গুপ্তচর(উয়ুন)
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৮:০৪:৪৯ রাত
সামরিক সাফল্য দক্ষ গুপ্তচর ব্যবস্থার ওপর দারুনভাবে নির্ভরশীল। রসূল(সা একটি সুদক্ষ গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এরা শত্র“ বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছিদ্র পথের অšে¦ষণনে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রাখত। সামরিক অভিযানকালে এবং এর পূর্বে গুপ্তচরেরা শত্র“ বাহিনীর গতিবিধীর খবরাখরব সংগ্রহের মাধ্যমে যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। তারা শত্র“দের সামরিক শক্তির পরিমান,সৈন্য সংখ্যা,তাদের সৈন্য বিন্যাস পদ্ধতি,তাদের কার্য ব্যবস্থা,পরিকল্পনা,গমন পথ,ঘটনাস্থলের মানচিত্র প্রণয়নসহ বহুবিধ বিষয়ে বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করত।
রসূল(সা: ) প্রত্যেকটি যুদ্ধে গুপ্তচরদেরকে কাজে লাগিয়েছিলেন। বদরের যুদ্ধেও তাদেরকে কাজে লাগানো হয়। তাঈম গোত্রের তালহা বিন উবাইদুল্লাহ এবং আদী গোত্রের সাঈদ ইবনে যায়েদকে সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকারী মক্কী কাফেলা সম্পর্কে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে পাঠানো হয়। এছাড়া ওয়াকিদী উল্লেখ করেছেন যে-মক্কী বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ নেতা মুনাব্বিহ বিন আল হাজ্জাজ পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষনে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন,তিনি নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে মাটিতে ২জন মুসলিম গুপ্তচরের পায়ের ছাপ শনাক্ত করেন। একই অভিযানে বদরের নিকট পৌঁছে রসূল(সা জুহায়না বাসবাস ইবনে আমর এবং আদী ইবনে আবী আল জাগবা নামক আরও দুজন গুপ্তচরকে মক্কী কাফেলার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে বদরের একটি কূপের কাছাকাছি পাঠিয়েছিলেন। তারা সে কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করেন। -(ওয়াকিদী,ইবনে সাদ-তাবাকাত)মক্কী বাহিনী উপস্থিত হলে রসূল(সা: ) আরও দুজন গুপ্তচর প্রেরণ করেন। এরা ছিলেন মক্কার প্রথম দিকের মুসলিম আম্মার ইবনে ইয়াসির(রা এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা। এ থেকে বোঝা যায় যে রসূল(সা: )এর সামরিক দক্ষতা কতটা উন্নত মানের ছিল। তিনি একই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যে আলাদা আলাদা বাহিনী প্রেরণ করেন,তালিয়া(ক্ষুদ্র দলের সমন্বয়ে তৈরী অগ্রবর্তী গোপন যোদ্ধা) প্রেরণ করেন এবং আরও বহু তথ্য,সক্ষমতা,পরিস্থিতি সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে সৈন্য সমাবেশ করেন। এবং তার(সা: ) প্রত্যেকটি যুদ্ধ কৌশল ছিল নৈপূণ্যে ভরা এবং তার কার্যকারীতার সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস।
উহুদের কথা না বললেই নয়। সে সময়েরও সফল্যজনকভাবে গুপ্তচরদেরকে ব্যবহার করা হয়েছিল। গুপ্তচরদের প্রথম ইউনিট খাযরাজ গোত্রের ফাযালাহর দুই পুত্র আনাস ও মুনসীকে প্রেরণ করা হয় শত্র“র সংবাদ নিতে। তারা সাফল্যজনকভাবে মক্কী বাহিনীর সাথে তাদের সৈন্যদের বেশে মিশে যায় এবং সুযোগমত সটকে পড়েন। তারা কুরাইশদের যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করেন। কুরাইশরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছনোর পূর্বেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ খবর রসূল এর কাছে চলে আসে। আর মক্কী বাহিনী শিবির স্থাপন করার পর রসূল(সা: ) একজন সুবিখ্যাত রণকৌশলী ও সামরিক বিশেষজ্ঞ আল হুবাল ইবনুল মুনযিরকে(রা গুপ্তচর হিসেবে পাঠান শত্র“ সৈন্যের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আসার জন্যে। তাকে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্র“ সৈন্যের সামরিক সক্ষমতা পরিমাপ করা। তিনি(সাতাকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন, রসূলের(সা: )কাছে ছাড়া আর কারো কাছে কোনোভাবেই যেন এতটুকু তথ্য না জানানো হয়। কারণ তিনি(সামনে করছিলেন- যদি শত্র“র সামরিক সক্ষমতা ধারণার চাইতে বেশী হয় তাহলে তা জানার পর মুসলিম সৈন্যের মনোবলের ওপর আঘাত আসতে পারে। নির্দেশ অনুযায়ী আল হুবাল শত্র“ বাহিনীর সকল তথ্য নিয়ে আসেন। ওয়াকিদীর বর্ণনা মতে-আল হুবালের তথ্য অনুযায়ী মক্কী বাহিনীতে ৩হাজার সৈন্য ছিল। এবং পরবর্তীতে প্রমানিত হয় যে,তার হিসাব একেবারে সঠিক। তাদের ২০০জন অশ্বারোহী এবং ৭০০ বর্ম পরিহিত সৈন্য ছিল। -(ওয়াকিদী,ইবনে সাদ)
উহুদ যুদ্ধে রসূল(সাএর একটি নির্দেশ না মানার কারনে মুসলিম বাহিনী চরম মূল্য দেয়। আর রসূল(সাকর্তৃক ৫০ জন তীরন্দাজ কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে সৈন্য সমাবেশ ছিল সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত এবং এতে মুসলিমরা শতভাগ ফল লাভ করেছিল, কিন্তু তারা সে ফল ভোগ করতে পারেনি তাদের অনাকাঙ্খিত আবেগের কারনে। ক্ষয় ক্ষতির বিচারে এ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় হয় কিন্তু উদ্দেশ্যগতভাবে কাফিররা এখানে সফল হতে পারেনি। আর মুসলিম সৈন্যরা প্রথমে বিজয় অর্জন করে,এরপর ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় কিন্তু তারপর পচাঁদপসরণ করে নতুনভাবে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়। ফলে ঐতিহাসিকরা এটাকে অমিমাংসিত যুদ্ধ বলেছেন। প্রখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক ওয়াকিদী ও তাবারী বলেন-মক্কী বাহিনী যুদ্ধের পর ময়দান থেকে বের হয়ে গেলে রসূল(সা তাদের আসল পরিকল্পনা জানার জন্যে আলী ইবনে আবু তালিবকে(রা পাঠান।
উস্দ আল গাবাহ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে,আর রাজীর মর্মান্তিক ঘটনার পর কুরাইশদের অভিসন্ধী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যে উমাইয়া ইবনে খুয়াইলিদ আল যামুরীকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। একই মিশনে আমর ইবনে উমাইয়া আল যামুরীকেও প্রেরণ করা হয়। মুরায়সীতে বনূ আল মুসতালিক গোত্রের সৈন্য সমাবেশের খবর মদীনায় এসে পৌছলে রসূল(সা: ) খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে বুরায়দা ইবনূল হুসায়বকে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের পানির উৎস্যস্থলে গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে আনেন। বিপক্ষ শক্তি সম্পর্কে এরূপ প্রাথমিক তথ্য মুসলিম বাহিনীকে শত্র“দের বিরুদ্ধে সুবিধা এনে দিয়েছিল। এবং মুসলিম বাহিনী আল মুরায়সী অভিযানকালে শত্র“দেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়েছিল।(তিনি রসূল(সা: )কে জানান যে বনূ কুরায়জার ইহুদীরা দূর্গ সংষ্কার করেছে। তাদের সৈন্যদের প্রশিক্ষন দিয়ে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করেছে এবং যুদ্ধের জন্যে গবাদীপশু জড় করেছে-তাবারী,বুখারী)
তবে খন্দকের যুদ্ধেই মুসলিম গুপ্তচরদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়। এ সময়ে মদীনা একমাস যাবৎ অবরুদ্ধ ছিল। রাজধানী শহর দীর্ঘ্য সময় অবরুদ্ধ থাকার সময় মুসলিম যোদ্ধারা শত্র“র শুধুমাত্র আশু সম্মুখ হামলার শিকারই ছিলনা বরং পশ্চাৎ দিকের বনূ কুরায়যার ইহুদী যোদ্ধাদের হামলার আশঙ্কায় ছিল। এ দুটি শত্র“ দলের প্রকৃত দূরভিসন্ধি জানার জন্যে রসূল(সা: ) খাওয়াত ইবনে জুবায়ের(রা নামক গুপ্তচরকে পাঠান। তিনি সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এর পূর্বে খন্দকের যুদ্ধে তাদের যোগদানের খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে রসুল(সা: )আল যুবায়ের ইবনুল আওয়ামকে(রা দায়িত্ব প্রদান করেন। অবরোধের শেষে রসূল(সা: ) হুযাইফা ইবনূল ইয়ামানকে(রা গুপ্তচর হিসেবে কুরাইশ শিবিরে প্রেরণ করেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এবং জীবনের ঝুকি নিয়ে কুরাইশ শিবিরে ছন্দবেশে প্রবেশ করেন এবং বিশেষ কৌশলে কুরাইশ শিবিরে আগুন জ্বালিয়ে চারিপাশে ঘিরে বসে থাকা মক্কীদের মধ্যে গিয়ে মিশে যান। তার পরিকল্পনা এতটা নিঁখুত ছিল যে,তাকে কেউ চিনতেই পারেনি। কিন্তু পরক্ষনেই কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ান শত্র“ বাহিনীর গুপ্তচরদের ব্যাপারে সকলকে সাবধান হতে বলেন এবং প্রত্যেককে তার পার্শ্ববর্তী লোকটির পরিচয় জিজ্ঞেস করতে বলেন। আর এখানেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি তাকে প্রশ্ন করার পূর্বেই তার পাশের লোকের কাছে পরিচয় জানতে চান। এতে তার নিজের ওপর অন্যদের সন্দেহ থাকেনা। এরপর তিনি তাদের বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি জানতে পারেন ও বিষয়টি যথারীতি রসুল(সা: )কে অবগত করেন।-(ওয়াকিদী,ইবনে সাদ-তাবাকাত)
অনুরূপভাবে হুদাইবিয়া অভিযানকালে বুসর ইবনে সুফিয়ান আল খুযাঈ রসুল(সা: )কে মক্কায় প্রবেশে কুরাইশ বাহিনীর বাধা প্রদানের প্রস্তুতি সম্পর্কে খবর জানার জন্যে মক্কা গমন করেন। -(ওয়াকিদী,তাবারী,ইবনে সাদ,ইবনে খালদুন)। হুনায়নের যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে আবী হাদরাদুল আসলামী রসূল(সা: )এর গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন এবং শত্র“দের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। এছাড়াও বহু সংখ্যক অজ্ঞাত পরিচয় গুপ্তচর ছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক,সামরিক সুবিধার জন্যে,মুসলিম তথা ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্যে বহু গুপ্ত সংবাদ প্রকাশিতই হয়নি কিন্তু তার ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল। রসুল(সা: ) ছোট ছোট গুপ্তচর টিম তৈরী করতেন এবং তাদেরকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল। তারা তাদের মূল নীতি জানত। আর ইসলামের জন্যে তারা তাদের সর্বোচ্চ সম্পদ- তাদের জীবন দিতে অতি আগ্রহী ছিল। অত্যন্ত সাহসী,নির্ভিক,সুকৌশলী,সময়োপযোগী যোদ্ধাদেরকেই গুপ্তচরবৃত্তির মত কঠিন কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আর এসব গুপ্তচর সঠিক তথ্য দিচ্ছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্যেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন টিম তৈরী করা হয়েছে। প্রস্তুতকৃত এসব গুপ্তচরও তাদের গোপন মিশনের পূর্বে জানত না তাদেরকে কোথায় পাঠানো হবে। তাদের মানুষিকতা ভিন্নভাবে তৈরী করা হয়েছিল। তারা শারিরীকভাবেও ছিল প্রচন্ড দক্ষ। তারা তাদের শারিরীক-মানুষিক সক্ষমতার প্রমান দিয়েছেন। যেসব গুপ্তচর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিতেন তাদেরকে পরবর্তীতে আবারও দায়িত্ব দেওয়া হত। তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগদান করা হত। আর একাজে ভয়াবহ গোনীয়তা রক্ষা করা হত। রসূল(সা: ) মক্কার কাফিরদের ব্যপারে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে অপরিচিত গুপ্তচরদের বেশী ব্যবহার করেছেন।
'তাদের ক্ষেত্রে বেশীরভাগ গোয়েন্দাই ছিল পশ্চিমাঞ্চলীয় গোত্রসমূহ থেকে। অনেক গুপ্তচরের মধ্যে ১৬ জন বিখ্যাত গোয়েন্দার পরিচয় আমাদের জানা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫জন ছিলেন শুরুর দিকের মুসলিম।' -(রসূল(সা: )এর সরকার কাঠামো)
ব্যপক একটি লেখা থেকে সংক্ষেপে লেখা হল। ইনশাঅাল্লাহ আগামী বছর বিস্তারিত জানাব
বিষয়: বিবিধ
২১৪৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন