লেখা প্রতিযোগীতা-" আমার পিতা"
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ৩১ মার্চ, ২০১৪, ০৯:৩৩:৩২ সকাল
পিতার বিষয়ে লিখতে বললে লেখাটা খুব সহজে ছোট বানানো যায়না,তা সে যেমন ধরনের পিতাই হোক না কেন। বহু দিনের বহু রকমের স্মৃতি পিতাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। আজ যখন আমার পিতার ব্যাপারে ভাবছিলাম তখন বার বার দূর অতীতে ফিরে গেছি। নানান রকম সুখ-দু:খের বিষয় মানস পটে ফুটে উঠেছে। আমি কথার গাথুনিতে পোক্ত নই,তাই হয়ত সুন্দর করে অনেক কিছুই বলতে পারব না। আজ পিতার ব্যাপারে আমার মূল্যায়ন কি,তা মনে হচ্ছিল। আমি আসলেই তা বলতে পারিনা। শুধু এতটুকু বলতে পারি, আমার পিতার আমার কাছে ভাল ছিলেন। সেই ভালোর রূপটাও আমি বিশ্লেষণ করতে মোটামুটি অক্ষম।
ইতোপূর্বে পাঠককে আমি আমার পিতার ব্যাপারে যে চিত্র দিয়েছি,তাতে নির্দয়-নিষ্ঠুর,কঠোর,হৃদয়হীন এক ব্যক্তির চিত্র ফুটে উঠেছে। এর বাইরেও আমার পিতার একটি রূপ ছিল,যা আমি পরে এসে আবিষ্কার করেছি কিন্তু প্রকাশের মত সুযোগ পাইনি।
আমার পিতা সেকালের আধুনিক এবং বেশ সচেতন এবং সম্মানিত মানুষ ছিলেন। তার ছেলেবেলা স্বাভাবিকভাবে কাটেনি। তিনি ছিলেন চরম স্বাধীনচেতা। স্কুলের ধরাবাধা নিয়ম তার ভাল লাগত না। স্কুল ফাকি দেওয়া এবং স্কুলের বই ছিড়ে বিড়ি বানানো ছিল তার কাজ। একটা সময় প্রতিদিন একটি করে বই ছিড়তেন। একটা বইএর দোকান ছিল,যার দোকানদার প্রতিদিন একটি করে বই বিক্রী করতে পছন্দ করত। প্রতি মাসে দোকানদার একবারে তার বইয়ের দাম পেয়ে যেত। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হওয়ার কারনে তার দিকে তাদের নেক নজর ছিল বটে কিন্তু দাদী ছিলেন কড়া মেজাজের। স্কুল ফাঁকি,পড়াশুনায় ফাঁকি তিনি মানতে পারতেন না। তাই অসম্ভব পেটাতেন। এছাড়া প্রতিদিন নানান রকম শয়তানী,মারামারির পরিমান ছিল অনেক,আর এর ফলাফলও ছিল প্রতিনিয়ত পিটানি খাওয়া। তারপরও আমার পিতা তার দুষ্টুমি থামায়নি। দাদা ছিলেন সরল-সোজা ভাল মানুষ। আমার পিতা তার পিতার কাছেই আশ্রয় পেতেন। তাদের আভ্যন্তরিন সম্পর্ক ছিল উষ্ণ। কিন্তু দাদীর প্রতি ছিল তার মারাত্মক ভীতি। বিষয়টি ছোটবেলায়ই ছিল এমন নয়। আমি ছোটবেলায় দেখেছি,আমার দাদী লাঠি দিয়ে আমার পিতাকে হুমকি দিচ্ছেন কোনো এক ব্যাপারে।
বাল্যকালে তিনি ছিলেন মাইর-দাঙ্গাবাজ ধরনের,কিশোর বয়সে ব্যাপারটি প্রায় খুন-খারাবীর পর্যায়ে গিয়েছিল। সে সময়েই এলাকা ছেড়ে ভিন্ন এলাকায় আস্তানা গেড়ে নানান রকমের রোমহর্ষক কাহিনীর জন্ম দিয়েছিলেন,যেখানে ভাল-মন্দ দুটোই ছিল। যৌবনে আর্মী অফিসার হিসেবে ১৯৬৫সালে ভারতের বিপক্ষে এবং ৭১এ পাকিস্থানের বিপক্ষে তার বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি ছিলেন লড়াকু মেজাজের এবং আমাদের সাথেও তার সেই মেজাজই বর্তমান ছিল। আমাদের ৬ ভাই বোনের মধ্যে আমি ৫নং এবং প্রথম থেকে আমি পর্যন্ত প্রত্যেকেই আমার পিতার হাতে মাইর খেয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম আমার সর্বকনিষ্ঠ বোন। আমরা তার মধ্যে মায়া-দয়ার ছাপ দেখিনি তা নয় কিন্তু সেটার চরিত্র ছিল ভিন্ন। যার যা প্রাপ্য তিনি তাকে তা দিতেন,অন্যদের সাথে সু-আচরণও করতেন কিন্তু আমাদের ছোটখাট ভুলকেও লাঠি দিয়ে মেরামত করতে চাইতেন।
সম্ভববত: আমার পিতা তার মায়ের কাছ থেকে বেশী বৈশিষ্ট্য পেয়েছেন,কারন তিনি ছিলেন সাংঘাতিক ধরনের নারী,আর তার ধকল আমাদের সকল ভাই-বোনদের উপর চলেছে। আমাদের প্রত্যেক ভাই-বোন পিতার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। ছোট-খাট ব্যাপারেও তিনি ছাড় দিতেন না। বড় দুই বোনের বিয়ে হওয়ার পর এবং তাদের একাধিক সন্তান হওয়ার পরও তাদেরকে কখনও কখনও হুককি ধামকি এবং চড় থাপ্পড় দিতে অগ্রসর হতে দেখা গেছে। দুলাভাই’রাও তার সামনে সর্বদা কাচুমাচু অবস্থায় থাকত। আমি কখনও তার সামনে তাদেরকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে দেখিনি। অন্য মানুষেরাও বিনা বাক্য ব্যয়ে তার কথা মেনে নিত,অবশ্য তিনি অন্যায় কিছু বলতেন না। তিনি বিচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ন্যায় নিষ্ঠ ছিলেন এবং আপন-পর বিচার করতেন না। সত্য কথা বলার ক্ষেত্রে কখনই কাওকে পরোয়া করতেন না। কে কি মনে করবে,এর প্রতিক্রিয়া কি হবে,তা জীবনেও ভাবেননি। এতে তার অনেক সময় ক্ষতি হয়েছে,তারপরও তিনি নির্ভীক সত্যবাদী ছিলেন। একবার তার প্রতিপক্ষ এক ক্ষমতাশালী লোক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর আনন্দ মিছিল করে অগ্রসর হলে তিনি সকলের সামনে তাকে ঝাড়– ছুড়ে মেরেছিলেন,কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেনি। অনেকবার তাকে হত্যা চেষ্টা হয়েছে,এমনকি একবার গভীর রাতে সন্ত্রাসীরা আমাদের বাড়ী আক্রমন করে লুট করে এবং আমার পিতাকে দৈহিক অত্যাচারের পর পরিবারসহ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে বড় সাইজের একটা বোমা ছুড়ে মারে,শেষ মুহুর্তে আমার পিতা সেই ছুড়ে দেওয়া বোমা ধরে ফেলে এবং তা খাটের উপর ছুড়ে মারেন। সেটি বিস্ফোরিত হয়ে তিনিসহ আমার মা এবং বোন অল্প আহত হয়,এরপরও তিনি দমে যাননি।
আমি যখন সম্ভবত: নবম শ্রেণীতে, তখনও একবার সন্ত্রাসীরা হত্যার চেষ্টা করেছিল। তারা ভুল করে আমি এবং আমার ভাই যে ঘরে ঘুমাতাম সেটাকে লক্ষ্য বানায় কিন্তু আমরা বুঝে ফেলাতে তারা চলে যায়। তার শত্রু ছিল,সে যাই হোক....
আমাদের সকলের মধ্যে আমার ভাই তার হাতে সবথেকে বেশী মাইর খেয়েছে। আমার ভাই স্কুল ফাকি দিত এবং দুষ্টামিও করত,আর তার পরিনাম ছিল ভয়াবহ। প্রায়শই অবস্থা খুন খারাবির পর্যায়ে চলে যেত,বা অবস্থা দৃষ্টে সেটাই মনে হত। আমার উপরের বোনটাও মাইর খেয়েছে এবং আমার ছোটবোন মাইর না খেলেও প্রচন্ড বকা খেয়েছে। তবে আমার পিতার সাথে তার সম্পর্কই ছিল সবথেকে কাছের। সেটা বোধহয় এই কারনে যে,আমরা ভয়ে পিতার কাছে ঘেষতে চাইতাম না,আর তারও কখনও ইচ্ছা হত তার সন্তানদেরকে কাছে পেতে।
আমার মনে পড়ে,অনেক তুচ্ছ কারনেও আমাকে তিনি বকা দিয়েছেন। যেসব ক্ষেত্রে একটু ধৈর্য্য ধারন করে আমাকে বোঝানো উচিৎ ছিল ,সেসব ক্ষেত্রে প্রচন্ড ধমক আমাকে বিধ্বস্ত করে দিত। আমার চিন্তার জগত উলোট-পালট হয়ে যেত। পিতা মানেই ছিল এমন একজন ব্যক্তি,যার মধ্যে দয়া-মায়ার উপস্থিতি কম। কল্পনায় সে সময়ের এমন অনেক পিতার চেহারা ভেসে উঠছে,যারা তাদের সন্তানের প্রতি মারাত্মক কঠোর হওয়াকে বীরত্ব ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছে। এটাকে সন্তান লালন-পালনের একটি শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে তারা মনে করত এবং গর্ব অনুভব করত। কিন্তু তারা এর বিপরীতে তার জন্ম দেওয়া সন্তানের মানুষিক পরিস্থিতির বিষয়ে মোটেও ওয়াকিবহাল ছিলনা। সেটা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন এমনটাও মনে করত না। বাড়িতে ত্রাশ সৃষ্টির মাধ্যমে সন্তানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই আসল কাজ। এমনকি সন্তানের শিক্ষককেও নিষ্ঠুর হতে অনুরোধ করত। শুধুমাত্র ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনের এই কৌশল কিছু ক্ষেত্রে কার্যকরীও ছিল। সন্তানকে কখনও বিদ্রোহ করতে দেখিনি। সে নৈতিকতা-অনৈতিকতার মানদন্ড না বুঝলেও অন্তত এটুকু বুঝত যে,যেকোনো অবস্থায় পিতার আদেশ শিরোধার্য। আর এই নতজানু চরম বাধ্যগত সন্তানই ছিল সমাজের আদর্শ সন্তান। তাই পিতার যে কোনো ধরনের আগ্রাসী আচরণ সমাজ কর্তৃক শুধু স্বীকৃত ছিল এমন নয়,বিষয়টি বাহবার যোগ্যও ছিল।
আমি প্রতিনিয়ত বহু সংখ্যক পিতাকে বিভিন্ন আসরে তাদের সন্তানদের প্রতি রুঢ় আচরন করার গল্প শুনতে পেতাম। কোনো পিতা-মাতা তার দুষ্টু সন্তানকে পিটিয়ে জখম না করা পর্যন্ত অনেক সময় প্রতিবেশী থামাতে যেত না। অনেকে বলত-তার একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। কিন্তু তার শিক্ষার তার ছিড়ে যাচ্ছে কিনা এটা নিয়ে কেউ চিন্তিত ছিলনা। সমাজে খারাপ হওয়ার উপায় উপকরণ যথেষ্ট কম থাকায় তখনকার সন্তানরা পারিবারিক চরম অত্যাচার নির্যাতন সত্ত্বেও সাধারণত অবৈধ চিন্তা করতে পারত না। সামাজিক অবস্থার কারনে তাদের সাহস ততটা চোখে পড়েনি। অনেকের আত্মবিশ্বাস বলে কিছু অবশিষ্ট ছিলনা। অনেকে মুখে বলত আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব বা এই গেলাম,কিন্তু সকলেই জানত যে, সে সন্ধ্যায়ই ফিরে আসবে। অত্যাচারিত সন্তানদের যেন কোনো আশ্রয় ছিলনা। মুরব্বীরা ব্যপক অত্যাচারিত সন্তানকে এই বলে সান্তনা দিত যে,পিতা তো মঙ্গলের জন্যেই মারে,আর অপরাধটা তো তোরই...ইত্যাদী। পিতার কোনো অপরাধ বা ভুলের কোনো সংশোধনী ছিলনা। অথবা তার কোনো ভুল ধরা হতনা।
তবে পিতার মধ্যে একতরফা নিষ্ঠুরতা কাজ করত এমন নয়। নিজ সন্তানের প্রতি মায়া তাদের ছিল কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিল,সন্তানকে বেশী মায়া দেখালে সে বিগড়ে যায়,সে আদর্শ মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠেনা। সমাজে পিতার কমন চিত্র ছিল কঠোরতার মাধ্যমে শাসন। তবে আমি তাদের ভিন্নমুখী মায়াময়তার চিত্রও দেখেছি। সে সময়ের পিতার অন্তরের খবর নিশ্চয় আমি দিতে পারিনা। কোনো কোনো পিতা সন্তানকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে,সন্ধ্যায় আবার তিনি খবর নিতেন তার সন্তান ফিরেছে কিনা। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস ছিল যতই পেটানো হোক না কেন,তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে থাকবে,এরপর তারা ঘরে ফিরবেই। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সেসব সন্তানরা সন্ধ্যায়ই ঘরে ফিরত,পিতার রাগ পড়ে গেলে মায়া-মমতাও জেগে উঠত। অনেক সময় দেখা গেছে পিতার অত্যাচারে সন্তান বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। সন্ধ্যায় সে ফিরেনি,তখন পিতা’ই চারিদিকে হন্যে হয়ে খুঁজতে লেগে গেছে।
এক পিতার কথা মনে পড়ে, তার সন্তানকে সাধারণ কারনে অতিরিক্ত পিটানোর পর যখন সে রাতে ফিরল না এবং এদিক ওদিক খুঁজেও পেলনা। মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে লাগল। কেউ খবর দিতে পারল না। রাত বাড়ার সাথে সাথে পিতার মনে নানান অজানা আশঙ্কা দেখা দিতে থাকল। ইতিমধ্যেই তার মা বকুনী শুরু করেছে,পিতার উদ্দেশ্যে-“ওভাবে কেউ কাওকে পেটায়। গরুকেও তো কেউ ওভাবে মারে না। পালিয়ে তো ভালই করেছে। মরলেই বাচি।ইত্যাদী” কথাগুলো বলে মা আচলে চোখ মোছে। পিতার মন নরম হয়,চরম উদগ্রীব হয়ে খুঁজতে শুরু করে। একসময় কারো মাধ্যমে তার খোজ জানতে পেরে সেখানে অনুতপ্ত হৃদয়ে উপস্থিত হয়। সন্তানের গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে নানাভাবে সান্তনা দেয়। বলতে থাকে-তুই এসব করিস বলেই তো আমার মাথাটা ঠিক থাকেনা। আর সারাদিন খেটে বাড়িতে এসে এরকম অভিযোগ শুনলে কারো মাথা ঠিক থাকে ? বাবা তুই কিছু মনে করিসনে,চল বাড়ি চল। তোর মা বসে আছে। তুই যাবি তারপর সে ভাত খাবে। পিতা নিজেও যে ভাত খায়নি সেটা আর বলেনা। সন্তান কাঁদতে কাঁদতে বলে-আমি যাব না,তুমি যাও। ¯েœহময়ী পিতা আবারও তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে এটা সেটা কিনে দেওয়ার কথা বলে এক সময় রাজি করায়। হয়ত তাকে কোলে নিয়েই রওনা হয়। পরবর্তী কয়েকদিন বেশ ভালই কাটে,তারপর আবারও একই ঘটনার পূণরাবৃত্তী।
আবার অনেক পিতাকে তাদের সন্তানকে সর্বদা সমর্থন করতে দেখেছি। সেসব সন্তানদের কেউ ভাল কেউ মন্দ ছিল কিন্তু তাদের পিতাদেরকে কখনও রাগ করতে দেখিনি। অনেকে নিজের সন্তানদের কোনো দোষ খুজে পেতনা,বরং অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিত। এটা নিয়ে ঝগড়া একেবারে কম দেখিনি। আমার পিতা এমনটা ছিলেন না। কেউ আমাদের ব্যাপারে সাধারণ শয়তানরি উর্ধ্বে গুরুতর ধরনের অভিযোগ আনলেই তিনি আমাদেরকে ডেকে বিষয়টি ফয়সালা করতেন এবং পূর্বেই কোনো মন্তব্য করতেন না। আমি যখন সম্ভবত সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি তখন আওয়ালের পিতা আমার পিতার কাছে অভিযোগ করল,রাত ১২টার সময় আমি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে তার আখের খেতে ঢুকে আখ চুরি করেছি। আখ আমি পূর্বে চুরি করিনি তা নয়,বহু স্থানেই এ ঘটনা ঘটিয়েছি কিন্তু রাত ১২টা সময় এ কাজ আবার কখন করলাম ? আমার পিতা আমাকে জিজ্ঞেস করাতে বললাম আমি একাজ করিনি। তখন আওয়ালের পিতাকে ডেকে আনা হল,আমার হাটু কাপতে লাগল,তবে আমাকে দেখেই তিনি বললেন-এ নয়, বরং ওর বড় ভাই এই কাজ করেছে,আমি নাম ভুলে গিয়েছিলাম। আমার বড় ভাই কি কাঁচা,যে এমন মুহুর্তে সামনে থাকবে ?
এসব ক্ষেত্রে আমার আব্বার কমন ডায়লগ ছিল,তোদের কি আমি খেতে দেইনা ? আমি তো তোদের রাজার বাচ্চাদের মত খেতে দেই,তারপরও তোরা এসব খাওয়ার জন্যে একাজ করিস ক্যান ? বাপকে কিভাবে বুঝাই এসব কাজের মধ্যে যে এ্যডভেঞ্জার জড়িয়ে আছে,তার দাম হিসেব করা যাবেনা। পিতার উপদেশ একান দিয়ে শুনে ওকান দিয়ে ডেলিভারী করাই নিয়ম ছিল,তাই আমরা উপদেশ তেমন পাত্তা দিতাম না। তবে এর মানে এই নয় যে,আমাদেরকে ওভাবে পেটানো বা প্রচন্ড হুমকি ধামকি দেওয়া সর্বদা সঠিক ছিল। আমার যেটা মনে হয়,তা হল তখনকার পিতাদের সন্তান লালন-পালন করা সংক্রান্ত বিষয়ে তেমন ভাল জানা ছিলনা। তাদেরকে কোনো বিষয় সুন্দরভাবে বুঝিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা কোনো পিতাকেই করতে দেখিনি। এক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থার ঘটতি তো ছিলই। এটা করোনা-ওটা কোরোনা এমনটা ছিল সর্বোচ্চ,কিন্তু ওটা কেন করব অথবা করব না, সেটা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হতনা। আমার পিতা এবং আরও কিছু পিতা সাধারণত এ পর্য়ায়ে খুব একটা যেত না। তারা বেশীরভাগ সময়ে হুঙ্কার দিয়ে বলত-এটা করলে খুন করব,মাথা উড়িয়ে দেব,কুকুর দিয়ে রক্ত খাওয়াব,জবাই করব,কুরবানী করব,হাড় গোড় ভেঙ্গে ফেলব ইত্যাদী। এতে কখনও কখনও ভয় পেয়ে সেটা করতাম না বটে কিন্তু সুযোগ পেলে কমেও ছাড়তাম না। আবার এমনও মনে হত, পিতারা তো এমন বলেই,এটা মানলে চলেনা। ক্রমাগত হুমকী ধামকীতে অনেক সময় প্রচন্ড রাগ বা জিদ চাপত এবং বেশী বেশী খারাপ কাজ করে প্রতিশোধ পরায়নও হয়ে উঠতাম। আমার পিতা উপদেশ প্রদান করেননি তা বলছি না,কিন্তু যেভাবে আশা করা যেত,সেভাবে হয়ত পাইনি,আর কিভাবে আশা করতাম তাও বলতে পারিনা,কারন এটার ব্যাপারে ধারনাই ছিলনা।
আমি পিতার সম্পর্কে লিখতে লিখতে অনেক দূর চলে এসে আপনাদের ধৈর্য্যকে দীর্ঘায়িত করেছি। আমি আসলে জানিনা আমার লেখাটা ঠিক কেমন হতে হবে। আমার পিতার কঠিন কঠোর রূুপের বাইরে কোমল বিষয়ও ছিল। তিনি হাসিখুশীও ছিলেন। এলাকার বিভিন্ন বিচার সালিশের সময় তিনি মজার মজার কথাও বলতেন। আবার হাসতে হাসতেই হঠাৎ উঠে কোনো অপরাধীকে পেটাতে শুরু করতেন। এমন মাইর মারতেন যে আশপাশের অন্য গন্যমান্য লোকেরা অনুরোধ করে থামাত। মাইরের উপর ওষুধ নাই,এটা ছিল সর্বজন বিদীত কথা। এতে কাজও হয়েছে,তবে এতটা নির্দয় সবসময় হওয়া বোধহয় উচিৎ হয়নি। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখতাম অপরাধী আর অপরাধ করছে না,আর আমার পিতা অনেককে জীবিকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। স্থানীয় এক চরিত্রহীন ছেলে অন্যের স্ত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরী করেছিল। লোকটি একদিন হাতে-নাতে ধরে বিচার সালিশে তাকে নিয়ে আসে। অপরাধীর পিতাকে ডাকা হলে-তিনি সামাজিক লজ্জার ভয়ে আসেননি এবং বলেছেন,আমার ছেলেকে মেরে ফেল,আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার পিতাকে সেদিন পিটাতে দেখিনি,বরং অনেকে যখন তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল করছিল,পেটানোর কথা বলছিল,তখন তিনি তাকে কিছু উপদেশ দিচ্ছিলেন। সকলকে বললেন,তাকে যেন দ্রুত বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই ছেলেটি পরে চরিত্রবান ছেলে হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিল। এলাকার কিছু চোরকে আমার পিতাসহ কিছু লোক গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়েছিল এবং পরে তাদেরকে কর্মসংস্থানের জন্যে ব্যবস্থা করা হয়। তারা পরবর্তীতে আর কখনই চুরী করেনি এবং তারা পড়াশুনা না শিখলেও তাদের সন্তানদের সুশিক্ষিত করার ব্যাপারে তারা মরিয়া হয়েছে। দূর গ্রামের গরিব বিপদগ্রস্ত মানুষদেরকে আমাদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত আসতে দেখতাম। আমার পিতা কখনও অর্থ,কখনও সৎ পরামর্শ এবং সুপারিশের মাধ্যমে সাহায্য করতেন। অনেকের সমস্যা মিটে গেলে তারা তাদের বাড়ি থেকে মুরগী,গুড়ের ভাড়,আম-কাঠাল এটা সেটা নিয়ে হাজির হত। তখন তাদেরকে যত্মসহকারে আপ্যায়ন করা হত। বাইরের মানুষের সাথে আমার পিতার সম্পর্ক ছিল ভাল,কিন্তু আমাদের সাথে কেন যে এমন করত !
আমার পিতা মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন মারাত্মক ভোজন রসিক মানুষ। তার খাওয়া সম্পর্কে গল্পও প্রচলিত ছিল,যেমন-তিনি একবারে একটি খাসি খেয়ে ফেলতে পারেন। বিষয়টা এভাবে সত্য না হলেও তিনি কেজি কেজি মাংস খেতেন এবং অতিরিক্ত খেতেন। মিস্টির প্রতি ছিল তার দূর্বলতা। তিনি কেজি কেজি মিস্টি খেতেন। তাই বৃদ্ধ বয়সে যখন আমার বড় বোন তাকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল,ডাক্তার বলল-মিস্টি কম খাবেন। আমার বোন ডাক্তারের সাথে গোপনে দেখা করে বললেন-কম খেতে বললে তিনি এক কেজী খাবেন। বলেন-মিস্টি খাওয়া নিষেধ। ডাক্তার প্রেসক্রিমশনে লিখে দিলেন-মিস্টি খাওয়া নিষেধ। পিতা বললেন- ওই ডাক্তার কোথা থেকে পাস করেছে ? ওর প্রেসক্রিপশন এই ছিড়লাম। ওর আদেশের আমি ধারি ? তাকে অনেক বিখ্যাত ডাক্তারের কাছে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে গেলেও তাদের কথামত তিনি কখনই চলেননি। আর তার শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকার কারনে আমরাও তেমন গা করতাম না। কিন্তু একসময় যখন শরীর খারাপ হতে শুরু করল,তখন চাপাচাপি করলে,বাড়িতে মোটামুটি নিয়ম মেনে চলতেন এবং বাজারে গিয়ে অনিয়ম করতেন। কড়া স্বাদের মাংস ভূণায় উদর পুর্তি করে,মাকে বলতেন একটা শশা কেটে আনো,ডাক্তার শশা খেতে বলেছে।
মারাত্মক মিস্টি খাওয়ার পরও তার ডায়াবেটিস ছিলনা। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন তার পছন্দ না হলে সে অনুযায়ী তিনি আমল করতেন না। আর একটানা বেশীদিন তিনি ডাক্তারের কথামত চলতেন না। বড় মাছ,মাংস এবং চর্বির ভূনা তিনি পছন্দ করতেন। তিনি বহু রকমের রান্না জানতেন এবং তা বাড়িতে ফলাতেন। কোন মাছের কি কি পদ রান্না করা যায় তা আমরা পরখ করেছি বহুবার। কোন সিজনে কি কি খাবার খেতে হয় বা মজা লাগে তা শিখেছি। প্রচন্ড কড়া খাবার খেতেন তিনি। বেশী ঘুমাতেন আর হুইল দিয়ে মাছ ধরার নামে বন্ধুদের নিয়ে প্রতিনিয়ত পিকনিকে গিয়ে হইহুল্লোড় করতেন। যা মনে চাইত তাই করতেন। আবার এলাকায় কোনো ভাল বিষয়ে তিনি উদ্যোগ নিলে করে ছাড়তেন। মানুষকে কোনো কাজে ঐক্যবদ্ধ করে আনন্দ উৎসববের মধ্যদিয়ে কাজটি করে ফেলতেন। তিনি জাঁকজমক পছন্দ করতেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পূর্বের কঠোর সেই রূপটিতে খানিক ভাটাও পড়ে।
আমাদের কোনো ভাই-বোনের সাথে তার দহরম মহরম না থাকলেও দূর থেকে অনেকের সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আমি আর আমার ভাই তাকে দূর থেকেও ভয় পেতাম। শুরুতে প্রচন্ড ভয় পাবার কারনে পরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারেনি। আমার পিতা একসময় আমাদেরকে তার কাছাকাছি থাকাকে আশা করত কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। আমি জীবনে কখনও তাকে একবারের জন্যেও আব্বা বলে ডাকিনি। আমি তাকে ঘৃণা করতাম না,বরং তার নানান কাজের জন্যে পছন্দ করতাম। আমার প্রতি তার প্রবল ভালবাসা আছে সেটা খানিক বুঝতেও পারতাম কিন্তু তার কাছে যাওয়া সম্ভব হতনা। কোথায় জানি একটা বাধা ছিল।
কিছু ঘটনা মনে পড়ছে, স্কুলে পড়া কালিন সময়ে আব্বার সাথে দাবা খেলেছি বেশ কয়েকবার। আমি আমার গৃহ শিক্ষকের সাথে এবং আশপাশের কিছু লোকের সাথে ভাল দাবা খেলতাম এবং কয়েকবার হারিয়েছিও। তারা হারলে রাগান্বিত হত। আমার পিতা বলল-দাবার বোর্ড নিয়ে আয়,দেখী কেমন দাবা খেলিস। তিনি মনে মনে আশা করতেন আমি জিতি,কিন্তু একবারও জিততে পারিনি। রাজা চেক দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কিন্তু আমি তার মুখের দিকে না তাকিয়েই চুপ করে বসে থাকতাম। তখন জিজ্ঞেস করতেন আরেকবার খেলব কিনা। খেলতে ইচ্ছা না করলেও না বলতে পারতাম না। বলতাম হু(মানে হ্যা)। খেলতে খেলতে অনেক সময় পার হয়ে যেত। আমার নাকে সর্দী জমা হলেও ভয়ে বাইরে গিয়ে নাক পরিষ্কার করে আসতে পারতাম না,প্রচন্ড প্র¯্রাব লাগলেও চেপে বসে থাকতাম। অপেক্ষা করতাম কখন মা ডাকবে। মা ডাকলেই নি:শব্দে উঠে চলে যেতাম,তারপর মনে হত আত্মা দেহে ফিরে এসেছে। একইভাবে আব্বার সাথে ক্যারম বোর্ডও খেলেছি,তবে এটাতে আমি তার চাইতে দক্ষ ছিলাম। পড়াশুনা শেষ করার পর দু-একবার পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আমার ভাই,অন্য আত্মীয় এবং আব্বা মিলে তাশ খেলাও করেছি। কিন্তু সে সময়ও আব্বার সামনে পূর্বের মত চুপসে থাকতাম। কখনই তার সাথে সহজ হতে পারিনি,কেন জানি চেষ্টাও করিনি।
ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার পেটানো এবং ব্যপক হুমকি ধামকির ফলে এবং সকলে তাকে অত্যন্ত ভয় করার ফলে তার প্রতি আমার এমন ভীতি তৈরী হয়েছিল যে জীবনে কখনই তার সাথে সহজ হতে পারিনি। মনে পড়ে একবার এক ধমকে হিসু করে দিয়েছিলাম। তার সামনে পড়লেই আমার মুখ ফেকাশে হয়ে যেত,দম বন্ধ হয়ে যেত। দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চাইতাম। তিনি আমাকে তার কাজ করতে খুব একটা আদেশ করেননি। শুধু চাইতেন আমি যেন পড়াশুনা শিখে মানুষ হই। আমি তার আদেশ শুনতাম আমার মায়ের মাধ্যমে। তার সামনে দাড়িয়ে আদেশ উপদেশ শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম না। ছোটবেলায় তার অবাধ্য হলেও,অপছন্দ করলেও এস.এসসি পরিক্ষার পর যখন আমি ঢাকায় চলে আসি,তখন আস্তে আস্তে তার প্রতি আমার অন্তরের একটা টান অনুভব করতাম কিন্তু তা কখনই প্রকাশ করতে পারতাম না। আমার মায়ের কাছে একটু একটু করে জানতে চাইতাম তার অবস্থা। মাঝে মাঝে তার কথা মনে হত। সেই ছোটবেলা আমি তার পান খাওয়া দেখে পান খেতে চাইতাম,তখন তিনি চিবানো পান আমার মুখে পুরে দিতেন,আমার ভাল লাগত ঠোট লাল করতে। একবার আমার দাদী নদীতে গোসল করতে নিয়ে না যাওয়াতে নদীর দিকে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছিলাম,আমার পিতা আমাকে কাধে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল,আমার কান্না থামানোর জন্যে আরও কি সব করেছিল মনে নেই। প্রত্যেক দুপুরে আমি তার সাথে ঘুমাতাম। আমার ঘুম আসত না। আমি ট্রেনের গল্প শুনতে চাইতাম। আমি তার বিশাল শরীরের উপর উঠে বসেছি ,শুয়েছি এবং খেলাও করেছি এমনটা ভাসা ভাসা মনে পড়ে।
ঢাকাতে থাকার সময় তার কথা মনে পড়ত,আবার তার পেটানোর কথাও মনে পড়ত কিন্তু তখন আর পূর্বের মত রাগ হত না। মনে হত, না পেটালে আমি আসলেই লাইনে থাকতাম না। আমার প্রতি তার আদর ছিল ভিন্ন রকম। আমি কিছু খেতে চাইলে তা যত দামীই হোক না কেন তিনি তা দ্রুত ব্যবস্থা করতেন। আর আশা করতেন আমি যেন তার মতই খাই। নিজের খাওয়ার বিভিন্ন গল্পও করতেন। আমার সাথে হাসি তামাশাও দু-একবার তিনি করেছেন। একবার কোনো এক প্রসঙ্গে তিনি অন্যের সাথে বলছিলেন-কুঁজো কখনও চিৎ হয়ে শুতে পারে ? কুজো যদি চিৎ হয়ে শুতে চায় তবে কি হয় ? আমি পাশ থেকে বললাম-কুজো চিৎ হয়ে শুলে নৌকা হয়। এরপর আমার পিতার সে কি গগন বিদারী হাসি। হাসতে হাসতে শেষ। ছোট্ট একটা কথা, কিন্তু এই কথাটা অনেকের সাথে তিনি বলেছেন। অন্যের সামনে তিনি আমার ব্যাপারে বেশী বেশী প্রশংসা করতেন। আমার এটাতে খুব লজ্জা করত। তার কথামত চললে তিনি খুব ভাল বাসতেন এবং অন্যের সাথে গল্প করতেন আমার ব্যাপারে, কিন্তু আমি বেশীক্ষন ঠিক থাকতাম না। একা একা থাকলে তার অনেক কথাই আমার মনে পড়ত। আমি কখনই তাকে ফোন করিনি। আমি কখনই তার সাথে কথা বলিনি। কখনই জিজ্ঞেস করিনি- তুমি কেমন আছ ? যখন তিনি কথা বলতেন,আমি শুধু উত্তর দিতাম এবং সেটাও চরম সংক্ষেপে।
বাড়িতে গেলে বহু রকমের খাবার আয়োজন করতেন তিনি। সামনে না গেলেও পাশের ঘর থেকে জিজ্ঞেস করতেন কি খাবি ? আমি চুপ থাকতাম। তখন বলতেন-এই মাছের সাথে ওই তরকারী,ওটার সাথে সেটা,এই মাংসের ভুনা,ওই মাংসের ঝোল,ওমুক দোকানের ওই মিস্টি এসব চলবে ? আমি অনুচ্চ স্বরে বলতাম হু। আবারও জিজ্ঞেস করলেও বলতাম-হু। তখন মায়ের কাছে জানতে চাইতেন, সে কি রাজি ? মা বলত-হ্যা রাজি। আমের সময় অনেক রকমের আম নিয়ে কাছে ডাকতেন। আমি সামনে যেতে চাইতাম না। শেষে প্রচন্ড জোরাজুরির পর গেলে আম ছুলে দিতেন,আমি দম বন্ধ করে খেতাম। পরক্ষনেই দেখতাম আরেক ধরনের আরেকটি আম ছুলে প্রস্তুত করেছেন এবং মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বলতেন এই আমটা ওই গাছের,এর স্বাদই আলাদা। এভাবে অন্তত ৮/১০টি বিভিন্ন সাইজের আম খাইয়েও তৃপ্তী পেতেন না। আমি বলতাম আর পারব না। তিনি মানতেন না। শেষে মায়ের সাহায্যে উঠে আসতে হত। আমার বুঝতে কষ্ট হতনা যে,তিনি আম খাওয়ানোর অজুহাতে আমার সান্নিধ্য চাচ্ছেন। আমিও বুঝতাম তাকে সময় দেওয়া উচিত কিন্তু আমি তা পারতাম না। লজ্জা মিশ্রিত ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল।
একসময় তার সাথে সুসম্পর্ক তৈরীর জন্যে চিঠি লেখার বিষয়টি মাথায় আসল। মায়ের চিঠির মধ্যে তার ব্যাপারে জানতে চাইতাম এবং কিছু উপদেশও দিতাম। কিছু মজার মজার কথাও বলতাম। খুব ভোরে উঠে হাটতে যেতে বলতাম,তবে সেটা যেন ততটা ভোর না হয় যাতে মানুষ চোর ভাবতে পারে...ইত্যাদী। তার জন্যে দামী ব্রান্ডের পোষাক,জুতো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পাঠাতাম। ছোট বেলায় শুনতাম আমার পিতা ৫০ জোড়া জুতা ব্যবহার করতেন,তাই আমিও বেশী বেশী জুতো কিনে পাঠাতাম। একদিন মা আমাকে বলল-তোর আব্বা মানুষকে মজা করে বলে বেড়াচ্ছে,‘আমার ছেলে তো আমাকে জুতোয় জুতোয় নিকেষ করল’।
অন্য ভাই-বোনরা তার সাথে ভাল যোগাযোগ করছে কিনা তার খবর রাখতাম। আমি ছাড়া সকলেই নিয়মিত তার সাতে যোগাযোগ রাখত। তিনি কখনও কখনও আমাকে ফোন করতেন,কিন্তু আমি তাকে কখনও সালামও দেইনি। আমি তার কথার উত্তর হ্যা,না,হু ইত্যাদীর মাধ্যমে দিতাম। আমি বাড়িতে গেলে দূর থেকে তার দিকে তাকাতাম। তার শরীরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতাম এবং মা’র মাধ্যমে উপদেশ দিতাম।
জীবনের শেষ দিকে এসে এঘর ওঘর কথা বলে তিনি হয়ত তৃপ্তী পেতেন না,আর তার কথার বেশী বেশী রেসপন্স আশা করতেন। কিন্তু চরম লজ্জা,সংকোচ আমাকে তা করতে দেয়নি। আমারও কখনও কখনও ইচ্ছা হয়েছে কিন্তু ভেতর থেকে এক ধরনের বাধার কারনে তা পারিনি। তিনি অনেকবার বলেছেন,আমার সামনে একবার আয়, আমি যেতে পারিনি। আমার পা আটকে গেছে। আমি বড়জোর দরজা পর্যন্ত পৌছেছি। আমার মা অনেক অনুরোধ করলেও আমি তা পারিনি। তার প্রতি আমার ভালবাসা ছিল অগাধ, তা আমি অনেক পরে এসে বুঝেছি,কিন্তু তা কখনই প্রকাশ করতে পারিনি।
যখন তার শারিরীক অবস্থা ভাল মনে হচ্ছিল না এবং যখন একযোগে সকল ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন তাকে ঢাকায় যেতে বলল এবং কারপরও যখন তিনি গেলেন না,তখন আমি একরাত জেগে তার কাছে সরাসরি একটি চিঠি লিখেছিলাম। এটাই তার কাছে আমার লেখা সরাসরি কোনো চিঠি এবং অত্যন্ত ছোট ছোট অক্ষরে লিখলেও কিভাবে তা ১০ পৃষ্ঠা হল এবং কিভাবে রাত শেষ হল তা আমি বুঝতেই পারিনি। সেই চিঠিটি তিনি অত্যন্ত যত্ম সহকারে পড়ার পর চিকিৎস্যার জন্যে ঢাকা যেতে আগ্রহী হন। তার একমাত্র ভয় ছিল,যদি ডাক্তার তার কোনো বড় রোগ খুঁজে পায় তাহলে নানামুখী নীতি,ওষুধ,পথ্যে তার জীবন দূর্বীষহ হয়ে উঠবে। প্রচন্ড স্বাধীনচেতা মানুষটি তার জীবনকে সর্বোচ্চ উপভোগ করতে চেয়েছিলেন,সকল অবস্থায়,অবশ্যই হালাল পন্থায়। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্টটি আমাদেরকে তছনছ করে ফেলে। আমরা তাকে পুরো বিষয়টি না বললেও তিনি হয়ত কিছুটা আচ করতে পেরেছিলেন কিন্তু তারপরও পাত্তা দেননি এবং ডাক্তারের পরামর্শ মানেননি। তার লিভার সিরোসিস হয়েছিল।
এমতাবস্থায় আমি প্রযুক্তি সংক্রান্ত একটি কোর্স করতে চায়নাতে গমন করি,তখন বেশ বুঝতে পারি,তার প্রতি আমি কতটা দূর্বল। প্রায় প্রতি রাতে তাকে স্বপ্ন দেখতাম। কখনও দেখতাম তিনি মারা গেছেন। উৎকন্ঠিতভাবে বাড়িতে ফোন করতাম। একদিন দুপুরে চায়নিজ ম্যানেজারের কাছে শুনলাম আমার পিতা মারা গেছেন। আমার মাথা যেন হঠাৎ ফাকা হয়ে গেল। আমি জীবনে যেন প্রথম বারের মত বোকা হয়ে গেলাম। আমার চিন্তাগুলো স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রচন্ড শক্ত হৃদয়ের মানুষটি আমি হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেলাম। আমার বোন আমাকে ওই মুহুর্তে ঢাকায় আসতে বললেন। বললেন-সবকিছু ঠিক আছে,চিন্তা করার কিছু নেই। ভাবলাম আমাকে শান্তনা দিচ্ছে। আমি টিকেট কেটেই রওনা হলাম। সারাপথ আমার পেছনের বিভিন্ন ঘটনা মনে হতে লাগল। ছোট বেলায় আমার ঘুম ভাঙত তার উচ্চস্বরের কুরআন তিলাওয়াতে। প্রায়ই সূরা আর রহমান তিলাওয়াত করতেন। আমি ”ফাবি-আইয়িয়ালা ইরাব্বীকুমা তুকাজ্জিবান” আয়াতটি মুখস্ত করেছিলাম,পরবর্তীতে পুরো সূরাটি মুখস্ত করে ফেলি। তার হুমকির ভয়ে ছোটবেলায় মসজিদে যেতাম এবং পরে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। বলতেন,নামাজ না পড়লে খাওয়া বন্ধ। । তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আল্লাহর কাছে এই ফরিয়াদ করছিলাম,তিনি যেন তার যে কোনো একটি আমলকে পছন্দ করে তাকে ক্ষমা করেন এবং জান্নাত দান করেন। আলগোছে আমি চোখ মুছতে থাকলাম। একেকটি ঘটনা মনে পড়তে লাগল আর চোখ ঝাপসা হতে থাকল।
ঢাকায় পৌছে দেখলাম আব্বা তখনও জীবিত। চায়নিজ ম্যানেজার ভুল বুঝেছিল। আমার আব্বা কয়েকদিন যাবৎ কোনো রকম নড়া-চড়া করতে পারছিল না। দেখলাম তার শরীর মারাত্মক খারাপ। আমার বোন আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল- ভাইয়া এসেছে। কথাটা শোনার সাথে সাথে আব্বা প্রথমবারের মত নড়ে চড়ে উঠলেন এবং তাকালেন, যেন তিনি আমার অপেক্ষায় ছিলেন। তারপর তিনি মুখ দিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন,তার দুচোখ অশ্রুতে ভরে গেল। আমার দিকে তিনি তার দূর্বল হস্ত প্রসারিত করলেন। আমি তাকে ঝাপসা দেখলাম,বুঝলাম আমার চোখও অশ্রুতে ভরে উঠেছে। আমি তার হাত স্পর্শ করলাম। আমার মা আমাকে বললেন,অন্তত একবার আব্বা বলে ডাক। তোর মুখে একবার আব্বা ডাক শোনার জন্যে সে সারা জীবন অপেক্ষা করেছে। আমি সমস্ত শক্তি জড় করে ডাকতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আমার মুখ দিয়ে শব্দটা বের হয়নি। ইয়া আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন ! এরপর তিনি মোটামুটি সুস্থ্য হয়ে ওঠেন।
এর কিছুদিন পর যখন বাড়িতে গেলাম। তখন মনে হল তিনি আমার সাথে বেশী বেশী কথা বলতে চান। আমি তার পাশের ঘরে বেশী সময় ধরে বসে থাকতাম,যাতে তিনি দূর থেকে কথা বলতে পারেন। আমার ভাই শেষ সময়ে তার সেবা করার জন্যে ভেতরের সমস্ত দ্বীধা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিলেন। নিজের চাকুরী ছেড়ে এসে তার সেবা করেছেন। একসময় দেখলাম সে তার সাথে বন্ধুর মত গল্প করছে। অথচ আমাদের মধ্যে তার মত পিটানী আর কেউ খায়নি। শেষ সময়েও ডাক্তারের কথা তিনি মানতেন না,অবশ্য ডাক্তার পূর্বেই বলে দিয়েছে,তাকে বাড়িতে নিয়ে যান,তিনি আমাদের নাগালের বাইরে। আমার আব্বার চরম অবাধ্যতায় আমার মা হতাশ হয়ে এক সময় বলেই ফেলল-‘সে যা পারে করুক, কিন্তু বেঁচে থাকুক।’ আব্বার ভয়াবহ অবস্থার কথা আমরা আমাদের মাকে কখনই বলতে পারিনি। ভাবতাম একদিন নিজে এমনিতেই জেনে যাবে। তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক এতটাই সুখকর ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। চরম কঠিন স্বভাবের পিতা কখনই আমার মায়ের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে কথা বলেননি। একদিন তিনি বলেছিলেন,তোর মাকে কখনই কষ্ট দিবিনা। উত্তরে কিছুই বলিনি,কারন এই একটি স্থানেই আমি তার হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে বলতে পারি,আমার শরীর থেকে চামড়া কেটে তোমার জুতো তৈরী কর, উহ্ শব্দটি উচ্চারণ করলে হত্যা করো,কোনো অভিযোগ করব না।
শেষবার যখন বাড়ি থেকে চলে আসছি,আমার আব্বা সিঁড়ির ওপর বসে আছেন। সম্ভবত: আমাকে সরাসরি দেখার জন্যে। মনে হল এই প্রথম আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। আমি দেখলাম তিনি তার সমস্ত আকাঙ্খা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিষ্পলক সে চাহনীর দিকে আমি গভীর মমতা নিয়ে তাকালাম এবং তাকিয়েই থাকলাম। মনে হল আমার ভেতরের সমস্ত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে,নিজের সাথে যুদ্ধ করে আমার পিতার চোখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। তার সে দৃষ্টির ভেতর দিয়ে আমার প্রতি তার ভালবাসার তলহীন গভীরতা উপলব্ধী করলাম। শিঘ্রই তার দুচোখ অশ্রসজল হয়ে উঠল এবং আমি আবারও আমার কাছে পরাজিত হলাম। দৃষ্টি নত করে আমার পথ ধরলাম। এই অংশটুকু যখন লিখছি,তখন আমার পিতার সেই সুগভীর দৃষ্টির বিষয়টি অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে আমার মানসপটে ভেসে উঠেছে। এখানে লেখায় বিরতি নিলাম।
শেষের অংশটি যখন লিখছি,তখন আমার হাত ধরে আসছে। আমার লেখা সামনে প্রসারিত হচ্ছে কিন্তু আমি পেছনে ফিরে যাচ্ছি। আমার পিতাকে ঘিরে আমার স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করছে গভীরভাবে। অনেক স্থানে নিজেকে অপরাধী এবং বঞ্চিত,দূর্ভাগা মনে হচ্ছে। শুনলাম আব্বার অবস্থা মোটেও ভাল না। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। ধীরে ধীরে অবস্থার চরম অবনতি হতে থাকল। এখন আর আমার কাছ থেকে তার কোনো সেবা দরকার নেই। তিনি সেবার উর্ধ্বে। আমি শুধু দূর থেকে তাকে ভালবেসেছি।
এক রাতে মায়ের ফোন পেয়ে আমরা সকলে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। ইলেকট্রিক পাখা চললেও আমি হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকলাম, মনে হল অন্তিম মুহুর্তে ভালবাসার অভিনয় করছি কিন্তু আমার আর কিছু জানা ছিলনা। তার নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বাতাশ করতে করতে আমার হাত ব্যাথা হলেও আমি থামিনি। ভয়,লজ্জা,সঙ্কোচে সারাজীবন যার কাছে আসতে পারিনি,আজ তার কত কাছে নির্ভয়ে দাড়িয়ে আছি।
সকালে মা’সহ আমরা সকল ভাইবোন আব্বার বিছানার চারিপাশে বসলাম। দুই দিন মারাত্মক কষ্টে থাকার পর তিনি হঠাৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার হাসলেন। খানিক চোখ বন্ধ করে থেকে আবারও আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এরপর তিনি চোখ বন্ধ করলেন এবং আর কখনই তাকাননি। ইনিই আমার পিতা,যাকে দূর থেকে ভালবেসেছি। আমি তার এমন সন্তান হতে চাই,যাকে আল্লাহ ভালবাসবেন এবং যার পিতাকে সম্মানিত করবেন। আমি আমার পিতাকে প্রকৃত সম্মানিত অবস্থায় দেখতে চাই।
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৮ বার পঠিত, ৪৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মহান আল্লাহ আপনার পিতাকে তার প্রিয় বান্দাদের কাতারে শামিল করে নিক।
আপনি দেখুন আপনার বাবার চরিত্র ও মেজাজ যেভাবে বর্ণনা করলেন তাঁর জন্য দরকার ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীর মন মেজাজের মতো পেশা। আর তিনি তাই হয়েছিলেন। আল্লাহ আপনার বাবাকে অগনিত কল্যাণ দানে ধন্য করুন এবং সর্বোত্তম পুরষ্কারে ভূষিত করুন।
একবার পড়লাম, ঠিক অতটা ভেতরে ঢুকতে পারিনি। আরেকবার চিবিয়ে-চিবিয়ে পড়তে হবে।
তবে আপনার বাবার শাষণের ষ্টাইলের সাথে আমার বাবার শাষণের ষ্টাইলের অনেক মিল।
আল্লাহ্ ঊনাকে জান্নাতুল ফেরদাইস নসীব করুন।
আব্বুর যে গভীর ভালবাসা আদল আছে তা খুঁজে পেয়েছিলাম।
চমত্কার লেখা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন