যুদ্ধবন্দীর পরিনাম
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ৩০ জুলাই, ২০১৪, ১১:৩১:৪৩ রাত
বানু কুরায়জা
খন্দকের যুদ্ধ ছিল মুসলিমদের জন্যে সবথেকে নাজুক যুদ্ধের একটি। এটি সংঘটিত হয়েছিল ৫ম হিজরীতে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদীনার সকল ইহুদীদের সাথে এবং অন্যান্য গোত্রের সাথে মুসলিমদের নিরাপত্তা চুক্তি ছিল। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্রই ইহুদীরা এই সন্ধিপত্র ছিঁড়ে ফেলে শত্রুদলে যোগদান করে। কুরায়যা গোত্রের এই বিদ্রোহের খবর পাওয়া মাত্র আওস ও খাযরায গোত্রের প্রধান সাদ বিন উবাদা (রাঃ) ও সাদ বিন মুয়ায (রাঃ) সহ আর কিছু সাহাবীকে মুহাম্মাদ (সাঃ) খন্দকের প্রান্ত থেকে কুরায়যা পল্লীতে পাঠান। তাঁরা কুরায়যা পল্লীতে উপস্থিত হয়ে আগের পৌণঃপুনিক চুক্তি ভাঙ্গার কথা তুলে ধরেন ও তাদেরকে এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু আহযাবে মুসলিমদের পরাজয় সুনিশ্চিত ও খায়বার থেকেও ইহুদী দল মদিনা আক্রমণে আসছে এই দুই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তারা উল্টো মুসলিমদের গালাগালি করা শুরু করে দেয়। তাদের দলপতি কাব বিন আসাদ বলে ওঠে, “মোহাম্মদ কে? আমরা তাকে চিনি না। আমরা কোনো সন্ধিপত্রের ধার ধারি না। তোমরা চলে যাও।”
খন্দকের যুদ্ধের পর যখন রসূল(সাঃ) অস্ত্র ত্যাগ করেছেন তখন ফেরেশতা জিবরাঈল এসে বলেন-“হে আল্লাহর রাসূল(সাঃ) আপনি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন ! অথচ ফেরেশতারা অস্ত্র ত্যাগ করেনি। হে মুহাম্মদ ! আল্লাহ আপনাকে বানূ কুরায়যার বিরুদ্ধে অভিযানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।......”-(ইবনে হিশাম)
রসূল(সাঃ) তাদের বিশ্বাসঘাতকতা,চুক্তি ভঙ্গ করা,শত্রুকে প্রকাশ্য ও গোপনে সাহায্য করা এবং সরাসরি মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধের অবরোধ করেন। এটি পচিশ দিন ধরে চলে। তাদের জন্যে পরাজয় নিশ্চিত হয়ে উঠল। তখন ইহুদী সর্দার কাব ইবনে আসাদ ইহুদীদের ডেকে বলল-হে ইহুদীরা তোমরা দেখতেই পাচ্ছ কি বিপদ এসেছে। এখন আমার পক্ষ থেকে তিনটি প্রস্তাব আছে তোমরা ভেবে দেখতে পার। ১. “এসো আমরা মুহাম্মদকে নবী হিসেবে মেনে নেই। আল্লাহর কসম তিনি যে সত্য নবী তা তোমরা অবশ্যই অবগত আছ। তাওরাতেও তার স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদেরকে নিরাপদ করতে পারি।” তারা বলল-আমরা কখনও তাওরাতের কতৃত্ব অস্বীকার করব না এবং তার বিকল্পও কখনও গ্রহন করব না। তখন তিনি বললেন, ২.তাহলে এসো আমরা আমাদের নারী-শিশুদের হত্যা করি এবং সর্বশক্তি নিয়ে মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। এতে আমাদের কোনো পিছুটান থাকবে না। তারা বলল- প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলা কি সম্ভব ? তারা না থাকলে সুখ স্বাচ্ছন্দের কি মানে আছে ? কাব ৩নং প্রস্তাবে বলল-তাহলে আরেক কাজ কর। আজ শনিবারের রাত। মুসলিমরা নিশ্চিত থাকবে যে,আজ আমরা অন্তত আক্রমন করব না। এসো আজ রাতেই তাদের উপর অতর্কিতে হামলা করি ! ইহুদীরা বলল-আমরা শনিবারের অমর্যাদা করতে পারব না। তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে আমাদের কিছু লোক পূর্বে এদিনের অবমাননা করার পরিনতি কি হয়েছিল।- (ইবনে হিশাম)
ইহুদীরা সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে রসূল(সাঃ)এর কাছে দূত পাঠিয়ে আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে(রাঃ) তাদের কাছে পাঠাতে বলল,যাতে তার সাথে আলোচনা করতে পারে। ইহুদীরা আবু লুবাবার কাছে জিজ্ঞেস করে-তোমার কি মনে হয়,আমাদেরকে মুহাম্মদের কথা মেনে নেওয়া উচিৎ ? তিনি বললেন-“হ্যা সেটা মেনে নেওয়াই উচিৎ। এরপর আবু লুবাবা সম্পুর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করে একটি বাড়তি কথা বলল,আর তা হল, যদি তোমরা রসূলের(সাঃ) কথা মেনে নাও তাহলে হত্যা(হাতের ইশারায় বুঝালেন)করা ছাড়া আর কিছু করবেন না।” পরক্ষনেই আবু লুবাবা এমন একটি মন্তব্য করার(যা ছিল এমন একটি সিদ্ধান্ত যে সম্পর্কে তার জানাই নেই)জন্য প্রচন্ড অনুতপ্ত হলেন এবং তিনি পালিয়ে গেলেন। আর ঘোষনা করলেন,যতক্ষন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করবেন, ততক্ষন তিনি নিজেকে দড়ি দিয়ে একটি খুটির সাথে বেধে রাখবেন।(তিনি এটিই করেছিলেন এবং ইবনে হিশামের বর্ণনায় এসেছে ৬দিন বাধা থাকার পর আল্লাহ আয়াত অবতীর্ণ করে তাকে ক্ষমার কথা জানান।)
যাইহোক, পরদিন সকালে ইহুদীরা রসূল(সাঃ)এর কাছে এসে জানালো তারা আল্লাহর রসূলের ফয়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত। এ সময় আউশ গোত্রের অন্যান্য নেতারা রসূল(সাঃ)এর কাছে এসে ইহুদীদের স্বপক্ষে সুপারিশ করল। বলল-তারা আমাদের মিত্র এবং খাজরাজের বিপক্ষে সহায়তা করে থাকে। আপনি বানূ কায়নুকার ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন,তাদের ক্ষেত্রে একই সিদ্ধান্ত গ্রহন করার অনুরোধ করছি। রসূল(সাঃ) বললেন-হে আউশ, আমি যদি এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তোমাদেরই একজনের উপর ছেড়ে দেই তাহলে তাতে তোমরা রাজি আছ ? তারা সমস্বরে বলল-হ্যা আমরা রাজি। তখন রসূল(সাঃ) হযরত সাদ ইবনে মু’আয(রাঃ)কে বিচারক মনোনিত করলেন। সাদ তখন সেখানে ছিলেন না। তিনি ছিলেন মসজিদে নববীর একটি তাবুতে। তার মিত্র গোত্রের লোকেরা তাকে সেখান থেকে গাধার পিঠে করে নিয়ে আসল এবং তার গোত্রের লোকেরা বলল-“হে সাদ ! তোমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ কর ! তোমাকে সালিশ নিয়োগ করেছে এ কারনে; যাতে তুমি তাদের সাথে সদয় আচরণ কর। -(ইবনে হিশাম)
সাদ বিন মু’আয বললেন-“আমি যে ফয়সালা দিব, সেটাই মেনে নিবে, আল্লাহর নামে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ ? ” ইহুদীরা সমস্বরে বলল-“আল্লাহর নামে ওয়াদা করছি মেনে নিব।” সাদ রসূল(সাঃ) যে পাশে অবস্থান করছিলেন সেখানে থাকা অন্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের দিকে তাকিয়ে সম্মানের সাথে বললেন,আপনারাও কি মেনে নিবেন ? যদিও রসূল(সাঃ)কে তিনি ইঙ্গিত করেননি তবুও রসূল(সাঃ)বললেন, “হ্যা আমরা মেনে নিব।” সাদ ঘোষনা করলেন-“বানূ কুরায়যার সকল প্রাপ্তবয়ষ্ক লোককে(কোনো কোনো বর্ণনায় যোদ্ধাদেরকে) হত্যা করা হোক এবং নারী-শিশুদেরকে বন্দী করা হোক।”-(ইবনে হিশাম)
রসূল(সাঃ) বললেন-“তোমার সিদ্ধান্ত আল্লাহরই সিদ্ধান্ত”। -ইবনে হিশাম
মূলত আরবের সক্ষম পুরুষ বা বালেগ পুরুষ বলতে যোদ্ধাকেই বুঝায়। প্রাচীন আরবে প্রত্যেক সক্ষম পুরুষের প্রধান উপাধী ছিল সে একজন যোদ্ধা,এরপর তার পেশাগত পরিচয়। ইবনে হিশামের বর্ণনায় বানূ কুরায়যার ৬০০-৭০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ৩০০,আবার অনেকে বলেছেন ৪০০জন। সর্বোচ্চ সংখ্যার কথা যারা বলেছেন,তাদের সংখ্যা ৯০০জন।
এবারে আমরা তাওরাতের একটি আয়াত পেশ করবঃ
“যখন আক্রমনের জন্যে কোনো শহরে যাবে তখন সর্বপ্রথম তাদেরকে কিছু শর্ত দিবে, যদি তারা শর্তগুলো মেনে নেয় এবং শহরের দরজা খুলে দেয়,তাহলে ভেতরের সকল মানুষ বাধনমুক্ত দাসে পরিনত হবে এবং তারা তোমাকে শ্রম দেবে। কিন্তু যদি তারা শর্ত প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়, তাহলে তোমাকে অবশ্যই শহরে আক্রমন করতে হবে। যখন তোমার প্রভূ শহরের মালিকানা তোমার হাতে তুলে দিবেন, তখন শহরের সকল পুরুষকে হত্যা করবে। কিন্তু তুমি তোমাদের জন্যে সকল নারী-শিশু,গবাদী পশু,অন্যান্য সকল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ রাখতে পার। তুমি শত্রুর পরিত্যক্ত সম্পদ উপভোগ করতে পার,যা তোমার প্রভূ তোমাকে দিয়েছেন।-(তাওরাত, দ্বিতীয় বিবরণ-২০:১০-১৪)
মুসলিম শরীফের ৪৩৬৪ নং হাদীস অনুযায়ী বানূ কুরায়যা দুইবার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এবং তারা মদীনা রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে মুসলিমদেরকে স্বমূলে ধ্বংস করার জন্যে কি আচরন করেছে,তার কিছুটা আমরা অলোচনা করেছি। আর তাদেরকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে,তা তাওরাতের বিধান অনুযায়ী সিদ্ধ। তবে এটা নিয়ে ইহুদীরা উচ্চবাচ্য করেনা। অবাক করার মত বিষয় হল,এটা নিয়ে আওয়াজ করে কম্যুনিস্টরা, যারা ধর্মকেই বিশ্বাস করেনা। আমি নিশ্চিত তাওরাতের এই আয়াত তিনটি তাদের জানা নেই,অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে ।
বানু কুরাইযার বর্ণনা আছে সুরা আহযাবের ২৬ নং আয়াতে,
“ কিতাবীদের মধ্যে যারা কাফেরদের পৃষ্টপোষকতা করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দূর্গ থেকে নামিয়ে দিলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি নিক্ষেপ করলেন। ফলে তোমরা একদলকে হত্যা করছ এবং একদলকে বন্দী করছ।”
আমরা প্রত্যেকটি যুদ্ধের পরিনতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি শুধু বানূ কুরায়যার যুদ্ধে যুদ্ধবন্দী নারীদেরকে দাসী হিসেবে গ্রহন করা হয়েছিল। তবে তাদের সাথে শত্রুতামূলক আচরণ করা হয়নি। মূতা বিয়ের মাধ্যমে তাদের সাথে স্ত্রীদের মত আচরণ করা হয়েছিল। আর স্ত্রীর মতই তারা সম্মান মর্যাদা প্রাপ্ত হয়েছিল।
আর এটি ছিল একটি অপশন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এটি যুদ্ধবন্দীদের অবধারিত পরিনতি নয়। সে সময়ে গোটা বিশ্বে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসীতে পরিনত করার বিধান প্রচলিত ছিল। তাই মুসলিমরা একতরফা সেটা বন্ধ করলে প্রতিপক্ষরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে আরও যুদ্ধে উৎসাহী হত। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিমরাই প্রতিপক্ষকে ছাড় দিয়েছে,ইতিহাস সাক্ষী। প্রতিপক্ষ যদি মুসলিমদেরকে আটক করে দাস-দাসী না বানায়,তাহলে মুসলিমরা এই চুক্তিতে সদা সম্মত এবং তারাও অনুরূপ আচরন করবে,এমনটাই বিধান। আর এই কঠোরতা শুধুমাত্র যুদ্ধের মত একটি চরম কঠোর বিষয়ের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। আর আমরা রসূলের(সাঃ) সময়ে মাত্র একবার এমন ঘটনা ঘটতে দেখী। ওসমানীয় খিলাফতের খলীফা দ্বিতীয় মুহাম্মদ বা মুহাম্মদ আল ফাতেহ যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসী বানানো যাবেনা মর্মে সন্ধী করেছিলেন এবং মুসলিমরাই এটি মেনে চলেছে,যখন অন্যরা যুদ্ধের ময়দান ও পরে আটককৃতদের উপর অমানুষিক নির্যাতন পরিচালনা করেছে। মুসলিমরাই চরম শত্রুকেও ক্ষমা করেছে,যুদ্ধবন্দীদেরকে নি:শর্ত মুক্তিও দিয়েছে।
শেষ কথা হলঃ- আল্লাহ তায়ালা বলেন- “ আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ”-(সূরা আশ-শুয়ারা-৪০)।
বিষয়: বিবিধ
১৫৭০ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
this is the right law....
ভালো লাগলো। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
জাজাকাল্লাহ খায়ের।
আল্লাহ এদেরকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দিন , দুনিয়াতে এবং আখেরাতেও - আমিন ।
ভালই লাগছে আপনার এই পোস্ট সমূহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন