আমার সংগীত জীবন !
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০২:৩২:১১ দুপুর
প্রথমবার সরাসরি গান বোধহয় স্কুলের এক মেয়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে ক্লাশ ২ তে পড়তাম। বাড়ির পাশের সহপাঠীকে ম্যাডাম গান গাইতে বলল। সে আমাদের সকলের সামনে দাড়িয়ে একটা কাগজ বের করল এবং সেটা দেখে গান গাইতে লাগল। মনে করতে পারছি না কোন গান তবে সেটা পরে বুঝেছিলাম। সে কবিতা পড়ার মত করে গান গেয়েছিল। লতা মুঙ্গেশকর সে সময়ে তার বিখ্যাত এ গানটি শুনলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হত, সন্দেহ নেই !
একদিন জাতীয় সংগীত মনে মনে আওড়ানোর পর ক্লাশরুমের মধ্যে অনুচ্চস্বরে গাইলাম। আমি ছাড়া আর কেউ তখন আশপাশে ছিলনা। নিজের সুর শুনে মনে হল, আমি তো খারাপ গাই না। এরপর কোনোগান শুনে তা কপি করতাম। কিন্তু কখনই মানুষের সামনে গান গাইনি।
নির্জন কোনো স্থানে গান গাইতাম। যেসকল স্থানে প্রতিধ্বনী শোনা যেত সেসকল স্থানে গান গাইতে ভাল লাগত। আমার এক ফুফাত ভাইয়ের সাথে ছোটবেলা থেকে আমার দহরম মহরম ছিল। শুধু সেই শুনত আমার গান। আমি ছিলাম বিশাল লাজুক স্বভাবের। মানুষের সামনে যেতে লজ্জা করত। আমার লাজুকতার অনেক কাহিনী রয়েছে।
প্রথমবার অন্য মানুষের সামনে গান গাই যখন আমি কলেজে পড়ি। এক সন্ধ্যায় এলাকার এক বড় ভাই ঢাকার বাসার বারান্দায় বসে একটা গান গাইলো। তারপর আমাকে বলল একটা গান শোনাতে। কুমার শানুর গান যশোর,সাতক্ষীরা,খুলনা এলাকার লোকের বেশ প্রিয়। আমারও প্রিয় ছিল। তাই গাইলাম ,কিন্তু আমার গরা কাপছিল,আমি থেমে গেলাম। চিন্তা করলাম এক জনের সামনে এই অবস্থা,আর যদি একাধীক লোক গান শুনতে চায়,তখন কি হবে ?
বাথরুমে গান গাইতে খুব মজা লাগত। এক সময় চিন্তা করলাম টেপরেকর্ডারে নিজের গান রেকর্ড করব। করলাম। নিজের গান শুনে নিজেরই লজ্জা করত।
এভাবেই চলছিল। কলেজে,ইউনিভার্সিটিতে থাকতে দু একবার পিকনিকে গেছি কিন্তু সেখানে আমি ফ্রি হতে পারতাম না। অন্যদের সাথে মিশে হৈ হুল্লোড় করতে পারতাম না। কেন যেন বাধা কাজ করত। তবে দু একবার অন্যের সামনে গেয়েছি। মানুষ প্রশংসা করেছে। ঢাকায় থাকতে বান্দর গ্রুপ ছিল বন্ধু। তাদের সাথে গান গেয়েছি বেশ। তারুন্যে পা দিয়ে কুংফু ক্লাবে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে বেশ কিছু সলিড বন্ধু হয়েছিল,বান্দরও ছিল। সেসময়ে বেশ ফাইজলামি করেছি। গান গাইতাম্ প্যারোডী বানাতাম। কখনও কখনও অনেকে মিলে টি.এস.সির মাঠে এবং বারান্দায় বসে উচ্চস্বরে গান গাইতাম। আশপাশে লোক জমে যেত। এক রিক্সায় ৩ জন করে উঠতাম এবং আমি উপরে বসতাম আর উচ্চস্বরে গান গাইতাম। রিক্সাওয়ালাকে গান গেয়ে নির্দেশনা দিতাম কোন দিকে যেতে হবে। শহীদ মিনারের সামনের রাস্তার ফুটপাথে বসে হাজির বিরিয়ানি খেতাম। বন্ধুর গাড়িতে বসেও গান গাইতে গাইতে উদ্দেশ্যহীন ঘুরতাম।
অনেক বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে অনুরোধে গান গাইতে হত। অনেক সময় লজ্জা করলে বলতাম লাইট অফ করেন,তবেই গাইব। এভাবে অনেকবার গাওয়া হয়েছে।
দুবার জাকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি এবং সেটাই প্রথম ইন্সট্রুমেন্টের সাথে গান গাওয়া,এর আগে খালি গলায়ই গেয়েছি। এর মধ্যে দ্বিতীয়বার এক কাহিনী ঘটে গিয়েছিল। গানের তাল সম্পর্কে আমার তেমন ধারনা ছিলনা। যারা যন্ত্রী তারাও এমন ধরনের নয় যে,মূল গানে যেরকম বাজনা আছে ঠিক সেরকমই বাজাবে। তাই গিটারিস্ট এবং কি-বোর্ডিস্টকে বলে রাখতাম কখন থামব আর কখন শুরু করব সেটা চোখের ইশারায় জানিয়ে দিবেন। প্রথমবার এক মধ্যম মানের ব্যান্ডে গেয়েছিলাম এবং তারা সহযেগীতা করাতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয়বার অনুষ্টানে এই সমস্যা হয়েছিল। ...
বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠান,তিনি ছিলেন আমার সিনিয়র। তার ছোট বোনও আমার সিনিয়র এবং তিনি ছিলেন কড়া স্বভাবের। কখনও এমন সব ঘটনা ঘটাতেন যা সবার পক্ষে সম্ভব হয়না। তো আমি গান শুরু করলাম্ যন্ত্রীরা বাজাচ্ছে,,,,সামনে অনেক দর্শক। অর্ধেক পথে বন্ধুর বোন উচ্চস্বরে বলে উঠল-এই তোর তাল ঠিক নেই,তুই থাম। তুই ৩ বার তাল মিস করছিস,তোর গাওয়ার আর কোনো অপশন নেই...থাম নইলে মাইক কেড়ে নেব।....বে-কায়দায় পড়ে গেলাম। কিন্তু আমি গাসি হাসি মুখ করে গান গেয়েই চললাম্ । এবার সে উঠে আসল এবং আমার মাইক ধরে ফেলল। কিন্তু আমিও শক্ত করে মাইক ধরে রাখলাম,,,ওদিকে ইন্সট্রুমেন্ট বেজে যাচ্ছে তার নিয়মে...ধস্তাধস্তীর মধ্যেও আমি গান গেয়ে যাচ্ছি। দর্শক সারিতে আমার পরিবারের সদস্যরাও ছিল। ানেকে হেসে আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছে ,আমি নাছোড়বান্দা আর সেও। এক সময় হ্যাচকা টানে সে মাউক্রোফোন কেড়ে নিল,আর তখন বাজনাও থেমে গেল,আমিও থামলাম। .....
এর অনেক দিন পর আমাদের এলাকার স্থানীয় ব্যান্ড নিয়ে বড় ভায়েরা ইদের পর সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমি কয়েকজনের সাথে শুনতে গেলাম। এক ফাকে এক বড় ভাইকে বললাম -আমি গান গাইতে চাই। সে তখন কয়েক জনের সাথে কথা বলল এবং নিশ্চিত করল। একজন আবার ভাবল আমি বড় শিল্পী,তাই বলল-ভাই এই স্টেজে গান গাবেন, আপনার ইজ্জত থাকবে ? বললাম-ইজ্জত থাকুক আর যাক,গান আমি গাইব।
উপস্থাপিকা ঘোষনা করলেন-এবারে গান পরিবেশনা করবেন, বিশিষ্ট এবং সুকন্ঠী.....। চিন্তা করলাম এখানে উপস্থিত কেউ জীবনেও আমার গান শোনেনি, বুঝল কি করে যে আমি সুকন্ঠী ? যাইহোক হিন্দী গানে মাত করলাম। এখানেও যন্ত্র বাদকদেরকে বলেছিলাম ইশারায় জানিয়ে দিবেন কখন শুরু করব।....
এর কয়েকদিন পর ঢাকায় রাস্তা দিয়ে হাটার সময় এক ছেলে বলল-ভাই গান তো গাইলেন কঠিন(দারুন)।...পুলকিত হলাম্। যশোরে মনিহার সিনেমা হলের সামনের এক বাস কাউন্টারে দাড়ানো অবস্থায় একজন বলল-ভাই গান তো দারুন গাইলেন।...আমি তো নিজেই নিজের কাছে মহা শিল্পী হয়ে গেলাম। ...
এরপর এক ঈদে আমার সকল ফুফু,তাদের কিছু ছেলে মেয়ে,আমার সকল বোন,আব্বা,মা আমাদের বাড়ির উঠোনে গোল হয়ে বসে বাইনা ধরল গান শোনাতে হবে। কেউ কেউ বলল-বয়স হয়েছে,কবে মরে যায় ঠিক নেই..বাপ তুই একটা গান ধর।....আমি একে একে ১৪/১৫ টা গান গাইলাম সে রাতে্ । ওটাই আমার আব্বা-মার উপস্থিতিতে প্রথম গান গাওয়া। ....এরপর আমার বড় বোন ভাল গানের শিল্পী রেখে আমাকে গান মেখাতে চাইলো। কিন্তু এসময়ে ইসলামের কিছু বিষয় গভীরভাবে আমার মধ্যে ঢুকতে শুরু করে। আমি জেনেছিলাম গানকে পেশা হিসেবে নেওয়া হারাম। তাই প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এবং কিছু ব্যান্ডে যোগদানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি ওপথে গেলাম না। গানকে আমার ব্যক্তিগত বিনোদনের বিষয় হিসেবেই গ্রহন করলাম। এরপর আর কখনই আত্মীয়স্বজনের সামনে গান গাওয়া হয়নি্ ।
পরবর্তীতে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে আমি ইসলামী সংগীত গেয়েছি,যদিও আমি মাত্র কয়েকটা গান জানতাম। আমি ব্যপক প্রশংসিত হয়েছিলাম্।
এক সময় গান শোনা নেশা ছিল। রাস্তায় চলার সময় মোবাইলে গান শুনতাম। পরে আল্লাহর কাছে প্রর্থনা করলাম এই অভ্যাস থেকে মুক্তি দেওয়ার। কঠিন ব্রেক কষলাম। নিজেকে অন্য দিকে ব্যস্ত রাখলাম,আর সেটা হল লেখালিখি। একেবারে সাধারণ কিছু লিখতে লিখতেই মনে হল বিশাল যুবশ্রেণীর জন্যে লেখালিখি তেমন হয়না। প্রতিষ্ঠিত লেখক,কবরা তাদেরকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কুরআন-সুন্নাহ চর্চা শুরু করলাম এবং আমার নিজের উপলব্ধী লিখে রাখতে শুরু করলাম। তারপর কিভাবে কিভাবে যেন লেখা চলছে এবং চলছে.....সব সময় ওই হাদীসটার কথা মনে পড়ে। রসূল(সাঃ)বলেছেন-প্রচার কর, তা একটি হাদীসই হোক না কেন..সম্ভবত বুখারী।....অবাক হযে গেছি পূর্বের সেই গান শোনার অভ্যাস একেবারেই ধুয়ে মুছে গিয়েছিল। পূর্বের আবেগগুলোর অবস্থা,অবস্থান বদলেছে। এখন আমি আমার মালিককে চিনি আর তার রাস্তায় চলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি তার কাছে সকল ভুলের ব্যাপারে ক্ষমা প্রার্থী। আল্লাহ যেন সঠিক পথে রাখেন এবং সফলদের কাতারে স্থান দান করেন !
বিষয়: বিবিধ
১৪০৭ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আজকে আমার কপালে খারাপী আছে!!! কারন এত হাসলাম!! উফ!!! যত হাসি তত কান্না..বলে গেছে কে যেন!!
বর্ণনার সাবলীলতায় যাপিত জীবনের একটা অংশ সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে!
কল্যাণময়ী পরিবর্তনে আলহামদু লিল্লাহ এবং অনেক ধন্যবাদ!
গানের প্রতি টান ছাড়তে পারছি না। যদিও সূরের বিন্দু মাত্রও অবশিষ্ট নেই তবুও একা-একা গাইতে অন্য রকম ভাল লাগা কাজ করে!
জীবনে একবারই প্রচলিত গানের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করে ছিলাম এবং দ্বিতীয় স্হান অর্জন করে ছিলাম!
আল্লাহর কাছে স্বীয় হেদায়েতের দোয়া চাচ্ছি!!
শেষ কবে গান শুনেছি আর মনে পড়ে না। সঙ্গীত আগের মত আর টানে না।
গায়ক না হয়ে আল্লাহর পথে ফিরেছেন এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া।
মন্তব্য করতে লগইন করুন