জেরুজালেম বিজয়
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৫ জুলাই, ২০১৪, ১১:১৯:২৯ রাত
কাফিররা গোয়েন্দাবৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ এমন অনেক পুরুষ,নারীদেরকে তার ও তার সেনাপতিদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেছিল কিন্তু গোয়েন্দাদের অনেকে সালাহ্উদ্দীনের চরিত্র,ন্যায় বিচার,ব্যক্তিত্ব ও মহান উদ্দেশ্যের কারনে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহন করে। কয়েকবার এমন হয়েছে যে প্রতিপক্ষের গোয়েন্দা সুলতানকে হত্যার উদ্দেশ্যে এসে ইসলাম গ্রহন করেছে, তখন সুলতান তাদেরকে দিয়ে উল্টো গোয়েন্দবৃত্তি করে ধোঁকা খাইয়ে চরমভাবে পরাজিত করেছে। নিপিড়ীত,নির্যাতিত,বঞ্চিত মানুষদেরকে যালিমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি সর্বদা চিন্তিত থাকতেন। জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে মজলুম জনতা তার কাছে ফরিয়াদ করে তাদেরকে যালিম শাসকের হাত থেকে রক্ষা করতে বলতেন। এই জনতাকে মুক্ত করতে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি নাওয়া খাওয়াও ভুলে যেতেন।
১১৮৭ সালে হিত্তিনের যুদ্ধে সুলতান ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত করে ফিলিস্থিনের পুরো অংশ উদ্ধার করেন। এ যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছেন খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক লেনপুল ঃ
“খ্রিষ্টান বাহিনীর অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য,যারা জীবিত ছিল তাদের সকলেই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিল। সবাই অবাক বিশ্ময়ে লক্ষ্য করলো যে,এক এক জন মুসলিম সৈন্য ৩০(ত্রিশ)জনের মত খ্রিষ্টান সৈন্যের প্লাটুনকে তাবুর দড়ী দিয়ে বেধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে,যাদেরকে সে বন্দী করেছিল। ক্রুসেডারদের লাশ এমনভাবে স্তুপাকারে পড়ে ছিল যেমনভাবে পাথরের উপর পাথর স্তুপাকারে পড়ে থাকে।” (সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী,পৃষ্ঠা- ১৮৯)
যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিলেন ক্রুসেডারদের সম্রাট ‘গাঈ’। তিনি যখন নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন (পূর্বের আচরণ চিন্তাকরে তার পক্ষে নিজের মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভব ছিলনা)তখন সুলতান তাকে বরফ মিশ্রিত ঠান্ডা পানি পান করান এবং তাকে তিনি ক্ষমা করে দেন।
সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী ১১৮৭ সালে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন বিজয়ীর বেশে। দীর্ঘ ৯০ বছর পর জেরুজলেমের এ মসজিদে মুসলমানরা একসাথে নামাজ পড়ার সুযোগ পেল। সুলতান নূরউদ্দীন জঙ্গী যখন শাসন কক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখনই তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে ছিল বাইতুল মুকাদ্দাসকে শত্র“ মুক্ত করা। আর তাই তিনি আগেই একটি জাঁকজমকপূর্ণ মিনার তৈরী করে রেখেছিলেন যা তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। নূরুদ্দীনের মুত্যুর পর তার এ পবীত্র দায়ীত্ব সালাহউদ্দীন নেন তাই তিনি সুলতান নূরুদ্দীনের শেষ ইচ্ছা পালনার্থে তার তৈরী করা মিনার বাইতুল মুকাদ্দাসে স্থাপন করেন।(হঁৎঁফফরহ লড়হমর ংরষবহ ংধষধযঁফফরহ ধরুঁনরৎ সধসধ)
জেরুজালেম বিজয়ের পর সুলতান ক্রুসেডারদের বিপরীতধর্মী কাজ করলেন। ক্রুসেডাররা মুসলিমদের উপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। ইহুদীদেরকেও রেহাই দেয়নি। কিন্তু সালাহ্উদ্দীন এখানকার সকল খ্রিষ্টানকে ক্ষমা করে দেন নিঃশর্তভাবে। যুদ্ধবন্দীদের অধিকাংশকেই মুক্তি দেন নিঃশর্তভাবে। জেরুজালেম বিজয় করে তিনি বিজাতীয়দের প্রতি যে উদারতা,নমনীয়তা, প্রদর্শন করেছিলেন,ইতিহাসে তা বিরল নয়,তা ঘটেছিল এবং এই ইতিহাস শুধুমাত্র আমাদের রোল মডেলদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছিল।
জেরুজালেম বিজয়ে খ্রিষ্টানরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। রোম,ইংল্যান্ড, ফ্রান্স,সিসিলি,অস্ট্রীয়া,ফ্লান্ডার্রস সহ ইউরোপের সকল এলাকা থেকে সম্মিলিত খিষ্টান বাহিনী সিরিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্রুসেডারদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৭ লক্ষ। অপরদিকে মুসলিমদের সৈন্য সংখ্যা ছিল তাদের থেকে প্রায় দশ গুন কম। আল্লাহ তায়ালা বলেন,“তোমাদের মধ্যে ২০(বিশ)জন ঈমানদার যোদ্ধা থাকলে তারা বিজয়ী হবে ২০০(দুইশত)জনের উপর। তোমাদের মধ্যে ১০০(এক’শ)জন থাকলে তারা বিজয়ী হবে ১০০০(এক হাজার)জনের উপর....”(আল-কুরআন,৮ঃ৬৫)মহান আল্লাহ ধৈর্যশীল,ঈমানদারদের বিজয়ী করলেন। গাজী সালাহউদ্দীন এবং তার বাহিনী সেই ঈমানদারীত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। সুলতান সালাহউদ্দীন একটি বাহিনী নিয়ে কখনও কখনও একই রনাঙ্গনে ৪/৫ টি শক্তিশালী বাহিনীর সাথে লড়াই করেছেন এবং একের পর এক বিজয় অর্জন করেছেন। তার কোন পরামর্শদাতা ছিল না। তিনি একাই জিহাদ এবং প্রশাসনিক কাজ চালাতেন দক্ষতার সাথে । তিনি নিজেই সুলতান,নিজেই নিজের পরামর্শদাতা,সেনাপতি,অপ্রতিদ্বন্দী বীর যোদ্ধা,জনগনের পাহারাদার এবং বিচারক ছিলেন। তাকে দেখলে মনে হতো তিনি একই সাথে অনেক জন।
তার জীবনি লেখক কাজী বাহাউদ্দীন সাদ্দাদ বলেন,‘আমি তার মধ্যে চরম হতাশাজনক পরিস্থিতিতেও ভয়ের কোন লক্ষণ দেখিনি বরং দেখেছি অসম্ভব ধৈর্য,সহনশীলতা,বুদ্ধিমত্তা। একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে কিভাবে অনুকূলে আনতে হয় তা তিনি জানতেন। তিনি এতটাই নির্ভীক ছিলেন যে,খ্রিষ্টাণদের সাথে যুদ্ধের সময় তিনি সামনের সারিতে দাড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত ও হাদিস শ্রবণ করতেন এটা ছিল তার অভ্যাস। যুদ্ধাবস্থায়ও তিনি কুরআন শুনতেন এবং কুরআন,সুন্নাহ থেকে সৈনিকদের উপদেশ দিতেন,যেন তিনি সমজিদে বসে খুৎবা দিচ্ছেন। শাসক হবার পর তার জীবন কেটেছে মূলতঃ যুদ্ধের ময়দানে,তাই যুদ্ধের ময়দানেই তিনি বিনোদন খুঁজতেন। জিহাদই ছিল তার ইবাদত এবং বিনোদন।’
সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তার সৈন্যদেরকে বলতেন-“তোমরা যদি তোমাদের কর্তব্যে নিষ্ঠাবান থাকতে পারো,ইসলামের উপর অটল থাকতে পারো,মুসলিম উম্মাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাও তাহলে বাইরের আক্রমন ও ভেতরের ষঢ়যন্ত্র কোনোটিই এ জাতির এতটুকু ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হবে না।... তোমার দৃষ্টিকে প্রসারিত কর, সীমান্ত ছাড়িয়ে দৃষ্টিকে আরও অনেক দূরে-বহু দূরে নিয়ে যাও। মনে রেখো,ইসলামী খিলাফতের কোনো সীমান্ত নেই। যেদিন তোমরা নিজেদেরকে এবং আল্লাহর মনোনিত দ্বীন ইসলামকে সীমান্তের বেড়ায় আটকে ফেলবে,সেদিন থেকেই তোমরা নিজ কারাগারে বন্দী হয়ে পড়বে আর ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকবে তোমাদের তীরের সীমানা। রোম উপসাগর অতিক্রম করে তোমরা আরও দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর। সমুদ্র তোমাদের পথ রোধ করতে পারবে না......পৃথিবীর দিকি দিকে আমরা অবশ্যই প্রজ্জলিত করব ঈমানের আলোকোজ্জল প্রদীপ।”
অসুস্থতার জন্য তাঁর জীবনে কিছু রোজা কাজা হয়ে গিয়েছিল। শেষ জীবনে তিনি তা আদায় করেন তবে তখনও তিনি সুস্থ ছিলেন না তাই তার ডাক্তার তাকে নিষেধ করলে তিনি বলেন ,“আগামী দিন কি ঘটবে সে সম্পর্কে আমি মোটেও আবগত নই,পরোয়াও করি না।” হজ্জ করার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনও হজ্জ করতে পারেননি। কারণ ভেতরে বাইরে শত্র“ এমনভাবে অবস্থান করছিল যে, তিনি নিশ্চিন্ত না হবার কারনে এক মুহুর্তের জন্যও উম্মাহকে ছেড়ে কোথাও যাবার চিন্তা করতে পারেননি।
৫৮৯ হিজরীর ২৭শে সফর তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু সর্যায় তার পাশে তার এক শুভাকাঙ্খী কুরআন তেলাওয়াত করছিল। তিনি সূরা হাশরের শেষ কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন, হুয়াল্লাহ হুল্লাযি লা ইলাহা ইল্লাহু ,আলিমুল গাইবী ওয়া শাহাদাতিহি ওয়া রহমান হির রহিম ... (“তিঁনিই আল্লাহ,তিঁনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই,দেখা অদেখা সবকিছুই তাঁর জানা,তিঁনি দয়াময়, তিঁনি করুণাময়। তিঁনিই আল্লাহ,তিঁনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই,তিঁনি রাজাধিরাজ,তিঁনি পুত পবিত্র,তিঁনি শান্তি দাতা,তিঁনি বিধায়ক,তিঁনি রক্ষক,তিঁনি পরাক্রমশালী,তিঁনি প্রবল,তিঁনি মহত্বের একক অধিকারী । মানুষ যেসব ব্যাপারে র্শিক করেছে তিঁনি তার থেকে সম্পুর্ণ পবিত্র। তিঁনি আল্লাহ তায়ালা,তিঁনি সৃষ্টিকর্তা,তিঁনি সৃষ্টির উদ্ভাবক,সবকিছুর রুপকার তিঁনি,তাঁর জন্যেই সকল উত্তম ও প্রশংসনীয় নাম। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে,তার সবকিছুই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছে,তিঁনি পরাক্রমশালী ও প্রবল প্রজ্ঞাময়।”আল-কুরআন,৫৯ঃ২২-২৪)। সালাহউদ্দীন প্রচন্ড অসুস্থতায় চোখ বন্ধ করেছিলেন। তিনি এ আয়াতগুলো শুনে চোখ খুললেন এবং বললেন, “ হ্যাঁ, এটিই সত্য ! এটিই সর্বোত্তম !!” এরপর তিনি চোখ বন্ধ করলেন এবং আর কখনও তা খোলেন নি।
কাজী বাহাউদ্দীন সাদ্দাদ তার ডায়েরীতে লিখেছেন,
“আমি আগে যখন শুনতাম যে,মানুষ অন্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে পারে ,তখন ভাবতাম ,এটা একটা কথার কথা। কিন্তু সুলতান সালাহউদ্দীনের মৃত্যুর পর তার জন্য মানুষের ভালবাসা দেখে আমার মনে হয়েছে এটি স্পষ্টত সত্য। আমার মনে হয়েছে যদি বলা হতো যে,কারো জীবনের বিনিময়ে সালাহইদ্দতীনের জীবন রক্ষা পাবে, তাহলে এখানে এমন লোক পাওয়া যেত না, যিনি তার জন্য স্বতস্ফুর্তভাবে জীবন দিতে চাইতেন না।”
সুলতান সালাহউদ্দীনের উপর কখনই জাকাত র্ফজ হয়নি, কারণ তাঁর এমন কোন সম্পদই ছিল না। উপহার সামগ্রী বা হাদিয়া তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিলিয়ে দিতেন। তিনি বলতেন,“আমার কাছে অর্থ সম্পদ এবং ধুলা,মাটির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।” মৃত্যুর পর তার সম্পদ ছিল, ১ দিনার(স্বর্ণ মুদ্রা)৪৭ টি দিরহাম(রৌপ মুদ্রা) মাত্র।
তিনি তার ব্যক্তিগত ক্ষতির জন্য কাউকে কখনও বকা দিয়েছেন এমনটি তার অধীনস্তরা মনে করতে পারেননি। তবে তিনি একবার প্রচন্ড পিপাসার সময় পানি দিতে দেরী হওয়ায় বলেছিলেন,“যদি আমাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা হয় ,তবে সরাসরি তা করে ফেল।”
মুসলিম উম্মার নিরাপত্তার চিন্তায় তিনি কখনই বিশ্রাম নেননি। জীবনকে উৎসর্গ করেছেন মানবতার জন্য,ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য,মিথ্যাকে নিশ্চিহ্ন করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তিনি বিচারের সময় কখনই স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহন করেননি,এমনকি নিজের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলেও তিনি তা গ্রহন করে নিজের দোষ খুঁজে বের করতেন। অভিযোগ যত মামুলিই হোক না কেন তিনি তা গ্রহন করতেন। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো থাকতো সাধারণ মানের, তাই তিনি ক্ষমা চাইতেন এবং বিচার প্রার্থীকে নিজের সম্পদ থেকে অংশ দিয়ে খুশি করতেন।
তিনি ছিলেন ইয়াতিমের পিতা,শিশুদের বন্ধু,তিনি ৫৭ বছর বয়ছে মুসলিম উম্মাহকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরলোক গমন করেন। তিনি এমনভাবে ক্রুসেডারদের ধ্বংস করেছিলেন যে,তার মৃত্যুর পর সূদীর্ঘ সময় ধরে খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে এমন একটি বাহিনী গঠন করতে পারেনি, যা মুসলিদেরকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে। কারণ মুসলিমরা ছিল অপ্রতিরোধ্য। আর তা সম্ভব হয়েছিল অস্ত্রের জোরে নয়,সেটা ছিল ঈমানী শক্তি যা গোটা পৃথিবীতে সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে।
এবার আমরা খুব দ্বিতীয় সালাহ্উদ্দীনের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত হব।
বিষয়: বিবিধ
২৬৯৮ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন