ইসলামে দাসপ্রথা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২০ জুলাই, ২০১৪, ১১:১৪:২৪ রাত
বি:দ্র: এই সিরিজের প্রত্যেকটি পর্ব না পড়লে বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং অহেতুক জটিল প্রশ্ন তৈরী হতে পারে। এই লেখাটি এখনও সম্পন্ন হয়নি। যতটুকুর কাজ হয়েছে,রমজান থাকতে থাকতে শেয়ার করছি। আশাকরি তাড়াতাড়িই আপনাদের সামনে সত্য উপস্থাথাপন করতে পারব এবং ইসলাম বিরোধীদের বিরোধীতার জবাব দিতে পারব ইনশাআল্লাহ। সাথে থাকুন।
দাস প্রথা নিয়ে ব্যপক কথা শোনা যায়,কারন এটি মানব ইতহাসের এমন এক কলঙ্কময় অধ্যায় যা ভোলা সহজ নয়। এর উৎপত্তি ঠিক কত আগে হয়েছিল,তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না,তবে এটি বহু হাজার বছরের পুরোনো একটি প্রথা। এই প্রথায় গোটা বিশ্ব পরিচিত,অভ্যস্ত ছিল। কিছু সংখ্যক মানুষ তার নিজের শক্তিমত্তার অহংকারে এবং সুবিধার প্রয়োজনে বিশাল সংখ্যক মানুষের উপর কর্তৃত্ব করেছে,আর মানুষের সে আকাঙ্খা পূরণ করতে একটি শ্রেণীকে তৈরী করা প্রয়োজন হয়েছে,এবং তারা হল দাস। এটি হল মানুষকে মানুষের গোলামীতে নিবদ্ধ করা।
আমরা যদি প্রাচীন ইতহাস ঘাটি তবে দাসদের করুন কাহিনী দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাব। কারন তাদের উপর কর্তৃত্ব করতে করতে এবং পদদলিত করতে করতে এক সময় তাদেরকে মানুষ মনে করা হতনা। এক শ্রেণীর জীব হিসেবে আখ্যায়িত করে সুবিধার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত এবং জীবজন্তুর মত আচরণ করা হত। তাদের কোনো অধিকার ছিল না। রোম,পারশ্য ,ভারতবর্ষ,রাশিয়া,চীন,আফ্রিকা সকল স্থানেই দাসবৃত্তি সমাজ-রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ছিল। এমনকি আজকের গণতন্ত্রের আদী পিতা এরিস্টটলের শিক্ষক প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্রাঙ্কন করেছেন,সেখানে তিনি একটি রাষ্ট্রে ৩ টি শ্রেণীর উল্লেখ করেছেন। তারা হল শাসক শ্রেণী,সৈনিক শ্রেণী এবং দাস শ্রেণী। দাসদের কাজ বাকি দুটি শ্রেণীর নি:শর্ত সেবা করা এবং তাদের নারীদের বা দাসীর কাজ হল অন্য শ্রেণীর মনোরঞ্জন করা। সকল সৈনিকের স্ত্রী হিসেবে তারা পরিগনিত হবে এবং এভাবে যেসব সন্তান জন্ম নিবে তা হবে রাষ্ট্রের সন্তান,কিন্তু রাষ্ট্র কোনো বিকলাঙ্গ সন্ত্রান গ্রহন করবে না। এরূপ বিকলাঙ্গ সন্তানদেরকে দূর দ্বীপে রেখে হত্যা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রোমে দাসদের সাথে যে আচরণ করা হত ,তা নিয়ে নানান সিনেমা পর্যন্ত তৈরী করা হয়েছে। শাসকগণ অথবা মনিবগণ সামান্য কারনেই দাস-দাসীদের উপর অমানবিক নির্যাতন করত। তাদেরকে শেকলে বেধে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ করা হত এবং চাহিদার তুলতায় অপ্রতুল খাবার,খাবারের উচ্ছিষ্ট প্রদান করা হত। পশুর সাথে ঘুমাতে দেওয়া হত। সামান্য কারনে হত্যা করা হত এবং দাস-দাসীদের হত্যাকান্ডকে কোনো অপরাধ হিসেবে ধরা হত না। নিছক মজা করার উদ্দেশ্যেও তাদরকে হত্যা করা হত। এমনকি প্রাচীন অলিম্পিক গেমসেও দাসদের আমৃত্যু লড়াই নামক খেলা অন্তর্ভূক্ত ছিল। দাসদের সাথে পশুর লড়াই চালিয়ে আনন্দ উপভোগ করা হত। বিভিন্ন উপলক্ষে দাসদের মধ্যে লড়াই চালানো হত এবং তারা আমৃত্যু লড়াই করে মনিবদেরকে আনন্দ প্রদান করত। প্রাচীন সমাজ গবেষকরাও দাসেদের সাথে সুআচনের পক্ষপাতি ছিলনা। তারা সুপারিশ করত,দাসেদেরকে যেন পেট ভরে খেতে না দেওয়া হয়। মালিকের উচ্ছিষ্ট খেয়ে তারা জীবন পার করবে। আর রাষ্ট্রীয় দাসদেরকে প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধের সময় শেকল পরিহিত অবস্থায় যুদ্ধের ময়দানে হাজির করা হত, যাতে তারা ভয়ে পালিয়ে না যায়। সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাথে নির্মম ব্যবহার করাই ছিল নিয়ম। তাদের জন্যে কোনো বিচার ব্যবস্থা ছিলনা। তাদের উপর অত্যাচার করলে কোথাও কৈফিয়ৎ দিতে হতনা।
শুধু রোম,পারস্য সা¤্রাজ্যেই নয়,পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থানে দাসদের কাহিনী ছিল করুন। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম দাস-দাসী ছিল,কিন্তু তাদের সকলের নিয়তি ছিল সমান। দাস-দাসীহীন অবস্থা সমাজ-রাষ্ট্র কল্পনাই করতে পারত না। ইসলামপূর্ব আরবের অবস্থাকে জাহেলিয়ার যুগ বা অজ্ঞানতার অন্ধকারের যুগ বলা হয়। সেখানে দাসদের সাথে অত্যন্ত বর্বর আচরণ করা হত। তাদেরকে হত্যা করলে শাস্তির বিধান ছিলনা। কখনও কখনও খেলার ছলে ঘোড়ার পায়ের সাথে তাদেরকে বেধে ঘোড়া ছুটিয়ে হত্যা করে মজা উপভোগ করা হত। তাদের সাথে কোথাও ভাল আচরণ করা হত না এমন নয়, কিন্তু পুরো বিষয়টি নির্ভর করত মালিকের একান্ত ইচ্ছার উপর।
শুধু প্রাচীন কালেই নয় আধুনিক কালেও দাসপ্রথা ব্যপকভাবে প্রচলিত ছিল। যুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর লোকেদেরকে দাস-দাসী হিসেবে ব্যবহার করা এবং তাদের পুরো জনতা বা পুরো সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন করা হাজার হাজার বছর ধরে গোটা বিশ্ব ব্যপী প্রচলিত ছিল। কোথাও কোথাও এসব দাস-দাসীদের উপর নির্মমতা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। আরব গোত্রগুলো যুদ্ধে জয় লাভের পর প্রতিপক্ষ নারী-শিশুদেরকে কখনও কখনও নির্দয়ভাবে হত্যা করত। সন্তান সম্ভবা মায়র পেট চিরে বাচ্চা বের করে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষন ও নির্মমতা ছিল পরাজিতদের নিয়তি।
এমনকি দাস প্রথার বিলুপ্তর পরও তা স্বগৌরবে চলেছে এবং এখনও তা ভিন্নভাবে প্রচলিত। বেশী দিনের কথা নয়, ১৯৩৭ সালের ২য় চায়না জাপান যুদ্ধে জাপানী সৈন্যরা চীনের নানজিং শহর, যেটাকে বলা হত দক্ষিন চীনের রাজধানী এই শহরটা জয় করে। তারপর জাপানী সৈন্যরা নানজিং শহরের সব মেয়েদের কে অপহরন করে তাদের যৌণদাসী বানায়। এই মেয়েগুলিকে জাপানী সৈন্যরা কমফোর্ট হার্ল নামে ব্যবহার করে।
১ম বিশ্বযুদ্ধ ও ২য় বিশ্বযুদ্ধেরসময় অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি উভয় গ্রুপই তার শত্রুদেশ সমূহ জয় করে সেই পরাজিত দেশের অসহায় মেয়েদের কে নিয়ে বিভিন্ন যৌণ ক্যাম্প করত। সেই সব ক্যাম্পে মেয়েদের কে কোন পোশাক ছাড়া রাখা হত। সৈন্যরা যুদ্ধ শেষে তারপর সেই সব ক্যাম্পে এসে গণহারে মেয়েদের কে ধর্ষন করত। শত্রু সৈন্যদের ধর্ষনের সময় সেই অসহায় মেয়েরা মারাও যেত।
এই যুদ্ধবন্দী নারীদের সাথে বিজিত দেশের সৈন্যরা কি রকম আচরন করত টা যদি আমরা উইকিপিডিয়া থেকে দেখি তাইলে সেখানে বলা হয়েছে-“ইয়াসুজী কানেকো নামক জাপানিজ সৈনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে- মেয়েরা কান্নাকাটি করত কিন্তু তা আমাদের কাছে ধর্তব্য ছিল না যে তারা বাঁচবে নাকি মারা যাবে। আমরা কোন বিতৃষ্ণা ছাড়াই তাদের কে ধর্ষন করে যেতাম। একটা যুদ্ধবন্দী নারী দিনে ৫০/১০০ জনের মত সৈন্যের সাথে মিলিত হতে বাধ্য থাকত। যঃঃঢ়://বহ.রিশরঢ়বফরধ.ড়ৎম/রিশর/ঈড়সভড়ৎঃথড়িসবহ
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন চীন আক্রমণ করে তখন জাপানী সৈন্যরা চীনের মেয়েদের কে যৌণদাসী বানিয়েছিল।জাপানী সৈন্যদের গনধর্ষনে অনেক চীনা মেয়ে মারাও গিয়েছিল।
এই মেয়েদেরকেও কমফোর্ট গার্ল নামে অভিহিত করা হত। ছোট ছোট শিশুদেরকেও ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও জাপানী সৈন্যরা তাদের সাথে বিছানায় যেতে বাধ্য করত।
জাপান, জার্মানী, রাশিয়া ও ফ্রান্স এরা ইউরোপ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ করার সময় সেইসব দেশের প্রচুর মেয়েকে যুদ্ধবন্দী বানিয়ে ধর্ষন করত। বিজিত সব দেশই এই সব মেয়েদেরকে দিয়ে পতিতালয় খুলত।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান যখন বার্মা আক্রমণ করে তখন অনেক বার্মীজ শিশুকেও জাপানীয সৈন্যরা যৌন দাসী হিসাবে ব্যবহার করত। প্রায় ২০ লাখের মত নারী ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয়েছিল।
যাইহোক প্রাচীন কালে অধিক দাসদাসী থাকার বিষয়টি মালিকদেরকে সামাজিক মর্যাদা প্রদান করত। তাই এই অহংকার বোধ তাদেরকে অধিক হারে দাসদাসী সংগ্রহে মনোনিবেশে সহায়তা করত। দাস-দাসীদের থেকে তারা সম্ভাব্য সকল প্রকার সেবা গ্রহন করত। তারা ছিল মালিকের হুকুমের গোলাম। ন্যায়-অন্যায় বিষয়টি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হত না। তারা ছিল যে কোনো হুকুম পালনে নিবেদিত এক শ্রেণী। তাদের জীবন চলত মালিকের একান্ত দয়ার উপরে।
যে যে ভাবে দাস তৈরী করা হত, তা হল:
১. যুদ্ধ সমূহের মাধ্যমে: এক গোত্র অন্য গোত্রের সাথে অথবা এক দেশ আরেক দেশের সাথে যুদ্ধ করলে পরাজিত বাহিনীর আটককৃত সৈন্যদেরকে হত্যা করা হত অথবা দাস বানানো হত। তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকেও দাস-দাসী বানানো হত এবং অত্যন্ত নির্মম আচরণ করা হত। যুদ্ধলব্ধ দাস-দাসীদের সাথে সবথেকে অমানবিক আচরণ করা হত, কারন তাদের সাথে শত্রুতা ছিল এবং এ্ই কারনে নির্দয় আচরণ করাকে স্বাভাবিক পরিনতি হিসেবে ধরে নেওয়া হত। যুদ্ধে আটক প্রতিপক্ষের গর্ভবতী নারীর পেট চিরে বাচ্চা বের করে হত্যা করার মত নির্মম ঘটনা আইয়ামে জাহেরীয়ায় অহরহ ঘটেছে।
২. ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দাস : কেউ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাকে দাস বানানোর নিয়ম ছিল সমাজ স্বীকৃত।
৩. চুরী-ডাকাতির শাস্তি স্বরূপ: কেউ চুরী-ডাকাতি বা কোনো সামাজিক অপরাধ করে ধৃত হলেও তাকে শারিরীক শাস্তি প্রদানের পর দাসত্ব বরণ করতে হত।
৪. অপহরন করে দাস বানানো: কোনো স্বাধীন মানুষকে কৌশলে অথবা জোরপূর্বক অপহরন করে দাস হিসেবে বিক্রী করা হত বা নিজেদের দাস হিসেবে গ্রহ করতে পারত। হযরত যায়েদ বিন হারিসা(রা এভাবেই অপহৃত হয়ে দাস হিসেবে বিকৃত হয়েছিলেন।
৫. কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা শাসকের সাথে অসাদ্যবহার করার কারনে জোর পূর্বক দাস-দাসীতে পরিনত করা হত বা করতে পারত।
৬. স্বাভাবিক ক্রয় বিক্রয়ের দাস: দাস-দাসী সমাজ স্বীকৃত পণ্য হওয়ার কারনে বাজারে তাদেরকে কিনতে পাওয়া যেত। বংশ পরষ্পরায় দাসেরা অপরের পণ্যে পরিনত হত। দাসত্ব ছাড়া তারা কখনই স্বাধীনতা কল্পনা করতে পারত না।
দাসত্বের উপরোক্ত ৬টি কারনের মধ্যে ইসলাম প্রথমটি ছাড়া বাকি সব কটি বাতিল করে দিয়েছে এবং চীরতরে নিষিদ্ধ করেছে। যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস হিসেবে গ্রহন করার বিষয়টি ইসলাম অনুমোদন দিয়েছে কিন্তু সেটি উপরোক্ত নির্মমতায় নয়, বরং একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে। আর এর পেছনে রয়েয়ে একটি বিশাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এটি আমরা আলোচনা করব।
পরের পর্ব আসছে :
বিষয়: বিবিধ
১৭০৩ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
উপমহাদেশে দাস প্রথা কেমন ছিল?লিখবেন দয়া করে।
অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন