মায়ের আগমন,শুভেচ্ছা স্বাগতম

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৯ মার্চ, ২০১৩, ১০:০২:২৪ রাত



একজন স্বনামধন্য এবং সুপরিচিত ব্লগার নূরে আয়েশা সিদ্দিকা জেদ্দা তার এক কমেন্টের মধ্যে আমার কাছ থেকে মা বিষয়ক একটি লেখা দেখতে চেয়েছিলেন। সম্মানিত সেই ব্লগারের সম্মানে কলম ধরলাম একেবারে আনাড়ীভাবে,নিজের ভাষায়। অবশ্য মা বিষয়টা এমন একটি ব্যাপার যার সম্পর্কে যেন তেনভাবে লিখলেও মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্য বেড়ে যায়। মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক একেবারে আভ্যন্তরিন। পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক রক্ষায় মায়ের নামটিই সর্বাগ্রে আসবে। এটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়,সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রত্যেক প্রাণীই তার বাচ্চাকে অতি মাত্রায় ভালবাসে এবং তার জন্যে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পিছপা হয়না। এক্ষেত্রে বহু বাস্তব কাহিনী উদাহরণ হয়ে রয়েছে। আজ কাল বিশেষ কিছু টেলিভিশন চ্যানেলেও এটা দেখা যায়।

মা সম্পর্কে কাউকে লিখতে বললে যে কেউ কিছু না কিছু লিখবে,কারণ এটা তাদের অভিজ্ঞতা। নিছক ইঁদুর কপালে না হয়ে থাকলে মায়ের স্নেহ ভালবাসা প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু জোটে। ‘আমার কাছে আমার মা অসাধারণ।’ আমি নিশ্চিত প্রত্যেকেই তাদের মায়েদের সম্পর্কে এভাবেই বলবে। এটা বলে সে তার মাকে সম্মানিত করল এমন নয়,বরং সে তার মায়ের চরিত্র বর্ণনা করল। মা তার নিজের আচরনের কারনেই তার সন্তানের হৃদয়ে এমন একটি অবস্থান দখল করে থাকে যা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের মত দখল হয়ে যায় না। ওটা স্থায়ী আসন গেড়ে বসে থাকে। সন্তান পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক না কেন,সে তার ওই ভালবাসার স্থানটি হারিয়ে ফেলেনা,বরং দূরত্ব,পরিস্থিতি তাকে তার মায়ের সান্নিধ্য পাবার জন্যে ব্যাকুল করে তোলে। তার প্রতি ভাবিত ও ধাবিত হতে বাধ্য করে। সন্তান তার মায়ের প্রতি যতটা সদয় আচরণ প্রদর্শন করতে পারে,তার মা তার চাইতেও অনেক বেশী সদয় তার প্রতি হয়েছে। আর জীবনের বাকী অংশ তিনি তার সন্তানের মঙ্গল চিন্তায়’ই ব্যয় করেন। এমনকি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও যিনি কখনও সে কথা স্বীকার করেন না এবং শত বঞ্চিত হয়েও যিনি কখনও অভিযোগ করেন না,তিনিই হলেন মা। ক্ষমা চাওয়ার আগেই যিনি ক্ষমা করে দেন তিনিই মমতাময়ী এবং আমাাদের সকলের মা।

এমনই একজন মা আছে আমার,যার সম্পর্কে স্বয়ং রসূল(সাঃ) হুশিয়ার করেছেন এভাবে যে, ‘সে ধবংশ হয়ে যাক,যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা যে কোনো একজনকে জিবিত অবস্থায় পেল আর জান্নাতে যেতে পারল না। ’ আমি আমার মাকে এখনও জিবিত অবস্থায় পেয়েছি আর আমি নিজেকে ধবংশ করতে চাইনা। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করার তেমন কিছুই করতে পারিনি,তবে একটি কাজ বোধহয় করতে পেরেছি। সেটি হল,আমি আমার মায়ের প্রতি চরম অনুগত। আমি তার যে কোনো কথা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেই,আর তিমি মহা পরহেজগার হেতু কখনও হারাম আদেশ করেন না। তিনি আসলে কখনও আদেশ করতে পারেন না।

আমার আব্বা ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি দাবি করার আগেই অনেক দাবি মিটিয়ে ফেলতেন। আর আমার মায়ের কোনো বিষয়ে খুব একটা অভাব ছিলনা। আর ৬ভাই বোনের প্রত্যেকে তার চরম অনুগত হবার কারনে তার নিজের তেমন ডিমান্ড তৈরী হয়নি। কেউ তাকে কোনো কিছু উপহার দিলে মনে হত,এটিই বুঝি তার সবথেকে প্রিয় এবং এর জন্যেই তিনি অপেক্ষা করে ছিলেন। তার কখনও কোনো জিনিজ দরকার হলে সেই বিষয়টি তার মুখ থেকে কিভাবে কিভাবে জানি আমরা জেনে ফেলতাম এবং ফেলি,আর তারপর সেটি তাকে দেওয়া হয়। আমি আবার এক কাঠি সরেশ। আমি চিন্তা করতে থাকি এ মুহুর্তে তার কি কি দরকার হতে পারে অথবা কি পেলে তিনি খুশী হতে পারেন। এরপর অনুমানে কিছু জিনিস কিনে ফেলি। সে পছন্দ করেনি এমনটা হয়নি। আমি বরাবরই উপহার প্রদান করে মানুষকে চমকে দেওয়ার লোক। তাই তাকেও চমকে দিতাম। বিদেশে গেলে আমার মাথায় একটা বিষয়ই ঘুরপাক খেতে থাকে ,আমার মার জন্যে কি নিয়ে যাওয়া যায়। বহু প্লানিং চলে মনের মধ্যে এটা নিয়ে। তবে আমি স্বার্থপর এবং এমন স্বার্থপর হতে আল্লাহই আদেশ দিয়েছেন। তিনি আমার এই তুচ্ছ খেদমতের জন্যে আমাকে স্বার্থ স্বরূপ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। যদিও আমি আমার এই কাজের কারনে জান্নাতের উপযোগী নই,বরং আল্লাহর ক্ষামাই আমার পাথেয়। আমি জান্নাতুল ফিরদাউস চাই,কোনো রকম শাস্তি ছাড়াই। অথচ ছোটবেলায় ,এক সময় আমি প্রচন্ড মারকুটে ছিলাম। বাইরের বাচ্চাদের পাশাপাশি আমার বোন,ভাই এমনকি আমার মায়ের ওপরও বেশ কয়েকবার ঝাপিয়ে পড়েছি। আমার আচরনে কেউ কিছু মনে করত না এমনকি বকাও দিত না। আমার দাবী না মেনে কারো কোনো উপায় ছিল না। আমি প্রচন্ড ভাংচুরও করতাম। এরপরও আমাকে একটুও বকা দেওয়া হতনা,তবে বিষয়টা আব্বাকে জানানো হত না।

স্পষ্ট মনে পড়ছে একটি ঘটনা। এক চাঁদনী রাতে আমাদের বাড়ির বারান্দায় আমি মায়ের সাথে বসে ছিলাম। সেটা ছিল পূর্ণচন্দ্র রাত। বয়স আমার ৮/৯ বছর হবে হয়ত। হঠাৎ কোনো এক কারনে আমি উত্তেজিত হয়ে বেশ জোরে আমার মায়ের কান ধনে টান মারলাম। তার কানে দুল ছিল,তিনি খুব ব্যাথা পেলেন কিন্তু কিছু না বলে মাথা নীচু করে কাঁদতে লাগলেন। খানিকক্ষন তার কান্না দেখে আমার চোখে পানি চলে আসল। আমি তাকে বুঝতে দিলাম না যে আমার চোখে পানি। আমার জ্ঞান বুদ্ধি তখন তেমন হয়নি। কিন্তু আমি জানতাম আল্লাহ আকাশে থাকেন। আমি সেই পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে বললাম-“আমি আর কখনই আমার মাকে কষ্ট দিবনা। আমি ওয়াদা করছি।” সু-মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমার ওয়াদা রক্ষা করার তাওফিক দিয়েছিলেন। আমি তারপর থেকে সজ্ঞানে আমার মাকে কষ্ট দেয়নি। আমি অনেক কঠিন পরিস্থিতি পার করেছি কিন্তু আমার মায়ের বিরুদ্ধে আমার মনে কোনো অভিযোগ তৈরী হতে দেইনি। আমার নফ্সকে বলতাম-‘হেই ! খবরদার ! ওয়াসওয়াসা দিবিনা, তোকে তোর শয়তান বাপসহ শেষ করে ফেলব !’

যেভাবে লিখছি তাতে লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। আমি বরং গত কয়েক দিনের ঘটনা বর্ণনা করি। মা এখন আমার সাথে আছে। আমার মা থাকেন যশোরে। কিছুদিন পূর্বে আমার সেঝো বোন আমাকে এবং আমার ছোট বোনকে তার ঢাকার বাড়িতে ডাকল। সে দাওয়াত করা মানে কিছু মজার খাবার খেতে পারার উপলক্ষ্য। মা আমাকে ফোন করলেন,এবং তার অবস্থা জানতে চাওয়াতে তিনি জানালেন-সেবা নিচ্ছি। কিসের সেবা,কার সেবা ইত্যাদী প্রশ্ন করার আগেই ফোন রেখে দিলেন। পরে আবার ফোন করব মনে করে আমিও আর ঘাটালাম না। আমার বোনের বাসায় প্রবেশ করেই চমকে উঠলাম,দেখি মা বসে আছে আর আমার দুই ভাগনী ,এক ভাইগনা তার সেবায় নিয়জিত। আমার মায়ের ভাষায় এরা নাকি তাকে জননেত্রীর(সরকার প্রধান বা এ ধরনের কিছু বিলাসী মানুষ যেভাবে সেবাপ্রাপ্ত হন) মত সেবা করে। হেসে উঠলাম,আনন্দিত হলাম। শুনলাম আমার ছোট বোন হঠাৎ এমন অনাকাঙ্খিতভাবে মাকে দেখে কিছুটা অতঙ্কে এবং আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল। তারপর অনেকরকম রান্না হতে থাকল আর আমরা লম্বা গল্প শুরু করলাম। আমার মায়ের সামনে যতবার যাই,ততবারই জান্নাতের কথা মনে হয়। এ জিনিস হাতছাড়া করা সম্ভব নয়।

আমার দুলাভাই তার কাজের কারনে যশোরের কাছাকাছি একটি এলাকায় গিয়েছিল ,আমার সেঝো বোন দুলাভাইকে বাড়ি পাঠিয়ে আমার মাকে নিয়ে এসেছে। এটাও একটা কিডন্যাপিং টাইপ ব্যাপার। কারণ আমার ভাই কোনোভাবেই তাকে পাঠাতে চাচ্ছিল না। এবং অনেক রকম বাহানা তৈরী করছিল। কিন্তু যেহেতু আমার মা নিজেই রাজি ছিল তাই তার আপত্তি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। মা সেঝো বোনের বাড়িতে ২সপ্তাহ থাকলেও আমার বড় বোনকে তা জানানো হয়নি। কারণ সে খানিকটা আমার আব্বার স্বভাবের। একটু ধর মার টাইপের।

মা গেল কয়েক দিনের জন্যে ছোট বোনের বাসায়। সেখান থেকে আমি গতকাল মাকে নিয়ে বাসায় আসলাম। আমি আর বড় বোন এক সাথেই আছি। আমাদের পারিবারিক,অর্থনৈতিক,আত্মিক সকল স্বার্থই এক। আমার বড় দুলাভাই মারা যাবার পর তার দুই ছেলে-মেয়ে অস্ট্রেলিয়া পড়াশুনা করতে চলে গেল। ওখানেই তারা স্থায়ী হল। আর আমরা দুই ব্যাচেলর এক বাড়িতে থাকলাম। আমার মা এখানে থাকতে খুব একটা পছন্দ করেনা তা জানি কিন্তু ....কোনো আওয়াজ হবেনা.....। তাকে এখানেই বেশী দিন থাকতে হয়,এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তার সেবায় নিয়োজিত রয়েছে একটি অমায়িক বালক এবং মহিলা। বালকটি পরিচ্ছন্নতা,কাপড় ধোয়া,রান্না সকল ব্যাপারে খুবই প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ্য।

সাধারনত: টিভি তেমন দেখা হয়না কিন্তু মায়ের কারনে তার ঘরে বসে বেশ খানিকক্ষন দেখলাম। আজ অফিসে যায়নি। প্রায় সারাদিন টুকটাক কাজ করেছি এবং তার সাথে কথা বলেছি। মা সরপুটি মাছ ভুনা,বেগুনের সাথে কৈ মাছ এবং মাসকলাইএর বড়ি,লাউশাক,সজনে ডাটার সাথে আলু এবং কৈ মাছ,ডাল ইত্যাদী রান্না করল। দুপুরে দুজন টানলাম বেশ। বিকেলে বাইরে গিয়ে কিছু খাবার কিনে আনলাম। সাধারনত আমি বিকেলে তেমন কিছু খাইনা কিন্তু মার জন্যে খাচ্ছি। এক সময় কোনো এক কারনে তিনি আমার বুকের খাচায় লাথি মেরে তা খেঙ্গে ফেলার কথা বললেন। কি সাংঘাতি ! তবে কারণটা এখনও আবিষ্কার করতে পারলাম না। তবে এটা বোধহয় আব্বার এক ডায়ালগের নকল। তিনি আমাকে বহুবার ফুটবলের মত কিক করে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন কিন্তু ধরতে না পারার কারনে আমার পক্ষে ফুটবল হওয়া সম্ভব হয়নি। এজন্যে বোধহয় গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়ার কথাটাই বেশী বলতেন,কারণ একাজে আমাকে তেমন কাছে পাওয়ার প্রয়োজন নেই।

মা’র স্বভাব হল,কিছুক্ষন পরপর কাজের মানুষের কাজে জানতে চাওয়া আমার এখন কিছু লাগবে কিনা,যদি লাগে তাহলে তা নিজ দায়িত্বে তিনি তৈরী করবেন। ঘরে থাকলে মাঝে মাঝে দরজা খুলে দেখবেন কি অবস্থা ইত্যাদী। কোনো কারণ ছাড়াও একটু খোজ খবর করাও তার দায়িত্ব। তার দায়িত্বই হল নিঃস্বার্থ সার্ভিস দেওয়া। এত ভাল ভালনা বলে রাখছি ! অসহ্য লাগছে,,,,, কিন্তু..... না। বাড়াবাড়ি ভালবাসায় অভ্যস্ত না হওয়াতে এমন খানিকটা হয়ে থাকে। মায়েদের বয়স বেড়ে গেলে তারা তাদের সন্তানদের প্রতি যেন আরও বেশী সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। এমন মায়ের সামনে ‘উহ ! ’ শব্দ কিভাবে করে কে জানে ! সে তো গুলি করলেও ‘উহ !’ করব না। বরং কোক্ করে মরে যাব।

লেখাটা যখন লিখছি তখন আমার বড় বোন এসেছে এবং সে মায়ের সাথে গল্প করছে। চলুক। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে, কাল খুব ভোরে আবার ইউ.এস এম্বেসীতে যেতে হবে। ভীসা দিলে আমেরিকাতে হবে সুপার ট্যুর। যদিও ভোরে উঠি,তারপরও লাইভ এ্যালার্ম হিসেবে মাকে জানিয়ে রেখেছি। আপনারাও রাত না জেগে ঘুমিয়ে পড়–ন,স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।

বিষয়: বিবিধ

১৫৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File