নিউ চায়না.....৩
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১০ মার্চ, ২০১৩, ১২:১১:১১ দুপুর
টিম বলতে লাগল-চায়নাতে এখন যুবকদের কিছু সমস্যা হয়েছে। আর সে সমস্যা শুরু হয়েছে যুগের হাওয়া নামক এক ধরনের টর্নেডোর কারনে। মেয়েদের চিন্তা চেতনায় এটি বেশ জোরে সোরে আঘাত হেনেছে। তার ফলশ্র“তিতে বিয়ের বাজারে খানিক আগুণও লেগেছে। মেয়েরা এখন একটু দেরীতে বিয়ে করছে,কারন প্রতিষ্ঠিত পাত্র এখন যুগের দাবী। পাত্রের বাড়ি,গাড়ী,টাকা না থাকলে যে বিয়ে হবেনা এমন নয়,তবে থাকাটা যেন বাধ্যতামূলকের কাছাকাছি। টিম বেশ হতাশ হল যে, পড়াশুনা করে সে কি এমন একটা চাকুরী পাবে যেখানে টাকার ছড়াছড়ি অবস্থা ! চায়নাতে লোকসংখ্যা প্রচুর হলেও জবের বাজার খারাপ নয়। বরং গত কয়েক বছরে তা বেড়েছে এবং বেতন ভাতাও অনেক বেড়েছে। তার সাথে পাল্লা দিয়েই মেয়েদের চাহিদা বেড়েছে আর তার ফলশ্র“তিতেই টিমের এই হতাশা। সান্তনা দিয়ে বললাম, এটা শুধু এখানেই নয় বরং সারা বিশ্বেই এমনটা ঘটছে।
বহুক্ষণ ধরে ২০০ কি:মি: গতিতে চলছি কিন্তু ফ্লাইওভার শেষ হচ্ছেনা। একের পর এক বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার। কোথাও কোথাও মাথার ওপর দিয়ে আরেক ফ্লাইওভার চলে গেছে। অনুমান করলাম কত টাকা এরা ঢেলেছে একেটা পিলার তৈরী করতে। বিশাল বিশাল পিলার দিয়ে তৈরী সুউচ্চ ফ্লাইওভার। কয়েকটি পিলারের কংক্রিট দিয়ে বোধ হয় আমাদের ছোট সাইজের নদীর ওপর ব্রিজ বানানো যাবে। স্ক্রীনে দেখলাম পরবর্তী স্টপ শাওশিং । অনেকে আমাকে আমার গন্তব্য জানিয়ে দিল,টিম তখন ঘুমাচ্ছে। আসলে আমি আরো দুজনকে চায়নিজ ভাষায় লেখা-‘আমি শাওশিং যাব,কতদূর ? সেখানে পৌছালে আমাকে ডেকে দিবেন’ জাতীয় গুরুত্বপূর্ন লেখা তাদেরকে দেখিয়েছিলাম। ইংরেজী না জানা সেসব লোক আমাকে ইশারায় বুঝালো তোমার স্টেশন সামনে। টিম জেগে উঠল,এবং কোনোভাবেই যেন আমি তাকে ভুলে না যায়, তা জানালো(আমি তাকে ভুলিনি)। সাংহাইতে যে কোনো সহযোগীতায় তাকে ফোন করতে বলল। আমিও অনুরূপ বললাম। তারকাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে অসলাম। লোকজনকে অনুসরন করে স্টেশনের বাইরে আসলাম।
আগেই বলেছি,এবার আমি খরচ সেভিং কর্মসূচী হাতে নিয়েছি। নো অতিরিক্ত খরচ,নো ভাব মারামারি। গত কয়েক বছরে চায়নাতে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে গড়ে ৭০% এর বেশী আর চায়নিজ ইউয়ানের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে ৪০%। খরচ না বাঁচিয়ে উপায় নেই।
স্টেশন থেকে আমার হোটেল বেশী দূরে নয়,তা আমি আগেই জেনেছি। এই দূরত্বে ট্যাক্সি নিতেই হবে ,কিন্তু না। এখানে প্রথমবারের মত সাইকেল রিক্সার এন্তেজাম দেখলাম। খুব আরামদায়ক রিক্সা এটি। বেশ বড়সড় এবং ঢাকার রিক্সার মত উুঁচু নয়। চায়নিজ ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম কত ভাড়া। উত্তরে যা জানালো তা বুঝতে পারলাম না। তাই মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়ে নাম্বার টাইপ করতে বললাম। সে ব্যাপারটি বুঝল না। মনে করল আমি বোধহয় কারো সাথে তাকে কথা বলতে বলছি। তাই সে বলল না,কথা বলব না। পরক্ষনেই সে তার নিজের পকেট থেকে টাকা বের করল এবং একটি দশ ইউয়ান,আরেকটি পাঁচ ইউয়ানের নোট দেখিয়ে বলল-ভাড়া হল ১৫ ইউয়ান(দুই শত টাকা)। রাজি হলাম। তাকে চায়নিজ ভাষায় লেখা হোটেলের নাম এবং ঠিকানা দেখালাম। সে আরেকজনের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হল যে,ঠিকানা তার চেনা আছে। বড় স্যুটকেস,ব্যাগ রাখার পরও আরামে বসলাম। ধীরে ধীরে তা চলতে লাগল। মাত্র দেড় বা দুই কি:মি: পর আমি গন্তব্যে পৌছালাম। ভারী স্যুটকেসটা সে মাথায় নিয়ে হোটেল লবি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। তার সৌজন্যতার জন্যে ধন্যবাদ দিলাম।
যখন আমি আমার রুমে ঢুকলাম তখন সন্ধ্যা। দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তিতে একটু শুয়ে থাকা উচিৎ, কিন্তু আমি যেহেতু ক্লান্ত হয়নি তাই বিশ্রামের প্রসঙ্গ আসছে না। আমি ওজু করে ট্রাউজার,টি-শার্ট পরে নিলাম। বাহ শান্তি লাগছে। মাগরিবের কসর হয়না তাই ৩ রাকাত ফরজ পড়ে কেড্স পরে লবিতে আসলাম। আশপাশে খাবার কোনো রেস্টুরেন্ট আছে কিনা জেনে নিলাম। হোটেলের একজন আমাকে সাথে নিয়ে দেখিয়ে দিল। আমাকে একটি মোবাইল সিম কিনতেও সাহায্য করল। এটা চায়না মোবাইলের রেডিমেড সিম। কিনলাম এবং মোবাইলে ঢুকালাম। কোনো রেজিস্ট্রেশনের ঝামেলা নেই। তবে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে না এসে মূল মোবাইল কোম্পানীর শো-রূমে গেলে আমাকে পাসপোর্ট এর কপি দিয়ে,অনেক রকম সই স্বাক্ষর করে তবে এ জিনিস নিতে হত। আমি ওসব ঝামেলার মধ্যে নেই। তাছাড়া চায়নিজ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বেশীরভাগ কর্মীই নারী। আমি আমার জীবনে সেবা দানের ক্ষেত্রে চায়নিজ নারীদের মত এত অযোগ্য,শ্লথ গতির নারী দেখিনী। ছোট্ট একটা কাজে যেখানে ২ মিনিট লাগার কথা,এরা অনায়াশে ১০/১৫ মিনিট নষ্ট করে,এরপরও ভুল করবে। এয়ারপোর্টের সেবাদানকারী কিছু নারী ছাড়া অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নারীদের ক্ষেত্রে এটা বার বার দেখেছি এবং মহা বিরক্ত হয়েছি। তবে সু-আচরনের কারনে সাত খুন মাফ করা যায়।
জরুরী কিছু ফোন ও মেসেজ প্রদান করে হাটতে থাকলাম,যেন আমার এ পথ চলাতেই আনন্দ। যে কোনো নতুন স্থানে গিয়ে হেটে আমি চারিপাশটা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করি। সন্ধ্যায় মৃদুমন্দ বাতাসে একটু শীত শীত অনুভূতি হচ্ছিল এবং তা ছিল খুব আরামদায়ক। পরিচ্ছন্ন ও প্রশস্ত রাস্তায় হাটতে ভাল লাগছিল। হোটেলের অনতিদূরে রাস্তার পাশে একটি বড় মার্কেট দেখলাম। সেখানে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। একটিতে ঢুকে দেখে শুনে নুডুলস,ভেজিটেবল,মাছ,ডিম খেলাম। স্বাদ আমার জিহবার অনুকূল না হলেও খেতে পারলাম। খাবার পর আবার হাটাহাটি। এখানেই হাটতে হাটতে দেখলাম অনেকগুলো ম্যাসাজ পার্লার। এখানে পুরুষের জন্যে নারী এবং নারীর জন্যে পুরুষ কর্তৃক ম্যাসাজের ব্যবস্থা দেখলাম। সবই দেখলাম হাটতে হাটতে। এখানকার মেয়েদের অনেকেই পতিতাবৃত্তির সাথে যুক্ত। যদিও সাংবিধানিকভাবে এদেশের সরকার এটি স্বীকার করেনা এমনকি পতিতাদের জেল জরিমানাও করে,তারপরও এ পেশা থেমে নেই। বরং এটা এখন বিরাট ইন্ডাস্ট্রী চায়নাতে।
হাটতেই থাকলাম। হাটতে বেশ মজাই লাগছে। রাস্তায় রং বেরঙের আলো,মসৃন রাস্তা,চমৎকার আবহাওয়া। এবার একটা বড় ফলের দোকানে ঢুকলাম। মনে বড় আশা ছিল খাব ফল ফর্মালিন,কার্বাইড ছাড়া। এ স্বপ্ন আমার সফল হল। বহুদিন পর অনেক রকম ফলের স্বাদ পেতে যাচ্ছি। এখানে শত শত রকমের দেশী-বিদেশী ফল রয়েছে। এক জাতের আপেল ছাড়া আর সকল ফলের দামই অনেক বেশী। এরা আধা কেজীর দাম ঝুলিয়ে রেখেছে। তাইওয়ানের আনারস দেখলাম প্রতি আধা কেজী বাংলা টাকায় ২৫০ টাকা পড়ছে। তারমানে এই সাইজের আনারসটি কিনতে আমাকে ১ হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে। নিকুজি করি তোর আনারসের। আমার কি রস কসের অভাব হয়েছে যে তোর আনারস খেতে হবে ? সেদিনও গাজীপুর থেকে ৩ কেজী ওজনের একেকটি অনারস কিনলাম মাত্র ৪০ টাকা করে। দোকান মালিক আমাকে দেখে যে মানের হাসি দিল,তাতে মনে হচ্ছে আমি বিল গেট্স না হলেও অন্তত মি: বিল। হয়ত সে মনে মনে আমার বিলটি হিসাবও করে ফেলেছে। ওর এই চেনা হাসিতে ‘ভোলার লোক’ আমি না। ভোলা দ্বীপের লোকও আমি না,ফলে আমাকে ভোলানো এত সহজ না(অবশ্য ভোলা দ্বীপের লোকদেরকে সহজে ভোলানো যায় এমনটাও শুনিনি)। কিন্তু তাকে ভোলাতে হলনা,আমি নিজেই ভুলে গেলাম। কিনবনা কিনবনা করেও ৬ রকমের ফল কিনে ফেললাম। এবং সবগুলোই দামী। ফেরার পথে ভাবছিলাম,দোকানদারের হাসীটাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হল। প্রতিজ্ঞা করলাম দোকানীর হাসি কান বরাবর গড়ালেও আমি আর ওপথ মাড়াবো না। কিন্তু এ ওয়াদা আমি পালন করতে পারিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি বেশ দূর্বল। অন্তত এই রূপবতী ফল-ফলাদীর ব্যাপারে তো অবশ্যই। শুধু ফল খাওয়ার জন্যেই খুব চমৎকার দুটি ফল কাটার ছুরি সাথে এনেছি। এর একটা ছুরি দেখলে যে কেউ তা পেতে চাইবে। এটি খুব সরু এবং প্রচন্ড ধারালো। কারো পেটে ঢুকিয়ে দিলে খানিকক্ষন পর্যন্ত সে বুঝতেই পারবে না যে পেটের মধ্যে কি সিধিয়ে দেওয়া হল।
পূর্বে বিভিন্ন দেশের বড় বড় ছুরি কোমরের বেল্টের সাথে ঝুলিয়ে,মাথায় হ্যাট,পায়ে হাইনেক সু- ওয়েস্টার্ণ কাওবয় স্টাইলে চলাচল করতাম। কখনও কখনও হাতে থাকত এয়ার রাইফেল। তরুন বয়সের পাগলামী মনে পড়লে হাসি পায়।
....চলছে.....
বিষয়: বিবিধ
১৬৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন