যে লেখাটি শেয়ার করতে বাধ্য হলাম !!!
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২০ মে, ২০১৪, ০৮:৪৬:৩২ সকাল
গোলাম মাওলা রনি
আমি যখন তাকে প্রথম দেখি তখনো তার নামের সাথে আল্লামা উপাধি সংযুক্ত হয়নি। সেটা ছিল ১৯৭৬ সালের কথা। আমি কেবল তার সুরেলা কণ্ঠ ও দাড়ি-টুপির আকৃতির কথা মনে রাখতে পেরেছিলাম। এরপর তাকে দ্বিতীয়বার দেখি ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে। ব্যবসা উপলক্ষে আমি তখন চট্টগ্রামে ছিলাম বেশ কয়েক দিনের জন্য। সারা দিন প্রচণ্ড কাজ। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই অখণ্ড অবসর। ওই শহরে আমার পরিচিত জন ছিল একেবারেই হাতেগোনা। দুই-এক দিন পর বিকেলে গেলাম পতেঙ্গা সৈকতেÑ তা-ও আর ভালো লাগছিল না। হোটেলে বসে থাকতে থাকতে যখন একেবারেই অধৈর্য্য হয়ে উঠলাম তখন দেখলাম অনেকগুলো লোক দলবেঁধে পাজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরে মাহফিলে যাচ্ছে। আমিও তাদের সঙ্গী হলাম কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই। প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর মাহফিলস্থলে পৌঁছলাম এবং ওয়ায়েজিনের কণ্ঠ শুনে বুঝলাম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি ওয়াজ শুনছিলাম এবং হেঁটে হেঁটে প্যারেড ময়দানের চার পাশে ঘুরে ঘুরে লোকজনের সংখ্যা নিরূপণের চেষ্টা করছিলাম। কত হবেÑ কেউ বলে পাঁচ লাখ, কেউ বলে দশ লাখÑ কেউ কেউ আরো বেশি। এত বিশাল জনসমাবেশ আমি ইতঃপূর্বে যেমন দেখিনি তেমনি আজ অবধিও দেখিনি কেবল তাবলিগ জামাতের মহাসমাবেশ ছাড়া।
ওই দিনের পর থেকে আমি জনাব সাঈদীর একজন ভক্ত হয়ে গেলাম। চট্টগ্রামের মাহফিলে আমার দ্বিতীয়বার যাওয়ার সুযোগ হয়নি কিন্তু মতিঝিল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের বিশাল মাঠের বার্ষিক মাহফিল নিয়মিত শুনেছি। কিন্তু আমার সুযোগ হয়নি তার সামনে দাঁড়িয়ে বা কাছে বসে দু’দণ্ড কথা বলার কিংবা একান্ত কাছ থেকে দেখবার। শেষমেশ সেই সুযোগটি এলো ২০০৪ সালে। আমার এক বন্ধু ফোন করে জানালেন যে সাঈদী সাহেব রাতে তার বাসায় দাওয়াত খাবেন। তিনি আর কাউকেই দাওয়াত দেননি কেবল আমাকে ছাড়া। আমি আগ্রহভরে সে রাতে বন্ধুর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। সাঈদী সাহেব এলেন এবং আমরা পরিচিত হলাম। তিনি যখন জানলেন যে আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রার্থী তখন ভারী উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন এবং মুচকি হেসে বললেনÑ আওয়ামী লীগে এত ভদ্রলোক আছেন তা আপনাকে এবং ফারুখ খানকে না দেখলে বোঝা যাবে না। আমি মূলত তার ওয়াজ মাহফিল নিয়েই কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবেগের আতিশয্যে পারিনি। কেবল জিজ্ঞাসা করেছিলামÑ শেখ হাসিনা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? তিনি বলেছিলেন, আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে। তিনি যদি জানতেনÑ তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে কিভাবে শ্রদ্ধা করে কেন করে এবং কখন করে তাহলে তার রাজনৈতিক দর্শন আরো মর্যাদা পেত।
এরপর আর আমার সাথে সাঈদী সাহেবের দেখাও হয়নি এবং কথাও হয়নি। উনি অবশ্য তার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেটাও হয়ে ওঠেনি ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই আমি তার সাথে ছিলাম এবং এখনো আছিÑ হয়তো আল্লাহ চাইলে ভবিষ্যতেও থাকব। তার সাথে থাকার মূল ভিত্তিটি হলো ওয়ায়েজিন হিসেবে তার বক্তব্য, সুরেলা আওয়াজ, ুরধার যুক্তি। বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা, সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষার প্রয়োগ এবং প্রচণ্ড মোহময়তার সুতীব্র চৌম্বক শক্তিতে লাখ লাখ মানুষকে মাহফিলের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আকৃষ্ট করে রাখার প্রবল ক্ষমতা। প্রথম জীবনে আমি দাদাকে নিয়ে তার মাহফিলে গিয়েছি। তারপর আব্বাকে নিয়েÑ সবশেষে গিয়েছি নিজের পুত্রসন্তানকে নিয়ে। যখন প্রথম গিয়েছিলাম তখন ছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। যখন সর্বশেষ গিয়েছিলাম তখন যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বে ঢোকার ভয় মনের মধ্যে প্রবেশ করেছিলÑ এবং তখন আমার কথা আর বক্তব্য শোনার জন্যও হাজার হাজার মানুষের সমাগম হতো। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলোÑ আমার প্রথম দর্শন ও শেষ দর্শনের মধ্যকার প্রায় ৩০টি বছরের ব্যবধানে একবারও জনাব সাঈদীর বক্তব্য পুরোনো, অ-আকর্ষণীয়, বিরক্তিকর কিংবা একঘেয়ে বলে মনে হয়নি। যুগ যেমন টেপ রেকর্ডার থেকে সিডি-ভিসিডি ও ডিভিডিতে রূপান্তরিত হয়ে ওয়েববেইজড হয়ে গেছে, তেমনি সাঈদী সাহেবও জমিনের মালিক আল্লাহর বাণী এবং তাঁর হাবিবের বাণীকে আধুনিক মানুষের মনের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন। ফলে গত প্রায় ৪০টি বছর ধরে বাংলা ভাষাভাষী তাবৎ দুনিয়ার মুসলমান নরনারীর কাছে তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন জীবন্ত কিংবদন্তি রূপে। মানুষের বুভুু আধ্যাত্মিকতার জগতে তিনি এক মুকুটহীন বাদশা এবং মনোজগতের আলোকিত স্বপ্নপুরুষ।
আমার ক্ষেত্রে কিন্তু জনাব সাঈদীর বিষয়টি এরূপ হওয়ার কথা ছিল না। কারণ শৈশব থেকেই আমি ধর্মকর্ম করার একজন রক্ষণশীল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠছিলাম। কলেজজীবনে এসে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির একজন কট্টরপন্থী কর্মী হিসেবে ইসলামপন্থী দলগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতাম না। এরপর আমি দেখা পাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতিদের। এদের দু’জন ইমামÑ খাজা আবু তাহের ও মাওলানা আব্দুল জলিলের পেছনে প্রায় দেড় যুগ ধরে জুমার নামাজ পড়েছি। এখানে উল্লেখ্য যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছে এবং তারা জামাত-শিবিরকে খুবই ঘৃণা করে, মনে হয় অমুসলিমদের চাইতেও বেশি। এমন একটি পরিবেশে থেকে সাঈদীর গুণমুগ্ধ ভক্ত হওয়া খুবই জটিল ও কঠিন একটি বিষয়। প্রথমে মনে হতোÑ আমি বোধ হয় একা। পরে দেখলাম আওয়ামী লীগ করেন এমন লোক তো বটেই অনেক হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানরাও সাঈদী সাহেবের জন্য পাগল। অনেক হিন্দুর বাড়ি-গাড়িতে আমি জনাব সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট কিংবা সিডি দেখেছি।
এই মুহূর্তে জনাব সাঈদী কারারুদ্ধ। তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত। আপিল আদালত হয়তো খুব তাড়াতাড়ি এবং যেকোনো সময় রায় দিয়ে দিতে পারে। কী রায় হয়েছে কিংবা কী রায় হবে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে মনোবেদনা তো অবশ্যই আছে। মনে প্রশ্ন জাগেÑ এমনটি কেন হলো। যে মানুষটি ৪০টি বছর ধরে সারা দুনিয়ার আনাচে কানাচে বাঙালিদের আস্তানায় গিয়ে কুরআন শুনিয়ে এলেন। তার কণ্ঠের মোহময় জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে মানুষজন সুপথ পেল কিংবা যার যৌক্তিক আহ্বানে লাখ লাখ মানুষ দ্বীনের পথে পাবন্দ হলো তিনি আজ কেনই বা এত বড় মুছিবতে পড়লেন! আমরা তেমন কিছু জানি নাÑ আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। তবে সাঈদী-বিরোধীরা যেসব কুৎসা রটনা করছে তা এ দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। সাধারণ মানুষের তো কোনো ক্ষমতাই নেই। তারা কেবল অন্তর থেকে কাউকে ঘৃণা করতে পারেন এবং আল্লাহর দরবারে ঘৃণিত ব্যক্তির জন্য শান্তি কামনা করতে পারেন। অন্য দিকে ভালোবাসার মানুষটির জন্য দোয়া করতে পারেন। সেই দিক বিবেচনায়Ñ জনাব সাঈদী এ দেশের লাখো-কোটি মানুষের মনের আকুতি মিশ্রিত দোয়া যে পাচ্ছেন তা আমি বলতে পারি নির্দ্বিধায়।
এবার আমি বলছিÑ ভিন্ন মতের, ভিন্ন ধারায় থেকেও কেন সাঈদীর অনুরক্ত হলাম। কারণ একটাইÑ আমার আত্মার খোরাক মেলে তার ওয়াজের মাধ্যমে। আজো আমি সময় পেলে ইউটিউবে গিয়ে যেমন কারি আবদুল বাসিত, শেখ মোহাম্মদ জিবরিল, শেখ মোহাম্মদ খলিল আল হুসাইরি, আবদুর রহমান সুদাইস, শেখ সুরিইয়াম, কারি সাদাকাত, মো: রিফাত, আল আফাসী প্রমুখের সুললিত কণ্ঠের কুরআন তেলাওয়াত শুনিÑ তেমনি জনাব দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজও শুনি। অবাক করার বিষয় হলোÑ সাঈদী সাহেবের ওয়াজের একেকটি ভিডিও ১৪-১৫ লাখ লোক পর্যন্ত দেখেছে। কোনো বাঙালি শিল্পী, কিংবা বক্তা কিংবা ওয়ায়েজিনের ভিডিও এত মানুষ আজ অবধি দেখেনি। আমি এসব ভিডিও বা অডিও কিপ শুনি এবং আত্মার প্রশান্তি অনুভব করি। আমি লক্ষ করেছি আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাঈদীবিরোধী লোকজন না বুঝে এবং না জেনেই সাঈদীর সমালোচনা করেন। আবার উল্টোটাও আছেÑ কোনো রকম ভালোমন্দ বিচার-বিবেচনা না করেই অন্ধভাবে সাঈদী সাহেবকে সমর্থন করেন। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন রকম। আমি ব্যক্তি সাঈদী সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না বা জানার প্রয়োজনও মনে করিনি। কিন্তু পবিত্র আল কুরআনের তাফসিরকারক অর্থাৎ মুফাসসিরে কুরআন হজরত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে জানি। তার বক্তব্যের কোন জায়গায় কতটুকু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং কোথায় কোথায়
অনন্যসাধারণ চমৎকারিত্ব রয়েছে তা যেমন লক্ষ করেছি তেমনি আরবি উচ্চারণের ভালো-মন্দের দিকেও খেয়াল করেছি। আরবি ব্যাকরণ কিংবা হাদিসের ব্যাখ্যা অথবা তাসাউফের আলোচনায় কেউ কেউ জনাব সাঈদীর পাণ্ডিত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন কিন্তু সামগ্রিকভাবে ইসলামের খেদমতে তার ধারে কাছে দাঁড়াতে পারেন এমন আলেম বাংলাদেশে একজনও নেই।
সাঈদীর পাশে কোনো আলেম দাঁড়াতে পারবেন নাÑ এত বড় কথা আমি কিভাবে বললাম? এ ব্যাপারে বিস্তারিত বললেই সম্মানীত পাঠক বিষয়টি স্পষ্ট বুঝতে পারবেন এবং সাথে সাথে এ-ও বুঝতে পারবেনÑ কেন আমার মতো লাখ লাখ মানুষ ভিন্ন ধারার রাজনীতির ধারকবাহক হওয়ার পরও জনাব সাঈদীকে পছন্দ করেন। পাক ভারত উপমহাদেশের ইসলাম ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা, ধ্যানধারণা তাবৎ দুনিয়া থেকে আলাদা। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মুসলমানগণের একটি বিরাট অংশ বিভিন্ন পীর, দরবেশ, আওলিয়া কিংবা মাজারকেন্দ্রিক ঐক্য গড়ে তুলে ধর্মকর্ম পালন করে থাকে। এসব পীর-ফকির-দরবেশ-দরগা ও মাজারে ফিবছর ভক্তবৃন্দ জমায়েত হয়ে নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী নামাজ, কালাম, জিকির, ফিকির, নাচ-গান ও খানাপিনা করে থাকেন। কেউ এই জমায়েতকে বলেনÑ ইসালে সওয়াব, কেউ বলেন ওরশ মোবারক আবার কেউ কেউ বলেন তাবলিগ বা বিশ্ব জাকের সমাবেশ। এসব অনুষ্ঠান দুই-তিন দিন ধরে হয়। অনুষ্ঠানের আশেপাশে বিরাট মেলাও বসে যায়। ধর্মকর্মের পাশাপাশি মানুষ দুনিয়াদারির কর্মকাণ্ডও করে থাকেন। পীরেরা কিংবা দরগার খাদেমরা সবসময় ভক্তকুলের কাছ থেকে নজরানা গ্রহণ করেন, যা তাদের সারা বছরের জীবন-জীবিকার একমাত্র সংস্থান বলে গণ্য হয়। আমার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুরে ছোট-বড় ১০-১২ জন দরবারভিত্তিক পীর-মোর্শেদ দেখে আসছি। তাদের মধ্যে আকার আকৃতি ও ভক্তকুলের সংখ্যাধিক্যে আটরশি ও চন্দ্রপাড়ার পীর সাহেবদের নামডাক দেশে থাকলেও স্থানীয় হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা অত ভালো না।
বড় হয়ে যখন পৃথিবীর অন্যান্য মুসিলম দেশে গেলাম তখন বাংলাদেশের মতো এরূপ কাণ্ডকারখানা কোথাও দেখলাম না। যা হোকÑ বহু পীরের কাছে গেলাম। মনে অনেক প্রশ্ন। অনেক কিছু জানতে চাই। কিন্তু পীরেরা কথা বলেন না। তাদের সামনে হাঁটুগেড়ে বসিÑ হাতজোড় করে থাকি এবং নজরানা দেই। পীরসাহেবরা জোরে জোরে ফুঁ দিয়ে দেন। পীর বাবার ফুঁ মাথায় নিয়ে বাইরে আসি কিন্তু অন্তর ঠাণ্ডা হয় না। বরং নজরানার টাকাগুলোর জন্য একধরনের মায়া মায়া ভাবের জন্য মনটাই খারাপ হয়ে যেত। এরপর আমি যেতাম বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে। বক্তা কান্নার ভান করে বিকট গলায় ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলে এমন সব মারিফাতি কিচ্ছাকাহিনী শুরু করত, যা শুনলে রুচিবান লোকের বমি বমি চলে আসত। চিন্তাশীল মানুষ হলে ইসলাম সম্পর্কেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলত। এ ঘটনার পর আমি ওই সব পীর-ফকিরের দরবার এবং গলাবাজ ওয়ায়েজিনদের মাহফিলে যাওয়া বন্ধ করে দেই। কুরআন-হাদিস পড়ার পাশাপাশি বিখ্যাত অলি আল্লাহগণের লিখিত বই পড়ার পর ধর্মকর্মে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করতে থাকি। অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামের তুলনা এবং আমাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝার জন্য আরো কিছু বইপত্র পড়ে নিজের জ্ঞান ও বিশ্বাসকে ঝালাই করে নিলাম। কিন্তু সমস্যা হলোÑ ধর্মমতে সব কিছু করতে পারছিলাম না।
আমি প্রাণপণে চাইতাম বাবা-মাকে শ্রদ্ধা ও আমার জীবনের সব ভালো জিনিসগুলো দিয়ে তাদেরকে সেবা করে আল্লাহ পাকের নৈকট্য হাসিল করার জন্য। আমি এ-ও চাইতাম যে আমার বহু কষ্টের উপার্জনের একটি অংশ ভাই, বোন ও দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলি করে দেই। গোপনে অসহায় লোকজনকে দানখয়রাত করি এবং জমিনে মাথা নিচু করে বিনয়সহকারে চলাফেলা করি। কিন্তু কিসের জন্য জানি নাÑ কৃপণতা আমাকে ভর করে বসল। বিনয়ের পরিবর্তে নিজের অর্থ, বিত্ত, জ্ঞান-গরিমা, চেহারা-সুরত ও বংশমর্যাদার জন্য রীতিমতো গর্ব বা অহঙ্কার করা শুরু করলাম। ফলে আমার আপনজনের অনেকের সাথেই আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল। ঠিক এই সময়ে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে আমি সাঈদী সাহেবের মাহফিলে গেলাম। তিনি সে দিন সুরা ফাতিহার তাফসির করছিলেন। তিনি বলছিলেনÑ রাহমান বা রহমান নামের মাহাত্ম্য সম্পর্কে। প্রথমে পুরো সূরাটি তেলাওয়াত করলেন। তারপর বর্ণনা করলেন সূরাটির গুরুত্ব। এরপর চলে গেলেন শাব্দিক অর্থের ব্যাখ্যায়। আলহামদু লিল্লাহ, রাব্বুল, আলামিনÑ এই তিনটি শব্দের মধ্যে রব শব্দের মর্মবাণী এবং মর্মার্থ শুনে আমি পাগল হওয়ার উপক্রম হলাম। এরপর তিনি যখন আর রহমান শব্দ নিয়ে তাফসির শুরু করলেন তখন সাঈদী সাহেবের গলার আওয়াজ ছাড়া আমি আর কিছু শুনতে কিংবা দেখতে পাচ্ছিলাম না। চোখ বন্ধ করে আমার মালিকের বিশালত্ব তার রব নামের ব্যাপকতা এবং রহমান নামের সার্থকতার আলোকে নিজের জীবনের সীমাহীন ব্যর্থতা আর অপূর্ণতার সন্ধান করছিলাম। মনের কালিমা দূর হয়ে সত্য ও শান্তির সুবাতাস কিসের যেন এক সুবাস দিয়ে আমায় মোহিত করে তুলেছিল। আমার চোখের পানির অবারিত ঝর্ণাধারা আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমার মালিকের দিকে। আমি সে দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছিলামÑ বাকিটা জীবন কল্যাণ, ন্যায়নিষ্ঠতা আর আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে কাটিয়ে দেবো। মাহফিল শেষে আমি হোটেলে ফিরে এলাম এবং কয়েক দিন পর ঢাকায়। একটি ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে কিনলামÑ পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, মেরাজের গুরুত্ব, স্বামী-স্ত্রীর মহব্বত, হুজুর সা:-এর জীবনী, সময়ের গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে জনাব দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট।
প্রতিদিন ফজরের নামাজ অন্তে আমি ক্যাসেটগুলো শুনতাম এবং আমার স্ত্রী ও সন্তানকে শোনাতাম। আমার শিশুসন্তানটি তখন মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। ছেলে আমার ক্ষণে ক্ষণে জায়নামাজ নিয়ে বসে পড়ত এবং নিজের ছোটখাটো চাহিদার কথা আল্লাহর কাছে বলত। আর প্রার্থনা করতÑ হে আল্লাহ তুমি আমাকে এবং আমার বাবাকে ওলি আল্লাহ বানিয়ে দাও। দূরে দাঁড়িয়ে আমি ছেলের মুনাজাত শুনতাম এবং চোখের পানিতে বুক ভাসাতাম। এর কিছু দিন পর আব্বা এলেন আমার বাসায় বেড়াতে। আমি আব্বাকে শোনানোর জন্য সাঈদী সাহেবের পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সংক্রান্ত ক্যাসেটটি ছেড়ে দিলাম। বাপবেটা একসাথে টেপ রেকর্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে শুনলাম। দু’জনই কাঁদছিলাম হয়তো আমার আব্বা স্মরণ করেছিলেন তার পিতা-মাতাকে আর আমি স্মরণ করছিলাম আমার জনক-জননীকে। আমি আব্বার দিকে অশ্রুভেজা চোখে তাকালাম মনে হলোÑ আহা! এই তো আমার জন্মদাতা! কত কষ্ট করে আমাকে লালন করেছেন। বড় করেছেন! আমি অবশ্যই পিতা-মাতার অবাধ্য হবো না। আমার মনের ইচ্ছা হলো আব্বাকে সেবা করার জন্য। ইচ্ছে হলো তাকে ভালোমন্দ কিছু খাওয়াই।
বাজারে গেলাম। আব্বার পছন্দের তরিতরকারি মাছ গোশত কিনলাম। স্ত্রীকে বললাম রান্না করো। আস্ত একটি মুরগি রোস্ট করো। আমার আব্বা সেটা খাবেন আর আমি বসে বসে দেখব। আরেক দিন মনে হলো আস্ত একটি ইলিশ মাছ কোপ্তা বানিয়ে আব্বার প্লেটে দেই। আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় যখন কাজগুলো করলাম তখন আমার সাথে আব্বার কেমন যেন একটি রূহানি বা আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল। আর তখন থেকেই মনে হতে থাকলÑ আমার ধনসম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা সব কিছুর মালিকই আমার পিতা। আমি এর পর থেকে কেবল আব্বার হুকুমের গোলাম হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে পেলাম। এর কয়েক বছর পর আব্বা হঠাৎ স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই রকমই ছিলেন। প্রায় ১২ বছর প্যারালাইজড পিতাকে সেবা করতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্ত হইনি। অফিসে আসার সময় সালাম করে আসতাম। আবার বাসায় ফিরে আব্বার মুখ না দেখে অন্য কারো দিকে তাকাতাম না। অসুস্থ আব্বা প্রায়ই বলতেন আমার ছেলে আমার হাজার তারার এক চাঁদ। আজো আব্বার কথা মনে হলে নিজের অজান্তে যেমন চোখের পানি চলে আসে তেমনি মনের মধ্যে বাজতে থাকে সাঈদী সাহেবের ওয়াজের মর্মবাণীগুলো।
মহান আল্লাহ পাক সব কিছু দেখেন এবং সব কিছু জানেন বলেই তার উপাধী সামিউন এবং বাছিরুন। নিশ্চয়ই তিনি বেখবর ননÑ ২০১৪ সালের বাংলাদেশ সম্পর্কে। সাঈদী-ভক্তরা হয়তো কোনো কিছুই জানেন না দুনিয়ার আদালত সম্পর্কে। কিন্তু আমার মতো লাখো-কোটি মানুষ যারা সাঈদী সাহেবের ওয়াজের মাধ্যমে আত্মার খোরাক পেয়ে জীবনধারা বদলাতে পেরেছেন এবং বিশ্বজাহানের রবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে শিখেছেন তারা হয়তো ধরে নিয়েছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে সাঈদী সাহেবের হয়তো ইমতেহান অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু ইমতেহানের সময় মানুষের জন্য বড় কর্তব্য হলোÑ আল্লাহ পাকের ফায়সালার প্রতি খউফ ও রিজ্জাসহকারে সন্তুষ্ট থাকা।
আমি আজকের লেখার প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। সাঈদী সাহেব সম্পর্কে বলতে গেলে শুধু এইটুকু বলেই শুরু করা যায়Ñ তিনি মহান আল্লাহ পাকের অপূর্ব সৃষ্টি। ইসলামের ১৪ শ’ বছরের ইতিহাসে আমি এমন কোনো মুফাসসির কিংবা মুহাদ্দিসের নাম শুনিনি যার বক্তব্য শোনার জন্য লাখ লাখ মানুষ একটি মাহফিলে হাজির হয়ে অসাধারণ নীরবতা নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে কুরআন ও হাদিসের মর্মবাণী শুনেছেন। একবিংশ শতাব্দীর অস্থির সমাজে কোনো একক ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর এমন কোনো ধর্মীয় নেতা নেই যার বক্তব্য জনাব সাঈদী সাহেবের চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ শোনে এবং অনুসরণ করে। পবিত্র কুরআনকে যারা আল্লাহর গ্রন্থ বলে মানেন ও বিশ্বাস করেনÑ তারা জনাব সাঈদীর গত চল্লিশ বছরের কুরআনি খেদমতকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন! আমার মনে হয় কুরআনের মালিকই উত্তম ফায়সালাকারী। কিন্তু রবের ফায়সালা তো নতুন এবং অদ্ভুত নয়Ñ তার সব সিদ্ধান্তই পূর্বঘোষিত। আমরা যারা আল্লাহকে রেখে অন্যকে মান্য করি বা উসিলা করি তাদের সম্পর্কে কুরআন বলেছেÑ ‘ইয়াবতাগুনা রব্বিহিমুল উসিলা’Ñ অর্থাৎ তোমরা যাদেরকে উসিলা হিসেবে মান্য করো- তারাই তো বিশ্ব রবের উসিলা করে থাকে। আজ যারা জমিনের বুকে উদ্ধত আচরণ ও অহঙ্কার করে বেড়ায় এবং জমিনের অবিচার ও অনাচার করে বেড়ায় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ পাকের সতর্কবাণী, যিনি দরাজ গলায় বাংলার আনাচে কানাচে পৌঁছে দিয়েছেন, সেই ব্যক্তিটি যদি মজলুম হয়ে পড়েন তবে তার মালিক তাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবেন সে কথাও কুরআনে বলা আছে বহু জায়গায় বহুবার। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদেরÑ আমরা জেনেও না-জানার ভান করি কিংবা দেখেও না-দেখার ভান করি। ফলে সবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন ফায়সালা এসে পড়ে তখন না পালাবার কোনো পথ খুঁজে পাইÑ না ভাগবার কোনো রাস্তার সন্ধান লাভ করতে পারি!
বিষয়: বিবিধ
১৪০৪ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গোলাম মাওলা রনি তিনি তার মুল কথাটি প্রকাশ করেছেন, এখন থেকে তিনি আরো বেশী গালাগালির মুখোমুখি হবে।
যাক, তাঁর পুরো বিশ্লষনটাই সুন্দর ও প্রাঞ্জল! আমিও ব্যক্তি জীবনে সাইদী সাহেবের ওয়াজ শুনে সঠিক রাস্তা পেয়েছিলাম। বর্তমান পৃথিবীতে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে সাইদী সাহেব আমার হৃদয়ের একটি বাতি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি তাকে আল্লাহর কারণে হৃদয়ের প্রতিটি অনুভুতি দিয়ে ভালবাসি।
রনী সুন্দর মনের কিনা জানি না। তবে সে এখন পড়াশুনা করে বলে মনে হয়। নি:সন্দেহে তার লেখা প্রশংসার দাবীদার। তবে তার জন্য আমারও করুণা হয়, জানি না তার এই লেখার উদ্দেশ্য। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন তখন দুষ্টদের দিয়েই তিনি দ্বীনের খেদমত করান। দু'আ রইল আল্লাহ তায়ালা যাতে রনীর এই তৎপরতাকে কবুল করেন আর হেদায়েতের পথে পরিচালিত করেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন