সিলভারক্রিক ফলস (ছবি আছে)
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৩ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:১৬:৪৪ রাত
এক রৌদ্রজ্জ্বল রবীবারে সিলভারটন সিটির সিলভারক্রিক ফলসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ওরেগনের জেফারসন সিটির ভেতর দিয়ে যখন চলছিলাম অসাধারণ লাগছিল। মনে হচ্ছিল মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ এক্স.পী’র বাই ডিফল্ট ডেস্কটপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। জেফারসন একটি পুরাতন শহর। এই এলাকার অধিকাংশ অংশ জুড়েই বিশাল বিশাল ফার্ম হাউস। ওরেগনে পৃথিবীর অধিকাংশ ঘাসের চাষ ও এর গবেষণা হয়। এখান থেকে পৃথিবীর অধিকাংশ ঘাসের বীজ রফতানী হয়। পাহাড়ী উচু-নীচু এবং সমতল ভূমীতে মাইলের পর মাইল চাষ করা ঘাসের ক্ষেত দেখলে যে কেউ আনন্দে ডিগবাজী খাবে। অতি চমৎকার সমৃন রাস্তা এবং তার দুধার দিয়ে সবুজ ঘাসের ক্ষেত, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ওরেগনে বছরের মাত্র এক/দু মাস বাদ দিলে সারা বছরই বৃষ্টিপাত হয়। তবে সেটি ভারী বৃষ্টিপাত নয়। কখনও মেঘ,কখনও বৃষ্টি,কখনও রোদ। এই প্রদেশটি খুবই সবুজ শ্যামল। রাস্তায় চলার সময় সবুজ ঘাসের মন মাতানো ক্ষেত ছাড়াও ফুলের গাছ,পাইন গাছের সারী,আঙ্গুর-আপেলসহ নানান ফলমূলের ক্ষেত চোখে পড়বে।
সুন্দর রাস্তা ধরে চলার সময় দেখলাম খুবই সুন্দর সুন্দর ফার্ম হাউস। এরা চাষাবাদের ক্ষেত্রে একেবারে যন্ত্রপাতি নির্ভর। উপায় নেই, কারন মানব লেবারের দাম অনেক বেশী। একজন দাষী বিশাল বিশাল সব যন্ত্রপাতি দিয়ে অল্প সময়ে চাষাবাদ করতে পারে। তবে চাষাবাদের সময় এরা শ্রমিকও নিয়োগ করে,যদিও পরিমানে অনেক কম। বিভিন্ন রকমের কাজের জন্যে এদের বিভিন্ন রকমের গাড়ী ও যন্ত্রপাতি রয়েছে। সুন্দর ফার্মের ভেতর কৃষক মনোরম বাড়ি তৈরী করে। এদেশের চাষারা অনেক ধনী। বহু কৃষকের ব্যক্তিগত বিমানও রয়েছে। অনেকের একাধীক ফার্মে একাধীক বাড়ি রয়েছে,তারা একেক সিজনে একেক বাড়িতে বসবাস করে। এরা হাসতে খেলতে এবং আনন্দে জীবন পার করে।
পাহাড়ী আঁকা-বাঁকা রাস্তায় চলে আসলাম। এখানে প্রকৃতি আরও সুন্দর। দুদিকে পাহাড়,তার মাঝ দিয়ে মোটামুটি প্রশস্ত এবং অতি সুন্দর রাস্তা চলে গেছে। পাহাড়গুলো সবুজ এবং এখানে বিশাল বিশাল পাইন গাছের জঙ্গল রয়েছে। পুরোটাই পরিকল্পিত। প্রতি বছর এরা পাহাড় থেকে গাছ কাটে এবং নতুন গাছ রোপন করে। বিভিন্ন স্তরে এরা বনভূমী সাজিয়েছে। যে অঞ্চলের বৃক্ষ বেশী পুরাতন হয়েছে সেখান থেকে কাটা হয়। পরের বছর উপযোগী হওয়া আরেকটি স্থান থেকে কাটা হবে। কয়েক যুগের পুরোনো বিশাল বিশাল গাছগুলো বানিজ্যিকভাবে কাটা হয়। পাহাড়ী অথবা সমভূমী সকল স্থানেই তা পরিবহনের জন্যে বিশাল বিশাল ট্রাক এবং ট্রেন রয়েছে। কাঠ বহন করার জন্যে ট্রেনে যথোপযুক্ত বগী সংযুক্ত করা হয়। বগীগুলো মূলত: খোলামেলা এবং চারিদিকে লোহার এঙ্গেল দিয়ে বড় গাছের কান্ডকে আকড়ে রাখা হয়। একেকটি বগীতে বিশাল পরিমান গাছের কান্ড একটার উপর আরেকটা রাখা হয়। আর একেকটি ট্রেনে প্রায় শ’খানেক বগী সংযুক্ত করা হয়। এগুলো লম্বায় মাইলেরও বেশী। সেগুলো বিশাল বিশাল কারখানায় চলে যায় সিজনিং এবং নির্ধারিত পরিমাপে কাটার জন্যে। এগুলো ঘরবাড়ী তৈরীসহ নানান কাজে লাগানো হয়।
বিশাল বিশাল আকারের পাইন গাছ চারিদিকে। শুনশান নিরবতা ভেঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। চমৎকার সর্পীল রাস্তা, সবুজ শ্যাওলা জমা শতবর্ষী গাছপালা,বনের মধ্যে আলো-ছায়ার লুকোচুরী,আর কি চাই ? এই অদ্ভূত প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যেতেই ভাল লাগে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটি প্রধান আকর্ষনীয় বনে চলে আসলাম। এখানে ঘন সন্নিবেশিত বিশাল বিশাল পাইন গাছের সারী। প্রচন্ড মোটা এবং সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে সেগুলো। রেইন ফরেস্ট,তাই গাছের গায়ে সবুজ স্যাতসেতে শ্যাওলা এবং আরও নানান পরগাছার বসবাস। এগুলো যেন গাছের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গরমেও রেইন ফরেস্টে ঠান্ডা লাগে। যদিও আজ রৌদ্রজ্জ্বল দিন তারপরও এখন শীতের সময়, তাই ভারী ওভারকোট সাথে এনেছি।
গাড়ী থেকে নামার পরই বুঝলাম ঠান্ডা শুরু হয়ে গেছে। ঠান্ডা বাতাশ বইতে লাগল। এখানে একটি কাঠের গেস্ট হাউস এবং রেস্ট হাউস রয়েছে। অনেকে অনেক পয়সা খরচ করে প্রাকৃতিক পরিবেশে এই কাঠের বাড়িতে রাত কাটায়। বিষয়টা অবশ্যই রোমাঞ্চকর। এখানে অনেকে পিকনিকে আসে। স্থানটাকে বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। একটি বিশাল ডাইনিং হল রয়েছে,যেখানে অনেক মানুষ একসাথে বসে খেতে পারবে। রান্নার সকল ব্যবস্থা রয়েছে। একটি ছোট পাহাড়ী নদী দূর থেকে এসে এখানে শতাধীক মিটার উপর থেকে পতিত হয়ে নতুনভাবে চলতে শুরু করেছে। নদীর উপরে একটি মনোরম কাঠের সেতু। তার ওপারে চমৎকার সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ এবং তার চারিদিকে ঘন জঙ্গল। অপূর্ব পরিবেশ। অতি সুন্দর রাস্তা চলে গেছে এদিক সেদিক,এঁকে বেঁকে। সেসব রাস্তায় চলতেই মজা লাগে। হারিয়ে যেতে ভাল লাগে। সে রাস্তায় চলার সময় হঠাৎ এক বিশাল সাইজের কুকুরের সাক্ষাৎ ঘটল। আমি বেশ ভয় পেলাম,এটা একেবারে বাঘ সাইজের। জীবনে প্রথমবার এরকম কুকুর দেখলাম। কুকুরটি আমার কাছে আসল,আর সাথে সাথে দূর থেকে এক ভদ্র মহিলা বলে উঠল-ভয় নেই,ও তোমার সাথে পরিচিত হতে গেছে। কুকুরটি আমার পায়ে শুকে শুকে পরখ করছিল,আমার তখন ভয়ে অবস্থা কাহিল কিন্তু মুখে ছিল হাসি। অবশ্য আমেরিকান কুকুর বলে কথা। আকার যেমনই হোক না কেন,এরা বিড়ালেও অধম। কয়েকটি বড় সাইজের কুকুরকে বিড়ালের ভয়ে ভীত হতে দেখেছি। এরা এমন আদরে কুকুরদেরকে লালন পালন করে ,যে এরা ডাকাডাকিও তেমন করে না। কুকুরগুলোকে ছোটবেলা থেকেই এভাবে বড় করে তোলা হয়েছে। এরা সকলকে বন্ধু মনে করে। এমনটি বিড়ালকেও কিছু বলে না। সারা জীবন দেখেছি কুকুরকে দেখলেই বিড়াল ভয়ে গাছে ওঠে,আর তখনও কুকুর গাছের নীচে দাড়িয়ে মহড়া নিতে থাকে। দেশে কুকুরের মারামারি দেখার জন্যে দুই কুকুরের মাঝে একটা মাংসের হাড় ছুড়ে মারতাম,মুহুর্তেই তারা কামড়া-কামড়ী শুরু করত এবং যে জিতত সেই’ই হাড়টির দখল নিত। কিছু দিন আগে এক বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে সে বাড়ির দুই কুকুরের মাঝে এক টুকরো খাবার ছুড়ে দিলাম,উদ্দেশ্য মারামারি দেখব। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে দুই কুকুরই শান্ত থাকল এবং এক কুকুর ধীরে সুস্থ্যে খাবারটি খেয়ে নিল। বুঝলাম প্রতিনিয়ত ভাল ভাল খাবার পাওয়ার কারনে এরকম। আমাদের দেশের কুকুরদের বেশীরভাগই বেওয়ারিশ ,খাওয়া দাওয়া পায়না, তাই স্বভাবের পুরোটাই প্রকাশ করতে তাদের একটুও বাধেনা। যাইহোক কুকুরটার মালিক এসে তার দখল নেওয়ার পর স্বস্তি পেলাম। আবারও ফুরপুরে মেজাজে ঘুরঘুর করতে থাকলাম,আঁতাবাঁকা রাস্তায়।
গোলাকৃতির রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে লাগলাম। নীচ থেকে জলপ্রপাত দেখতে বেশী ভাল লাগে। এটি পাথুরে পাহাড়। আগ্নেয় শীলা দ্বারা তৈরী। জলপ্রপাতের নীচের দিকের পাথর কেটে রাস্তা তৈরী করা হয়েছে,যাতে পর্যটকরা সেখানে দাড়িয়ে একেবারে নিকট থেকে জলপ্রপাত দেখতে পারে। রাস্তা ভেজা,কারন জলপ্রপাতের পানির ছিটা এখানে এসে পড়েছে। প্রচন্ড কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া এখানে। বিশাল বেগে জলরাশী নীচে আছড়ে পড়ছে। নীচে আরেকটি নদী হয়ে সেটা আরও বহুদূর গড়িয়ে চলেছে। চারিদিকে বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজী। কোথাও কোথাও বড় বড় গাছ বয়সের ভারে অথবা ঝড়ে উপড়ে পড়েছে। সেগুলো এতটাই মোটকৃতির যে নির্দিধায় তার উপর দিয়ে হেটে চলা যাবে। চারিদিকের চমৎকার প্রকৃতির ছবি তোলার সময় বারবার হাত পকেটে ঢুকিয়ে গরম করে নিতে হচ্ছিল। এমন মনে জচ্ছিল যেন আমি জমে গেছি। সত্যিই এমন হতে পারে। অতিরিক্ত ঠান্ডায় কখনও কখনও কোনো অঙ্গ জমে যেতে পারে,তখন সেটা অকেজো হয়ে যায়। এজন্য অতিরিক্ত ঠান্ডায় ঝিম মেরে না থেকে শরীরের অঙ্গ সমূহ নাড়াচাড়া করা উচিৎ।
প্রচন্ড ঠান্ডা পানির ঝাপটার মধ্যেও জলপ্রপাতের নীচের অংশে গেলাম। সেখানে দাড়িয়ে পানির গর্জন শুনে ভয় করতে লাগল। ঠান্ডা পানির ঝাপটার কারনে বেশীক্ষণ দাড়ানো সম্ভব হলনা। তবে বার বার জলপ্রপাতের দিকে তাকাচ্ছিলাম। আমার সত্যিই ভাল লাগছিল। পা টিপে টিপে সাবধানে আবার উপরের দিকে উঠে আসলাম। এবার উপরে দাড়িয়েও জলপ্রপাতটি দেখলাম। সকল দিক থেকেই এটি ভাল লাগছিল। উপরে উঠে দেখলাম একই স্থানে দাড়ানো দুটি বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কেটে ফেলা অংশটি সমতল, তাই এক লাফে সেখানে গিয়ে উঠলাম,মূর্তীর মত দাড়িয়ে চারিদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। কিন্তু এটি ছিল পিচ্ছিল এবং লাফ দিয়ে নামার সময় আমার পা পড়ল একটি কাটাপূর্ণ লতার উপর। মুহুর্তেই আমি একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেলাম কিন্তু শেষ সময়ে বিশেষভাবে সামলে নিলাম। তারপরও বেশ ব্যাথা পেলাম হাতে এবং হাতের কয়েক স্থানে বুনো কাটা ফুটে গেল। বুঝলাম পুলাপাইনের মত কাজটা করা ঠিক হয়নি,কিন্তু আমি এসব না করে মজা পাইনা। ঘুরতে আসলে মজাটাই আসল। সত্যিই স্থানটা খুব ভাল লাগল, মন ভরে গেল।
কিছুদিন পর ব্যপক তুষারপাত শুরু হল,যা গত কয়েক দশকেও হয়নি। সেসময় শুনলাম কিছু লোক সিলভারক্রিক ফলস দেখতে গিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে একজন আমার লাইনের। সে জলপ্রপাতের খুব কাছাকাছি গিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। আর অমনি পা ফসকে নীচে পড়ে যায়। পতনটা হয়েছিল পাথরের উপর,সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। তাই জনৈক কবি বলেন-ভাবিয়া করিও কাজ ,করিয়া ভাবিও না।
বিষয়: বিবিধ
১৫৬৮ বার পঠিত, ৪৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর কাহিনীর জন্য ধন্যবাদ। আবার আসার ইচ্ছে আছে।
তয় আপ্নি মাশাল্লাহ, ফার্স্টক্লাস।
মন্তব্য করতে লগইন করুন