আমার প্রিয় খাবার
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ৩০ মে, ২০১৫, ১১:৫১:৪৬ রাত
একবার মোল্লা নাসিরুদ্দীনকে তীর ধনুক দিয়ে রাজা মশাই লক্ষ্যভেদ করতে বললেন। নাসিরুদ্দীন লক্ষভ্রষ্ট তীরের ব্যাপারে বলল-এভাবে আমাদের খাদ্যমন্ত্রী তীর ছুড়ে। আবারও মিস হলে বলল-এভাবে আমাদের উজীর সাহেব তীর ছুড়ে। এভাবে...একে একে বহু তীর নিক্ষেপের পর একবার একটি তীর লক্ষ্যভেদ করে, আর নাসিরুদ্দীন বলে ওঠে,এতক্ষনেই নাসিরুদ্দীন তার নিজের তীরটি ছুড়ল।
আমার ধারনা, আমার আজকের লেখা দেখে অনেকে বলে উঠবে এতক্ষনেই দ্য স্লেভ তার নিজের একান্ত প্রিয় বিষয়টি নিয়ে লিখল।
অামার পিতা ছিলেন একজন অতি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ,আর তিনি ছিলেন সাংঘাতিক ভোজনরসিক লোক। এলাকায় তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন বিরাট ফুর্তিবাজ। লোকজন ,বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করা,পিকনিক বা খাবারের আয়োজন করা ছিল নিত্যদিনের কাজ। তিনি মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন আর তিনি রান্নাও করতে পারতেন। আমাদের প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে ব্যপক বৈচিত্র থাকত। মজার মজার সব খাবার খেতে আমার দারুন লাগত। আজ এতটা দিন পরে এসে ঠিক বুঝতে পারছি না কোন খাবারটা আমার বেশী প্রিয়।
ছোটবেলায় আমি রাখালদেরকে পছন্দ করতাম। আমার এক ফুফুর বাড়ি আমাদের বাড়ির পেছনেই। তাদের অনেক জমিজমা তাই সর্বদা ২ অথবা ৩ জন রাখাল বাড়িতে রাখত। আর তাদের সাথে ছিল আমার সখ্য। এদের সাথে মাঠে মাঠে ঘুরেছি বেশ। তখন অনেক কৃষককে ক্ষেতের আইলে বসে পান্তাভাত পেয়াজ,মরিচ দিয়ে খেতে দেখেছি। সাংঘাতিক লোভ লাগত সে খাওয়া দেখে। কেউ কেউ পেয়াজের ক্ষেত থেকে সদ্য পেয়াজ তুলে পান্তাখাতে খেত। আমার মনে হত আহ, যদি এভাবে আইলে বসে পান্তাভাত খেতে পারতাম ! কৃষকের জন্যে তাদের সন্তানেরা গামছায় বেধে খাবার নিয়ে যেত। অনেকের পাতে দেখতাম কিছু শুকনো মরিচ পোড়া,পেয়াজ আবার পান্তার গামলার একপাশে অল্প একটু তরকারী। তারা অত্যন্ত সুন্দর করে পান্তা মাখাতো,অামি লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকাতাম কিন্তু তারা এটা খেয়াল করত না।
বাড়িতে এসে আমি ঠিক সেরকম পান্তা খেতে চাইতাম,আর পোড়া মরিচ ,পেয়াজ ঠিক কৃষকের মতকরে মাখাতাম। পান্তা খেতে আমার সত্যিই ভালো লাগত। একেবারে ভেতর থেকে তৃপ্তী পেতাম। কিন্তু সবথেকে প্রিয় খাবারের মধ্যে এটাকে ইচ্ছা থাকা সত্তেও রাখছি না।
আমি জীবনে যে কত রকম খাবার খেয়েছি তার কোনো হিসেব নেই। সত্যি বলতে কি আমার মা রান্না করত অসাধারণ। সে যা কিছুই রান্না করুক না কেন ,সেটাই অনেক মজা হত। সম্ভবত প্রত্যেকেই প্রিয় রাধুনি হিসেবে তাদের মাকে সামনে রাখে। সেটা এ কারনে যে তার মা'ই তার খাবারের স্বাদের ব্যাপারে প্রথম থেকে অভিজ্ঞতা দান করে। অন্য মানুষের রান্না পছন্দ হলেও মায়ের রান্নাটাই ছিল আমার প্রিয়। আমার আব্বা বাজার খেতে ফিরে বলে দিত কোন তরকারী সাথে কোন মাছ কিভাবে যাবে। কোনটা কেমন রান্না করতে হবে বা কিভাবে রান্না করলে বেশী মজা লাগবে ইত্যাদী।
আমার প্রিয় মাছ হল কৈ,শিং,মাগুর,ইলিশ কিন্ত ব্যপক মজা পেতাম পার্শে মাছ ভুনা খেতে। এই মাছ সব সময় পাওয়া যায় না। এটার ভুনা অসাধারণ। বর্ষায় আমরা খিচুড়ী আর ইলিশ মাছ ভুনা,গরুর মাংস এসব খেতাম। সেসবের স্বাদ অতুলনীয়। তবে ইলিশের ডিম আর আলুভাতি করত মা। এক কথায় সুপার। ইলিশের ডিমের ওপর কোনো জিনিস নেই। লাউ এর সাথে শিং মাছ ব্যপক দারুন লাগত। বেগুনের সাথে ইলিশ,মাগুর মাছের ঝোল,চিংড়ী ভাজি এবং ভুনা। চিংড়ী মাছ কখনও নারকেলের দুধের সাথে রান্না হত,তার স্বাদ ভোলার নয়।
রুইমাছ ভাজি করে আলুর সাথে ভুনা করা হত,সে এক অসাধারন কান্ডবান্ড। ছোট মাছের চচ্চড়িও ভালো লাগত। বেশী করে পেয়াজ মরিচ দিয়ে রান্না করা হত এটা। তবে স্কুল থেকে ফিরে যেদিন গরুর মাংস দেখতাম,সেদিন আমার আনন্দ হত বেশী। মা গরু,খাশি,মুরগী অত্যন্ত চমৎকার করে রান্না করত।
মুরগীর মাংস কাঠালের বিচি দিয়ে রান্না করত মা,আর ওলকচুর সাথে মুরগী রান্না করাটা ছিল মায়ের এক স্পেশাল আর্ট। এ জিনিস না খেলে বোঝা যাবেনা কতটা দারুন। ইশ....সর্বনাশ হয়ে গেল...এখন তো খেতে ইচ্ছে করছে....ওদিকে আজকের এই লেখাটা লিখতে গিয়ে চুলায় থাকা ভাত পুড়েছে....
আমার ভালো লাগে কচুশাক,পুইশাক,অন্যান্য শাকও ভালো লাগে। সীম চচ্চড়ি লাগে সুপার। আর তিতা করল্লা রান্না হলে মনে হত তরকারীর কড়াইতে ফুটবলের মত কিক করি। মা ফুলকপি দারুন রান্না করত। আর ঝিঙ্গা ছিল আমার খুব প্রিয় তরকারী। এটা ইলিশ মাছ ছোট করে কুটে চচ্চড়ি করা হত। বেগুন ভর্তা,ভাজি বেশ দারুন লাগত। কলার তরকারী ছিল আমার অনেক প্রিয়। আর টমেটো তো সারাজীবনের প্রিয়। মেটে আলুর তরকারীর কথা শুনে মনে হচ্ছে এক্ষুনি দেশে যাই। এর উপর জিনিস নেই। যেটা মাথায় আসছে সেটাকেই প্রিয় করতে ইচ্ছে করছে।
স্কুলে এক বুড়ি তেতুল বিক্রী করত,অার চাটনিও। সেই বুড়ির চাটনির এত মজার চাটনি আর কখনই খাইনি। স্কুলে মিজান নামের এক লোক ঝালমুড়ি বিশেষভাবে তৈরী করত। সেটা ছিল অসাধারণ। অনেক বছর পর সেই মিজানের ঝালমুড়ি খেয়েছিলাম। পূর্বের কথা চিন্তা করে একসাথে ১০ টাকার কিনলাম। মিজান ভাইকে যখন বললাম, ভাই আপনার ঝালমুড়ির স্বাদ অার আগের মত নেই। মিজান ভাই মুচকি হেসে বলল-আমি এখনও সেই আগের মতই ঝালমুড়ি বানাচ্ছি,কিন্তু আগে তুমি মায়ের আচলে থাকা এক টাকা দিয়ে কিনে খেয়েছো,তাই সেটার স্বাদ তোমার কাছে অতুলনীয় ছিল । এই বয়সে এসে ওই স্বাদ আর ফেরৎ পাবেনা। তার কথাটা আমার মনে গেথে গেল। আসলেই সময় আর ফেরৎ আসবে না। ছোটলোয় যা খেয়ে ও করে মজা পেয়েছি,বড় বেলায় সেটাই কখনও রং হারায়।
আমার খাবারের তালিকা সত্যিই বিশাল। আমি পুরোটা বর্ণনা করতে পারব না, ইচ্ছাও নেই। আমার প্রায় সব রকমের ফল খেতে ভালো লাগে। তবে ছোটবেলা থেকে টক জাতীয় ফলের প্রতি ব্যপক আকর্ষন। তেতুলের জন্যে যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছি তা নিয়ে আস্ত বই লেখা যাবে। জলপাই,কদবেল,বরই বা কুল,কাচা আম ওহ....অসহ্য ! পেয়ারা,জামরুল,তরমুজ,আমড়া,কামরাঙ্গা,পেপে...এসব আমার প্রিয়।
আর মিস্টির মধ্যে প্রায় সবটাই দারুন লাগে। সন্দেশ খুব ভালো লাগত। রসগোল্লা খেলে তো .....আর চমচম,কালোজাম,রসমালাইয়ের স্বাদ তো অসাধারণ। আর পানতোয়াও দারুন। পুডিংও ভালো লাগত,তবে ছোটবেলায় এটা চিনতাম না। আমার দই ও খুব ভালো লাগে।
যাক এবার আমার খাবারের গাড়ি থামানো প্রয়োজন,কারন সবকিছুর ভেতর থেকে একটি খাবারকে পছন্দ করেই নাকি পোস্ট করতে হবে মর্মে আওয়াজ এসেছে। কিন্তু আমি একটি খাবার নয় বরং একটি খাবারের কম্বিনেশনকেই আমার পছন্দের তালিকার উর্ধ্বে রাখলাম। সেই ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত এটার ব্যাপারে অামার রুচির কোনো রকম হেরফের হয়নি। আর তা হল আলুভর্তা ও ডাল। তবে এটা হতে হবে টক ডাল। মানে ডালের সাথে টক জাতীয় জিনিস থাকতে হবে। সেটা কাচা আম হলে প্রথম শ্রেনীর হবে,আম না পাওয়া গেলে তেতুল,জলপাই চলবে,আর কিছু চলবে না। আর আলু হতে হবে বালি বালি মার্কা। আঠালো আলুভর্তা আমার পছন্দ না। ভর্তা মাখতে হবে শুকনো মরিচ দিয়ে এবং মরিচ হবে অনেক। খাটি সরিষার তেল দিয়ে মাখতে হবে, ঘি দিলে চলবে না।
বসতে হবে মাদুরে,চেয়ার টেবিল হলে চলবে না। গরম আম-ডাল থাকবে গামলায়, ছোট বাটিতে হলে চলবে না। খেতে হবে কান্দা উচু থালায়, সমান প্লেট হলে চলবে না। ডালের পাত্রের মধ্যে নারকেলের খোলে তৈরী ওড়ং থাকতে হবে, চামুচ হলে চলবে না। পাতে ডাল ঢেলে আলুভর্তা দিয়ে মনোযোগসহকারে খেতে হবে, চারিদিকে তাকালে চলবে না। এভাবে টেনে যেতে হবে, লোকজন নিম্নে ২৮ এবং সর্বোচ্চ ৩২ সংখ্যক দন্ত বিকশিত করে হাসবে,হেসে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়বে,খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা ডালের পাত্রে এসে না পড়ে...এটা ঠিক থাকলে ওরা পড়ুক আর মরুক তাতে কিছু এসে যায় না। তবে তাদের দিকে তাকালে চলবে না। চলবে শুধু আম-ডাল আর শুকনো মরিচে মাখানো আলুভর্তা। ইনশাআল্লাহ জান্নাতেও এটা খেতে চাইব।
বিষয়: বিবিধ
২৮৮২ বার পঠিত, ৩৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খাবার ম্যানু তো চমৎকার বর্ণনা করেছেন। অনেক অনেক শুকরিয়া।
সত্যি করে বলুনঃ ইদুর ছানার মত এটি কি?
আপনি যেভাবে মাছা, মাংস, সবজি রান্না এবং খাওয়ার বিবরন দিলেন অনেক মহিলাই এভাবে সুচারু রুপে বিবরন দিতে পারবে না!
বেশ কিছু ভুলে যাওয়া খাবারের কথা স্মরনে চলে এলো!
যেভাবে লিখেছেন আমাদের তো বটে স্বয়ং মডারেশনের ও জিভে জল চলে আসবে আর পুরষ্কার নির্ঘাৎ আপনার কাছেই
শুভকামনা রইলো!
যায় হোক অনেক ভাল লেখেছেন। আলহামদুল্লিলাহ।
পুরো পোষ্ট পরে বুঝলাম, আপনি খাদক না হলেও পেটুক ছিলেন।
টক ডাল বেলুম্বু দিয়েও করা যায় মানে আমাদের বাসায় এখন কেবল একটা বেলুম্বু গাছ রয়ে যাওয়ায় শুধু সেটা দিয়েই করা হয়! আর শুকনা মরিচ ষড়িষার তেল দিযে আলুর ভর্তা তৈরিতে আমি বিশেষজ্ঞ বলতে পারেন! দির্ঘ মেস জিবনে এইটা ছিল প্রায়ই সাপার মেন্যু। এখনও এই আইটেম আমি নিজের হাতেই বানাই। বউ এর হাত পড়লে স্বাদ এর তেরটা বাজে!
এতো দেখি আমার কাহিনি। আমার ও অনেক খাবার অনেক পছন্দ। কোন নির্দিস্ট একটা খাবার সিলেক্ট করা তাই আমার জন্য অনেক কঠিন.............।
যাহক, আপনার পোস্ট পড়ে আমার ও অনেক খাবারে কথা নতুন করে মনে পড়ল.......
) ) )
) ) )
সত্যিই মডারেটরও জিহ্বার ঝোল সাম্লে রাখতে পারবেনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন