আত্মার খোরাক: রেহনূমা বিনতে আনিস
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১২:৪৩:৩৭ দুপুর
Search Facebook
আত্মার খোরাক
December 24, 2014 at 9:49pm
উস্তাদ রেহনূমা বিনতে আনিসের লেখায় সামাজিক,পারিবারিক যেসব চিত্র থাকে তা এক কথায় অসাধারণ। একটি পরিবারকে কিভাবে গঠন করা উচিৎ,পরিবারের সদস্যদের চিন্তাধারা কেমন হওয়া উচিৎ,ছোটদের প্রতি আচরণ কেমন হলে তারা উন্নত আদর্শ নিয়ে বড় হতে পারবে এবং সে লক্ষ্যে পরিবার,সমাজ গঠন করতে ভূমিকা রাখবে সেটা তার লেখায় বারবার উঠে আসে। তার আজকের লেখাটা পড়ে মনে হল শেয়ার না দিলে চলবে না। পড়ুন তবে:
আগামীকাল ক্রিসমাস। আজ দুপুর বারোটায় অফিস ছুটি হয়ে গেল। অফিস এলাকা থেকে ট্রেনে বাসার কাছাকাছি স্টেশনে পৌঁছে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। দেখলাম ক্রিসমাসের নানান সিম্বল দিয়ে সাজানো একটা বাস এসে স্টেশনে দাঁড়ালো। বাস ভর্তি বিশাল বিশাল ব্যাগ। বাসটা দাঁড়ানোর সাথে সাথে কয়েকজন বাস থেকে লাফিয়ে নেমে স্টেশনে গমনাগমনরত লোকজনের মাঝে নানান উপহার বিলি করতে লাগল। আমার কাছে এলে উপহার নিলাম না, কিন্তু ওদের সাথে কথা বললাম। ওরা কয়েকটি পরিবার মিলে টাকা সংগ্রহ করে ডলার স্টোর থেকে একটাকা থেকে পাঁচ টাকার ভেতর প্রচুর পরিমাণ বই, খেলনা ইত্যাদি উপহার কিনেছে। উপহারগুলো র্যাপিং বা প্যাকেট করার পরিবর্তে ওরা খোলাই দিচ্ছে যেন র্যাপিংয়ে যে খরচ লাগত তা দিয়ে আরো বেশী জিনিস কেনা যায়। তারপর ওরা শহর এলাকার বাস ভাড়া করে পুরো শহর ঘুরে ঘুরে লোকজনের মাঝে এগুলো বিলি করছে, যে যতটা চায়। কোন গানবাজনা নেই, ব্যানার নেই, ক্যামেরা নেই, কাকে দিচ্ছে সে ব্যাপারে ভেদাভেদ নেই, মুখের হাসিতেও কার্পণ্য নেই - আছে শুধু শুভেচ্ছা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আমার ব্যাগে নানাবিধ জিনিসপত্র থাকে। ওখান থেকে কিছু চকলেট বের করে বাচ্চাগুলো আর ওদের মাকে দিলাম।
গতকাল শ্রদ্ধেয় বড়ভাই ডঃ আবুল কালাম আজাদ ভাই বলছিলেন বিদেশে অবস্থানরত কিছু কিছু বাচ্চা মনে করে ঈদে কোন আনন্দ হয়না। সত্যি কথা বলতে গেলে দেশে অবস্থানরত বাচ্চারাও আজকাল আর ঈদে মজা পায়না। আমার ধারণা, এর প্রথম কারণ, আমরা মুসলিমরা আমাদের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান রাখিনা; দ্বিতীয় কারণ, যতটুকু জ্ঞান আছে ততটুকুরও চর্চা করিনা। আল্লাহ আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর ইবাদাত করার জন্য। এর মাধ্যমে তিনি আমাদের একটি কল্যাণকামী জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন যারা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে, অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে, অন্যের জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করবে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভোগবাদীতার অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছে আমাদের বিশ্বাস, জ্ঞান, সদিচ্ছা। ফলে ধর্ম এখন মুসলিমদের কাছে একটি আচারসর্বস্ব বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা নামসর্বস্ব মুসলিমরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি যে আমাদের সর্বগ্রাসী চাহিদা বাড়ী, গাড়ী, নারী, টাকা, আসবাব, পোশাক, জুতো, খাবার, পানীয় কিছু দিয়ে নির্বাপিত হয়না। ঈদের সময় আমরা কি পেলাম তা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে কি দিলাম তা ভাবার সময় হয়না। অথচ ঈদ এসেছে পরের কারণে স্বার্থ বলি দেয়ার মাঝে যে তৃপ্তি রয়েছে তার স্বাদ আস্বাদন করাতে। ভাল খাবার, ভাল পোশাকের মাধ্যমে সাময়িক আনন্দ লাভ করা যায় হয়ত। কিন্তু অপরকে খাইয়ে, অপরকে পরিয়ে যে দীর্ঘস্থায়ী আনন্দ তার স্বাদ পাওয়া না গেলে ঈদের আনন্দ কি আসলেই অনুভব করা যায়?
আমার বাবার দেয়া দু’টো শিক্ষা আমার সন্তানদের মাঝে বপন করে দেয়ার চেষ্টা করেছি। একটি ঈদের, আরেকটি সার্বক্ষণিক। বাবা বলত, ঈদে নিজেদের জন্য কিছু না কিনে অন্যকে দেয়া উচিত। আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমরা মধ্যবিত্তের অধিকাংশ মানুষ এতখানি সচ্ছল যে ঘুরেফিরে সারা বছর প্রয়োজনমত কাপড় কেনা সম্ভব হয়, হোক দামী বা সাধারন। তারপর ঈদের সময়ও যদি আমরা নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি তাহলে ঈদের শিক্ষাটাই যে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়! ঈদের সময় দিতে হবে অন্যকে, যাদের সারাবছর দেয়া হয়ে ওঠেনা বা যে সারাবছর কেনার সামর্থ্য রাখেনা। আরেকদিন বাবা হাত উপুড় করে বলল, ‘এটা সবসময়ই’, তারপর হাত পেতে বলল, ‘এটার চেয়ে উত্তম’। অর্থাৎ অন্যকে দেয়া অন্যের কাছে পাওয়ার চেয়ে উত্তম। কারণ আমরা যা পাই তা পাবার সাথে সাথে হিসেব মিটে যায়। কিন্তু আমরা যা দেই তা শত হাজার লক্ষ কোটিগুণে বর্ধিত হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে। যা আমরা নিজেদের জন্য খরচ করি সেটাই আসলে ব্যায়, আর যা আমরা অন্যকে দেই সেটাই পরকালীন জীবনের জন্য জমা। সুতরাং, দিতে পারাটাও একটা সৌভাগ্য। এই সৌভাগ্য সবার হয়না।
এই শিক্ষাগুলোর পাশাপাশি আমরা, ক্যাল্গেরীর কিছু মায়েরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি পরবর্তী প্রজন্মকে ইসলামের শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হলে একে আনন্দদায়ক এবং উপভোগ্য করতে তুলতে হবে। তাই সারাবছর আমরা নানান ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকি। একইভাবে ঈদকেন্দ্রিক কিছু আয়োজন করা হয়ে থাকে যেন বাচ্চাদের কাছে মনে হয় এটি একটি কাঙ্খিত এবং আনন্দময় অনুষ্ঠান। যেমন রোজার শুরু থেকেই আমরা মহা উৎসাহে সেহরীতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তে, সম্মিলিতভাবে রাত্রিকালীন ইবাদাত করতে, সবাই মিলে কুর’আন নিয়ে আলোচনা করতে বাচ্চাদের নিয়ে যাই। ইফতার বিলি করার আয়োজন করলে বাচ্চাদের কিছু আইটেম করতে দেই, হোক সেটা সালাদ কাটা কিংবা চপ বানানো। ঈদের রান্না করার সময় বাচ্চাদের রান্নাঘরে ডেকে নেই, যেমনই হোক কিছু একটা ওদের করতে দেই। ঈদের আগের দিন ওরা সবাই একত্রিত হয়ে মেহদী লাগায়, গল্প করে। ঈদের দিন সকালে সবাই একত্রে ঈদের নামাজে যাই। সন্ধ্যায় সবাই এক বাসায় একত্রিত হয়ে খাওয়া দাওয়া করি, রান্না সবাই মিলে ভাগ করে নেয়া হয়। তারপর থাকে বাচ্চাদের সাথে মায়েদের গল্প করার একটি পর্ব। কোরবানীর ঈদের আগে কোরবানীর পশু নির্বাচন করতে ওদের ফার্মে নিয়ে যাই। মাংস এলে ওদের দিয়ে ভাগ করাই, কাকে কাকে দিতে হবে লিস্ট করতে দেই, বিলি করতে ওদের সাথে নিয়ে যাই। বাচ্চারা যখন এই কাজগুলোতে অংশগ্রহন করবে তখন ওরা ঈদের আসল স্পিরিটটা বুঝতে পারবে কারণ এর কোনটিই আত্মকেন্দ্রিক নয়, সবটাই অন্যকে দিয়ে অন্যের জন্য করে আনন্দ পাবার ব্যাপার। জামাজুতোর হিসেব আর টিভিতে অনুষ্ঠান দেখে এই আনন্দ পাওয়া যায়না, তাছাড়া এই জিনিসগুলো কি আসলে ঈদের স্পিরিটকে ধারণ করে?
আমরা স্কুলে শিক্ষা সফরে যাই যেন শেখার বিষয়টি হাতেকলমে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, এর খুঁটিনাটি দেখতে এবং জানতে পারি। বাবামা হোল সন্তানের সবচেয়ে বড় শিক্ষাঙ্গন। সুতরাং, তাঁদের দায়িত্ব সন্তানদের শুধু লেকচার না দিয়ে হাতেকলমে জড়িত করা। এভাবে তারা শুধু জানবে না বরং করতে এবং উপভোগ করতে শিখবে। ধীরে ধীরে ওরা এগুলোতে কেবল অভ্যস্ত হতে শিখবেনা বরং উৎসাহ পেতে শিখবে। একসময় তাদের কাছে ধরা দেবে জীবনের সেসব নীরব আনন্দ যা রঙ্গে ঢঙ্গে শব্দে প্রাচুর্যে নয়, আত্মার খোরাক হয়ে দোলা দিয়ে যায় হৃদয়ের গভীরে। কিন্তু এর জন্য আগে বাবামাকে সংকল্প করতে হবে বস্তু এবং ভোগবাদীতার কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার, সন্তানদের সময় দেয়ার, তাদের নিয়ে এই কাজগুলো করার এবং এগুলোকে ভালোবাসতে শেখার। তখনই তাদের জীবনে ইসলাম একটি আচার বা অনুষ্ঠানের পরিবর্তে একটি জীবনাচরণ এবং আল্লাহ একজন দূরবর্তী প্রভুর পরিবর্তে একজন সদা নিকটবর্তী বন্ধু হিসেবে ধরা দেবেন। আমরা কি চাইনা একটি পবিত্র জীবন এবং একজন পরম উপকারী বন্ধু?
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৯ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মানে আপনার ছবি।
আপনিতো বাহ সেরকম স্বাস্থ্যবান।
তবে আপনার পাশে আমি দাড়ালে নিশ্চিত আমাকে আপনার ছোট ভাই বলবে সবাই।
আমার ব্লগে আসা বন্ধ করে দিতে দেখছি
তার লেখায় সেটা প্রমান পাওয়া যায়। আপনিও
কম না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন