আমেরিকাতে একটি চাকুরীর জন্যে যুদ্ধ
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৯ মার্চ, ২০১৪, ০৯:২৮:১৩ রাত
বাইরে থেকে আমেরিকা দেখা আর ভেতরে থেকে দেখার মধ্যে পার্থক্য অনেক। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আমেরিকা নিয়ে স্বপ্ন ভিন্ন রকম উচ্চতাসম্পন্ন। তারা ভাবে এখানে কোনোভাবে পৌঁছাতে পারলেই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হয়। বিষয়টি এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে আমেরিকার হাজার ঘটনা বর্ননা করলেও এবং বিশ্বস্ত মাধ্যমে তারা তা জানলেও এবং তা তাদের কল্পিত স্বপ্নের বিপরীতে গেলেও যদি সুযোগ তৈরী হয় আমেরিকাতে আসার,তাহলে অধিকাংশ লোকই এখানে আসতে রাজি হবে। এমনকি তাতে যদি তার ভিটা-মাটি বা শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে হয়,তবুও সে এতে রাজি হবে। এমনকি যদি সুযোগটি বৈধভাবে তৈরী না হয়,তবুও সে এই প্রস্তাবে রাজি হবে। যতক্ষন না তারা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত তাদের চৈতন্যদয় হবেনা।
ইউরোপ,আমেরিকা এবং মধ্য-প্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকুরীর জন্যে অবৈধ পথে গমন করার জন্যে বহু সংখ্যক লোক মরিয়া। অথচ যেসব কাজ চরম দায়িত্বশীলতা নিয়ে তারা এসব দেশগুলোতে করে,তা যদি নিজ দেশে করত এবং যে পরিমান টাকা তারা দালালদের হাতে তুলে দেয় তা দিয়ে ছোট খাট কোনো কাজ শুরু করত,তবে দেশেই এদের অনেকে ভাল কিছু করতে পারত। কিন্তু এরা তা করেনা। এরা ভাবে বিদেশে গেলেই টাকা হাতছানি দিয়ে ডাকে। মূলত: এসব কল্প কাহিনী এমনিই তৈরী হয়নি। যারা বিদেশে মানবেতর জীবন যাপন করে একটা সময় মোটামুটি মানের একটি কাজ পায় এবং কোনোভাবে বৈধতা পায়,তারাও দেশে ফিরে সমাজে নিজের দাম বাড়ানোর জন্যে নিজের অবস্থানকে উচ্চে তুলে ধরার স্বার্থেই নানান ঘটনা তৈরী করে রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করে।
আমি সৌদী আরব ফেরত একজনকে চিনতাম। তার বৈধতা ছিলনা এবং দীর্ঘদিন তার কাজ কর্ম ছিলনা,অবশেষে সে একটি বাড়ির দারোয়ানের চাকুরী পায়। দেশে তার অবস্থা মোটেও ভাল ছিলনা,জীবন যাত্রার মান ছিল খুবই নি¤œ মানের। তাই তার কাছে ওই চাকুরীটির মূল্যায়ন ছিল এই যে-সেখানে তার থাকার ঘরে এয়ার কুলার ছিল,ফ্রিজার ছিল,বিছানা ছিল আরামদায়ক এবং তার কাজ তেমন ছিলনা। শুধু খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমানোটাই যেন আসল কাজ। সে যখন মানুষের সাথে গল্প করেছে তখন সে তার এসব সুবিধার কথাই বর্ণনা করেছে। ফলে অনেক মানুষ তার কথা শুনে মনে মনে এক ধরনের স্বপ্ন তৈরী করে ফেলেছে। এমনকি আমি শুনলাম অনেকে তার কাছে জিজ্ঞেস করেছে সেখানে যাওয়ার কি উপায় এবং কতটাকা লাগবে। ভাবখানা এমন যে যদি সে বলত,আমাকে এত টাকা দিলে আমিই ব্যবস্থা করে দেব,তাহলে হয়ত অনেকে রাজি হত। অথচ অবস্থা হল এই যে, সেই লোকটি অল্প কিছু টাকা হাতে নিয়ে বাড়িতে এসেছিল,যা তার অথবা তার পরিবারের জন্যে মোটেও যথেষ্ট ছিলনা। আমার মনে হল তাতে তার কিছুই এসে যায় না,বরং এত বছর বিদেশে ছিল এবং এতটা সময় আরামে বা সুখে ছিল এটাই তার কাছে সুখকর। সুখস্মৃতিটাই তার কাছে আসল ব্যাপার। এ জাতীয় কিছু মানুষের বর্ণনার কারনে সমাজে বিদেশ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। আর এর ফল হয়েছে এই যে,অতি উৎসাহী লোকেদের অনেকে অবৈধ পথে বিদেশ যাবার পরিকল্পনা করেছে,অনেকে গমনও করেছে। অনেকে গন্তব্যে পৌঁছার পূর্বেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধৃত হয়ে কারাবরণ করেছে অথবা দেশে ফেরত এসেছে আবার অনেকে কঠিন এবং ঝুকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণও করেছে। কিন্তু তাতে অবৈধভাবে বিদেশ গমন থেমে থাকেনি।
আমার এক পরিচিত লোক একবার মালদ্বীপে যাবার জন্যে পাগল হয়ে উঠল। এর কারন হল অন্য দেশের থেকে এখানে প্রবেশ সহজ এবং এখানে চাকুরী করে অনেকে বিরাট অংকের বেতন প্রাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু খোজ খবর করে দেখলাম এই দেশটির তথ্য তার বহু পূর্বেই আমাদের দেশীয় দালাল চক্র জানে। আর সেসময়ে পত্রিকায় কিছু সচিত্র প্রতিবেদন দেখলাম যা দেশে সচেতন মানুষ শিউরে উঠবে,যদিও তখনও সেখানে আদম পাচার থেমে ছিলনা। সেখানে মোট জনগনের সংখ্যা ২লক্ষ ৭৫ হাজার,আর সেখানে ৭৫ হাজার বাংলাদেশী কাজের আশায় গমন করেছে। এছাড়া অন্য দেশেরও কিছু লোক আছে। তাদের অবস্থা এমন যে,না পাচ্ছে কাজ,আর না পাচ্ছে খাবার। মসজিদেও স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। মূলত: মালদ্বীপ একটি গরিব এবং খুবই ক্ষুদ্র দেশ,কিন্তু বিগত কয়েক বছর বা এক দশকের বেশী সময় ধরে সেখানে বিশ্ব বিখ্যাত কিছু কোম্পানী পর্যটন খাতে বিরাট বিনিয়োগ করেছে। কারন দেশটি অত্যন্ত সুন্দর। গত এক দশক ধরে সেখানে প্রচুর পর্যটক গমন করছে এবং এ কারনে পর্যটন খাতে কিছু কাজের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও কর্মরত বাইরের লোকের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা বেশী ,তারপরও বেশ কিছু বাংলাদেশী কর্মজীবীও সেখানে দীর্ঘদিন ধরে আছে। মালদ্বীপের ব্যাপারে আমার কাছে অনেক পূর্ব থেকেই চমকপ্রদ সব ঘটনা আসছিল। সেখানে যারা চাকুরী করছে তারা অনেক বেতন প্রাপ্ত হয়,জীবন-যাত্রার মান ভাল ইত্যাদী। কিন্তু বাংলাদেশীরা ওদিকে বানের পানির মত যাচ্ছে এমন খবর পত্রিকা না পড়লে জানতাম না। আর মালদ্বীপ বিশ্বে তেমন কোনো প্রভাব না রাখার কারনে এই দেশটির খবরও তেমন ছিলনা। তাই যখন শুনলাম এত অধিক পরিমান বাংলাদেশী সেখানে কাজের আশায় প্রবেশ করেছে,তখন সত্যিই অবাক হলাম। আর সেখানে যেসব লোকেরা গিয়ে বসে আছে,পর্যটন খাতে তাদের ঠিক কোথায় ফিট করা হতে পারে,এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারনা নেই। সম্ভবত এসব লোকেরা ওখানে গিয়ে বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। কারন এখনও পর্যন্ত তাদের প্রধান পেশা সাগরে মাছ ধরা। পর্যটন খাত থেকে তাদের কয়েক’শ কোটি ডলার উপার্জন হয় বটে কিন্তু এটা ছাড়া অন্য এমন কোনো খাত নেই যেখান থেকে জনগণ ব্যপক ভিত্তিক আশা করতে পারে।
সেখানে অধিকাংশ লোকই গরিব,আর কিছু লোক ধনী বা স্বচ্ছল। যেহেতু জিডিপি হিসেবে করা হয় মোট উপার্জন সকল জনতার উপর ভাগ করে দিয়ে,তাই দূর থেকে জনগনের অবস্থা আচ করা যায় না। জিডিপি দেখে জনগনের প্রকৃত চেহারা হিসেবে করে শিক্ষিত আদমরাও ঠকে। এই দেশটির ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। শেষে অবস্থা এমন হয়েছে যে,বাংলাদেশীদেরকে দেশে সহি সালামতে ফেরত পাঠানোর জন্যে সেই দেশটির কর্তৃপক্ষ আইন-কানুন সহজ করে তাদেরকে বৈধভাবে ফেরত যাবার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। আর এতকিছু দর্শনের পর আমার পরিচিত সেই লোকটি তার বিদেশ গমন সংক্রান্ত অভিলাশের পরিসমাপ্তী ঘোষনা করেছে। তবে সকলে এভাবে চুপসে যায় না, অনেকে আরও বেশী উদ্যমী হয়ে সেখানে গমন করতে মরিয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার সেখানে গমন নিষিদ্ধ করার পরও এয়ারপোর্টের কিছু কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে প্লেনে চড়া যাচ্ছে এমনটাও শুনেছিলাম। আর ২০১৪ সালের মার্চ মাসের খবর হল,টাকার অভাবে বাংলাদেশে অবস্থিত মালদ্বীপের হাইকমিশন বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে,অথচ মাত্র ৭জন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়ে বারীধারার একটি নগন্য ছোট্ট বাড়িতে তাদের অফিসিয়াল কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছিল।
এসকল অবস্থা ইউরোপ-আমেরিকার ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। এখানে আসার জন্যে মানুষ আরও বেশী মরিয়া। আমার প্রতিবেশী,আত্মীয় স্বজনের কেউ কেউ মনে করেছে,যেহেতু আমি বিদেশ ভ্রমন করি,তাই বিদেশে যাবার উপাই আমারই ভাল জানা আছে। এক সকালে এক প্রতিবেশী ছোট ভাই ফোন করে বলল-চাচা আমি আপনাকে কিছু টাকা দিচ্ছি,আপনি আমাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেন। আমি যেন আসমান থেকে পতিত হলাম। পরক্ষনেই ভাবলাম এরা যদি ধরাশায়ী না হয় তবে কারা হবে ? তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলাম যে-কোনো দেশে যাওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। আর অবৈধভাবে কোথাও যাওয়া উচিত নয়,এতে অনেকে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। সে আমার কথা হয়ত ততটা বিশ্বাস করেনি,কারন সে কয়েক জনের উদাহরণ দিয়ে বলল-তারা তো সেখানে গেছে এবং ভাল আছে। আমি সম্ভাব্য সকল উপায় উপকরণ ব্যবহার করে তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছু দিন পর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম সে মালেশিয়া গমন করেছে। আরেক প্রতিবেশী ভদ্র মহিলা আমার সামনে তার পুত্রকে বলেছিল,এবার তুই তোর এই ভায়ের সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে যাস,আমি টিকেট কাটার টাকা দিয়ে দেব। আমি কিছু বলিনি,কারন তার ধারনা ওই পর্যায়েরই ছিল। তবে ভাগ্য ভাল যে ,তার পুত্রটি সুশিক্ষিত এবং জানে বিষয়টি আসলে কেমন। এভাবে কখনও কখনও আমি বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়ি। তবে পূর্বের থেকে মানুষ শিক্ষিত হয়েছে,তাই তারা বুঝতে পারে,আমি আসলে এমন ক্ষমতাশালী নই যে,তাদেরকে বিদেশ পৌঁছে দিতে পারি। তবে কেউ কেউ যে ইচ্ছা করলে এটি পারে,তা তারা বিশ্বাস করে। কারন এর প্রমানও তাদের কাছে রয়েছে। তবে আমার ক্ষমতা থাকলে এদেরকে অবশ্যই সাহায্য করতাম। জনসংখ্যা যে অভিশাপ নয়,তা জনগনের যোগ্যতা দেখে প্রমানিত হয়। বিশ্বের বহু স্থানে,বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে বাঙ্গালী আছে এবং তারা নানান গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করে যাচ্ছে। সরকারী যদি তোনো সুষ্ঠ নীতিমালার ব্যপকভিত্তিক বাস্তবায়ন থাকত,যেমন: শ্রমিক হিসেবে বা বিভিন্ন পেশায় যারা বিদেশে যেতে চায় তারা তাদের নির্ধারিত পেশায় প্রশিক্ষন নিবে,বিদেশী কোম্পানীর চাহিদানুযায়ী নিয়মানুযয়ী শ্রমিক গমন করবে,সরকার ভিসা এবং প্লেন ভাড়া বাবদ যে টাকা লাগে শুধু সেটাই নিবে। যদি শ্রম সংক্রান্ত বিষয়ে আলাদা একটি দক্ষ বিভাগ দক্ষতার সাথে পরিচালিত হত,তবে এই খাত থেকে বাংলাদেশ ব্যপক লাভবান হত। বর্তমানে শ্রম কল্যান মন্ত্রনালয় নামক একটি বিভাগ আছে, সেখানে আমি বেশ কয়েকবার বিভিন্ন মানুষের জন্যে গিয়ে কল্যানের বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। সর্বোচ্চ স্তরে গলদ থাকলে কোনো ডিপার্টমেন্টই চলতে পারেনা।
আমি যেভাবে ঘটনা বর্ননা করছি তাতে লেখা বিরাট আকার ধারন করতে যাচ্ছে। এবার আমি আপনাদেরকে আমার ঘটনা শুনাব। এটা না শুনালেও পারতাম কিন্তু আমার ঘটনাসমূহের মধ্যে অন্যের জন্যে শিক্ষা,সতর্ক বার্তা থাকতে পারে বলে মনে করছি। আমার দিনগুলো বরাবরই ভালভাবে কেটেছে,যদিও এর জন্যে আল্লাহর শুকরিয়া তেমন আদায় করা হয়নি। তবে আমার উপর থেকে আল্লাহ তার রহমত এবং বরকত কখনও প্রত্যাহার করেননি। এ কারনেই আমি ভাগ্যবান। আমার স্মৃতিসমূহের মধ্যে সুখস্মৃতিই আসল। দু:খের পরিমান কম ,আর আমি দু:খকে পাত্তাও দেইনা। কোনো দু:বোধ আমাকে সাধারণত হতাশ করেনা,অথবা খানিকক্ষন মন খারাপ হলেও পরক্ষনেই ভেতর থেকে একটা আলাদা আবেগ এসে আমাকে উদ্যমী করে ফেলে। এটাই আল্লাহর রহমত,আর তাই আমি সুখী মানুষ।
আমার দিনগুলো ঢাকাতে ভালই কাটছিল। বাড়িতে,অফিসে সর্বত্রই মর্যাদা পরিপূর্ণ ছিল। কর্ম জীবনের পুরাটাই অফিসিয়াল কর্মকর্তা ছিলাম। সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবেও সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করেছি। কিন্তু শেষে এসে পরিকল্পনাগত কিছু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লাম। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে বনিবনা হলনা। তার চিন্তা-চেতনা,নৈতিকতা,মূল্যায়ন এবং আমারটার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখা দিল। শিঘ্রই বিষয়টি খারাপের দিকে যেতে থাকল। ব্যাংক থেকে শত-কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ব্যাপারেও বিরাট মতপার্থক্য তৈরী হল। কল কারখানার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশের যে ব্যবসা গত দুই বছর ধরে একত্রে চালিয়েছি,তাতে শত ভাগ লোকসানের পর মন মানুষিকতায় কিছু পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল। একে একে কর্মচারীদের বিদায় দৃশ্যও ভাল লাগছিল না। তাই সবকিছু ছেড়ে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসাটাকেই উপযুক্ত মনে করলাম। কিন্তু আসার পর বুঝতে পারলাম,আমিও আমার সেইসব প্রতিবেশীর থেকে অন্তত বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে চিন্তা চেতনায় ততটা উন্নত ছিলাম না। আমি এখানে যা দেখেছি তা চিন্তার সাথে ততটা খাপ খায়না। কিন্তু হেরে যাওয়ার লোক আমি না।
আমি বরাবরই ব্যবসায়ী এবং আমার অভিজ্ঞতাও আছে এ ব্যাপারে। তরুন বয়স থেকেই পারিবারিক ব্যবসার সাথে ছিলাম,ফলে চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়ে অনিহা ছিল। অন্যের আদেশ মানতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে অফিস করতে হবে এটি মানতে পারিনি,কারন আমি প্রচন্ড স্বাধীনচেতা। মার্কিন মুল্লুকে ব্যবসা করার চিন্তা করে বুঝলাম এখানকার মার্কেট অল্প কিছু দৈত্য-দানব দখল করে বসে আছে। আমার মত ফকির ফাকরার কোনো বেইল নেই। তারপরও কিছু চিন্তা দাড় করিয়েছি। তবে চাকুরীটা যে জরুরী তা বুঝে ফেললাম। কারন এখানে জীবন যাত্রা ব্যয়বহুল। কিন্তু চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়ে আমার যা ধারনা ছিল তার ছিটেফোটাও দেখতে পেলাম না।
আমি দেখলাম সকল বড় কোম্পানীতে আবেদন করার পদ্ধতি হল ইন্টারনেট এবং তা শুধু নিজের বৃত্তান্ত শোনানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়,বরং তাদের পক্ষ থেকে নানামুখী প্রশ্নের নানান রকমের উত্তর প্রদান করতে হচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানী সেসব পশ্ন-উত্তর সেশনের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এভাবে তারা প্রার্থী সম্পর্কে একটি প্রথমিক ধারনা লাভ করে থাকে। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা শোভনীয় নয় বা আইনানুযায়ী বৈধ নয় কিন্তু সেসব ক্ষেত্রেও তারা নানান প্যাচে প্রশ্ন করে উত্তর জেনে নেয়। বর্ন,গোত্র,বয়স ইত্যাদী সম্পর্কে সরাসরি তথ্য জানতে চাওয়া নিয়মের মধ্যে না পড়লের তারা তা জেনে নেওয়ার জন্যে প্রশ্নের নানা রকম ফাঁদ তৈরী করেছে। তবে ধর্মীয় পরিচয় জানতে চায়না। এর কারন ধর্ম এদের কাছে কোনো আলোচ্য বিষয় নয়। এরা এসবের উর্ধ্বে। কিন্তু এক একটি কোম্পানীতে আবেদন করতে দুই ঘন্টা সময়ও লেগে গেছে। সিয়ার্স কোম্পানীর কথা মনে পড়লে জ্বর আসে। ৩ ঘন্টা সময় লেগেছিল তাদের অনলাইন প্রশ্ন এবং নানান সিচুয়েশনের ব্যাখ্যামূলক উত্তর প্রদানে। অনেক সময় মাথা হ্যাং হয়ে যেত।
প্রথমে চাকুরী খুঁজতে গিয়ে দেখলাম সোশাল সিকুইরিটি কার্ড ছাড়া আবেদনই করা যায় না। আবেদন করার দুই সপ্তাহ পর সোশাল সিকুইরিটি কার্ড পেলাম এর কয়েক দিন পর গ্রীন কার্ড পেলাম। এরপর উঠে পড়ে লাগলাম একটি সম্মানজনক চাকুরীর জন্যে। আমার ধারনা ছিল আমি খুব সহজেই একটি চাকুরী পেয়ে যাব। এখানে অনেক চাকুরী আছে এমনটাও মনে হয়েছিল। আমার যা অভিজ্ঞতা আছে তাতে একটি ভাল চাকুরী জোগাড় করা কঠিন কিছু হবে না। কিন্তু বাস্তবতার সংস্পর্শে এসে আমি প্রায় হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার বারবার মনে হতে থাকল ,যারা এদেশে অবৈধ এবং যারা অশিক্ষিত তারা চাকুরী কিভাবে পায় ? কারণ চাকুর পাওয়ার শর্তই হল সোশাল সিকুইরিটি কার্ড থাকতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ এসেছে এখানে,তারা কি করছে ? তারা কিভাবে চাকুরী পেয়েছে। আধা শিক্ষিত সেসব মানুষদেরতে দেশে গিয়ে যে ভাব নিতে দেখা যায় তা কি এখানেও প্রযোয্য ? তারা কি এখানে ভাল আছে ? তারা কি ধরনের চাকুরী করছে। প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় সকল শ্রেণীর চাকুরীতেই তথ্য প্রযুক্তির সাথে জানা শোনা থাকতে হয় দেখছি,তাহলে তারা কি করে এসব করল ? নাকি তারা চরম নিম্ন মানের এবং নিম্ন আয়ের চাকুরী বেছে নিয়েছে ? এসব চিন্তা করতে করতে মাথা নষ্ট হয়ে গেল। চরম অশান্তির মধ্যে সময় অতিবাহিত হতে থাকল।
কিন্তু আমি দমে যাইনি। প্রচুর আবেদন করার পরও ইন্টারভিউ নিতে কেউ ডাকল না দেখে চিন্তা করতে শুরু করলাম কোনো সমস্যা আছে কিনা। আবার এই চিন্তাও আসল যে আমি তো সেখানে লিখেছি আমি এশিয়ান,তবে কি এশিয়ানদের কোনো চাকুরী নেই ? চাকুরীর অভিজ্ঞতা লিখেছি,পেছনের সকল কোম্পানীর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছি,তবে কি বাংলাদেশী কোম্পানী এবং পড়াশুনার কোনো মূল্য নেই বলে ইন্টারভিউ নিতে আপত্তি ? এরকম নানান প্রশ্ন মাথায় আসতে লাগল। কিছু কিছু মানুষের সাথে শেয়ারও করলাম কিন্তু আমার সন্দেহ দূর হল না। কেবল মনে হতে লাগল কোথাও নিশ্চয়ই আমার ভুল হচ্ছে। মানুষ বলতে থাকল,তুমি মাত্র এক সপ্তাহেই ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছ কেন, অপেক্ষা কর এবং চেষ্টা করতে থাক। কিন্তু আমার মন মানেনা। আমি সব সময় অতিরিক্ত পরিশ্রম করে দ্রুত ফল আশা করি। তাদের কথায় স্বস্তি পেলাম না।
একদিন চিন্তা করলাম,আচ্ছা আমি অনলাইনে আবেদন করছি,এতে তারা তো আমাকে দেখতে পারছে না,তাহলে সরাসরি দৌড়ালে কেমন হয় ! যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন ‘কমকাস্ট’ নামক একটি বিশাল কোম্পানীর স্টোরে গেলাম কেনা-কাটার জন্যে। এরা আবার মেম্বার ছাড়া অন্যদেরকে কিনতে দেয়না। ওয়ালমার্টের মতই এটি,এদের আরও বহু অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তো, কেনাকাটার পর ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের কোম্পানীতে চাকুরী করার সিস্টেম কি ? কথাটা বলতে কেমন জানি লজ্জা করতে লাগল। কারন সামান্য ক্যাশিযার কি এই ব্যাপারে জানবে ? আবার অন্য কাকে জিজ্ঞেস করব তাও জানিনা। যাইহোক, ক্যাশিযার মহা ভদ্রতার সাথে বলল,আপনি কি অনলাইনে আবেদন করেছেন ? করলে আমাদের সার্ভিস ডেস্কে যান এবং সেখানে একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করুন। বললাম, আমি কর্পোরেট জবের জন্যে আবেদন করেছি। তিনি আমাকে স্টোর ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে বললেন। আমি খানিক পর তার সাথে কথা বললাম। তিনি বললেন, কর্পোরেট জবের জন্যে শুধুমাত্র অনলাইনেই আবেদন করতে হবে,আর আপনাকে চাকুরী করতে হবে ভিন্ন স্টেটে,আপনি সেটা ভেবে দেখেন। কর্পোরেট জবের পরিমান অনেক কম এবং আমরা বাইরের দেশ থেকেও লোক হায়ার করি কিন্তু গুরুত্ব প্রদান করা হয় তাদেরকে, যারা সমজাতীয় কোম্পানীতে পূর্বে একই ধরনের চাকুরী করেছে। বললাম,মার্কেটিংএ আমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে এবং এই বিষয়েই আবেদন করেছি কিন্তু ভিন্ন স্টেট দূরের কথা এই সিটির বাইরে যাওয়াও আপাতত সম্ভভ নয়,কারন আমার ব্যক্তিগত গাড়ী নেই। তিনি বললেন,আপনার উচিত স্টোরের কোনো পজিশনে আবেদন করা এবং পরে আপনি অন্য পোস্টে আবেদন করতে পারবেন। সেটা বেশী কার্যকরী হবে। ভদ্রলোকটির এই পরামর্শ যে কতটা বাস্তবসম্মত ছিল তা বলে বুঝান যাবে না। আসলে আমারও ঠিক এমনই কিছু একটা মনে হচ্ছিল- অনলাইনে আবেদন করার পরও নিশ্চয়ই আরও কিছু একটা করতে হয়,নইলে ওরা ভাবে,এমন কত জনই তো আবেদন করে প্রতিদিন। আমি আবারও আবেদন করলাম তবে ভিন্ন পোস্টে। পরের দিন সার্ভিস ডেস্কে যাবার পর আমার নাম,ফোন নং,আবেদনের তারিখ ইত্যাদী লিপিবদ্ধ করলাম। তারা বলল-আমরা এটা দেখব এবং আপনাকে ফোনে জানাব। তারা আমাকে ডাকেনি কিন্তু আমি একটি সিস্টোম শিখে গেলাম। এই বিষয়টি চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়ে আমাকে একটি বার্তা প্রদান করে এবং আমি তা খানিকটা বুঝতে পারি। নিয়ত করি,যে কোম্পানীর যে পোস্টেই আবেদন করিনা কেন, আমাকে উক্ত কোম্পানীর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে হবে। নইলে শুধু আবেদনের কোনো ভাত নেই। জীবন বৃত্তান্তে বাংলাদেশ নামক তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের নাম দেখে হয়ত অনেকে কাগজগুলো ফেলে দিবে।
এরপর যত স্থানে আবেদন করেছি,সারাসরি সেখানে ছুটে গেছি এবং আমার জীবন বৃত্তান্তের একটি কপিও তাদেরকে দিয়েছি। এরা হাসিমুখে সকল বিষয়ে সাহায্য করে। আমার মনে হল এটা কার্যকর পদ্ধতি। একইসাথে আমি ম্যানেজারের সাথেও সাক্ষাৎ করে আলাপ চালিয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু তারপরও কাঙ্খিত ফললাভ সম্ভব হলনা। একদিন ওয়াল মার্টের এক বয়ষ্ক ম্যানেজার আমাকে পরামর্শ দিল,তুমি অভিজ্ঞ কিন্তু যেহেতু আমেরিকায় তোমার চাকুরীর অভিজ্ঞতা নেই,তাই তুমি কোনো সাধারণ পোষ্টে আগে আবেদন কর এবং কিছুদিন চাকুরী করার পর একই কোম্পানীতে কর্পোরেট পজিশনে বা উপরের কোনো পোস্টে আবেদন কর,সেটাই ভাল হবে। কারন তুমি যেসব পদে আবেদন করছ,সাধারণত সেসব পদে এখানকার অনেক অভিজ্ঞ লোক আবেদন করছে এবং কোম্পানী অবশ্যই তাদেরকে অনেক বেশী প্রাধান্য দিবে। কারন তারা কোনো কোম্পানীতে ঢুকেই কাজ শুরু করতে পারবে,আর তোমার যত অভিজ্ঞতাই থাক না কেন কোম্পানী তোমাকে দিয়ে কাজ করানোর আগে প্রশিক্ষন দিবে। কারন তুমি উক্ত কোম্পানীর কালচারের সাথে অভ্যস্ত কিনা তারা তা জানেনা। আর যেহেতু বড় পদের বেতন বেশী তাই তারা অনেক বেশী বিছু আশা করে। এজন্যেই তারা অনেক সময় অন্য স্থান থেকে মানুষ হায়ার না করে নিজেদের তৈরী করা জুনিয়রদেরকে ধীরে ধীরে সিনিয়র হিসেবে উত্তরনের সুযোগ দেয়। ভদ্রলোকটি কর্ম ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও আমাকে এতটা সময় দিল এবং মারাত্মক সুপার কিছু উপদেশ দেওয়ার কারনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাকে বললেন,ওয়াল মার্টে আবেদন কর এবং সপ্তাহে দুই দিন এসে দেখা কর। এতে তারা তোমার চেহারা চিনবে এবং একদিন সবার আগে তোমাকেই ইন্টারভিউতে ডাকবে। তার এই উপদেশ সত্যিই অসাধারণ ছিল। এই কাজটি মার্কেটিংএর একটি সিস্টেমের মধ্যে পড়ে। একজন মানুষকে বার বার নক করলে বিরক্ত হয়,আবার বার বার নক করলে প্রডাক্টও বিক্রী হয়। বুঝতে হবে কখন কি আচরণ করতে হবে। আমি সিস্টেম শিখে ফেললাম।
এরপর ম্যানেজার,ডিরেক্টর পদে আবেদন না করে নীচের পোস্টে আবেদন করতে শুরু করলাম। বিভিন্ন কোম্পানীর ওয়েব সাইটে থাকা আমার প্রফাইল পরিার্তন,পরিবর্ধন করলাম। প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানীতে যাওয়া শুরু করলাম। সকল বিষয়ে নোট রাখলাম এবং লগইন নেম,পাসওয়ার্ডও লিখে রাখলাম। কেউ কেউ অনলাইনে আবেদন করতে বলল,আবার কেউ কেউ সেখানে বসেই আবেদন করতে বলল। এভাবে মাত্র ৩/৪ দিনের মধ্যেই ৪০টির মত কোম্পানীতে আবেদন করলাম। ফোর্ড,টয়োটা,হোন্ডা,হুন্ডাইসহ বেশ কিছু গাড়ী কোম্পানী,শেভরণ,শেল,প্লেন তৈরী করা এবং তার যন্ত্রাং তৈরীর কোম্পানী, বিভিন্ন রিটেইল স্টোর যেমন-কস্টকো,ওয়াল মার্ট,সেফওয়ে,ফ্রেড মায়ার,টার্গেট,হোম ডিপোসহ আরও কিছু কোম্পানী,কম্পিউটার প্রস্তুতকারী কোম্পানী সবখানে আবেদন করলাম এবং যেখানে সম্ভব দেখা করার চেষ্টা করলাম। স্যুট-টাই পরে বিশাল ভাব নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গমন করলাম এবং এতে লাভ হয়েছে।
ফোর্ড ,হোন্ডা এবং টয়োটা কোম্পানীর ইন্টারভিউতে মাত করলাম। তারা আমাকে অনেক সময় দিল এবং আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে ইন্টারভিউ সমাপ্ত হল। এদের মধ্যে ফোর্ড কোম্পানী আমাকে সাংঘাতিক পছন্দ করেছে। আমাকে তারা তাদের অন্দর মহলে নিয়ে গেল এবং আপ্যায়ন করল। আমি যখন ফিরে আসছি,তখন আবারও ডেকে একজন সেলস ম্যানেজারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল,আমি জব করলে কত টাকা বেতন চাই। এই প্রশ্নের উত্তর খুব টেকনিক্যালী দিলাম,তাতে আমার ডিমান্ড তারা বুঝল কিন্তু আমাকে পরে আর ফোন করেনি। আগামী ৩ মাস পর তাদের নতুন লোক দরকার হবে। আমাকে তারা লিস্টের শীর্ষে রাখছে এটা বলেছে। টয়োটা কোম্পানীও পছন্দ করেছে এবং আমাকে ২ মাস পর নিতে পারে বলল। একে একে অনেকগুলো কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিলাম এবং সকল স্থানেই ভাল করেছি। তারা যা জানতে চেয়েছে সেসব বিষয়ে আমি আগে থেকেই অভ্যস্ত। নিজেকে যেভাবে তুলে ধরলে একটি কোম্পানীর লোকেরা খুশী হয় সেভাবে তুলে ধরতে থাকলাম এবং তারা আমাকে পছন্দ করেছে। যে কোনো কোম্পানী সবশেষে ছেড়ে আসা চকিুরীর ব্যাপারেই জিজ্ঞেন করে এবং এটিই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমি পূর্বে কোন বিষয়ে কাজ করতাম,আমার দক্ষতা কতটুকু ছিল সেটাই তারা কথোপকথনের মাধ্যমে জেনে নিতে চায়। আমি কোম্পানীর ডিরেক্টর ছিলাম,সে বিষয়টি চেপে গিয়ে নিজেকে একজন অন্যতম উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বানিয়ে সকল স্থানে কথা বলেছি,এটাই যুক্তিযুক্ত ছিল,নইলে উক্ত পোস্টের সাথে মিলত না। নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে,সেটা বুঝাতেই নিজের পদ পরিবর্তন করতে হয়েছে। এতে কাজও হয়েছে।
এসবের পূর্বে একদিন যখন নিজের যোগ্যতার উপর আস্থা হারাচ্ছিলাম সেদিন আমি একটি রেস্টুরেন্টের সার্ভার পদে আবেদন করলাম। পরের দিন একটি ওপেন ইন্টারভিউতে ডাকল। আশপাশের লোক নিষেধ করল কিন্তু আমার নিজের যোগ্যতা প্রমানে এতটাই মরিয়া ছিলাম যে এটা আমি করলাম। আমি নির্ধারিত সময়ে গিয়ে দেখলাম তরুন থেকে বুড়ো বয়সী ১২জন লোক বসে আছে । খানিক পর এক সুদর্শন মেয়ে এসে হাত-পা-দেহ নেড়ে-চেড়ে খানিক বক্তৃতা করল এবং বলল,আপনাদেরকে কিছু সময় দিচ্ছি এর মধ্যে এই রেস্টুরেন্ট নিয়ে একটি গান তৈরী করুন। খানিক পর এসে আমি শুনব। আপনারা কয়েকজন মিলে গ্রুপ তৈরী করেও করতে পারেন। শরীরডা জ্বলা শুরু হল। সামনের ছেলেটা নাকি ভাল গিটার বাজায়,সে নিজেই জানাল। বললাম,আমি এক সময় ভাল গান গাইতাম। বেশ কয়েকবার স্টেজে পারফর্মও করেছি। তারা বলল-ওহ তাই....তাহলে তো আমাদের গানটাই সবথেকে ভাল হবে ! বললাম, আপনারা তৈরী করেন,আমি শুনব। টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটিল স্টার স্টাইলে তারা কয়েক লাইন গান বানাল,শুনে মনে হল পা থেকে জুতো খুলে সপাসপ ঝাড়ি। কিন্তু মুখে হাসি টেনে বললাম দারুন ! আমার গ্রুপ যখন সম্মিলিতভাবে গান গাচ্ছিল,তখন তাদের সাথে সাথে গাইলাম না। মেজাজ তেড়া হয়ে যাচ্ছিল। ভাবছিলাম আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে উত্তম কিছু প্রদান করবেন এবং এই ফাউল অবস্থার হাত থেকে রেহাই দিবেন।
মনে পড়ল অনেক দিন আগে ঢাকাতে এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। বিদেশী এক কোম্পানীর চাকুরীতে যোগ দেওয়ার দিন যখন সবার সাথে পরিচিত হলাম তারপরই বাধল বিপত্তি। একটি বড় ঘরে আমরা গেলাম এবং রুম ভর্তি ছেলে-মেয়ে মিউজিকের তালে তালে নাচতে থাকল। এটা নাকি কালচার্ড করার প্রাথমিক সবক। এখানে হাসি-আনন্দে মিলে মিশে অফিস করতে হবে ,তার জন্যে একটি চমৎকার পরিবেশ তৈরী করে তারা এই তাল করল। খানিকক্ষন থাকলাম,তারপর ম্যানেজারের সাথে দেখা করে বললাম-আমি তো মার্কেটিং সংক্রান্ত কাজ করব,তাহলে আমাকেও এখানে থাকতে হবে ? মাসে কতদিন আপনারা এভাবে কালচারাল প্রগ্রাম করেন ? তিনি বললেন-প্রতি সপ্তাহে একবার অথবা মাসে দুইবার,এতে নাকি মন মানুষিকতা ভাল থাকে,কাজে অগ্রগতি হয়। বললাম, আমি দু:খিত, চাকুরিটা করতে পারলাম না। মাত্র ২ ঘন্টা ছিল সেই চাকুরীর মেয়াদ। এরপর অনেক বড় কোম্পানীতে সর্বোচ্চ পদে চাকুরী পেয়েছিলাম এবং ঈমান-আমলও টিকে ছিল। আর আজ এখানে তুচ্ছ এই কাজের জন্যে ফাউল কাজ করব ! মেজাজ বিলা হল, চলে আসলাম।
কয়েকদিন পর একটা বড় কোম্পানী থেকে ফোন আসল এবং পরের দিন সকালে ইন্টারভিউ। খানিক পর আরেকটি কোম্পানীর ফোন আসল,পরদিন দুপুরে ইন্টারভিউ। সকালের ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রায় ৪০ মিনিট বিভিন্ন বিষয়ে কথা হল। বিভিন্ন সিচুয়েশন দাড় করিয়ে সেই পরিস্থিতিতে আমার ভূমিকা কি হবে জানতে চাইল,আমি অত্যন্ত সাবলীলভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে এবং ব্যাখ্যা করে প্রত্যেকটা বিষয়ে উত্তর দিলাম। ইন্টারভিউ শেষে আমাকে জানাল যে-আপনার উত্তরগুলো ছিল এক্সিলেন্ট। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চলে আসলাম। ২ ঘন্টা পর আমাকে ফোন করে বলল-আপনি দ্বিতীয় স্টেপের জন্যে নির্বাচিত হয়েছেন,খুব আনন্দিত হলাম। জিজ্ঞেস করল কখন দ্বিতীয় স্তরের পরিক্ষা দিতে চাই। বললাম আজ দুপুর। গেলাম,আরও কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল এবং ড্রাগ টেস্ট নিল। তারপর আমার সকল তথ্য চেক করল। মনে হচ্ছিল আমি টিকে যাচ্ছি। এদিকে আরেক কোম্পানীতে ইন্টারভিউ। এই কোম্পানী ততটা বড় নয় কিন্তু ম্যানেজার হিসেবে আবেদন করেছি। আমার তেমন গনজ ছিলনা। কিন্তু ইন্টারভিউ ভাল হল। তারা জিজ্ঞেস করল কত ডলার চাই। এমন একটা সংখা বললাম যাতে তারা দিতে না পারে। তারা আমাকে ডাকল না,আমারও ইচ্ছা ছিল না।
বাসায় ফেরার পর পূর্বের কোম্পানী থেবে আবারও কল আসল, ফোনে জানাল-আপনাকে আমরা হায়ার করলাম। আগামী সোমবার থেকে কাজে যুক্ত হতে সমস্যা আছে ? আমি মনে মনে বললাম আলহামদুলিল্লাহ ! ,আমি এখনই যুক্ত হতে রাজি কিন্তু মুখে বললাম-ঠিক আছে সোমবার। এসব ঘটনা ছিল সোশাল সিকুউরিটি কার্ড পাওয়ার পর মাত্র দশ দিনের মাথায়। আল্লাহ আমার সম্মান ইজ্জত রক্ষা করেছেন। আমি যতবার প্রকাশ্য খারাপ বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছি,ততবারই বড় বড় সাহায্য পেয়েছি। গত পরশু ছিল চাকুরীতে আমার প্রথম দিন। সকলে আমার সাথে সুআচরণ করেছে এবং তারা ছিল সহযোগী। বেশ ভাল লেগেছে। আবারও আলহামদুলিল্লাহ !
বিষয়: বিবিধ
৩৫০৪ বার পঠিত, ৪৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার বাবা সোদি-আরবে থাকে। আর হ্যা আমার বাবা যদি সোদি আরবে না যেত, তাহলে আমি এখানে হয়তো লিখার চান্স পেতাম না!!! পডা-লেখা হত কিনা সন্দেহ!!! তবে আমার মা-বাবা খুব সচেতন পডা-লেখার প্রতি!!! যাই হোক বলতে চাচ্ছি সোদি আরবের কারণে আমাদের ভাগ্য বদল- এই জন্য মহান আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া! তাই আমার কাছে মনে হয় বি্দেশ ব্যাতিত কিছুই নাই!! দেশ কী আছে ভাই??
ব্যাবসা করতে গেলে চাঁদা বাজের ভয়, হরতাল, মারা-মারা আরো কত কী। চাকুরির জন্য গেলে মামা-খালু!!! তাই আপাতত আমি বিদেশ যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতেছি--
----
ধন্যবাদ- দারুন লেখনি উপহার দেয়ার জন্য-
I thought you live in Australia...
You are a very confident person. Good luck brother.
সরি, গায়ে পড়ে অনেকগুলু পরামর্শ দিয়ে ফেল্লাম।
যদি মনে করেন কোন রকম নির্দেশনামূলক সাহায্য লাগবে, ফোন দিতে পারেন। আপনি চাইলেই ফোন নম্বর দেব। ভাল থাকবেন।
যদি ঐ ধরাটা না খেতাম তা হলে হয়তো দাঁড়াতে পারতাম না।
এভাবে কথা বলা নিষেধ আছে বলেন আল্হামদুলিল্লাহ...আল্লাহ আপনার কল্যান করেছেন...
যতবারই হোচট কেছেছি ততবারও নতুন কিছু পেয়েছি যা আগের থেকেও উত্তম।
অনেকে ভিজিট ভিসায় গিয়েও সেখানে রুটি রুজির বন্দোবস্ত করেন, সেটা কিভাবে করেন জানাবেন। আমার জানা মতে একজন এভাবেই গোঁ ধরেছেন, তার কাছে পাঁচ ভিজিট ভিসা আছে, সেটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে বলবেন কি? অনেক ধন্যবাদ।
যদি নিউইয়র্ক এর দিকে আসেন বান্গালী কারো সাথে কনষ্ট্রাকশনে কাজ পাবেন হয়তও। হাড়-ভান্গা পরিশ্রম।এর বাহিরে অন্য কিছু নাই।
আপনার থাকবেনা কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স, সোশ্যাল সিকিউরিটি অথবা মেডিকেল ইন্সুরেন্স। হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিসিট ভিসায় আমেরিকা আসবেন না, প্লিজ।
আপনাদের দুজনের কাছেই আমার প্রশ্ন ভিজিট ভিসায় গিয়ে বৈধ হবার উপায় কি? কেননা জানা মতে কয়েকজন পাঁচ বছরের ভিজিট ভিসা পেয়েছেন। তারা সেখানে কোন উপায়ে বৈধ হতে পারে? আশা করি জানাবেন। অনেক ধন্যবাদ।
খুঁশি হব ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন