হিজরত কি প্রাণভয়ে পলায়ন,নাকি রাজনৈতিক দূরদর্শীতা !!!
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০২ জুলাই, ২০১৪, ১২:০৬:০৩ দুপুর
আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি মক্কাতে রসূল(সা কতটা নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। তিনি শারিরীকভাবে,পারিবারিকভাবে,সামাজিকভাবে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মানুষিকভাবে তাকে চরম বিপর্যস্ত করার প্রচেষ্টাই অব্যাহত ছিল। যেকোনোভাবে তার কর্মকান্ডকে থামানোর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। কিন্তু তিনি সেসব অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন একইসাথে ইসলামের দাওয়াহ দৃঢ়তার সাথে চালিয়ে গেছেন। হিজরত অর্থ যদি হয়ে থাকে পালিয়ে যাওয়া বা আত্মগোপন করা ,তাহলে যেদিন থেকে তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়া পরিচালনা করছিলেন, সেদিন থেকেই এর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু রসূলের(সা হিজরত তার পরিবারের ও সাহাবীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্যে ছিলনা,যদিও আপাত দৃষ্টিতে সেটাই মনে হয়। মূলত: তা সংঘটিত হয়েছিল মহান আল্লাহর নির্দেশে, আর এটি ছিল রসূলের এক দূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা বা সিদ্ধান্ত।
রসূল(সা এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর আদেশে আল্লাহর যমিনে তার দ্বীন কায়েম করা। আর এর জন্যে নির্দিষ্ট কোনো ভূখন্ড শর্ত নয় ,বরং অনুকূল পরিবেশ,সুবিধাই আসল। রসূল(সা যখন মক্কাতে ইসলামের দাওয়া শুরু করেছিলেন তখন তিনি ভাবতেন মক্কাতেই হয়ত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু মক্কায় তিনি সাহাবীসহ চরম নির্যাতিত ও উপেক্ষিত হলে বিভিন্ন গোত্রের শ্মরনাপন্ন হন। নতুন নতুন স্থানে দাওয়াহর ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন,একই উদ্দেশ্যে ইয়সরিব বা মদীনাতেও ইসলামের দাওয়া সম্প্রসারিত হয়।
সুদীর্ঘকাল ধরে মক্কার লোকেরা দু:খ দারিদ্রের মধ্যে কালাতিপাত করত। তারা যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকত। বছরে তিন মাস যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল,আর সে সময়েই তারা বানিজ্য কাফেলা নিয়ে বিদেশ ভ্রমন করত এবং জিবীকা অšে¦ষণনের সুযোগ পেত। অন্য সময়ে কোনো গোত্র তার শত্রু গোত্রের এলাকার ওপর দিয়ে গমন করলে জীবন নিয়ে ফিরে আসা কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেনি। অনুর্বর মক্কাতে ফসলাদীর প্রাচুর্যও ছিলনা। তারা বিশেষ কোনো শিল্পকর্মেও সমৃদ্ধ ছিলনা। ফলে তারা বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের রাস্তা সর্বদা পরিষ্কার রাখত। ক্কাবাঘরের ক্ষ্যাতী দূরদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার কারনে এশিয়া ,আফ্রিকার দেশগুলোর বানিজ্য কাফেলা বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী নিয়ে মক্কাতে আসত এবং মক্কার লোকেরা তা ক্রয় করত। আর মক্কার লোকেরাও বিদেশে তাদের বাণিজ্য পরিচালনা করত। ফলে যেসকল রাস্তা মক্কা থেকে বহির্বিশ্বের উদ্দেশ্যে চলে গেছে তা নিরাপদ, অক্ষত রাখা ছিল তাদের টিকে থাকার স্বার্থে।
যেকোনো স্বাধীন দেশ বা জাতি তাদের নিজেদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়। তা না হলে তার জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। এটি হল একটি জাতির অস্তিত্ব সংক্রান্ত বিষয়। ফলে তারা তাদের সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সামরিক নিরাপ্তার জন্যে যাবতীয় ব্যবস্থা করে । কিন্তু যদি কেউ ভিন্ন চিন্তায় চিন্তিত একটি জাতির মধ্যে অবস্থান করা অবস্থায় একটি নতুন চিন্তায় চিন্তিত বা নতুন আদর্শে উজ্জিবীত জাতি গঠন করতে চায়,তাহলে তাকেও নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে আলাদা একটি জাতি গঠন করতে হবে। আর তা করতে গিয়ে তাকে অবশ্যই প্রচলিত সমাজের ধ্যান ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রের প্রচলিত নীতি-পদ্ধতি উৎখাত করে,তার স্থলে নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর এ কাজটি অবশ্যই সমাজে প্রচলিত পূর্বোক্ত চিন্তা,ধ্যান-ধারণার সাথে আপোষে হতে পারেনা। নীতির ক্ষেত্রে আপোষ হলে প্রতিষ্ঠিত আদর্শটি নিজস্ব স্বকীয়তা পেতে পারেনা। ইসলাম ছিল এমনই একটি বিষয়। আর তাই রসূল(সা ইসলাম প্রতিষ্ঠাকল্পে কাফির,মুশরিকদের সাথে কোনো রকম আপোষ করেননি, বরং তাদেরকে নি:শর্তভাবে ইসলাম গ্রহনের আবেদন জানিয়েছেন।
একইসাথে ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মানষে, সকল বিষয়ের ফয়সালা ইসলাম দ্বারা করার জন্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র-সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তায় তিঁনি(সা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অন্য ব্যবস্থাপনার অধীনে থেকে কখনও ইসলাম নামক জীবনাদর্শের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আর আল্লাহর রসূলের সাথে মক্কার শাসকবর্গের এখানেই ছিল মূল শত্রুতা। যতদিন রসূল(সা গোপনে ইসলাম প্রচার করেছেন,ততদিন পর্যন্ত তিনি কাফিরদের রোষানলে পড়েননি। সেসময়ে তাকে উপহাস করা হত বটে,, কিন্তু অত্যাচারের মাত্রা ছিল সিমীত। কারণ তখন ইসলাম নামক ব্যবস্থাপনা ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সিমাবদ্ধ। যখনই তা প্রকাশ্যতা পেল এবং নতুন নতুন আয়াত নাযিল হওয়া শুরু করল ও তার সমাজে জোরে শোরে প্রচারিত হল, তখনই শাসকের গাত্রদাহ শুরু হল। কারণ এতে তাদের নেতৃত্ব,কর্তৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা তারা করছিল। আর এটাই ছিল স্বাভাবিক। রসূলের(সাসাথে কাফিরদের মূল শত্রুতা মূলত রাজনৈতিক। কারণ কাফিররা তাদের কর্তৃত্বে আঘাত লাগে এমন বিষয় পরিহার করতে নিষেধ করেছিল। যেসব দেব-দেবীর নামে তাদের সমাজিক রসম রেওয়াজ পরিচালিত হত,তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে নিষেধ করা হত। স্বামাজিক-রাজনৈতিকভাবে যেসব পৌত্তলিক নীতি পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তার বিরুদ্ধে কথা বলতে নিষেধ করা হত। সকল রকমের অত্যাচারে যখন তাঁকে(সা হটানো গেলনা, তখন তাকে নানান রকম লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি তা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কাফিরদের আপোষমূলক কথা মেনে তিনি ব্যক্তিগত ইবাদত চালিয়ে যেতে চাইলে নিশ্চিন্তে তা করতে পারতেন, এমনকি সেসব ইবাদতের জন্যে তারাই উৎসাহিত করেছিল। কিন্তু এখানে তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তিনি তাদের মধ্যে থেকে ,তাদের মত করে পরিচালিত না হয়ে আল্লাহর আদেশে সকলকে পরিচালিত করার জন্যেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর এ কারনে ইসলামের একটি পরিপূর্ণ রূপের বাস্তবায়ন জরুরী ছিল। আর সেটি করতে হিজরত ছিল একটি কৌশল, যা কোনোভাবেই জীবন ভয়ে পলায়ন নয়, বরং এটি একটি দূরদর্শী ও সুবিশাল রাজনৈতিক কৌশল। আমরা সামনে এটি আলোচনা করব:
ব্রিটিশ জেনারেল টুকার তার ‘প্যাটার্ণ অব ওয়ার’ গ্রন্থে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড সম্পর্কে লিখেছেন যে, “যদি ক্রুসেডের নাইটগণ দামেস্কের প্রতিরক্ষা গুরুত্বকে বুঝে নিতে পারতেন এবং উক্ত শহরকে প্রতিরক্ষা কেন্দ্র বানিয়ে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে একে(দামেস্ক) তার পক্ষে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে পারতেন,তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সালাহউদ্দীন নিশ্চিতভাবে ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত ও ধবংস করতে পারতেন না। এভাবে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম নিশানাও আর থাকত না। দূর্ভাগ্য যে ক্রুসেডারগণ দামেস্কের গুরুত্ব উপলব্দী করতে পারেননি। এ কারনেই ইসলামের ঝান্ডা দুনিয়ার বুকে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। ”
ব্রিটেনের বিখ্যাত প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ জেনারেল কিগেল তার ‘অপারেশন অব ওয়ার’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন-“ যদিও শত্রু বাহিনীর ওপর সাফল্য লাভের খুবই জরুরী হাতিয়ার হল-সু-শৃঙ্খল,সু-সংগঠিত ও সু-প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, কিন্তু সেই বাহিনীকে সাফল্যজনকভাবে পরিচালনার জন্যে অতি জরুরী বিষয় হল-তাদের একত্রিত হয়ে বা সুসংগবদ্ধ হয়ে লড়াই করা। তারা যেন একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লড়াই করতে পারে তা নিশ্চিত করা। সেনাবাহিনীর সকল অংশ একই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একইরূপ পরিকল্পনার অধীনে থেকে লড়াই করবে। আর তাদের রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। রসদসমূহ যেন সর্বদা মজুদ থাকে এবং ফুরিয়ে যাবার পূর্বেই যেন তা পূণরায় মজুদ করা যায়,শত্রু যেন ক্ষতিসাধন করতে না পারে সে ব্যাপারে জেনারেলকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর কোথা থেকে,কিভাবে রসদসমূহ সংগ্রহ ও সরবরাহ করা হবে সেটিও জেনারেল গভীরভাবে ভাববেন ও সূচীন্তিত সিদ্ধান্ত নিবেন। আর এর জন্যে একটি প্রতিরক্ষা কেন্দ্র প্রস্তুত করা ও তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য বিষয়। ”
ব্রিটিশ জেনারেল বার্ড তার ‘ডিরেকশন অব ওয়ার’ নামক গ্রন্থে বলেন যে-“যে জাতি স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে চায়,তাকে স্বীয় প্রতিরক্ষা ও হেফাজতের জন্য প্রতি মুহুর্তে লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। যদি সে লড়াইয়ে প্রস্তুত না থাকে,তবে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন সে করতে পারে না। অতিসত্ত্বরই তাকে গোলামীর জিঞ্জির পরিধান করতে হবে। প্রকৃত সত্য এই যে, এমন মেরুদণ্ডহীন জাতির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আজকাল রাজনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক-সাং®কৃতিক জীবনের ভিত্তি শুধু এই বিষয়ের মধ্যে প্রথিত যে-উক্ত জাতির নিকট যথেষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য বাহিনী আছে কি নেই।”
তিনি প্রতিরক্ষা কৌশল সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরও বলেছেন যে-“শত্রুদের সাথে যুদ্ধে বিজয় অর্জনের সুবিধার্তে সমরোপকরণ,রসদ এমন একটি স্থানে জমা করে রাখতে হবে,যা শত্রুরা দখল করতে বা ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। আর প্রতিরক্ষা কেন্দ্র এমন স্থানে হওয়া উচিৎ যেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে সুবিধা হয় একইসাথে রসদ সরবরাহ করা সহজ হয়।”
এবার আমরা ইয়াসরিব বা মদীনার প্রতিরক্ষা গুরুত্ব আলোচনা করব:
পরের পর্বে পড়ুন....
বিষয়: বিবিধ
১৮১৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মদিনার প্রতিরক্ষা গুরুত্ব জানার জন্য জেনারেল আকবর খান এর লিখিত "হাদিছে দেফা" বাংলায় "ইসলামি প্রতিরক্ষা কেীশল" বই টি খুবই ভাল। বাংলাদেশে এটি দুস্প্রাপ্য। আপনার ওখানে খোজ করলে ইংরেজি অনুবাদ পেতে পারেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন