল কিতাবকে তার কথিত অনুসারীরা বাইবেল বলে,কিন্তু‘ আজকের বাইবেল কিতাব শতাধিক রকমের। অর্থাৎ সকল বাইবেল একই রকম নয়। একেক জন একেকভাবে লিখেছেন,যেখান থেকে সত্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এটার বিকৃতি যে স্বজ্ঞানে সুস্থ্য মস্তিষ্কে করা হয়েছে তা সূরা আল ইমরানের ৬৯,৭০ এবং ৭১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে জানাচ্ছেন এভাবে- “এই কিতাবধারীদের একটি দল তোমাদেরকে কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত করে দিতে চায়, যদিও তাদের এ বোধটুকু নেই যে,তাদের নিজেদের ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে তারা পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম হবেনা। হে কিতাবধারীরা ! তোমরা জেনে বুঝে কেন আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করছ ? অথচ (এই ঘটনাসমূহের সত্যতার)সাক্ষ্য তো তোমরা নিজেরাই বহন করছ। হে কিতবাবধারীরা ! তোমরা ‘হক’কে বাতিলের সাথে মিশিয়ে মূল বিষয়কে সন্দেহযুক্ত করে দিচ্ছ, অথচ (এটা যে সত্যের একান্ত পরিপন্থী) তা তোমরা ভাল করেই জানো।
(উল্লেখ্য: মুহাম্মদ(সা রসূল রূপে আবির্ভূত হওয়ার পর ইহুদী-খ্রিষ্টানদের বেশ কিছু পন্ডিত ব্যক্তি তাকে মেনে নিয়েছিল; তাদের কিতাবে রসূলের(সা আগমনের বিষয়ে এবং তার নিদর্শন সমূহের উল্লেখ থাকার কারনে, কিন্তু বহু পন্ডিত ব্যক্তি এ তথ্য জানা সত্ত্বেও রসূলকে(সা মেনে নেয়নি বরং বিরোধীতা করেছিল। ইহুদীরা হযরত ইব্রাহিমকেও(আ তাদের নিজেদের নবী উল্লেখ করত এবং বলত- শেষ নবীও বনী ইসরাইল থেকে আসবে। তাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচারের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এখানে আয়াতের মাধ্যমে জানাচ্ছেন যে-
“যাদেরকে আমি পূর্বে কিতাব দান করেছি, তারা মুহাম্মদকে রসূল হিসেবে এমনভাবে চিনে,যেমনভাবে তারা তাদের নিজ পুত্রদেরকে চিনে, নিশ্চয়’ই তারা জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করছে”
-আল-কুরআন,২:১৪৬)
“যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক নিরক্ষর নবীর, যার উল্লেখ আছে তাওরাত ও ইঞ্জীলে(বাইবেল),যা তাদের নিকট আছে তাতেও লিপিবদ্ধ পায় ...( আল-কুরআন,৭ঃ১৫৭) “আল কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়। পূর্ববর্তী কিতাব সমূহে অবশ্যই এর উল্লেখ আছে। বনী ইসরাইলের(ইহুদীদের) পন্ডিতগণ এবিষয়ে অবগত আছে।”-(আল-কুরআন,২৬ঃ ১৯৫-১৯৭)
সূরা আল ইমরানের ৭৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন-“ আহলে কিতাবদের মধ্যে এমন কিছু লোকও আছে, যারা যখন কিতাবের কোনো অংশ পড়ে তখন নিজেদের জিহবা এমন করে এদিক সেদিক করে নেয়,যাতে তোমরা মনে কর যে,তারা সত্যিই বুঝি কিতাবের কোনো অংশ পড়ছে; কিন্তু তা কিতাবের কোনো অংশই নয়। তারা আরও বলে এটা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে, কিন্তু আসলে তা আল্লাহর কাছ থেকে আসা কিছু নয়। এরা জেনে শুনে আল্লাহর ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চলেছে।”
আহলে কিতাব বলতে তাদেরকে বুঝায়,যারা আল-কুরআনের পূর্বে কিতাবপ্রাপ্ত। পূর্বে কারা কারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন সে সম্পর্কে আমাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য নেই, আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে আমাদেরকে অতি অল্প তথ্য জানিয়েছেন, তবে সাধারনতভাবে আমরা ইহুদী এবং খ্রিষ্টানদেরকে আহলে কিতাব হিসেবে বুঝে থাকি। আর দৃশ্যমানভাবে এরাই জেনে বুঝে তাদের কিতাব বিকৃত করেছে (অন্যরাও করেছিল কিন্তু তাদের ব্যাপারে আমাদের কাছে সু-স্পষ্ট তথ্য নেই)। মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন-
“হে মানুষ , তোমরা যারা ঈমান এনেছ ! তোমরা যদি এই আহলে কিতাবদের কোনো একটি দলের কথাও মেনে চল,তাহলে এরা তোমাদের ঈমান আনার পরও কাফির বানিয়ে ফেলবে।”
(আল-কুরআন,৩:১০০)
হযরত ঈশা(আঃ)এর পাঁচ’শ একাত্তর বছর পর সারা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যে প্রেরিত হন হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)। রসূল(সাঃ) বলেন- “আমি দুনিয়া এবং আখিরাতে ঈশা ইবনে মারইয়ামের সবথেকে নিকটতম। নবীগণ পরষ্পরের ভাই,তাদের মাতা ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু তাদের দ্বীন এক,আর আমার এবং তাঁর(ঈশা আ মধ্যে আর কোনো নবী নেই।”-(বুখারী ও মুসলিম)
বিষয়: বিবিধ
১২৪২ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বিন্দুতে সিন্ধু!!
জাযাকাল্লাহ..
সমস্ত বিভ্রান্তি থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুণ এবং আমাদের ঈমানে মজবুতি দান করুণ!
জাযাকাল্লাহ খাইর!
সুন্দর পোস্টের জন্য ধন্যবাদনিন
মন্তব্য করতে লগইন করুন