প্রিয় ব্যক্তিত্ব-আমার পুটির মা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৫ জুন, ২০১৫, ১১:৫২:৪৪ রাত
জানি আপনারা অবাক হচ্ছেন অথবা হাসাহাসি করছেন শিরোনাম দেখে কিন্তু এটা সত্য। আমি মিথ্যা বলি না তা নয়, কিন্তু আমি সত্য বলতে পছন্দ করি,আলহামদুলিল্লাহ আমি সত্যবাদী।
পুটির মা নামক একটি চরিত্র আমি আমার নিজের কল্পনায় তৈরী করেছি। আমি সেটাকে নিয়ে আমার অবসর কাটাই। বাস্তবে পুটির মা সেরকম কিনা সেটা আল্লাহই ভালো জানেন,কিন্তু এটা আমার এক অতি কল্পনার সৃষ্টি। আমি আমার স্ত্রীকে ওরকম পেতে চাই এবং আমিও তার জন্যে ঠিক পুটির বাপের মতই।
আমার কল্পনার পুটির মা'ই আমার প্রিয় মানুষ। একটা সময় ছিল যখন অনেক আড্ডবাজি করেছি,বন্ধুদের সাথে নানানভাবে মেতেছি। কিন্তু এখন আমি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছি। নিজের একাকিত্ব ভুলতে নিজের মনেই অনেক কিছু তৈরী করি। আমি আসলে অনেকটাই নি:সঙ্গ। আমার এবং আরো কিছু মানুষের প্রবল প্রয়োজন আমাকে এই নির্জনে এনেছে। বলা যায় আমি বন্ধুহীন। ব্লগের অদৃশ্য মানুষগুলোই আমার বন্ধু।
আমি আমার নিজের জগতে নিজের মত বেচে থাকি। সুখ,দু:খ,হাসি আনন্দ সব নিজের সাথেই হয়। এরই ভেতর দিয়ে হঠাৎ পুটির মায়ের জন্ম। এক অনাগত চমৎকার একটি মেয়ে সে।
পুটির মা আমার সকল পরিবেশের সাথী। আমি যেভাবে তাকে চাই ,সে আসলেই তেমনটা নয় বলে মনে হয়,কিন্তু পরক্ষনেই আবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় যে,সে আমার মতই। তার কথা,চাল চলন খুবই দারুন। পুটির মা খুবই সাধারন সাদাসিদা নারী। তার চাহিদা একেবারেই কম। মোটা ভাত,কাপুড়ে সে সুখী। সে সাংঘাতিক ক্রিয়েটিভ একজন। সে জানে কিভাবে অল্পতে তুষ্ট থাকা যায়। সে সেই চেষ্টাই করে।
পুটির মা একটি ধনী পরিবারের মেয়ে। তার পিতা ধনী ব্যবসায়ী,তার মা অত্যন্ত গুনবতী। জানিনা তার মায়ের গুনের পুরোটা তার মধ্যে এসেছে কিনা কিন্তু তার গুন দেখে মনে হয়েছে অনেককেই ছাপিয়ে গেছে। ওর এক বোনের বিয়ে হয়েছে অন্যতম সেরা ধনীর সাথে। কিন্তু পুটির মা কেন যে আমাকে বিয়ে করতে গেল বুঝলাম না।
আমি এক দরিদ্র কৃষক। অন্যের ক্ষেতে কাজ করি আর নিজের ছোট্ট একটা ক্ষেতও আছে। মূলত আমি পরের ক্ষেতেই কাজ করতাম। পরে পুটির মায়ের উৎসাগেই নিজের জায়গায় চাষাবাদ শুরু করি। পুটির মায়েদের বিশাল জায়গা জমি আছে,তার একটি অংশ আমাদের গ্রামেও রয়েছে। পুটির মায়ের বাপ, একবার গ্রামে আসল তার এই অংশটির আবাদ করার জন্যে। তিনি বর্গা দিয়েছিলেন পূর্বে। কিন্তু যাকে বর্গা দেওয়া হয়েছিলো সে সুবিধার ছিলনা। ফসল তেমন দিতনা আর লোকসান হয়েছে বলত। এবার উনাকে কেউ আমার কথা বলেছিলো। উনি আমাকে ডেকে বললেন-তুমি এটার চাষ করো,তেমাকে টাকা দেব নগদ। তিনি আমাকে অগ্রীম কিছু টাকা দিলেন। আমি বললাম, আমি তো অগ্রিম টাকা নেইনা। আর আমি আপনার ক্ষেত চাষ করব সঠিকভাবে। সেটা বিত্রী করব,আর খরচ বাদে যেটা লাভ হবে তার ৪০% আমাকে দিতে হবে। আপনি এই হার আপনার মত করেও বলতে পারেন। আর লোকসান হলেও আপনাকে সেটার অংশ নিতে হবে। কিন্তু আমি মিথ্যা বলিনা। আর আমি ভালো কৃষক।
তিনি রাজি ও খুশী হয়েছিলেন আর আমি বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিলাম। তবে উনার জমিটা নীচু স্থানে হওয়ায় এবং পানি জমে যাওয়াতে ফসল ভালো হতনা। কিন্তু উনি আমার বিশ্বস্ততায় খুশী ছিলেন। আমি উনার প্রতিনিধিকে সাথে নিয়ে হাটে ফসল বিক্রী করে হিসাব করে টাকা প্রদান করতাম। একবার উনার ছোট মেয়ে গ্রামে আসে। সেটা ছিল শীতকাল। আমি তরকারীর চাষ করেছিলাম। সে মেয়েটি ক্ষেত দেখে খুব খুশী হয়। তাকে আমি গ্রাম দেখাই ,নদীর ধারে নিয়ে যাই। টুকটাক কথা থেকে অনেক কথা.....। এরপর সে কয়েকবার আমার গ্রামে এসেছে। একদিন সে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাকে তার ভালো লাগার কথা বলে। আমি আকাশ থেকে পড়ি। এক দরিদ্র কৃষককে কারো ভালো লাগতে পারে তা ছিল কল্পনার অতীত। আমি তাকে আমার বাড়িতে এনে আমার ঘর দেখাই। আমার সম্পর্কে সব তথ্য দেই,কিন্তু সে বলে এসব দেখালে কোনো লাভ নেই,আমি যা দেখার তা দেখেছি। মেয়েটা ছিল জেদী প্রকৃতির। সে তার পরিবারকে কিভাবে কিভাবে জানি ম্যানেজ করে ফেলে। আমরা বিয়ে করি। কিন্তু সামাজিকতার ভয়ে তার পরিবার আমাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে। এতে আমরা কিছু মনে করিনা। আমরা সুখে দিন পার করি আর আল্লাহর ইবাদত করি। আমরা সর্বদা আল্লাহর উপর নির্ভর করি এবং তার বিধানে সন্তোষ প্রকাশ করি।
বিয়ের পর থেকে প্রতিটা দিনই আমি তাকে নতুন করে চিনি। সে এক বিশ্বয়কর নারী। তার কোনো আচরনে কখনই তার পূর্বের জীবনের ছাপ পড়েনি। সে ধনী ও উচু পরিবারের ,সেটা প্রকাশ করেনি বরং আমার মত করে চলার চেষ্টা করেছে। আমার সাধারন ইনকামে সে সন্তুষ্ট। তার প্রয়োজনটাকে সে আমার সাধ্যের মধ্যে বেধে ফেলেছে। কিন্তু সে যে এই আত্মত্যাগ করেছে,সেটাও সে আচরনে প্রকাশ করেনা। আমার সাথে ঝগড়াও করে,কিন্তু সেটা আমার নিজের বিষয় নিয়ে। আমি ইবাদতে গাফিলতি করলে সে মোটেও সহ্য করেনা। ফজরের সময় উঠতে দেরী করায় পৌষ মাসের শীতে আমার গায়ে কতবার যে ঠান্ডা পানি ঢেলেছে তার হিসেব নেই। আমার ছেড়া লুঙ্গীতে সে সযত্নে তালি লাগিয়ে দেয়। জানে নতুন লুঙ্গী বছরে মাত্র ১/২ বার কেনার সামর্থ আছে আমার। আর আমি তাকে বছরে ২টা শাড়ী দিতে পারি,আর হাত খরচের জন্যে অল্প কিছু টাকা। তার কিছু মুরগী আছে,বাড়ির পেছনে কিছু তরকারীর মাচাও আছে। এটা সেটা বিক্রী করে অল্প কিছু টাকাও তার হাতে আসে। সেটা দিয়ে মাঝে মাঝে ভালো মন্দ খাবার কিনে আনায়। আবার কয়েকবার আমার লুঙ্গি গেঞ্জী কিনে দিয়েছে। সে আমার সংসারটা জান্নাত বানিয়ে দিয়েছে।
আমি বাইরে তেমন আড্ডা মারিনা। চা খাওয়ারও অভ্যাস নেই। পুটির মা মাঝে মাঝে চা বানায়। সে লেবু চা পছন্দ করে। তার সাথে চা খেতে হয়,নইলে সে রাগ করে। তার পছন্দের চা খেতে খেতে এখন আমার ওটাই পছন্দ হয়ে গেছে। পুটির মা এক অবাক করা নারী। বাসর রাতে আমাকে বলেছিলো-এই তুমি নাক ডাকো নাকি ঘুমালে ? বললাম , না, এই অভ্যাস আমার নেই। আমি সুস্থ্য সবল মানুষ। সে বলেছিলো-বেচে গেলে। ঢোক গিলে বললাম,নইলে কি করতে ? সে বলল-গলা টিপে ধরতাম। কি সাংঘাতিক নারী ! প্রথম দিনই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম সে অনেক দারুন একজন মহিলা।
একবার কাজের কারনে যোহরের নামাজ পড়তে মনে ছিলনা। পরে দেখী কিছুই রান্না হয়নি। বললাম রান্না করোনি ? সে বলল-নামাজ পড়েছো আজ ? তখন আমার হুশ হলো। সে বলল-ঠিক আছে নামাজ পড়ে নাও আমি রান্না বসাচ্ছি। খেতে দেরী হবে,এটাই তোমার শাস্তি। অথচ আমার কারনে সে নিজেও দেরী করে খেয়েছে,সে বিষয়টি সে কিন্তু উল্লেখই করেনি। কি সাংঘাতিক মেয়ে !
এরপর থেকে আমার সাধারনত এরকম ভুল হয়না। বিভিন্ন বিষয়ে তার বিভিন্ন রকম শাস্তি আমাকে লাইনে থাকতে বাধ্য করে। আমাদের সময়গুলো খুবই উপভোগ্য। প্রতিটা ক্ষনই আনন্দময়। কখনই বুঝতে পারিনা যে আমি গরিব। তার গুন আমাকে মুগ্ধ করে। আমি তার সরাসরি প্রশংসা করি,কিন্তু সে তা করেনা। সে গরম বাক্য বিনিময়েও ভালোবাসা প্রকাশ করে। এটাই তার স্বভাব।
পুটির মা সুন্দর করে গল্প করে। রাতে আমরা যখন শুতে যাই,তখন অনেক ক্ষন ধরে গল্প করি। সারাদিনের ঘটে যাওয়া নানান বিষয়,ভবিষ্যৎ পুটিদের নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করে সে। সে বলে আমরা আমাদের পুটিদেরকে অনেক বড় বড় আলেম বানাবো। তারা প্রচলিত অশিক্ষিত হুজুর হবেনা। তারা হবে বড় স্কলার। তারা সমাজকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবে। তাদের জন্যে আমি সবকিছু করব। তার স্বপ্ন আমার ভেতর প্রবেশ করে। আমিও তার মত স্বপ্ন দেখী।
পুটির মার মত সত্যবাদী এবং সৎ সাহসী নারী আমি দেখিনি। সে অন্যায়ের বিরোধীতায় প্রবল । সে কাওকে পরোয়া করেনা। সেদিন একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলে একটা মেয়ের ওড়না টানাটানি করে। এটা দেখতে পেয়ে পুটির মা লাঠি দিয়ে এক ছেলেকে এমনভাবে পিটিয়েছে যে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। এটা নিয়ে গ্রামে শালিস বসানো হল। কেউ কেউ এটাকে বাড়াবাড়ি বললেও অধিকাংশই পুটির মায়ের প্রশংসা করল আর সেই ছেলেদেরকে হুশিয়ার করে দিল। আমাদের গ্রামের মানুষগুলো বেশ ভালো।
পুটির মা ইসলাম সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখে। আর সে এলাকার নারীদেরকে এটা শেখায়। তার কারনে অনেকে কুসংষ্কার বাদ দিয়ে পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করেছে। আর প্রতিবেশীদেরকে সর্বদা সাহায্য করে। আমাদের সকল প্রতিবেশীই তাকে আদর্শ মনে করে। আর আমাকে বলে -তোমার তো রাজকপাল।
একবার এক খাজাবাবা আমাদের বাড়িতে এসে কিসব কান্ড পাকানোর চেষ্টা করছিলো। পুটির মা সুন্নাহ থেকে যতগুলো প্রশ্ন করেছে তার একটারও ভালো জবাব দিতে পারেনি সেই বাবা। এরপর পুটির মা বলল-হয় ইসলামে প্রবেশ করো ধান্দাবাজি রেখে, নইলে ওই যে লম্বা লাঠি দেখতে পাচ্ছেন....বুঝেছেন ? খাজা বাবা সাগরেদ নিয়ে প্রস্থান করল।
পুটির মায়ের চরিত্র,আচরন,তার সত্যবাদীতা,তার হাসি,তার খুনসুটি,তার ব্যক্তিত্ব,তার স্বভাব,সাহস,তার অভিব্যক্তি সবকিছুই অতি উন্নত। তার ভালোবাসা,তার দায়িত্ববোধ,তার নিষ্ঠা,একাগ্রতা,কর্মতৎপরতা,রুচি অসাধারণ। আমার মত হতদরিদ্র এক কৃষককে সে যেভাবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আপন করে নিয়েছে তাতে তার অতি উন্নত মানের জীবনবোধের শুধু প্রশংসা করলেও কম করা হয়।। সেই আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। আমার পুটির মাকে আমি অনেক ভালোবাসি,মূলত: সে যা করেছে তার প্রতিদান আমি তাকে দিতে পারিনা। আল্লাহই তার উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন। তার জন্যে অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া রইলো।
বিষয়: বিবিধ
২০৩৩ বার পঠিত, ৫১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনি পুঁটির মা নিয়ে এত বড় একটা সপ্ন দেখছেন যে আপনার সপ্নটা ভেঙ্গে দিতে মন চাচ্ছে না
গামছা বানামু
তবে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে আনকমন হয়েছে তাই পুরস্কার পাইলে ও পাইতে পারেন ।
ভাই নিজের জগতটা নিজের মত গুছিয়ে নিন তাহলে দেখবেন আর নি:সঙ্গতা আর লাগছে না।
যদিও একরকম ভাবে গুছিয়ে নিয়েছেন
এখন থেকে পুঁটির বাপ রাজা পুঁটির মা রানী.... রাজা রানীর সিংহাসনে সুখের স্রোত বয়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশা।
পুঁটির মা যেন আপনার কল্পনা থেকেও ভালো হয় যেই কামনা করি মহান আল্লাহর দরবারে।
ধন্যবাদ। রাজা পুঁটির বাপ।
দোয়া রইলো অনেক অনেক অনেক... আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আপনার শুভ্র ও শুদ্ধ স্বপ্নগুলো কবুল করে নিন। আমীন।
আপনার লেখাটি যখন পড়ছিলাম তখন এই গানটি শুনছিলাম -- কেন যেন মনে হল আপনি এভাবে খুজেন আপনার পুটির মাকে তাই শেয়ার করলাম----
স্লেভ ভাই ইহা দেখিলে নিশ্চয়ই হিট খাইবে...
পুরোটাই সিনেমাটিক , কিন্তু তারপর ও অনেক ভাল লাগল, পুটির মায়ের ব্যাপারে অনেক পজেটিভ আপনি। দোয়া করি এমন পুটির মা আপনার জীবনে আসুক যার সম্পর্কে আপনি সব সময় পজেটিভ থাকতে পারেন আর আমাদেরকে মাঝে মাঝে দাওয়াত দিয়ে পুটির মায়ের মাচার ফ্রেশ সবজি খাওয়াতে পারেন...
হাটে না যাইয়ো, মাঠে না যাইয়ো
ঘাটে না যাইয়ে একেলা
কদম ডালে বইসা আছে
বন্ধু চিকন কালা
ও চিকন কালা
ওরে শালা
পুটির মা দেবে
লাঠি দিয়ে ডলা....
খুব সুখপাঠ্য হয়েছে! একেবারে দেশি মুরগীর সাথে ছোট লাল গোল আলুর ঝোলের মতোন
পোস্ট এবং মন্তব্য দুটোই উপভোগ্য হয়েছে! আল্লাহ আপনার মনে রমানুষ মিলিয়ে দিক! আমিন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন