ইসলামে দাস-দাসী মুক্তি

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৫ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:২৮:১১ সকাল





কিভাবে ইসলাম দাস-দাসীকে মুক্তি দিয়েছে?


আমরা আলোচনা করেছি যে, ইসলাম যখন দাস-দাসীর মান সমুন্নত করা, তার সাথে উত্তম ব্যবহার করা, তাকে সম্মান করা এবং তার প্রতি ইহসান করার ব্যাপারে নিয়মনীতি ও নির্দেশমালা প্রণয়ন করেছে, তখন তার উদ্দেশ্য ছিল দাস-দাসীর মানবিক অস্তিত্ব ও সম্মানকে অনুভব করা ... এমন কি যখন সে বাস্তবে তার এই অস্তিত্ব বা অবস্থানকে অনুভব করবে এবং এই সম্মানের বাস্তবতা উপভোগ করবে, তখন সে দাসত্ব থেকে তাকে মুক্ত করার আবেদন করবে এবং মুক্ত করার পথে পথ চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণে সে পূর্ণ স্বাধীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনিত হবে।

আর এর অর্থ হল, ইসলাম কর্তৃক দাস-দাসীকে মুক্ত করার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য প্রণীত শর‘য়ী নিয়মনীতির মাধ্যমে কার্যতঃ দাস-দাসীকে মুক্ত করার পূর্বে তাকে মনের ভিতর ও হৃদয়ের গভীরতা থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, যাতে সে তার অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারে এবং যথার্থতা ও বলিষ্ঠতার সাথে স্বাধীনতা দাবি করতে পারে; আর এটাই হলো স্বাধীনতার প্রকৃত গ্যারান্টি !!

আদেশ বা ফরমান জারি করার মাধ্যমে দাস-দাসী মুক্ত করার দ্বারা আসলেই দাস-দাসীর মুক্তি অর্জিত হয়নি ... আর আমরা যা বলি, তার পক্ষে উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো ‘আব্রাহাম লিংকন’

তার ঘোষনার মাধ্যমে মানুষ দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়নি,কারন ব্যাপারটা মানুষিক,দালিলিক নয়। তবে বিষয়টি প্রশংসনীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সেটি মানুষকে সমতার বার্তা দেয়। আইন-কানুনের কাছে মানুষের মূল্য নিরূপিত হয়। কিন্তু যারা রাষ্ট্র,সমাজ পরিচালনা করে,আইন-কানুন প্রয়োগ করে,তাদের মানুষিকতায় পরিবর্তন সাধিত না হলে কাগজে কলমে দাসত্ব বিলুপ্ত হবে বটে কিন্তু বাস্তবে দাসপ্রথা বলবৎ থাকবে। এবং সেটিই দেখা গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তা নিকট অতীত পর্যন্ত ব্যপকভাবে চলেছে,তারপর সংজ্ঞা বদলেছে। এমনকি আজও বর্ণবাদ রয়ে গেছে,অর্থনৈতিক দাসত্ববাদ রয়ে গেছে। নব্য সাদ্রাজ্যবাদ বিশ্বকে নানা ভাগে ভাগ করে তৃতয়ি বিশ্বের সাথে যে আচরণ করে,তাকে দাস ব্যবস্থার নতুন রূপ বলা যায়।

দাস-দাসী মুক্ত করার ব্যাপারে ইসলাম যে শরী‘য়ত সম্মত পদ্ধতি প্রণয়ন করেছে, তা নিম্নোক্ত পদ্ধতি বা ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে:

ক. উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দান;

খ. কাফ্ফারা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দান;

গ. লিখিত চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি দান;

ঘ. রাষ্ট্রীয় তত্ত্ববধানে মুক্তি দান;

ঙ. সন্তানের মা (উম্মুল অলাদ) হওয়ার কারণে মুক্তি দান;

চ. নির্যাতনমূলক প্রহারের কারণে মুক্তি দান।

উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দান:

“তবে সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি। আর কিসে আপনাকে জানাবে যে, বন্ধুর গিরিপথ কী? এটা হচ্ছে দাসমুক্তি ...।” সূরা আল-বালাদ: ১১ – ১৩

অন্যদিকে যেসব হাদিসে দাস-দাসী মুক্ত করার ফযিলত ও মর্যাদা বর্ণনা এসেছে এবং দাস-দাসী মুক্তিদানকারী ব্যক্তির জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সেগুলোর সংখ্যা অনেক বেশি, গণনার বাইরে; আমরা উদাহরণস্বরূপ তন্মধ্য থেকে সাধ্যমত কিছু উপস্থাপন করেছি:

— ইবনু জারির রহ. আবূ নাজীহ রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“যে কোনো মুসলিম পুরুষ কোনো মুসলিম পুরুষ (গোলাম) কে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রত্যেকটি অস্থির বিনিময়ে তার এক একটি অস্থিকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন। আর যে কোনো মুসলিম নারী কোনো মুসলিম দাসীকে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রত্যেকটি অস্থির বিনিময়ে তার এক একটি অস্থিকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন।” - [মুসনাদে আহমদ]।

— ইমাম আহমদ র. ‘আমর ইবন ‘আনবাসা রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করে বলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মাসজিদ নির্মাণ করবে যাতে আল্লাহ তা‘আলার যিকির (স্মরণ) করা হবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো একজন মুসলিম গোলামকে আযাদ করবে, তা জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য তার মুক্তিপণ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার পথে শুভ্রকেশী (বৃদ্ধ) হবে, তা তার জন্য কিয়ামতের দিনে আলো হবে।” - [মুসনাদে আহমদ]

— ইমাম আবূ দাউদ ও নাসায়ী র. ‘আমর ইবন ‘আনবাসা রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

“যে ব্যক্তি একজন মুমিন গোলামকে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা সেই গোলামের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে জাহান্নামের আগুন থেকে তার প্রতিটি অঙ্গকে মুক্ত করবেন।” - [আবূ দাউদ ও নাসায়ী]।

— ইমাম আহমদ র. বারা ইবন ‘আযেব রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

“জনৈক বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করল এবং তারপর বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি কাজের প্রশিক্ষণ দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে; তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি দাস-দাসী আযাদ কর এবং দাস মুক্ত কর। তারপর সে বলল: এই দু’টি কাজই কি এক জাতীয় কাজ নয়? জবাবে তিনি বললেন: না। দাস-দাসী আযাদ করা মানে হল, তুমি তাকে মুক্ত করার মাধ্যমে পৃথক করে দেবে; আর দাস মুক্ত করা মানে হল, তুমি তার মুক্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করবে।” - [মুসনাদে আহমদ]।

— ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. প্রমূখ সা‘ঈদ ইবন মারজানা র. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি একজন মুমিন গোলামকে আযাদ করবে, আল্লাহ তা‘আলা সেই গোলামের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে জাহান্নামের আগুন থেকে তার প্রতিটি অঙ্গকে মুক্ত করবেন; এমন কি তিনি হাতের বিনিময়ে হাত, পায়ের বিনিময়ে পা এবং গুপ্তাঙ্গের বিনিময়ে গুপ্তাঙ্গকে মুক্ত করবেন ...।” [বুখারী ও মুসলিম ]।

আলী ইবন হাসান র. হাদিসের বর্ণনাকারী সা‘ঈদ ইবন মারজানা র. কে উদ্দেশ্য করে বললেন: তুমি কি এই হাদিসটি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র নিকট থেকে শুনেছ?

জবাবে সা‘ঈদ ইবন মারজানা র. বললেন: হ্যাঁ।

অতঃপর আলী তাঁর এক গোলামকে লক্ষ্য করে বললেন: তুমি ‘মাতরাফ’ (তাঁর গোলামদের একজন) –কে ডাক, অতঃপর সে যখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন তিনি বললেন: যাও, তুমি আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত।

আর দাস-দাসী মুক্তি দাতাদের মর্যাদা প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত এসব দৃষ্টিভঙ্গির ফলে মুসলিমগণ দাস-দাসীদের মুক্ত করার বিষয়টিকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে তাদের মনের আনন্দ দানকারী এবং চোখের প্রশান্তি দাতা হিসেবে গ্রহণ করেছে, যাতে তারা ঐ দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর জান্নাতের অধিকারী হতে পারে, যেই দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কোনো উপকারে আসবে না।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে অতি উত্তম নমুনা বা আদর্শ পেশ করেছেন, যেহেতু তিনি তাঁর মালিকানায় থাকা সকল গোলামকে মুক্ত করে দিয়েছেন। আর এই ক্ষেত্রে তাঁর অনুসরণ করছেন তাঁর সাহাবীগণ ঈমান ও বিশ্বাসের সাথে এবং স্বপ্রণোদিত হয়ে।

আর আবূ বকর সিদ্দিক রা. মক্কার কুরাইশ নেতাদের নিকট থেকে গোলামদের ক্রয় করার জন্য অনেক সম্পদ খরচ করেছেন, যাতে তিনি তাদেরকে মুক্ত করে দিতে পারেন এবং তাদেরকে দিতে পারেন পূর্ণ স্বাধীনতা।

আর ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একটি বিরাট সংখ্যক দাস-দাসীকে মুক্ত করা হয়েছে ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে আল্লাহর নিকট থেকে পুরস্কার লাভের আশায় স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে মুক্ত করার পদ্ধতিতে।

আর ইসলামের আগে ও পরে এই বিরাট সংখ্যক দাস-দাসীকে মুক্ত করার কোনো দৃষ্টান্ত মানবতার ইতিহাসে নেই, যেমনিভাবে তাদের মুক্তি দানের কার্যক্রম ছিল নিরেট ও নির্ভেজাল মানবতার প্রতীক, যা মানুষের হৃদয় ও ঈমান থেকে বেরিয়ে এসেছে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও তাঁর জান্নাত ব্যতীত অন্য কিছু অর্জনের উদ্দেশ্যে নয় ! !

* * *

০ কাফ্ফারা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দান:

আর দাস-দাসী মুক্ত করার ক্ষেত্রে শরীয়ত সম্মত উপায়সমূহের মধ্য থেকে এটা একটা অন্যতম মহান উপায়; আল-কুরআনুল কারীম কাফ্ফারা স্বরূপ দাস-দাসী মুক্ত করার জন্য অনেক বিষয়ে বক্তব্য পেশ করেছে, শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ড ও প্রকাশ্য এসব গুনাহের মধ্য থেকে কোনো একটিতে মুসলিম ব্যক্তি জড়িয়ে গেলে (তার উপর এই ধরনের কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে)।

আর অধিকাংশ অপরাধ ও শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ড এমন, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন ও বাস্তব জীবনকে পরিবেষ্টন করে আছে!! ...

সুতরাং যখন দাস-দাসী মুক্ত করে দেওয়া হবে এসব অপরাধ ক্ষমার অন্যতম উপায়, তখন এর অর্থ হবে- ইসলামী সমাজে দাস-দাসীদের একটা বিরাট সংখ্যার মুক্তির ব্যাপারে ইসলাম দ্রুত কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে !! ...

আপনাদের সামনে আল-কুরআনুল কারীমের বক্তব্যের আলোকে কাফ্ফারার মাধ্যমে দাস-দাসী আযাদ করার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় তুলে ধরা হল:

- ভুলবশত হত্যার কাফ্ফারা নির্ধারণ করা হয়েছে একজন দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“আর কেউ কোনো মুমিনকে ভুলবশত হত্যা করলে এক মুমিন দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা কর্তব্য ।”

- যদি এমন সম্প্রদায়ের কাউকে হত্যা করা হয়, যাদের সাথে আমরা পরস্পর অংগীকারাবদ্ধ, তবে সে ক্ষেত্রে হত্যার কাফ্ফারা নির্ধারণ করা হয়েছে একজন দাস মুক্ত করা; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“আর যদি সে এমন সম্প্রদায়ভুক্ত হয় যাদের সাথে তোমরা অংগীকারাবদ্ধ, তবে তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা এবং সাথে মুমিন দাস মুক্ত করা কর্তব্য।” (সূরা আন-নিসা: ৯২)

- ইচ্ছাকৃত শপথ ভঙ্গের কাফ্ফারা নির্ধারণ করা হয়েছে একজন দাস মুক্ত করা; আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

“... কিন্তু যেসব শপথ তোমরা ইচ্ছে করে কর, সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। তারপর এর কাফ্ফারা দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাস মুক্তি ...।” সূরা আল-মায়িদা: ৮৯

- যিহারের(যিহার হল: স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলা: “তুমি আমার উপর আমার মায়ের পিঠের মত হারাম”। সুতরাং এই শব্দের কারণে তার উপর তার স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে, যেমনিভাবে তার উপর তার মা হারাম।) কাফ্ফারা নির্ধারণ করা হয়েছে একজন দাস মুক্ত করা, যখন সে তার শব্দগুলো উচ্চারণ করবে, অতঃপর সেই কথা থেকে ফিরে আসবে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“আর যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে এবং পরে তাদের উক্তি প্রত্যাহার করে, তবে একে অন্যকে স্পর্শ করার আগে একটি দাস মুক্ত করতে হবে, ...।” (সূরা আল-মুজাদালা: ৩)

- রমযান মাসে ইচ্ছাকৃত সাওম ভঙ্গের কাফ্ফারা নির্ধারণ করা হয়েছে দাস মুক্ত করা, আর এটা সাব্যস্ত হয়েছে সহীহ সুন্নাহর মধ্যে।

এ ছাড়াও আল-কুরআনুল কারীম নির্দেশিত আবশ্যকীয় কাফ্ফারাসমূহ ভিন্ন অন্যান্য ব্যাপারে মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক সম্পাদন করা যে কোনো গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার জন্য মুস্তাহাব হিসেবে দাস-দাসী মুক্ত করার বিষয়টি রয়েছে, এই কাজের জন্য একটি বিরাট সংখ্যক দাস-দাসীকে মুক্ত করা সম্ভব: [আরও সুন্দর হয় ভুলজনিত হত্যার কাফ্ফারার প্রতি আমাদের বিশেষ ইঙ্গিত করলে; কারণ, আমরা আলোচনা করেছি যে, তার (ভুলজনিত হত্যার) কাফ্ফারা হলো নিহত ব্যক্তির পরিবারকে রক্তপণ আদায় করা এবং সাথে একজন দাস মুক্ত করা; আর যে নিহত ব্যক্তি ভুলজনিত কারণে নিহত হয়েছে, সে হলো মানব আত্মা, যাকে কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়াই তার পরিবার-পরিজন হারিয়েছে, যেমনিভাবে হারিয়েছে তার সমাজ।

এই জন্য ইসলাম দুই দিক থেকে তার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছে: তার পরিবারকে রক্তপণ আদায় করার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেওয়া; আর একজন মুমিন দাস মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে সমাজকে ক্ষতিপূরণ দান!? কারণ, দাস মুক্ত করে দেওয়ার মানে যেন ভুলজনিত হত্যার মাধ্যমে যে প্রাণটি চলে গেছে, তার বিনিময় স্বরূপ একটি প্রাণকে বাঁচিয়ে দেওয়া।

আর এর উপর ভিত্তি করে ইসলামের দৃষ্টিতে দাসত্ব হলো মৃত্যু অথবা মৃত্যুর সাথে তুলনীয় একটি বিষয়; তা সত্ত্বেও দাস-দাসীকে বেষ্টন করে আছে প্রতিটি নিরাপত্তা বিষয়ক দায়-দায়িত্ব; আর এই জন্যই ইসলাম দাস-দাসীদেরকে (সত্যিকারের) জীবন দানের জন্য তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ]- (শহীদ সায়্যিদ কুতুব, ‘আনিল ‘আদালত আল-‘ইজতিমা‘য়ীয়্যাহ ফিল ইসলাম ([ইসলামে সামাজিক ন্যায়নীতি]। ।

* * *

০ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি দান:

এটা দাস-দাসীর জন্য মুক্তি পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ, যখন সে নিজেই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মুক্ত হওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হবে এবং সেই অর্থের ব্যাপারে গোলাম ও মনিব ঐক্যমত পোষণ করবে যে, গোলাম কিস্তিতে তা মনিবকে পরিশোধ করে দেবে; অতঃপর যখন সে তা পরিশোধ করবে, তখন সে স্বাধীন হয়ে যাবে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿

“... আর তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের মধ্যে কেউ তার মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি চাইলে, তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হও, যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলে জানতে পার। আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে দান কর।” -(সূরা আন-নূর: ৩৩)

ফকীহগণের দু’টি অভিমত:

গোলাম কর্তৃক মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির আবেদনে সাড়া দেওয়া মনিবের উপর ওয়াজিব (আবশ্যক) হবে কি?

প্রথম অভিমত: গোলাম কর্তৃক মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির আবেদনে সাড়া দেওয়া মনিবের উপর ওয়াজিব নয়,বরং মুস্তাহাব।

দ্বিতীয় অভিমত: মনিবের উপর আবশ্যক হলো গোলাম কর্তৃক তার মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির আবেদন করলে তা গ্রহণ করা এবং তার উপর ওয়াজিব হলো যখন সে উভয়ের ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্ধারিত অর্থ আদায় করে দিবে তখন তাকে মুক্ত করে দেওয়া।

আর কুরতুবী’র বক্তব্য অনুযায়ী যাঁরা এই অভিমতের প্রবক্তা, তাঁরা হলেন: ‘ইকরিমা, ‘আতা, মাসরুক, ‘আমর ইবন দিনার, দাহ্হাক ইবন মুযাহেম এবং আহলে যাওয়াহের মধ্য থেকে একদল আলেম।

আর তাঁরা ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র কর্মকাণ্ডকে যুক্তি হিসেবে পেশ করেছেন; আর তা হলো সিরীন আবূ মুহাম্মদ ইবন সিরীন আনাস ইবন মালেক রা. এর নিকট তার মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির আবেদন করেছিলেন, আর তিনি (আনাস রা.) ছিলেন তার মনিব ; অতঃপর আনাস রা. অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন, ফলে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দোররা উত্তোলন করে তাঁকে সতর্ক করলেন এবং আল্লাহ তা‘আলা’র বাণী তিলাওয়াত করলেন:

“তাহলে তোমরা তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হও, যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলে জানতে পার।” (সূরা আন-নূর: ৩৩)

অতঃপর আনাস রা. চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন; আর ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আনাস রা. এর উপর তাঁর উপর ওয়াজিব না হওয়া কেবল কোনো বৈধ কর্মের ব্যাপারে দোররা উত্তোলন করেন নি।

আর ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টিকে আরও মজবুত করে আয়াতটির শানেনুযূল :

কুরতুবী’র বর্ণনা অনুযায়ী আয়াতটি হুয়াইতিবের ‘সবীহ’ নামক গোলামের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে; সে তার মনিবের নিকট তাকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য লিখিত চুক্তির আবেদন করে, কিন্তু ‘হুয়াইতিব’ সে আবেদন নামঞ্জুর করে; অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এই আয়াতটি নাযিল করেন; তারপর হুয়াইতিব তাকে একশত দিনারের বিনিময়ে মুক্ত করে দেওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন এবং তাকে বিশ দিনার দান করলেন; অতঃপর ‘সবীহ’ তা পরিশোধ করলে তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।

ইসলাম কর্তৃক প্রবর্তিত কতগুলো বিধি-বিধানের মাধ্যমে গোলামের উপর ‘মুকাতাবা’ চুক্তিকে সহজ করে দেওয়া হয়েছে; তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিয়মনীতি হল:

১. ইসলাম যাকাতের মাল থেকে ‘মুকাতিব’ গোলামকে মুক্ত করার সুযোগ করে দিয়েছে; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা সাধারণভাবে বলেছেন:

“সদকা তো শুধু ফকীরদের জন্য ... এবং দাসমুক্তিতে ...।” -( সূরা আত-তাওবা: ৬০)

২. গোলাম যে অর্থ মনিবকে প্রদান করবে, তা বিভিন্ন কিস্তিতে পরিশোধ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে; কেননা, ইমাম বুখারী ও আবূ দাউদ র. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন:

“বারীরা রা. আমার কাছে এসে বলল, আমি আমার মালিক পক্ষের সাথে নয় উকিয়া দেওয়ার শর্তে ‘মুকাতাবা’ নামক দাস-দাসী আযাদ করার লিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি— প্রতি বছর যা থেকে এক উকিয়া করে দেওয়া হবে; সুতরাং আপনি আমাকে (এই ব্যাপারে) সাহায্য করুন।” - [ বুখারী ও আবূ দাউদ ]।

৩. মনিবের উপর কর্তব্য হলো তার গোলামের মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি বাস্তবায়নের অর্থের যোগান দানে সহযোগিতা করা, যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের মধ্যে তাকে এই ব্যাপারে নির্দেশ করেছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“... তাহলে তোমরা তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হও, যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলে জানতে পার। আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে দান কর।”-(সূরা আন-নূর: ৩৩)

সহযোগিতার দু’টি পর্যায়:

- হয় সে (মনিব) তাকে তার হাতে যা আছে, তা থেকে কিছু প্রদান করবে।

- নতুবা সে চুক্তি মোতাবেক গোলাম কর্তৃক প্রদেয় অর্থ থেকে অংশবিশেষ ছাড় দিয়ে দেবে।

আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু চুক্তি মোতাবেক অর্থের এক-চতুর্থাংশ ছাড় দেওয়াকে উত্তম মনে করেছেন; আর আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার এক-তৃতীয়াংশ ছাড় দেওয়াকে উত্তম মনে করেছেন; আর এই ধরনের সহযোগিতাকে কেউ কেউ ওয়াজিব মনে করেন।

ইমাম শাফে‘য়ী র. বলেন: সহযোগিতার জন্য মনিবকে বাধ্য করা হবে; আর মনিব যদি মারা যায় এবং সে তার ‘মুকাতিব’ গোলামকে অর্থিক সহযোগিতা না করে থাকে, তাহলে বিচারক তার ওয়ারিসদেরকে তাকে সহযোগিতার জন্য নির্দেশ প্রদান করবে।

৪. যখন গোলাম চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত অর্থ তার মনিবকে পরিশোধ করে দিবে, তখন সে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্ত হয়ে যাবে এবং মনিব কর্তৃক আযাদ বা মুক্ত করার অর্থবোধক কোনো শব্দ উচ্চারণের প্রয়োজন হবে না।

৫. কুরতুবী র. তাঁর তাফসীরের মধ্যে পূর্ববর্তী কোনো কোনো আলেমের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন: যখন গোলামের মুক্তির জন্য তার ও মনিবের মধ্যকার চুক্তি সম্পাদনের কাজ সম্পন্ন হবে, তখন এই চুক্তির কারণে সে মুক্ত হয়ে যাবে এবং সে আর কখনও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে না; আর এই অবস্থায় সে তার মনিবের নিকট আর্থিকভাবে ঋণী হবে, যেই পরিমাণ অর্থের ব্যাপারে তাদের উভয়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।

এসব বিধিবিধানকে ইসলাম ‘মুকাতিব’ গোলামের জন্য তার মুক্তির ব্যাপারে অপরাপর শরীয়তসম্মত উপায় হিসেবে প্রণয়ন করেছে; বরং এগুলো মুক্তির দরজা উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির জন্য বড় ধরনের উপায়সমূহের অন্তর্ভুক্ত, দাস-দাসীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তার মনের ভিতরে মুক্তির আগ্রহ অনুভব করে; আর সে তার মনিব কর্তৃক অদূর ভবিষ্যতে স্বেচ্ছায় তাকে মুক্ত করার সুযোগ দিবে কি দিবে না, সেই অপেক্ষা করবে না; কারণ, গোলাম যখন মনিবের নিকট তাকে মুক্তি দানের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার জন্য আবেদন করবে, তখন মনিব কর্তৃক সেই চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া আবশ্যক হবে।

* * *

বিষয়: বিবিধ

১৫১৭ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

251100
০৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:৫৫
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : মেহনতি লেখা। ভালো লাগলো ধন্যবাদ
০৫ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:৩৫
195349
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ধন্যবাদ
251120
০৫ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১১:১০
আবুনোভা লিখেছেন :
০৫ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:৩৫
195350
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ধন্যবাদHappy Happy
251241
০৫ আগস্ট ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৭
আফরা লিখেছেন : এইটা কি শেষ পর্ব নাকি ?
০৫ আগস্ট ২০১৪ রাত ১১:০২
195498
দ্য স্লেভ লিখেছেন : মনে হচ্ছে তাই। কিন্তু দেখী আরও কিছু রসদ জোগাড় হয় কিনা। আমি অবসরের অনেকটাই এর পেছনে ব্যয় করেছি। এবার একটু ঘুরব Happy
আজ যাচ্ছি অলামেট রিভার সাইট....হাটব আর হাটব...নদীতে নেমেও যেতে পারি...Happy
০৯ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:২৫
196612
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ২য় পর্ব আপলোড হয়েছে,পড়তে পারেন
251307
০৬ আগস্ট ২০১৪ রাত ১২:২৭
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : ধন্যবাদ অনেক সময় ব্যায় করেছেন! লেখটিতে জানার অনেক কিছু আছে। যা জীবনের পথে কাজে আসবে!
251355
০৬ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৫:৫৯
শেখের পোলা লিখেছেন : মূলতঃ ইসলাম শুরু থেকেই মানুষের ভেদাভেদ দুর কার পক্ষে৷ দাস মুক্তি তারই একটি দক্ষেপ৷ বিভন্ন পন্থায় তার উৎসাহই প্রদান করা হয়েছে৷ ধন্যবাদ৷
০৬ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:০৮
195550
দ্য স্লেভ লিখেছেন : সঠিকGood Luck Good Luck Good Luck Good Luck
252497
০৯ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:২৪
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ওহ! এখানে তো পয়েন্ট করে দেয়াই ছিলো! পরেরটা আগে পড়ার কারণে বোঝা যায় নি!
০৯ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:২২
196607
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ধন্যবাদ Happy
252576
০৯ আগস্ট ২০১৪ বিকাল ০৫:০৩
আহ জীবন লিখেছেন : অনেক বিষয় জানলাম।
০৯ আগস্ট ২০১৪ রাত ১১:০১
196846
দ্য স্লেভ লিখেছেন : Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck পড়ার জন্যে ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File