এপ কেভ এবং মাউন্ট সেইন্ট হেলেন
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১০ আগস্ট, ২০১৫, ০৯:০৩:৪৫ রাত
ওয়াশিংটনের ভ্যাঙ্কুভারে মিটিং ছিল। সকাল পৌনে ৭টায় রওনা হলাম। পোর্টল্যান্ডের পূর্বে শেরহুড সিটিতে ফ্রেড মায়ার নামক স্টোর থেকে কিছু খাওয়ার জিনিস কিনলাম। পূর্বেই অবশ্য ব্যাগে আরও কিছু খাবার ছিল। ২৬০ কি:মি: পথ পাড়ি দিয়ে ভ্যাঙ্কুভারে আসলাম। ২ঘন্টায়ই কাজ মিটে গেল আর পূর্ব পরিকল্পনা মত দর্শনীয় স্থান দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম।
ভ্যাঙ্কুভার থেকে Gifford Pinchot National Forest এ আসলাম। এখানে এপ কেভ নামক একটি আগ্নেয় লাভার প্রাকৃতিক টানেল রয়েছে। এর দৈর্ঘ ৪০২৩ মিটার। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ব বৃহৎ এবং পুরো উত্তর আমেরিকার মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। ১৯৫১ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। আগ্নেয়গিরি থেকে উত্থিত লাভা কোনো স্থানে পতিত হওয়ার পর এর ভেতর থাকা বড় হাওয়াপূর্ণ স্থান বা বুদবুদ থেকে এরকম টানেল তৈরী হয়।
এরকম কোনো টানেল বা গুহা পূর্বে কখনই দেখিনি। এটি ছিল আমার কাছে এক অভাবনীয় বিষয়। কল্পনাই করিনি এরকম কোনো জিনিস প্রাকৃতিকভাবে তৈরী হতে পারে।
ভিজিটর সেন্টার থেকে একটি হ্যাজাক লাইট নিলাম আর আমার ব্যাগের পকেটে থাকে একটি হেড লাইট,যা লেড। সেটি মাথায় পরে নিলাম। এবার কিছুদূর হেটে বাগানের ভেতর থাকা গুহার মুখে আসলাম। সিড়ি দিয়ে ভেতরে নেমে গেলাম। ভেতরের প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখতে আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রচন্ড ঘন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম। আরও বেশ কিছু দর্শনার্থী ছিল। এই গুহার দুটি অংশ আছে, একটি উপরের স্তর,আরেকটি নীচে।
প্রথমে যে অংশ ধরে অগ্রসর হলাম সেটি খুবই কষ্টকর অংশ। এখানে বড় বড় পাথর খন্ড রয়েছে যা উচু নীচু। এর উপর দিয়ে সতর্কতার সাথে এগিয়ে চললাম। মাটির উপরের তাপমাত্রা ২৬/২৭ ডিগ্রী হলেও এখানে ৬/৭ ডিগ্রী। অন্ধকারে এরকম ভয়ঙ্কর পাথরের উপর দিয়ে বেশীক্ষন চলতে ভালো লাগল না। ভেবেছিলাম খানিক পর সমতল অংশ পাব। কিন্তু একজন বলল, এভাবে অনেকদূর যেতে হবে। খানিকপর ফিরে আসলাম এবং নীচের স্তরের টানেলে গমন করলাম। এটা অপেক্ষাকৃত সমতল। টানেলের ভেতরের উচ্চতা বেশীরভাগ অংশেই ১৫ ফিটের উপরে। আর এমন প্রশস্ত যে পাশাপাশি অন্তত ১২/১৩ জন লোক নির্দিধায় চলতে পারবে।
হাতের হ্যাজাক লাইট ধরে আশপাশ দেখছিলাম। অসম্ভব সুন্দর লাগল। কালো পাথরের ছড়াছড়ি নীচে। অসমতল দেওয়াল এবং কোনাকৃতির ছাদ। আকা বাকা রাস্তা ধরে হেটে চললাম। আস্তে আস্তে এটি আরও নীচের দিকে চলে গেছে। টানেলের শেষে এসে দেখলাম এর উপরে আরেকটা টানেল রয়েছে এবং উভয়ের মধ্যে সংযোগও রয়েছে একটি গর্তের মাধ্যমে। এই অংশটির ছাদ একটু বড় তবে টানেল শেষে এসে সরু হয়ে অন্যটির সাথে মিশেছে। ওপাশে যেতে হলে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। এক স্থানে দেখলাম একটি বেশ বড় পাথর খন্ড আলোর কারনে চিক চিক করছে। মনে হল এর উপর ছোট ছোট চকচকে পাথর বসানো। অগ্নুৎপাতের ফলে অনেক সময় মূল্যবান পাথরও বেরিয়ে আসে।
খানিকক্ষন থেকে চলে আসলাম। এই দৃশ্য আমি ভুলব না। এ এক অসাধারন জিনিস। এর সৌন্দর্য অতুলনীয়।
উপরে এসে বনের ভেতর দিয়ে হাটলাম একা। আড়াই মাইল দূরে এসে দেখলাম একটি পাথরপূর্ণ এলাকায় একটি ফাটল। আর নীচে নেমে দেখলাম একটি ছোট্ট গর্ত। এটিই টানেলের শেষ মুখ। এই প্রবেশ মুখ দিয়ে নীচে নামলাম এবং খানিক থেকে চলে আসলাম। সুন্দর বনভূমির নীচে এরকম দারুন একটি টানেল রয়েছে তা মানুষের জানা ছিলনা। ১৯৫১ সালে লরেন্স জনসন নামক এক লোক এটি খুজে পায়। সে মূলত একটি বড় গাছকে দেখে তা খানিকটা উপড়ে গেছে। বিষয়টি পরখ করতে গিয়েই সে এই লাভা টিউবটি খুজে পায়।
এখান থেকে এবার যাত্রা শুরু করলাম মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস এর দিকে। প্রায় ৭০ কি:মি: আকা বাকা রাস্তা পার হয়ে এবং সুন্দর সুন্দর লুকআউট অতিক্রম করে সেন্ট হেলেন্সে এসে পৌছলাম। শীতে এ এলাকা তুষারে ঢেকে থাকে। তখন গাড়ির চাকায় বিশেষ চেইন লাগিয়ে চলতে হয়,নইলে চাকা পিছলে পতন অনিবার্য। শেষের ১৫ কি:মি: রাস্তার অধিকাংই ছিল খাড়া ঢাল। নীচের দিকে তাকালে ভয় করে। কোনোভাবে গাড়ি উল্টে গেলে শত শত মিটার নীচের গিয়ে পড়বে এবং কেউ আস্ত থাকবে না তা তো বলাই বাহুল্য।
মাউন্ট সেইন্ট হেলেন্স একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরী। আমেরিকায় অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ক্ষয় ক্ষতিতে এই আগ্নেয়গিরীই পয়লা নম্বরে অাছে। ১৯৮০ সালের অগ্নুৎপাতে ৫৭জন মানুষ মারা যায়। এখান থেকে কাছাকাছি দূরত্বে ট্রুম্যান নামক একটি বুড়ো বসবাস করত। তাকে সরে যেতে বলা হলে এবং বারবার অনুরোধ করলেও সে তার বাড়ির মায়ায় থেকে যায়। আর লোকটি তার বাড়িসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সে সময় ২৫০ জন লোক বাড়ি ছাড়া হয়,২৪ কি: মি: রেলওয়ে ধ্বংস হয়,২৯৮ কি:মি: হাইওয়ে ধ্বংস হয়ে যায় এবং অগ্নুৎপাতের ফলে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৫৪ কি:মি: দূরের সিয়াটল সিটি ৬ ইঞ্চি পুরু ধুলা,ছাইয়ে ঢেকে যায়। এরপর ২০০৪ এবং ২০০৮ এ স্বল্প মাত্রার অগ্নুৎপাত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই এলাকার এবং এর আশপাশের কয়েকশত বর্গমাইল এলাকার নীচে গলিত শীলা বা ম্যাগমা অনেক উপরের স্তরে উঠে এসেছে। যে কোনো সময় আাবারও অগ্নুৎপাত হতে পারে। ১৯৮০ সালে আশপাশের বিশাল এলাকার বন জঙ্গল সম্পুর্ণ পুড়ে যায় এর উত্তপ্ত ধোয়া ও ছাইয়ে। দেখলাম হাজার হাজার মরা গাছ পাহাড়ের পাদদেশে পতিত। পরে অবশ্য নতুন করে অনেক গাছপালা জেন্মেছে। ৮৩৬৩ ফুট উচু এই অাগ্নেয়গিরীটাকে ইয়াং অাগ্নেয়গিরী বলা হয়। কারন এর পাথরের বয়স মাত্র ৪০ হাজার বছর। সাধারনত: আগ্নেয়গিরীর পাথরের বয়স মিলিয়ন মিলিয়ন বছর হয়ে থাকে।
সেইন্ট হেলেন্সের জ্বলামুখের কাছে স্বাভাবিকভাবে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই,অবশ্য হেলিকপ্টারে যাওয়া যায়। আর নিরাপত্তার কথা ভেবে সেখানে যাওয়ার রাস্তা বানানো হয়নি। এটি খুবই খাড়া এবং এর মুখের একপাশ ঢালু। সেদিক দিয়ে এর ছাই,ভষ্ম,গলিত পাথর গড়িয়ে পড়েছিলো। দেখলে ভয় লাগে। মনে হয় পৃথিবীতেই কত ভয়ঙ্কর আগুন রয়েছে,তাহলে জাহান্নামের অাগুন কত ভয়ঙ্কর !!
পাশে সুন্দর একটা লেক দেখলাম,স্বচ্ছ তার পানি। আশপাশে বেশ কয়েকটি মরা পাহাড়। একটি উপত্যকা দেখলাম ছাইয়ের অাস্তরনে ঢাকা। আরেক পাশ থেকে মাউন্ট রেইনিয়ার নামক ১৪৪০৯ ফুট উচ্চতার একটি সূপ্ত অাগ্নেয়গিরী স্পষ্ট দেখা যায়। ওটার দিকে তাকিয়ে মনে হল অাকাশের উপর মাথা তুলে দাড়িয়েছে। অসম্ভব সুন্দর লাগল। মেঘের অনেক উপরে এর মাথা।
বেশ কিছুক্ষন থেকে ফিরতি পথ ধরলাম। পাহাড়ী পথ এখানে বেশ প্যাচালো। খানিক পর অামার অস্বস্তি লাগতে শুরু হল। বুড়ো বয়সে বমি করে মান ইজ্জত খোয়াতে মন চাইলো না,ওদিকে নীম্নচাপটাও তীব্রতর হয়েছে। রাস্তার এক পাশে পার্ক করে এক রোল টয়লেট টিস্যু নিয়ে বাগানের মধ্যে দৌড় দিলাম। আশপাশে সতর্কতার সাথে একবার তাকিয়ে একটি বড় গাছকে জৈব সার উপহার দিলাম। ত্যাগেই যে চরম শান্তি তা উপলব্ধী করলাম !!! এরপর ফুরফুরে মেজাজে বাড়ির পথ ধরলাম......
বিষয়: বিবিধ
১২৯৪ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হচ্ছে মরুভুমির মতন। তাই না
সুন্দর বর্ণনা। অভিযানের স্রোতে যেন পুটির মা তলিয়ে না যায়। ধর্যবাদ..
এভাবে একা একা ঘুরতে আপনার ভাল লাগে? তাড়াতাড়ি পুটির মাকে নিয়ে আসেন। কারণ সুন্দর কোন জায়গায় কাছের মানুষের সাথে ঘুরতে গেলে আনন্দটা অনেক গুণ বেড়ে যায়। আর ভাল লাগা গুলো শেয়ার করলে আরো ভাল লাগা তৈরি হয়....।
"মারমারি করব,খুনোখুনি করব"
কি খবর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন