বাচ্চা শয়তান-৩
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১২ মার্চ, ২০১৪, ০১:১৯:১২ রাত
ছোট বেলায় আমি আমার নিজেকে দিয়ে অন্যকে চিন্তা করতাম। আমি যে অবস্থার মধ্য দিয়ে কাল যাপন করতাম অন্যের ক্ষেত্রে ও তাই মনে করতাম। আমি ছিলাম একটি সম্ভ্রান্ত স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। আমরা দুই ভাই এবং চার বোন। আমার বাপ দাদারা ছিলেন ব্যবসায়ী এবং খুবই প্রভাবশালী। আব্বা ছিলেন আর্মি অফিসার এবং বীর মুক্তি যোদ্ধা। তার সেক্টর ছিল আট নম্বর। একাত্তরে যুবকদেরকে প্রশিক্ষন দিয়ে যুদ্ধপযোগী করার কাজে তিঁনি নিয়জিত ছিলেন। হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের কাছে তিঁনি ছিলেন ত্রাস। সে কাহিনী পরে বলব,আগে আমার কাহিনী বলি।
আমাদের একটাই মাত্র কাজ ছিল ,সেটা হল পড়া শুনা করা। বাড়িতে সার্বক্ষনিক লজইন মাস্টার থাকত। তারা থাকত রাস্তার পাশের একতলা বৈঠক খানায়। এর ছিল দুটি দরজা,একটি বাড়ির দিকে ,অন্যটি রাস্তার দিকে। বাইরের থেকে কেউ আব্বার সাথে দেখা করতে আসলে আগে বৈঠক খানায় বসত। মূলতঃ ওটা ছিল মিটিং রুম। পরে ওটাই আমাদের পড়ার ঘর হয়েছে। অমি যাদের সাথে পড়া শুনা করতাম তাদের বেশীরভাগই ছিল দরিদ্র পরিবারের। ধনী গরীব সংক্রান্ত বিষয় আমি বুঝতাম না। আমার স্কুলের বন্ধুদের অধিকাংশই গরিব ছিল। যে কজন ধনী ছিল তাদের সাথে আমার তেমন ভাব ছিল না,যেমনটা ছিল গরিব ছেলেদের সাথে। আসলে আমরা ছিলাম উচ্চ মধ্যবিত্ত।আমার স্কুলের বন্ধুদের অনেকেই আমাকে বলত -তোরাতো বড় লোক। তাদের একথা শুনে ওদেরকে কেমন জানি পর পর লাগত। আর আমি বুঝতাম না বড়লোক মানে আসলে কি। আমি ভাবতাম সবাই আমার মত। যখন তাদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে স্কুলে আসত না তখন আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করতাম। তারা বলত আব্বা অথবা মা যেতে দেয়নি। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম কেন ? তারা বলত বাড়ি অথবা মাঠে কাজ ছিল। আমি একথা শুনে তাদেরকে খুবই ভাগ্যবান মনে করতাম। কারণ বাপ মা স্কুলে আসতে নিষেধ করে এমন কথা আমি জীবনে শুনিনি। এত উত্তম বাপ-মার সন্তান তারা ! আমার নিজের বাপের উপর তখন খুব রাগ লাগত। আমার ব্যাপারটা আবার অন্য রকম ছিল ,আমি কোনো কারনে স্কুলে যেতে না পারলে স্যাররা আমার আব্বার সাথে বলে দিত ,তবে সেটা মাঝে মাঝে ঘটত,সব সময় না। এর ফলাফল আমার জন্য শুভ হত না। তবে আমার অনুরোধে আমার ডিফেন্স মিনিস্টার(মা) অনেক সময় সামলে নিত।
একবার(সম্ভবতঃক্লাস ফোর এর থাকতে)আমাদের একটা বড় গাছ কাটা হচ্ছিল তখন আমি একটা দা নিয়ে সদ্য কাটা গাছের কাছে দাড়ালাম এবং ভাবলাম এই দা টা দিয়ে গাছের ডাল কাটতে থাকলে এই শ্রমিকদের খানিকটা উপকার করা হবে আর মাও বোধহয় খুশি হবে। আমি গাছের ডাল কাটতে লাগলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল স্কুলে না যাওয়া। এ কাজ করতে করতে যখন স্কুলের সময় পার হল তখন আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল ভয়ে। আমার মা হঠাৎ আমাকে এ অবস্থায় দেখে যেভাবে বাপের ভয় দেখালো তাতে স্কুল ফাকি দিয়ে মোটেও স্বস্তি পেলাম না। আমি তাকে বললাম-আমি তো কাজ করছিলাম(আমি ভেবেছিলাম আমার অন্য বন্ধুদের বাপ/মা কাজের কথা শুনলে যেমন খুশি হয় মা বোধহয় তেমনি খুশি হবে কিন্তু ঘটনা বিপরীত হল) ,মা শুনে আর এমন করতে নিষেধ করল(এমনটি আরও পরের দিকে করেছি,স্কুল ফাঁকি দিতে বহু প্লান করেছি,পরে বলব...)।
আমার বন্ধুদের পিতা মাতাকে আমি খুবই শ্রদ্ধার সাথে দেখতাম কারণ তারা এত মহান যে,মাঝে মাঝে তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেন। তাদের বাস্তবতাটা কলেজে ওঠার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। আমার প্রায়ই মনে হত ,আমার যদি বাড়িতে বা মাঠে কোনো কাজ থাকত তাহলে স্কুলে যাওয়া লাগত না। নিজেকে দূর্ভাগ্যবান মনে করতাম। প্রত্যেকদিন সকাল আর সন্ধ্যায় আমার মন খারাপ হত। কারণ সকালে স্যারের কাছে পড়ে আবার স্কুলে যেতে হত আর সন্ধ্যায় বৈঠক খানায় পড়তে হত। স্যারের কড়া নজর এড়িয়ে কোনো শয়তানি করা যেত না। তবে আমি আর পান্না টেবিলের নিচ দিয়ে লাথি মারা মারি করতাম এবং মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে পড়তাম। একই সাথে চিরকুটে স্যারকে গালি দিয়ে তা পান্নাকে পাস করে দিতাম,পান্নাও দিত। মাঝে মাঝে এমন কিছু লেখা হত যার কারনে হাসি চেপে রাখা সম্ভব হতনা। কখনও কখনও এমন হয়েছে , হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম অথচ মনোযোগ সহকারেই পড়ছিলাম। স্যার তখন গর্জে উঠত এবং পড়ার সময় হাসাহাসি করতে নিষেধ করত। কিন্তু স্যার কখনও বুঝতে পারেনি যে,প্রত্যেক চিরকুটেই তার বিরুদ্ধে কথা লেখা থাকত।
একদিন স্যার পান্নাকে বকা দিল পান্না চুপ। তাকে পড়তে বললেও সে মুখ চুন করে বসে থাকল। স্যার আবার বকা দিল এর একটু পর ওর চিরকুট পেয়ে হেসে উঠলাম স্যার আমাকে কড়া ধমক দিল এবং পড়ার সময় হাসা হাসি করতে নিষেধ করল। পান্নার চিরকুটে লেখা ছিল ‘শুয়োর’ (সরি স্যার) । মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় যখন লোড শেডিং হত তখন আমাদেরকে হারিকেন ধরিয়ে পড়তে হত। পান্না জীবনে কোনা দিন হারিকেন আনতে যেয়ে সময়মত ফিরেনি আমি একথা কসম খেয়ে বলতে পারি। দেরি করে এসে বলত,হারিকেনের সলতে পুড়ে গিয়েছিল/নীচে পড়ে গিয়েছিল,তেল ছিল না,চিমনিতে এত ময়লা জমেছিল যে মুছতে এত দেরী হয়েছে। সলতে আসলে ও ইচ্ছা করে ভেতরে ফেলত,হারিকেনের তেলও ফেলে দিত, আমিও দিতাম রেগুলার। মাঝে মাঝে লোড শেডিংয়ের সময় আমরা স্যারকে গল্প করতে বলতাম,স্যার কখনও কখনও করত। তবে পটভূমি আমরাই তৈরী করতাম। হঠাৎ করে কোনো বিষয়ে কয়েকটা কথা সিরিয়াসলি বলেই চুপ হয়ে যেতাম,স্যার তখন সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করত,তারপর আরও দুটো মিছে কথা বললেই স্যার খানিকক্ষণ সেই বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করত। স্যারের থেকে আমাদের জ্ঞান নেওয়ার কোনো ইচ্ছা,উদ্দেশ্য ছিলনা,আমরা টাইম পাস্ করতে পারলেই খুশি হতাম।
এক সন্ধ্যায় রেড ক্রিসেন্টের নাইটগার্ড সারুর মেয়ে বড় খুকির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আমরা ঠিক করেছিলাম আজ যেভাবেই হোক পড়ব না। আমাদের পাড়ায় তখন যার বিয়ে হোক না কেন আমরা সবাই আনন্দ ভাগা ভাগি করতাম। দাওয়াত দিয়ে কাউকে আনতে হত না। অংশগ্রহন থাকত স্বতস্ফুর্ত। কি খেতে দেওয়া হল সেটা কোনো ব্যাপার ছিল না। হৈ হুল্লোড় করতে পারাটাই ছিল আসল। সেদিন সন্ধ্যার পর ছোট খুকিদের বাড়িতে বেশ আনন্দের তোড় জোড় চলতে লাগল। এসময় আমাদের বাড়িতে টিপু নামের শিক্ষক ছিলেন। তাকে আমরা খুব ভয় পেতাম কারণ তিনি ছিলেন মোটা সোটা লম্বা এবং কালো, তবে তিনি ভয়ঙ্কর কেউ ছিলেন না। সেদিন স্যারের উপর মেজাজ খারাপ হয়েছিল প্রচন্ডভাবে। স্যার কিভাবে জানি আমাদের মতলব বুঝতে পেরেছিলেন। স্যার সন্ধ্যায় পান্নাকে ধরে নিয়ে গেল তারপর বিশাল লম্বা পড়া তৈরী করতে বলল। এরপর পান্না বলল- স্যার আমি বড় খুকিদের বাড়ীতে একটু যাব আর আসব। অনুমোদন নিয়ে পান্না বিশ্বাসঘাতকতা করছে দেখে স্যার মা’কে দিয়ে পান্নাকে ডেকে আনল।
আমি ওই সন্ধ্যায় পড়তেই যায়নি। এসব ক্ষেত্রে আমি মোটেও কাঁচা ছিলাম না। আমি জানতাম একবার পড়তে গেলেই স্যার আটকাবে। এরপর পান্না দেখল আমার আসার ইচ্ছা নেই অথচ ওকে পড়তে যেতে হবে। তখন সে স্যারের অনুমোদন নিয়ে আমাকে ডাকতে আসল। আমাকে বলল স্যার তোকে এক মিনিটের জন্যে ডাকছে,শুনেই চলে আয়। পড়া-শুনার ব্যাপার না,অন্য ব্যাপার। স্যারের প্রতি হঠাৎ আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভক্তি উথলো উঠলো। আমি ভাবলাম এক মিনিটেরই তো ব্যাপার,চলে গেলাম। দরজা খুলে গদ গদ হয়ে বললাম-স্যার,ডেকেছেন ? স্যার বললেন- ভেতরে আয়,আসলাম। চেয়ারে বস ! বসলাম। বই খোল ! খুললাম। পড় ! পড়লাম না,পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। মনে মনে নিজের মুখে থুথু দিলাম,কারণ বোকামী করেছি। রাগে দাত কিড় মিড় করছিলাম আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। পান্নার দিকে কড়কড়ে দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম কিন্তু সে আমার দিকে তাকালো না। বোধহয় সে মনে মনে বলছিল- আমার দিকে নয়,স্যারের দিকে তাকা। স্যার সবই বুঝতে পারছিল কিন্তু কেন যে সেদিন নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল তা বুঝলাম না আজও। স্যার অন্য দিনের চেয়ে আমাদেরকে বেশী পড়া দিয়ে বলল,এটা তৈরী করার আগে কোনো ছুটি নেই। আমরা পড়া তৈরী করলাম কিন্তু ছুটি দিলনা। আবারও নতুন পড়া তৈরী করলাম তবুও ছুটি দিলনা। আমাদের কলিজা ফেটে যাচিছল । শেষে রাত দশটার পর আমাদের ছেড়ে দিল আমরা বাড়িতে না গিয়ে বড় খুকিদের বাড়িতে গেলাম তবে ততক্ষণে সব শেষ,একই সাথে এটাও বুঝলাম যে,স্যার কেন আমাদের এতক্ষণ আটকে রাখল। আসলে স্যারের ওই রাতে খুব শখ হয়েছিল ভাত,তরকারি আর পানির সাথে অমাদের থুথু আর মাটি খাওয়ার। ব্যাপারটা স্যার সরাসরি বললেই পারত(!)।
চলিতেছে...
বিষয়: বিবিধ
১৩৭৭ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ফেসবুকে কি আইডি যেনো?
মাইনাচ........
শয়তানটাকে ধরিয়ে দিন।
তবে একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক এর লিখায় পড়েছি বাচ্চাদের শয়তান বা অসৎ বলা বয়স্কদের নিয়মিত অভ্যেস। তবে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। কয়জন বাচ্চা কালোবাজারি করে বা ঘুষ খায়।
দুষ্টু পিচ্চিই বটে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন