সালাহউদ্দীন আইয়ুবী: জোকী
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৪ জুলাই, ২০১৪, ০৮:৩৮:০৬ সকাল
মুনাফিক নাজী চাটুকারিতার মাধ্যমে সালাহ্উদ্দীনের মন জয় করার চেষ্টা করে। সালাহ্উদ্দীন তার গোপন চক্রান্ত সম্পর্কে সু-স্পষ্ট ধারনা লাভের জন্য বেশ কিছু গোয়েন্দা জাল বিস্তার করেন। নাজী কতৃত আয়োজিত এক সামরিক অনুষ্ঠানে নাজী মন ভোলানো এক গল্প ফেদে ‘জোকী’ নামক এক ইহুদী অনিন্দ সুন্দরী নারীকে সালাহ্উদ্দীন এর সাথে একান্তে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সালাহ্উদ্দনকে টোপ গেলাতে পেরেছে ভেবে সে মনে মনে অনন্দে ডিগবাজি খায়। জোকী সালাহ্উদ্দীন এর তাবু থেকে গভীর রাতে নাজীর তাবুতে ফিরে বর্ণনা করতে থাকে কিভাবে সালাহ্উদ্দীন তার সাথে একটি সুবর্ণ সময় কাটিয়েছে। নাজি আনন্দে পাগল হয়ে যায়।... নাজী জোকীর প্রেমে পড়ে যায় এবং অন্য রক্ষিতার চাইতে তার কদর অনেক বেড়ে যায়।
.............. গভীর রাত,রক্তাক্ত আহত এক নারী সালাহ্উদ্দীন এর তাবুর কাছাকাছি এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। দেহরক্ষীরা কাছে আসতেই বলে ওঠে-‘ সালাহ্উদ্দীন কে বলুন জোকী এসেছে’। ধনুক থেকে তীর যেমন দ্রুততায় ছিটকে যায় সালাহ্উদ্দীন ও আলী বিন সুফিয়ান তেমন দ্রুততায় বের হয়ে আসেন। আলী বলে ওঠেন-‘কে তোমাকে জখম করল জোকী ?’ জোকি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করে না। নির্দেশের সূরে শুধু বলেন-‘অন্যদেরকে এখান থেকে চলে যেতে বলুন !’ অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরনে সে অবসন্ন এবং মৃতপ্রায়। সালাহ্উদ্দীনকে চিকিৎস্যার সুযোগ না দিয়েই এক নাগাড়ে জোকী বলতে থাকেন-
“উত্তর-পূর্ব দিকে ঘোড়া হাকান ! উত্তর-পূর্ব দিকে !! দুজন অশ্বারোহীকে যেতে দেখবেন। উভয়ের পোষাকই বাদামী রঙের। একটি ঘোড়া বাদামী, অন্যটি কালো। তাদেরকে দেখলে ব্যবসায়ী মনে হবে। তারা নাজীর পত্র বহন করছে,যা সম্রাট ফ্রাংকোর কাছে পৌঁছাবে। নাজীর সূদানী সৈন্য বিদ্রোহ করবে। আপনাদের সালতানাত কঠিন বিপদের সম্মুখিন। তাড়া তাড়ি করুন ! অশ্বারোহীদেরকে ধরে ফেলুন !! দেরী করবেন না !!! ” জোকী জ্ঞান হারায় .....।
আলী বিন সুফিয়ানের মুখ থেকে একটি মাত্র শব্দ বের হল-‘আমাকে অনুসরণ কর !’ অ-স্বাভাবিক ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলেছেন গোয়েন্দা কমান্ডার আলী বিন সুফিয়ান। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত অশ্বটি যেন মনিবের মনোভাব বুঝতে পেরেছে, সেও যেন অল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করার শপথ নিয়েছে। সম্রাট ফ্রাংকোর হেড কোয়ার্টার,সেখানে পৌছানোর প্রকাশ্য,গুপ্ত সকল পথই আলীর নখদর্পনে। তাদেরকে ধরার পূর্বেই তারা ফ্রাংকোর সীমানায় পৌঁছে গেলে কোন কৌশল অবলম্বন করবেন দ্রুতবেগে ধাবমান কমান্ডার সে পরিকল্পনাটাও সাজিয়ে নিচ্ছেন। খিলাফতের বাইরের ভূখন্ডে পরিচালিত তার সফল পরিকল্পনাগুলোর অভিজ্ঞতা একে একে তার নতুন পরিকল্পনাকে পাকাপোক্ত করার প্রচেষ্টায় রত। অবিশ্রান্তভাবে ঘোড়া ছুটিয়ে ভোর হল। অন্য সময়ে যে ঘোড়াটি অন্তত একটি বিশ্রাম নেয় আজ সে কোনো বিশ্রাম নিলনা।
.... ওই তো খেজুর বিথির মধ্যে তাদেরকে দেখা যাচ্ছে.... আলীর ৭ জন যোদ্ধা তাদেরকে পাকড়াও করল। চিঠিটি উদ্ধার করা হল, সম্রাট ফ্রাংকোকে লেখা হয়েছে-
‘অমুক দিন গ্রীস,রোম ও অন্যান্য অঞ্চলের খ্রিষ্টানদেরকে সাথে নিয়ে সমুদ্র পথে রোম উপসাগরের দিক থেকে মিশর আক্রমন করুন।...আপনার আক্রমনের পর আমার সৈন্যরা বিদ্রোহ করবে... বিজয়ী হলে বিনিময় হিসেবে পাবেন মিসরের সিংহভাগের নিয়ন্ত্রণ...।’
সুলতান সালাহউদ্দীনের মুখের ভাব-ভঙ্গী দেখে কখনও অনুমান করা যেতনা যে,তিনি এখন কি ভাবছেন। খুবই নির্লিপ্ত,নির্বিকার ভঙ্গিতে তিনি বিশাল বিশাল পরিকল্পনা করতেন,তিনি তা পারতেনও। চিঠিটি হাতে নিয়ে তিনি ভিন্ন রকম কিছু পরিকল্পনায় মেতে উঠলেন।
আরেকটি চিঠি লিখলেন সম্রাট ফ্রাংকোর উদ্দেশ্যে,দিন তারিখও তার সুবিধা অনুযায়ী হিসাব করে লিখলেন। তারপর বিশ্বস্থ,পরিপক্ক দুজন সেরা গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সম্রাট ফ্রাংকোর কাছে পাঠালেন। এদিকে তিনি সুদানী বাহিনীকে মিসরীয় বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেন কিছু দূরদর্শী ও দুঃসাহসিক পরিকল্পনায়। নাজীকে সৈন্য বাহিনীর অগোচরে সুকৌশলে আটক করা হয় এবং মাটির গভীরে অবস্থিত একটি গুপ্ত কক্ষে তাকে আটক রাখা হয়। নাজীর খবর কেউ জানেনি (অথচ এই পরিকল্পনাটির পরও খ্রিষ্টানরা নাজীর সাথে যোগাযোগের জন্য বহু গোয়েন্দা টিম পাঠিয়েছে। এ জাতীয় আরো বহু ঘটনার কারনে খ্রিষ্টান সম্রাট,কমান্ডারা সালাহউদ্দীনের বুদ্ধিমত্তা,কৌশলের প্রশংসা না করে পারেনি)। নাজীর অনুগতদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সুদানীদের মধ্যে যারা ঈমানদার ছিল তাদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হয়,অনেককে ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। তবে নতুন এ পরিকল্পনায় সালাহউদ্দীন তার ইরাকী বিশ্বস্ত সেনাদেরকে ব্যবহার করেন যাদের সংখ্যা মাত্র ৩হাজার ৫শত। ৮ দিন পর সালাহউদ্দীনের গুপ্তচর ফিরে আসে এবং সাথে নিয়ে আসে নাজীর উদ্দেশ্যে লেখা সম্রাট ফ্রাংকোর চিঠি...।
১১৬৯ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সেনাপতি এম্লার্ক এর নেতৃত্বে ১২৫টি যুদ্ধ জাহাজ সাগর তীরে নোঙ্গর ফেলে, সাথে থাকে সম্রাট ফ্রাংকোও। হঠাৎ কোথা থেকে আগুনের গোলক নিক্ষিপ্ত হতে থাকে মিঞ্জানিকের মাধ্যমে। জাহাজের পালে আগুন লেগে যায় এবং জাহাজেও তা ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকরা সে পরিস্থিতির বর্ণনায় লিখেছেন-‘মনে হচ্ছিল রোম উপসাগরে আগুন লেগেছে।’ শুরু হয় তীর বৃষ্টি। যুদ্ধের কমান্ড সুলতান সালাহউদ্দীন আইউয়ুবীর হাতে। খ্রিষ্টান সৈন্যদের অনেকে জীবন বাঁচাতে পানিতে লাফিয়ে পড়ে। খ্রিষ্টান জাহাজ পালাতে গিয়ে একে অপরের সাথে সংঘর্ষ বাঁধায়। ঠিক এমন সময় সুলতান সালাহ্উদ্দীনের নৌ-বাহিনীর জাহাজ শত্র“কে ঘিরে ফেলে। ওদিকে সম্রাট ফ্রাংকো স্থল পথেও সৈন্য প্রেরণ করেছেন। অনুরূপ আরেকটি পরিকল্পনায় তাদেরকেও পর্যুদস্ত করা হয়। তাদের বেশীরভাগ সৈন্যই মারা যায়। সম্রাট ফ্রাংকো,এম্লার্ক আত্মসমর্পন করে এবং তাদেরকে ক্ষমা করা হয়। ১৯শে ডিসেম্বর সন্ধির চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। (সুলতান সালাহউদ্দীন এই যুদ্ধের আগে নুরুদ্দীন জঙ্গীকে তা গোপনে অবগত করেন। যখন রোম উপসাগরে যুদ্ধ চলছে তখন সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী সম্রাট ফ্রাংকোর দেশ আক্রমন করে তাকে পর্যুদস্ত করেন। সম্রাট ফ্রাংকো নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করে একটি ভিন্ন ডিজাইনের দেশকে আবিষ্কার করে দারুনভাবে মুষড়ে পড়েন। ঐতিহাসিকরা বলেন-নুরুদ্দীন জঙ্গী না থাকলে ইতিহাস সুলতান সালাহ্উদ্দীনকে দেখতে পেত না। সুলতান নুরুদ্দীন প্রতিটি সঙ্কটময় মুহুর্তে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা করেছেন। )
ঐতিহাসিক লেনপুল,উইলিয়াম বলেন-“রাতের বেলা বিপুল সংখ্যক শত্র“ সেনার উপর গুটিকতক সৈন্যের কমান্ডো আক্রমন এবং চোখের পলকে উধাও হয়ে যাওয়া ছিল সুলতান সালাহ্উদ্দীনের এমন এক রণ কৌশল যা,খ্রিষ্টানদেরকে বিপুল ক্ষতির সম্মুখিন করেছে। ....কৌশলের মারপ্যাচে তিনি শত্র“কে তার পছন্দনীয় স্থানে যুদ্ধ করতে বাধ্য করতেন।...”
সুলতান সালাহ্উদ্দীন জোকীকে বাঁচানোর সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। অন্দর মহল থেকে নাজীর সংবাদ নিয়ে ফেরার পথে আততায়ী কর্তৃক আক্রান্ত হয়েও তিনি উক্ত আততায়ীকে খঞ্জরের সাহায্যে হত্যা করতে সক্ষম হন। জোকীর পিতা-মাতা ছিল দরিদ্র এবং পিতা ছিল অন্ধ। তার রুপ ও বুদ্ধিমত্তার কারনে ইহুদী চক্রান্তকারীরা ১২ বছর বয়সেই তাকে অপহরণ করে দীর্ঘ সময় ধরে প্রশিক্ষিত করেছে। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান তার নৈতিকতা বোধ,ইসলামের মহাত্ব দিয়ে তাকে সত্যের পথে থাকতে অনুপ্রাণীত করেন এবং প্রচুর অর্থ দেওয়ারও প্রতিশ্র“তি দেন। আলী বিন সুফিয়ান তার পিতা-মাতাকে গোপনে অর্থ সাহায্য দিতেন। নাযী ইসলাম ও মুসলিমের সম্মানকে ধুলায় লুটানোর জন্য সালাহউদ্দীনকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল জোকীর মাধ্যমে কিন্তু সে জানতো না যে, সালাহউদ্দীন আইউয়ুবী এ ক্ষেত্রে তার শিক্ষক। ফলে সে নিজেই নিজের ফাঁদে আটকে গেল(বন্দী নাজীর কাছ থেকে গুরুত্বপুর্ণ তথ্য নিয়ে তার চক্রান্তের সহযোগীসহ তাকে গোপনে হত্যা করে মাটিতে পুতে ফেলা হয়)। এ জাতীয় বহু পরিকল্পনাতে সালাহউদ্দীন বিজয়ী হয়েছেন এবং এর মাধ্যমে ইসলামের অগ্রযাত্রা অব্যাহত গতিতে চলেছিল। জোকী সালাহউদ্দীন এর উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে আগেই ধারণা পেয়েছিল অন্য নারী গোয়েন্দাদের মাধ্যমে। মৃত্যুর সময় সে আফসোস করে বলেছিল-
“হায় আমি যদি মুসলিম হতাম ! ...সুলতান ! আমার পিতা-মাতাকে দেখবেন। তাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্যই আমি এ পথে পা বাড়িয়েছি।...আমি আমার কর্তব্য পালনে কোনো ত্র“টি করিনি...। আল্লাহ আপনার সালতানাতকে নিরাপদ রাখুন ! (সালাহউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে বললেন)-সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর চরিত্র কত পবিত্র তা আমার চাইতে কেউ বেশী জানে না ! ” জোকীকে সুলতান অতি মর্যাদার সাথে দাফন করার নির্দেন দেন। বহু নারী ইসলামী খিলাফতের মহা সর্বনাশে ইন্দন যুগিয়েছিল আবার এ রকম বহু নারী ইসলামী খিলাফতের মর্যাদা রক্ষায় উৎসর্গীত হয়েছিল।
বিষয়: বিবিধ
২২১৭ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কোরানকে ধারন করতে হবে ! আর পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া চলবেনা !
লিখতে থাকুন জাতির বিরত্বগাধা ইতিহাসের আলোচনা। সাথেই আছি আমরা।
এরপর জোকী নাজীর সাথে এমনভাবে আচরণ করে যাতে নাজী ভাবতে থাকে,সুলতানকে সে পটিয়ে ফেলেছে। আসলে জোকী রিভার্স খেলছিল এবং জোকী তার অসাধারন বুদ্ধিমত্তায় অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য উদ্ধার করে। তার যাতায়াত ছিল সবথেকে উচু স্থানে। মূলত সে ছিল প্রশিক্ষিত ও প্রথম শ্রেণীর গোয়েন্দা।
******
আরেকটি স্থান হল নাজী। নাজীকে এবং তার অন্যান্য সামরিক সহযোগীকে কৌশলে আটক করে তথ্য মুছে ফেলা হয়। তারা কোথায় এ খবর অল্প কয়েকজন ছাগা কেউ জানত না। আর মাটির নীচের এক বাঙ্কারে নাজীসহ অন্যদের চামড়া উঠিয়ে ফেলা হয় এবং তারপর তাদের তথ্য নিয়ে উচ্চ মানের গোয়েন্দাদের দ্বারা সালাহউদ্দীন ইউরোপের সবকটা রাজা,সেনাপতিকে ব্যপক ধোকা দেন এবং ১০০% সফল হন্ । নাজীর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
অবাক করা বিষয় হল, এরপর অনেক বছর পর্যন্ত ইউরোপীয় রাজা,শাসকরা নাজীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে এবং সালাহউদ্দীন নাজীর পক্ষ থেকে নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। তবে সবথেকে মজার কাজ তিনি করেছেন, খ্রিষ্টান গোয়েন্দাদের মাধ্যমে,যাদের কেউ কেউ তাকে হত্যা করতে এসে ইসলাম গ্রহন করে।
তারা বীরত্বের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লড়তে চাইলে তিনি নিষেধ করেন এবং ভয়াবহ কিছু যুদ্ধ পরিকল্পনা করেন। আর এসব কারনে সালাহউদ্দীনের শত্রুরাও তার প্রশংসা করেছে।
আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে আমাদের আমাদের বসবাস।
Thanks a lot brother.
মন্তব্য করতে লগইন করুন