ওরেগন টু ওয়াশিংটন
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০১:১৬:২২ রাত
পোর্টল্যান্ড যাবার শখ ছিল,কিন্তু কেন যাব তা জানতাম না,দরকারও নেই। চললাম, রাস্তা সোজা। এটা হাইওয়ে ৫, মোটামুটি বেশ সভ্য-শান্ত হাইওয়ে। ঘন্টায় ৬৫মাইল বা ১০৫ কি:মি: গতিতে চলার কথা থাকলেও অধিকাংশ গাড়ি প্রথম লেনে প্রায় ৮০ মাইল বা ১৩০কি:মি: বেগে চালায়,তবে বড় বড় ট্রাক বা ট্রেইলারগুলো নিয়ম মেনেই চলে। ওরগনে শীতে বেশ বৃষ্টিপাত হয়,তবে সেটা অবশ্যই ঢাকার মত নয়। বৃষ্টির সম তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশী থাকে। এখানে ছিটেফোটা মার্কা বৃষ্টিই আসল,আর মাঝে মাঝে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়। ঢাকাতে যেমন এক ঘন্টা বৃষ্টি হলে অনেক রাস্তা হাটু বা কোমর পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়,এমনটি এখানে হয়না। রোদ এবং মেঘ খেলা করে আকাশে এবং হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয। তবে এদের আবহাওয়া পূর্বাভাস চমৎকার। এখনও পর্যন্ত আমি ভুল খুঁজে পাইনি,তবে ভুল হয়না এমন নয়। এখানে বাড়ি সবই প্রায় একতলা,কিছু আছে দ্বিতল,সবই কাঠের এবং দেয়ালগুলো দুই স্তর বিশিষ্ট এ্যালুমিনিয়ামের। বৃষ্টি উপভোগের স্থান এটি নয়। অন্তত আমার এ স্থান ভাল লাগেনা বৃষ্টি উপভোগের জন্যে। আমার ভাল লাগে গ্রামের বাড়ি,সেখানে বৃষ্টির দিন মানেই আলাদা একটি উপভোগের দিন। মনে পড়ে আব্বা বৃষ্টির দিনগুলোতে ভুনা খিচুড়ী,ইলিশ মাছ ভাাজি,ভুনা এবং গরুর মাংসের বন্দোবস্ত করত। মা’ও রান্না করত চমৎকার। সেসব কথা চিন্তায় আসলেও মজা লাগে। বৃষ্টির দিনে ঘরের মধ্যে কত রকমের খেলা করতাম,গল্প করতাম তার কোনো কিনারা নেই। এরকম একটি স্থানে সেসব মজা পাওয়া সম্ভব নয়। এমনকি গ্রামের স্টাইলে বাড়ি তৈরী করলেও না,কারন সেই পরিবেশ এখানে আনা সম্ভব নয়।
বৃষ্টি¯œাত রাস্তার ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে যাওয়ার সময় সামনের গাড়ির থেকে বেশ খানিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। কারন গতির কারনে ধাক্কা লেগে যেতে পারে,আরেকটা কারন হল প্রচন্ড বেগে যাবার কারনে গাড়ির চাকার সাথে ভেজা রাস্তার ব্যপক সংঘর্ষে বাষ্পের সৃষ্টি হয়,যা পেছনের গাড়ির চালকের দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায় এবং উইন্ডশিল্ডের ওপর সেই পানি এসেও পড়ে। সবথেকে ভয়ঙ্কর হতে পারে যদি সামনের গাড়িটি হঠাৎ কোনো কারনে তার গতি অনেক কমিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্থানে এ কারনে দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষ করে তুষারপাতের সময় এটি হয়। তুষারপাতে রাস্তার ওপর একটি আবরন জমে,যা খানিকটা পিচ্ছিল,এতে গাড়ির ব্রেক সমস্যাগ্রস্ত হয়। শীতে সাদা এবং দৃশ্যমান তুষারের বদলে হালকা ধরনের তুষারও পড়ে,যা দৃশ্যমান হয়না কিন্তু রাস্তায় হালকাভাবে জমে থাকে। এটাকে ব্লাক ¯েœা বলে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু এলাকায় এ সমস্যা আছে। সেসময় গাড়ি নিরাপদ গতিতে চালাতে হয় এবং এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়ির দূরত্ব বেশী রাখতে হয়। ব্রেক চাপতে হলে অনেক দূর থেকে চাপতে হয়। তুষারের ওপর অনেকস্থানের রাস্তায় পাথরের কুচি ফেলে দেওয়া হয় যাতে গাড়ির চাকা পিছলে না যায়। ওরেগনে আগ্নেয় পাথরের অভাব নেই,ফলে এরা তা করে। তুষারপাতের পর প্রধান প্রধান বা উল্লেখযোগ্য রাস্তা থেকে বিশেষ গাড়ির সাহায্যে তুষার অপসারণ করা হয়।
আমরা উডবার্ণ নামক একটি স্থানে একটি হালকা বিশ্রাম নিলাম। হাইওয়ের অনেক স্থানে এমন বিশ্রামাগার তৈরী করা হয়েছে,যেখানে মানুষ তাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন মিটিয়ে,পেটে কিছু দানাপানি ঢুকিয়ে,একটু হাটাহাটি করে আবার চলতে পারে। আমরা চললাম। পোর্টল্যান্ড আসলাম। এখানে বারবার স্ট্রিটে একটি মুসলিম গ্রোসারী স্টোরে আসলাম। গত একমাসে বাইরের লোকদের মধ্যে আমার দেখা এই দোকানদারই একমাত্র মুসলিম ব্যক্তি। সালাম বিনিময় করে ভাল লাগল। এখানথেকে আমি খাটি মসুরের ডাল,মসলা,পরোটা,তেতুল কিনলাম। গত এক মাসে যত স্টোরে গিয়েছি,তার কোথাও আস্ত এলাচ দেখতে পাইনি। লবঙ্গ,দারুচিনি,কালো মরিচ/গোল মরিচ থাকলেও এলাচ ছিলনা। শুধুমাত্র কর্ভালিসের একটি আরবীয় মুসলিম স্টোরে সেটা দেখেছিলাম,তবে দাম ছিল অনেক চড়া। কিন্তু এখানে বেশ দারুন মসলা পেলাম,দামেও ভাল। অন্যসব জিনিসের দাম যথেষ্ট বেশী, তবে ভাল।
এখানে একটি মসজিদ আছে। গেলাম সেখানে। আনুমানিক ১০/১২ কাঠা জমির উপর এটি গড়ে উঠেছে,তবে দেখতে সুন্দর। এখানে প্রতিটি এলাকায় একাধীক গীর্জা বেশ বড় সড় স্থান নিয়ে গড়ে উঠলেও তা কোনো সময়ই সরগরম থাকেনা। একমাত্র রবীবারে কিছু বুড়ো হাবড়া সেখানে যাতায়াত করে ধর্মচর্চার পাঠ সম্পন্ন করে। কিন্তু মসজিদ যেমনই হোকনা কেন,এমনকি টং দোকানের মত হলেও দৈনিক পাঁচবার মানুষ তাতে নামাজ আদায় করবেই। আর শুক্রবারে তো দাগাবাজরাও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মসজিদকে ঘিরে ইবাদতের এই আগ্রহে মোটামুটি মানের মুসলিমেরও অন্তর খুশীতে উথলে উঠবে। মসজিদটা দেখে আমার যে কি ভাল লাগল ! তখন কেবল সকাল সাড়ে দশটা বাজে,নইলে যোহরের নামাজ আদায় করতে পারতাম। সাথের মুসলিম আত্মীয় আবার এতটা আগ্রহী নয়,তবে আমার আগ্রহে আগ্রহী হল। আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম এবং দেখতে থাকলাম। ভাল লাগল। ভেতরে খুবই পরিচ্ছন্ন,পরিপাটি। এটি দ্বিতল বিশিষ্ট এবং একপাশে একটি মিনার রয়েছে। মহিলাদের জন্যে আলাদা স্থানে নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। চলে আসলাম আবার বারবার স্ট্রিটে।
বেশকিছুক্ষন পর আরেক হালাল স্টোরে আসলাম। এই স্টোরটার নামই হালাল স্টোর। এটা পূর্বেরটার চাইতে অন্তত ৭/৮ গুন বড়। এটা আরবীয় লোকদের। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যায়। আমার একটি হামান দিস্তা দরকার ছিল রান্না করার জন্যে মসলাপাতি গুড়ো বা ছ্যাচার জন্যে। আমি তা পেলাম। এবার রান্না জমবে ভাল। কিনলাম মুরগী এবং গরু। এবার পাশে অবস্থিত ওমানী রস্টুরেন্টে গেলাম। সেখানে গরু-ছাগলের মাংসে তৈরী শরমা খেলাম। এমন সাইজের শরমা আমি জীবনেও খাইনি। এটি বিশাল কিন্তু সাবাড় করলাম।
এবার পোর্টল্যান্ডের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরলাম। কোথায় কোথায় ঘুরলাম তা মনে করতে পারছি না,তবে ভাল লেগেছে। এখানে বেশ দূর থেকে এসে অলামেট নদী পোর্টল্যান্ড এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে,আবার কলাম্বিয়া নদীও ওয়াশিংটন এবং ওরেগনকে বিচ্ছিন্ন করেছে। অলামেট নদীর পানি সর্বদা কর্দমাক্ত,একেবারে পদ্মার পানি অথবা তার চাইতেও ঘোলা। এর ¯্রােত বেশী তাই সর্বদা মাটি প্রবাহিত করে। যেসকল শহরের উপর দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হতে দেখেছি,সেসকল নদীর উপর একই স্থানে একাধিক সেতু তৈরী করা হয়েছে,যাতে নদীর কারনে যাত্রা কোনোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত না হয়। আর পোর্টল্যান্ডে এসে দেখলাম নদীর ওপর বহু সংখ্যক সেতু এবং ফ্লাইওভার। সেসব সেতুর একটি দেখলাম দ্বিতল। আবার তার আশপাশ দিয়ে অনেকগুলো ফ্লাইওভার চলে গেছে। একাধিক স্থান থেকে ফ্লাইওভার এসে নদীর উপরে থাকা সেতুর উপর দিয়ে চলে গেছে। মোটামুটি বড়সড় সেতু এগুলো। আরেকটি সেতু তৈরী হতে দেখলাম কাছাকাছি। এরা এমন দেশ যারা প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুত কোনো কাজ করে ফেলতে পারে। আমলাতান্ত্রিক বা ব্যবসাতান্ত্রিক সমস্যা এসব ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়ায়না। যদিও এদের ফিটফাট চেহারার অন্তরালে গরিব বিশ্ব সম্পর্কে মারাত্মক ভয়াবহ একটি রূপ রয়েছে,তারপরও বলা যায় নিজ দেশে এদের সুদর্শন রূপটিই প্রত্যক্ষ করা যায়।
আমরা কলাম্বিয়া নদীর ওপর স্থাপিত একটি স্টিল ব্রিজের ওপর দিয়ে ওপারে চলে গেলাম। অর্থাৎ ওয়াশিংটনে প্রবেশ করলাম। এপাশে ভ্যাঙ্কুভার,বেশ দারুন একটি শহর। কিন্তু কোথাও নামা হল না,কারন বৃষ্টি। অনতিদূরে একটি দর্শনীয় প্রাকৃতিক ঝর্ণা আছে কিন্তু এই আবহাওয়ায় যাওয়া যাবেনা। রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরতে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ফিরতি পথ ধরলাম। আবারও পোর্টল্যান্ডের বিভিন্ন স্থাপনা দেখা দিল। এখানে কাচ এবং স্টিলের সমন্বয়ে একটি বিশাল টুইন টাওয়ার আছে। বেশ ভাল লাগল দেখতে,এটি একটি কনভেনশন সেন্টার। যাইহোক,ফিরতি পথ ধরলাম।
এবার উডবার্ণে অবস্থিত পৃথিবী বিক্ষাত সব ফ্যাশন ব্রান্ডের স্টোর আউটলেটে প্রবেশ করলাম। একটি এলাকাজুড়ে বহু সংখ্যক স্টোর রয়েছে,যেখানে বিখ্যাত বিখ্যাত ব্রান্ডের পোষাক,জুতোসহ বিভিন্ন সামগ্রী সজ্জিত রয়েছে। এখানে সারা বছরই ব্যপক মূল্যহ্রাস থাকে। স্থানটি আমার বেশ পছন্দ হল। আমার প্রিয় কিছু ব্রান্ত এখানে আছে,অবশ্য এখন আর পূর্বের মত ব্রান্ড নিয়ে মাতামাতি করিনা। তারপরও দুই ঘন্টা ব্যয় করলাম এখানে। মূল্যহ্রাস ৭০% পর্যন্ত দেখলাম,কিন্তু ৭০% কম দামেও অধিকাংশ বাঙ্গালী তা কিনতে পারবে না। একটা জ্যাকেট পছন্দ হল কিন্তু ব্যপক মূল্যহ্রাসের পরও তার দাম একশত পঞ্চাশ ডলার। নেড়েচেড়ে দেখে আবার ঝুলিয়ে রেখে আসলাম। আরও বহু জিনিস এভাবে নেড়েচেড়ে দেখেছি। তবে না কেনার আরও একটি কারন হল,ঢাকা থেকে আসার সময় এত ব্যপক পোষাকাদী এনেছি যে না কিনলেও চলে। তাছাড়া এটা আমার দেশ নয়,এখানে খরচের ব্যাপারে একটু হিসেব না করলে চলবে না। একটা চকলেটের দোকানে ঢুকলাম,খেলাম,তারপর ফিরলাম। ভ্রমনটা ভাল লাগল।
বিষয়: বিবিধ
১৪৯০ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
(2) আস্ত এলাচ দেখতে পাইনি। কারন
আপনি ইন্ডিয়ার ষ্টোরে যাননি।
বাকি লেখা গুলো ক্লোজ হয়েছে। অল্প দিনে অনেক কিছু জেনে গেছেন।
এবার পাশে অবস্থিত ওমানী রস্টুরেন্টে গেলাম। সেখানে গরু-ছাগলের মাংসে তৈরী শরমা খেলাম। এমন সাইজের শরমা আমি জীবনেও খাইনি। এটি বিশাল কিন্তু সাবাড় করলাম।......
একটা চকলেটের দোকানে ঢুকলাম,খেলাম,তারপর ফিরলাম। ভ্রমনটা ভাল লাগল। ........
আচ্ছা আপনের পেটডা কত বড় হবে? হাঠু থেইক্যা গলা পর্যন্ত? নাকি তার চেয়েও এর পরিধি বিস্তৃত? খাওয়ার সময় গ্যাঞ্জাম খানের কথা একটু স্মরণ করণ যায় না?
বেলা সাড়ে এগারোটাতেই প্রচন্ড ক্ষিদা লেগে গেল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাইওয়ে রেস্টিংপ্লেস বা গ্যাস ষ্টেশনগুলির সুবিধা অনেকের মুখেই শুনেছি এবং পড়েছি। দুঃখ হয় তখনই যখন মনে পড়ে একসময় শেরশাহ প্রত্যেক রাজপথে দুই ক্রোশ(প্রায় চারমাইল) পরপর কূপ সহ সরাইখানার ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে সাধারন মানুষরাও বিশ্রাম নিতে পরত এবং পরিবার সহ নিরাপদে পথ চলতে পারত। ইবনে বতুতার ভ্রমনকাহিনীতে পড়েছি তিনি এইধরনের সরাইখানা তৎকালিন মুসলিম বিশ্বের প্রায় সবখানেই থাকছেন। তার কাছে কোন অর্থ না থাকলে সহায়তা পাচ্ছেন। আরব দেশেও শুনেছি এই ধরনের রেস্টিং প্লেস আছে। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে পরিবার নিয়ে কোথাও বের হতে গেলে এই সমস্যা হয়। বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ হাইওয়েতে এই ধরনের হোটেল থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে মহিলাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা অনেক জায়গাতেই নাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন