ফ্লাই আমেরিকা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৭ জানুয়ারি, ২০১৪, ১২:০৬:১৭ রাত
২০১৪ সালের ১৮ই জানুয়ারী, বসবাস করার উদ্দেশ্যে সুদূর উত্তর আমেরিকার ওরেগন রাজ্যের উদ্দেশ্যে উড়লাম। গত ২০দিন ধরে বেশ খোঁজাখুজি করে এমিরেটতস এয়ার লাইন্স এর একটি সস্তা গোছের টিকেট জোগাড় করেছি। বছরের এই সময়টাতে মানুষ ভ্রমনে বের হয় তাই ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এয়ার লাইনগুলোর লেজে পা দেওয়া যায়না। তাই এসময়ের সস্তা মানে আসেলে সস্তা নয়।
ঢাকা বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের উপর মানুষের চাপা অথবা স্ফুলিঙ্গসম ক্ষোভ থাকা অতি সাধারণ ব্যাপার,তা কর্মকর্তাগণকে দেখেই আচ করা যায়। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সব থেকে বেশী আয় আসে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা থেকে। আমাদের সরকার অসহযোগীতা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে এ খাতকে দমাতে। ইচ্ছা করলেই যে অনেক কিছু করা যায় না,তার প্রমান প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। কারন এখানে মানুষ স্বয়ং রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বস্ব লুটপাটের শিকার,তাই জীবনের তোয়াক্কা না করে বিদেশ পাড়ি দিতে কাওকে উড়ো জাহাজের চাকা ধরে,কাওকে সাগর সাতরে বিদেশ যেতে দেখা যায়। এমন অপ্রতিরোধ্য যে জনতা,তাকে ঠেকানো এত সোজা কাজ নয়। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাটি অযাচিত প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে থাকল,মনে হল আমাকে ভদ্রতার সাথে নানাভাবে বিব্রত করার মধ্যেই তার যাবতীয় ইহজাগতিক সুখ-শান্তি-কল্যান নিহিত। তিনি আমার নাম-ধাম,বংশ পরিচয়,ভ্রমনের উদ্দেশ্য,সেখানে আমার অবস্থান,আমার পেশা,নেশা,পরিবার সম্পর্কে ডজন খানেক প্রশ্ন করলেন। মনে হল আমার এ ভ্রমনে তার যমের অরুচী। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতাও এমনই। এরা অন্যেদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম। আমার ধারনা হয়েছে এরা আমার সাথে তুলনামূলক ভাল আচরণ করে। প্রতিবারই আমি দেখী আমার সামনের লোকদেরকে নানাভাবে প্রশ্ন করা হয়। অথচ ভারত-বাংলাদেশ বাদ দিলে তাবৎ দুনিয়ার বেশীরভাগ কর্মকর্তাগণই সুআচরণ করে তাকে এবং অযথা সময় নষ্ট করেনা। একবার একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম বিদেশে গিয়ে যাতে বিপদে না পড়ে তার কারনে এরা পূর্বেই এমন সব প্রশ্ন করে সঠিক বিষয়টি জেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই প্রশ্নের উত্তরে অট্টহাসি হাসা ছাড়া উপায় নেই। কারন এটা জানতে জেরা করার কোনো প্রয়োজন নেই,কাগজপত্র সমূহ দেখাই যথেষ্ঠ। আর যদি কর্মকর্তাসমূহ কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজ দেখে সঠিকতা নির্ণয় করতে না পারে,তাহলে এখনও যথেষ্ট সরকারী খাস জমি পড়ে আছে,সেখানে আবাদ করে অনেকে বেশ সাবলম্বী হয়েছে,তাদেরকে সেখানে পূণর্বাসিত করার কথা সরকার নিজ মুখ রক্ষার্তেই ভাবতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। অনেক শিক্ষিত লোকই এখন চাষাবাদ করছে। মানুষকে বহুভাবে সেবা করা যায়।
পৃথিবীতে সবথেকে ভাল এবং ভয়ঙ্কর প্রাণী হল মানুষ। এরা শুধু অন্য মানুষের ক্ষেত্রে খারাপ বা ভাল হতে পারে তাই নয়,বরং নাগালের মধ্যে পড়া সকল সৃষ্টির ব্যাপারেই এদের ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগে কিনা জানিনা,তবে এবছর প্রকৃতি মানুষের একহাত দেখে নিচ্ছে,বোধহয় পা’সহ। গত বিশ বছরের মধ্যে সবথেকে বেশী ঠন্ডা পড়েছে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের বহু অংগরাজ্যে মারাত্মক তুষারপাত হয়েছে এবং তাপমাত্রা অনেক স্থানে হিমাঙ্কের নীচে ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত চলে গেছে। জানলাম এটা মঙ্গল গ্রহের চাইতেও নি¤œ তাপমাত্রা এবং উত্তর মেরূর কোনো কোনো এলাকার চাইতে নী¤œ। বেশ কিছু মানুষ ঠান্ডায় জমে মারা গেছে। এরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিধায় মৃতের সংখ্যা অনেক কম। এই পরিমান তাপমাত্রায় আমাদের মত হতভাগা দেশগুলোতে এক রাতে অন্তত ৫০ভাগ লোক মারা যেতে পারত। পত্রিকায় পড়েছি ফুটন্ত এক কাপ গরম পানি শুণ্যে ছুড়ে দিলে তা পড়ার পূর্বেই বরফ হয়ে যায় এই তাপমাত্রায়। ওরেগনে অবশ্য এমন তাপমাত্রা পড়েনি কিন্তু আমার ট্রানজিট আছে নিউ ইয়র্কে। সেখানে হাজার হাজার প্লেনের সময়সূচী পরিবর্তন করা হয়েছে বা বাতিল করা হয়েছে।
আল্লাহর অশেষ রহমত যে আমি কেন জানি এক সপ্তাহ পরের একটি দিন হঠাৎ করেই নির্ধারণ করলাম। নইলে আমার নিয়ত ছিল ১০তারিখে যাওয়া। আর সেসময় মারাত্মক শৈত্য প্রবাহ চলছিল এবং দুই ফুট পুরু তুষারপাত। একইসাথে ঘন কুয়াশা,যা কয়েক মিটার দূরের বস্তুও দৃষ্টি গোচর করেনা। আমি ৫ঘন্টারও অধিক উড়ে দুবাই শহরে আসলাম। এখানে আমাকে দীর্ঘ আট ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। বরাবরের মতই আমি অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগ বহন করছি। হাতে ৭ কেজী বহন করার অনুমতি থাকলেও আমি ১৩ কেজী বহন করছি এবং সাথে আছে বঙ্গ বাজার থেকে কেনা দুটি কম্বলসম ওভারকোট,আর মূল ব্যাগের সাথে আটকানো আছে আরও একটি ছোট ব্যাগ। স্যুট পরে এইসব আমাকে মুখে হাসির রেখা টেনেই বহন রতে হচ্ছে,কারন মুখ বেজার করে লাভ নেই,বরং হাসিমুখে কথা বলাও সাদাকাহ,তাই ...।
আমার ব্যাগটি একটি বিশাল সাইজের মাউন্টেন ব্যাগ এবং এর নিজস্ব ওজনই ৫ কেজীর উপরে। এর আকৃতি দেখে আপত্তি করা স্বাভাবিক কিন্তু জিনিসটি বেশ উপকারী। প্লেনের ভেতর ভত্র মহিলা আমার ব্যাগটির ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানাল। একজন ক্রু সেটা হাতে ওজন করে দেখল কিন্তু বলল ঠিক আছে। তবে উক্ত ভদ্র মহিলা মানতে চাইল না। তিনি বললেন,এটা এভাবে বহন করা যাবেনা। আমি বললাম আমি তো এটা নিয়ে পূর্বেও ভ্রমন করেছি,কই সমস্যা তো হযনি ! এমনকি ১৭কেজি বহন করেছি। তিনি বললেন,কোন এয়ারলাইন্সে ভ্রমন করেছেন ? বললাম,সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্স। তিনি বললেন সেটা তো তাদের ব্যাপার,সেটা তো আর এটা নয়। আমি বললাম তাহলে কি আপনারা তাদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম মানের সার্ভিস দিচ্ছেন ? তিনি আর কথা বাড়ালেন না, বললেন, আচ্ছা পরবর্তিতে আপনি এটা খেয়াল করবেন। নাহ, জিনিসটা আসলেই বড়। আমাকে কিছু জিনিস কমিয়ে তারপর নির্ধারিত বক্সের মধ্যে ব্যাগটা ধরাতে হল।
দুবাই বিশাল এয়ারপোর্ট। একটা নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত আমাকে এই ভারী জিনিস নিয়ে হাটতে হয়েছে,সেটা ছিল কষ্টকর,তবে যখন মনে হয়েছে সবটুকু ওজনই নিয়ে ভ্রমন করতে পেরেছি,কিছুই রেখে আসতে হয়নি,তখন ভাল লেগেছে। গত একমাস ধরে ব্যাগ গোছানো সফল হয়েছে। শক্তি কিছু ক্ষয় হলে সমস্যা নেই। দুবাই এয়ারপোর্ট হল ধনীদের আখড়া। এখানে আসলেই মানুষের সেই কথাই মনে হবে। এত দামী জিনিস দিয়ে সজ্জিত এটা যা না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। বাহ্যিক চাকচিক্য তো ছিলই। কিন্তু এখানে যেসব দোকানপাট আছে তাতে পৃথিবীর সবথেকে দামী পণ্য সামগ্রী বিক্রী হচ্ছে। যে কোনো ধরনের পোষাকের দামও অনেক বেশী। কিন্তু আকৃষ্ট করল বেশ কিছু দোকান,যারা শতভাগ খাটি স্বর্ণ বিক্রী করে থাকে। দেখলাম বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণের বার বিক্রী হচ্ছে। কিছু বার দেখলাম ১ কেজী ওজনের। স্বর্ণের ওজন লোহার চাইতেও বেশী ফলে এক কেজী স্বর্ণের বার আকারে বেশ খানিকটা ছোট। কিন্তু আমি জীবনেও এমন স্বর্ণের দোকান দেখিনি। বেশ খানিকক্ষন তাকিয়ে থাকলাম কিন্তু সত্যিই আমার লোভ লাগল না। আমার মনে হল এইসব সম্পদের জন্যে মানুষ কত মারামারিই না করে। হাজার হাজার ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ড এই সম্পদের জন্যেই ঘটে চলেছে। অথচ এর মূল কাজ হল সৌন্দর্য বর্ধন করা। ভাবলাম,আচ্ছা আমি যদি মনে করি স্বর্ণ আমার সৌন্দর্য বর্ধন করবে না,তাহলে স্বর্ণের কোনো দাম আছে ? আসলে এর মূল্য আমরাই নির্ধারণ করেছি। কাজের বিচারে স্টিলের যে উপযোগীতা ,তা স্বর্ন পূরণ করতে পারবে না। কাজেই এর চাইতে স্টিল সেরা। এটা একটা যুক্তি,কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে এই ধাতুটি একটি লোভনীয় বস্তু হিসেবে পৃথিবীর সকল প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এটি লোহার মত সহজলভ্য হলে অবশ্য এর তেমন কদর থাকত না। এমনই একটি ঘটনা ঘটবে কিয়ামতের পূর্বে। সূরা জিলজালে এটি বর্ণিত হয়েছে...পৃথিবী মহা কম্পনে প্রকম্পিত হবে এবং এর অভ্যন্তরস্থ সম্পদসমূহ বের করে দিবে। মানুষেরা অবাক হবে এবং অজ¯্র সম্পদের উদগীরনে তারা বুঝতে পারবে কতটা খারাপ কাজ তারা করেছে এই তুচ্ছ সম্পদের কারনে।.... যাইহোক, আমি এত সাধু না। প্রচুর টাকা পকেটে থাকলে এখান থেকে স্বর্ণের বার কিনতাম না,এ কথা আমি আবার কখন বললাম ?
দুবাই এয়াপোর্ট ভাল লেগেছে শুধু এর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা,আভিজাত্যের কারনে নয়। এখানে কিছুদূর পরপর রয়েছে নামাজের ঘর। সেখানে নারী ও পুরুষের জন্যে আলাদা আলাদা নামাজের ঘর নির্ধারিত রয়েছে। ফজরের আযান শুনে আমি নিকটস্থ নামাজের ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম অনেক লোক নামাজ আদায় করছে। আমিও কসর আদায় করলাম। বেশ পরিপাটি,সুদৃশ্য নামাজের স্থান,ভাল লাগবেই।
এবার একটি স্থান খুজতে থাকলাম যেখানে কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া যায়। এখানে ৪৯ ডলারের বিনিময়ে মারহাবা .... নামক একটি বিশেষ টিকিট কাটা যায় বা এরকম কিছু একটা সুবিধার কথা শুনেছিলাম। এর বিনিময়ে স্বল্পকালীন বিশ্রাম,খাওয়া ও ঘোরাঘুরি করা যায়। বেশীরভাগ মানুষ দেখলাম এয়ারপোর্টের ভেতর বেঞ্চে বসে সময় পার করছে,আমি সংখ্যা গরিষ্ঠের পক্ষ নিলাম। এখানে সাধারণ যাত্রীদের কথা চিন্তা করে একটি বিশাল করিডোর বরাবর লম্বা এক ধরনের বিশেষ চেয়ার স্থাপন করা হয়েছে,যেখানে মানুষ দুপা তুলে বেশ আরামে শুয়ে থাকতে পারে। আমি বেশ কিছুদূর হেটে দেখলাম সবগুলোতেই মানুষ ঘুমাচ্ছে। তারপর একটি পেলাম খালি। আমার ট্রলিটা পায়ের কাছে রেখে আরামে শুয়ে পড়লাম এবং ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসল। প্লেন ভ্রমনে আমার তেমন ঘুম হয়না। এখানে শুয়েই মনে হল,বিনা কারনে ৪৯ ডলার খরচ করে মারহাবা সুবিধা নেওয়ার কি দরকার ? আর প্লেনে যে পরিমান খেয়েছি এবং ব্যাগে যে পরিমান অছে তাতে আগামী দুদিন পার করা যায়। কিন্তু শান্তি কপালে তো থাকতে হবে ! এক বাঙ্গালী এসে আমাকে অমার্জিত ভাষায় ঘুম থেকে জাগাল। বলল-“হ্যালো ! এই যে হ্যালো !! দিস ইজ মাই সিট, আমি একটু টয়লেটে গিয়েছিলাম।” বাক্যের শেষের টুকু বাংলায় বলার পরই বোধহয় তার হুশ হল এবং আবারও ইংরেজীতে কিছু একটা বলতে চাইলে আমি তার দিকে না তাকিয়েই ঠিক আছে বলে উঠে চলে গেলাম। সিটটি ফিরে পেয়ে তার কি জাতের গর্ব হচ্ছিল,তা তার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম। প্রচন্ড খারাপ লাগা অনুভূতী কাজ করল। এটা কি বাঙ্গালী ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব হত ? প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। অত্যন্ত নীচু জাতের অশিক্ষিত না হলে এমন আচরণ প্রদর্শন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বেশীরভাগ লোক মুসলিম,অথচ আচার আচরনে ইসলামের ছাপ পাওয়া অনেক সময়ই দুষ্কর। আমি বেশ কিছুটা সময় ঘোরাঘুরি করে,সেই লোকটির সামনা সামনি বিপরীত পাশের সারিতে একটি সিট পেলাম কিন্তু তার দিকে চোখ পড়বে ভেবে অস্বস্তি লাগল। ট্রলিটা ঠেলে আমার চোখের সামনে রাখলাম যাতে তাকে দেখতে না হয়। আহ ! কি যে শান্তি লাগল। মোবাইল ফোনে এলার্ম সেট করে খানিক ঘুমালাম।
এবার উঠলাম পৃথিবীর সবথেকে বড় প্লেনে। এটি দ্বিতল বিশিষ্ট এবং একাধারে সম্ভবত ১৬ঘন্টার বেশী উড়তে পারে। যাত্রী সংখ্যা সম্ভবত: সাড়ে আট’শ, গন্তব্য নিউ ইয়র্ক। এটি সাড়ে চৌদ্দ ঘন্টার ভ্রমন। লক্ষ্য করলাম প্লেন যথাসম্ভব স্থল ভাগের ওপর দিয়ে উড়তে ভালবাসে। কারন তাতে বিপদের সম্ভাবনা কম এবং সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী। এটি সরাসরি আটলান্টিক পাড়ি না দিয়ে এক পাশে বেকে আটলান্টিক পাড়ি দিল। এতে তার অন্তত তিন হাজার কি:মি: অতিরিক্ত ওড়া লাগলেও সুবিধা আছে। প্লেনে কসর নামাজ আদায় করলাম। বহুক্ষন উড়লেও আমি মাগরিব পড়তে পারলাম না। কারন স্ক্রিনে দেখলাম আমরা দিনের অংশের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছি। রাত আমাদের পেছনে এবং দিন আমাদের সামনে,ফলে দীর্ঘক্ষন উড়লেও রাতের নাগাল পেলাম না। যেহেতু যেসব স্থল বা জলভাগের উপর দিয়ে উড়ছি সেখানে দিন,তাই সে অংশে মাগরিব পড়া যাবেনা বলেই মনে হল। তবে ওজু করে রেখেছিলাম যাতে নামাজ আদায় করা যায়। কিন্তু নিউ ইয়র্কে যখন নামলাম,তখন বিকেল। এখানে দেখলাম আলো ঝলমলে অবস্থা। আকাশ সম্পুর্ণ পরিষ্কার,তাপমাত্রা মাত্র শুণ্য ডিগ্রী সেলসিয়াস। গত কয়েক দিনের তুলনায় এটি অত্যন্ত চমৎকার আবহাওয়া। এটার জন্যে চিন্তায় ছিলাম। কারন ৪০ ঘন্টা ভ্রমনে যদি কোনো সময়সূচী বদলে যায় তাহলে সত্যিই তা অত্যন্ত অস্বস্তিকর। নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডী এয়ারপোর্টে দেখলাম প্রতি ঘন্টায় হাজারের উপরে যাত্রী আসে। আমি যে লাইনে দাড়িয়ে ইমিগ্রেশন দর্শন করতে থাকলাম,তা লম্বায় এক কি:মি: এর বেশী হবে,কারন তা একটি বড় স্থানে সাপের মত পেচিয়ে পেচিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষন পর আমি খুব চমৎকারভাবে এবং কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পার হলাম। আমাকে কোনো প্রশ্ন তারা করল না।
এক স্থানে ট্রলি দেখলাম সারি সারি। একটা ঝেড়ে টান দিলাম,আসল না। আবারও হেচকা টান দিলাম কাজ হলনা। আশপাশে কেউ নেই দেখেই মারলাম লাথি,ভাবলাম আমি ভুল করছি। আবারও টানাটানি করলঅম,কাজ হলনা। আরেক স্থানের ট্রলি নিয়েও টানাটানি করলাম,ফলাফল একই। দেখলাম লক করা।
একজন সাউথ এশিয়ান ক্লিনারকে বললাম কিভাবে ট্রলি পাব ? তিনি বললেন ৫ ডলার দিয়ে ট্রলি নিতে হয় কিন্তু আমাকে ১০ ডলার দাও আমি তোমাকে নির্ধারিত কাউন্টারে পৌছে দেব। বললাম, না থাক আমি ভাল আছি। ৫ ডলারে ট্রলি নিয়ে নির্ধারিত কাউন্টারে গেলাম এবং ব্যাগসমূহ প্রদান করলাম। এবার স্কাই ট্রেনে উঠলাম এবং টার্মিনাল ৫ এ বিশাল লম্বা লাইনে দাড়িয়ে নির্ধারিত গেটের সামনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এখানে প্রায় আট ঘন্টা অপেক্ষার পর জেট ব্লু নামক আমেরিকার স্থানীয় এয়ারলাইন্সের একটি ছোট প্লেনে উঠলাম। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল তাই ঘন্টা খানিকের জন্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙার পর দেখলাম পাশের যাত্রী ডিনার করছে। ভাবলাম আমারটাও সরবরাহ করবে কিন্তু করেনি। এদের সার্ভিস ভাল না। ভাল সার্ভিস হলে এরা আমার সিটের ওপর একটি স্টিকার লাগিয়ে যেত এবং আমার ঘুম ভাংলে খাবার সরবরাহ করত। পাশের যাত্রী হাভাতে টাইপের। দেখলাম নিজের সাথে আনা বিশাল এক বক্স নুডুলস খেল। তার বেশ কিছুক্ষন পর দেখলাম আরেক বক্স খাবার খেয়ে ফেলল। আমার লোভ হল। আমি পেছনে থাকা কেবিন ক্রুদের স্থানে গেলাম,দেখলাম তারা খাচ্চে। আমি গিয়ে এক প্যাকেট চিপস আর এক বোতল পানি আনলাম। তারা তাদের মত খেতে থাকল। বুঝলাম এরা এরকমই। এক মহিলাকে দেখলাম তার কালো রঙের মাঝারি সাইজের কুকুরটাকে তার পাশে বসিয়ে ভ্রমন করছে। এটা আমার মাথায় ঢুকল না। যদি মেনেও নেই,কুকুর ছাড়া ইহ জীবনে তার কেউ নেই ,তারপরও এত মাখামাখি অস্বস্তিকর। আর এভাবে ভ্রমন করা যায় তা প্রথমবার দেখলাম। আমি জানতাম কুকুরদের জন্যে আলাদা খাচা থাকে,তাদেরকে সেখানেই রাখা হয় এবং সেটা থাকে মালপত্র রাখার স্থানে। প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টার ভ্রমনে তার পাশের সিটের যাত্রী হলে আমি টিকতে পারতাম না। আমি ওরেগনে নামলাম এবং একইভাবে আমাকে ট্রলি ভাড়া করতে হল। এ বিষয়টি জীবনে প্রথমবার দেখছি। এত বিশাল দেশ অথচ কতটা অনুদার চরিত্রের ! শুনেছি এদেশে মানুষের উপর ভয়াবহ ট্যাক্স আরোপ করা হয়, সেটা ট্রলির উপরও পড়েছে,জানতাম না।
বিষয়: বিবিধ
২৯৯০ বার পঠিত, ৯৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সফর বরাবরই কষ্টের,সুখের অনুভতি মিশ্রিত থাকে।
গত ২ বছরে আমি আমেরিকার লোকাল ফ্লাইটগুলাতে ২০ বারের বেশী ভ্রমন করেছি। আপনি হলে প্রত্যেকটার জন্যই হয়তো এমন একেকটি লেখা উপহার দিতেন।
আমি বর্তমানে গত দুই বছর যাবৎ আ্যারিজোনায় আছি চাকুরির সুবাদে, কিন্তু আমার প্রাণ নিউইয়র্কে, তাই এত ওড়াওড়ি!
এবার কাছাকাছি পেনসেলভেনিয়াতে চাকুরী পেয়েছি, আগামি রবিবার আবার উড়াল দিচ্ছি।
ও ইয়েস! ওয়েলকাম টু আ্যামিরকা!
যাক খুব ভালো লেগেছে পড়ে ।অনেক ধন্যবাদ
আজ আমার কোম্পানিতে একজন নতুন মুখ জয়েন্ট করেছে সে ব্রাজিলিায়ান। ব্রাজিল থেকে আসে বাংলায় আর আমরা বাংলাথেকে পালাই।
আপনি দেশে নাই ভেবে খুব খারাপ লাগছে ভাই। সত্যি একজন ইসলাম প্রিয় মুসলিম ও মেধাবিকে হারালো বাংলাদেশ তার নিজের অজান্তে। জানিনা আরো কতো হারাবে এভাবে।
আপনাকে আল্লাহ ইহজীবন ও পরজীবনে ভালো রাখুন।
আসলে আমি যদি আপনাকে মনের কস্টটা দেখাতে পারতাম।!!
তার পরেও আপনার জন্য দুআ থাকবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ আপনার ইমান,আমল,মুসলিম,দ্বীনে অবিচল থাকা,সকল বিষয়ে যথেস্ট হন। আমিন।
০ ওখানে কি আপনার কোন আপনজন থাকে ?
০ আপনি কি ওখানে চাকরি করবেন ?
''এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সব থেকে বেশী আয় আসে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা থেকে। ''
০ এই প্রবাসীদের মধ্যে আবার ভাগ আছে ।
১. যারা শুধু চাকরীর উদ্দেশ্যে প্রবাসী হয়
২. যারা বসবাসের জন্য প্রবাসী হয়
রেমিটেন্সের বিশাল অংশই আসে এই চাকরীর উদ্দেশ্য প্রবাসীদের কাছ থেকে । এবং এরা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী প্রায় সবাই । চাকরি শেষ হয়ে গেলে তারা আবার ফিরে আসবে । কোন কোন সময় এর আগেই তাদের বের করে দেওয়া হয় ।
আর যারা বসবাসে উদ্দেশ্য প্রবাসী হয় তারা এই সব মধ্যপ্রাচ্যের দেশে যায় না , যায় আমেরিকা , কানাডা , অস্ট্রেলিয়া - এসব দেশে । এসব দেশে যারা বসবাস করতে যায় তাদের আসল উদ্দেশ্য হয় ঐ দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করা । এই প্রবাসীরা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের মত নিজের দেশে টাকা পাঠায় না কারণ এসব দেশ তো লিভিং কস্ট খুবই বেশী । নিজেরাই চলতে হিমশিম খায় , সাবেক-দেশে টাকা পাঠালে চলবে কি করে ?
''ভাবলাম,আচ্ছা আমি যদি মনে করি স্বর্ণ আমার সৌন্দর্য বর্ধন করবে না,তাহলে স্বর্ণের কোনো দাম আছে ? আসলে এর মূল্য আমরাই নির্ধারণ করেছি। কাজের বিচারে স্টিলের যে উপযোগীতা ,তা স্বর্ন পূরণ করতে পারবে না। কাজেই এর চাইতে স্টিল সেরা। ''
০ আমার কাছেও স্বর্ণকে খুব বেশী দাম দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় । সৌন্দর্য্য বর্ধন ছাড়া এটা আর কি উপকার করতে পারে লোহা বা তামার চেয়ে ? সূরা কাহফ এ জুলকারনাইনের ঘটনায় আমরা লোহা ও তামার কথা জানতে পারি ।
''এত বিশাল দেশ অথচ কতটা অনুদার চরিত্রের ! শুনেছি এদেশে মানুষের উপর ভয়াবহ ট্যাক্স আরোপ করা হয়, সেটা ট্রলির উপরও পড়েছে,জানতাম না। ''
০ এজন্যই তো তারা এতটা উপরে উঠতে পেরেছে ।
বসবাসের জন্য যদি ওখানে যান তাহলে কি বেকার ভাতার উপর চলার চিন্তা ভাবনা আছে যেখানে চাকরির ব্যাপারে কিছু বললেন না?
''কারন এখানে মানুষ স্বয়ং রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বস্ব লুটপাটের শিকার,তাই জীবনের তোয়াক্কা না করে বিদেশ পাড়ি দিতে কাওকে উড়ো জাহাজের চাকা ধরে,কাওকে সাগর সাতরে বিদেশ যেতে দেখা যায়। এমন অপ্রতিরোধ্য যে জনতা,তাকে ঠেকানো এত সোজা কাজ নয়।''
০ সবাই যদি এত অপ্রতিরোধ্যভাবে বিদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করে তাহলে দেশের কি হবে ? দেশে কি কর্ম সংস্থান হচ্ছিল না ?
''......তাহলে এখনও যথেষ্ট সরকারী খাস জমি পড়ে আছে,সেখানে আবাদ করে অনেকে বেশ সাবলম্বী হয়েছে,তাদেরকে সেখানে পূণর্বাসিত করার কথা সরকার নিজ মুখ রক্ষার্তেই ভাবতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। অনেক শিক্ষিত লোকই এখন চাষাবাদ করছে। মানুষকে বহুভাবে সেবা করা যায়।''
০ সব রসূনের কোয়া শুরু হয় এক জায়গা হয়ে , মিলিতও হয় আরেক জায়গায় গিয়ে ।
ওরেগণ কেন গেলেন। ওদিকটার আবহাওয়া সারা বছরই বাজে। ঠান্ডা-মেঘলা আর বৃষ্টি।
অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনী, সাবলীল রম্য! পরবর্তী ঘটনাবলী জানান দিতে যেন কসুর না হয়।
এবার দেশ থেকে আসার সময় প্রশ্ন করলেন, আমি কত তারিখ দেশে এসেছি। বুঝতে পেরেছি এটাও নাযেহাল করার একটি কৌশল। জবাব দিলাম- পাসপোর্টে সিল আছে একটু কষ্ট করে দেখে নিন, ঠিক এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না।
নারে ভাই আমি আমেরিকা যামু না। বিমান দেখলে বুকের মধ্যে দরফর দরফর করে দ্যাশে যাইতে মুঞ্চায়।
নাম্বার দেন। আমি আপনাকে কল করবো।
আপনার উচিৎ ছিল সাউতের ষ্টেটে থাকা।
ওখানে প্রচুর ঠান্ডা। আমি জর্জিয়াতে থাকি।
যা আমেরিকান সরকার অনুমোদন করেছে।
ভালো লাগলো
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
এখনো মন খুলে মন্তব্য করার সময় হলো না বলে দু:খিত। তবে ভ্রমণ কাহিনী পেলে পাঠ করবো এর নিশ্চয়তা দিলুম।
আপনার উদ্দেশ্য সফল হোক, আন্তরিক দোয়া করছি।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং আমাদের জন্য আরো বেশী করে লিখা পরিবেশন করুন, এই কামনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন